রোম সাম্রাজ্যের উত্থান (পর্ব-৩২): মারিয়াস ও সুলা

রোমান সমাজ ও রাজনীতির টানাপোড়েনে রিপাবলিকের বিদায়গাঁথা লেখা হচ্ছিল। গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের পথ ধরে অপ্টিমেট আর জনতুষ্টিবাদী দল, বা পপুলেয়ারদের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই রক্তাক্ত হয়ে উঠতে থাকে। ইতালীয় মিত্রদের নাগরিকত্ব নিয়ে এই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র তৈরি হয়, সিনেট এবং প্লেবেইয়ান কাউন্সিল। ট্রিবিউনরা কাউন্সিলের মাধ্যমে রোমান সিটিজেনদের ভোটকে কাজে লাগিয়ে সিনেট ছাড়াই আইন পাশ করে নিতে পারতেন। রাষ্ট্রের আইন-কানুন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার করার প্রবণতা উভয়ের মাঝেই দেখা যায়। অপ্টিমেট এবং পপুলেয়ার দলের ছত্রছায়ায় রোমান জেনারেল মারিয়াস এবং সুলার দ্বন্দ্ব রোমকে ঠেলে দেয় গৃহযুদ্ধের দিকে।

গাইয়াস মারিয়াস

মারিয়াসের জন্ম হয় ১৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, বর্তমান ইতালির ল্যাৎযিওর অধিভুক্ত অ্যার্পিনামের এক ইতালীয় সেটলমেন্ট, সিরেটায়। তার পরিবার ছিল প্লেবেইয়ান। তরুণ বয়সেই তিনি রোমান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। একজন সাধারণ লিজিওনেয়ার থেকে নিজের দক্ষতা ও রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি দ্রুতই উপরের দিকে উঠে আসেন। তিনি বিভিন্ন সময় ট্রিবিউন এবং প্রিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, এবং ১১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে স্পেনে রোমের প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবেও নিযুক্ত হন।

জুগুর্থাইন লড়াইয়ের সময় প্রথমে মেটেলাসের অধীনে, এবং কন্সাল নির্বাচিত হবার পর মারিয়াস নিজেই যুদ্ধের কম্যান্ড দেন। তার অধীনে রোমান সেনারা জুগুর্থাকে বন্দি করে। এরপর সিম্ব্রি ও টিউটনদের বিপদ থেকেও তিনি রোমানদের রক্ষা করেন। এসময় অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে তিনি পরপর আরো চারবার কন্সালের দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক সাফল্যের জন্য মারিয়াস প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম। ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি ঘুষ ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো কন্সালের পদ দখল করেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের সাথে তার ঘেঁষাঘেঁষি রোমান জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।

দুর্নীতিগ্রস্ত এক রোমান রাজনীতিবিদ, স্যাটার্নিনাসের সাথে এসময় মনোমালিন্যের জেরে মারিয়াস তাকে দমন করতে বাধ্য হন, কিন্তু তিনি সিনেট ও জনতা উভয়ের কাছেই অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। অনেকদিন তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু সোশ্যাল ওয়ার শুরু হলে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রথমে সেনাদলের উপদেষ্টা নিযুক্ত হলেও অপর সেনানায়কদের মৃত্যুর পর তিনি মধ্য ইতালিতে রোমান বাহিনীর সর্বাধিনায়কে পরিণত হন।

লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুলা

মারিয়াসের নেমেসিস, লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুলা এসেছিলেন দরিদ্র এক প্যাট্রিশিয়ান পরিবার থেকে। তার জন্ম ১৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। শিক্ষাদীক্ষা থাকলেও অর্থের অভাবে তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল ছিল না। কিন্তু উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু সম্পত্তির অধিকারী হলে সুলার অবস্থার পরিবর্তন হয়। জুগুর্থাইন যুদ্ধে তিনি ছিলেন মারিয়াসে সহকারী। সেনাদলে তুলনামূলকভাবে আনকোরা হলেও তিনি দ্রুত শিখে নেন এবং নানাভাবে তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। জুগুর্থাকে বন্দি করে যুদ্ধের সমাপ্তিতে তার ভুমিকাই ছিল মুখ্য। কিন্তু সেনাপতি হবার বদৌলতে মারিয়াস সমস্ত কৃতিত্ব নিয়ে নিলেন। অনেকে মনে করেন, মারিয়াসের সাথে তার দ্বন্দ্বের সূচনা এখান থেকেই।

লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুলা; Image Source: silverdollarco.net

সিম্ব্রি ও টিউটনদের সাথে সংঘর্ষের সময় সুলা ছিলেন ক্যাটালাসের সাথে। এই যুদ্ধের পর ক্যাটালাস ও মারিয়াস ট্রায়াম্ফ পেলে সুলা নিজেকে বঞ্চিত মনে করলেন। এবার তিনি রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হলেন। ৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুলা প্রিটর নির্বাচিত হন। তার কর্মজীবন আরো সমৃদ্ধ হয় যখন ৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পূর্বদিকে পরাক্রান্ত পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চল সিলিসিয়ার গভর্নর হলেন। এখানে তিনি তার সামরিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে পালন করেন।

মারিয়াস ও সুলার সংঘাত

এশিয়া মাইনরে পন্টাসের রাজা ছিলেন ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস। সোশ্যাল ওয়ারে রোমের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ৮৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষদিক থেকে তিনি রোমের এশিয়া প্রদেশগুলো একে একে দখল করে নিতে থাকেন। রোমের নিষ্পেষণে হাঁপিয়ে ওঠা এথেন্সসহ অনেক গ্রিক রাজ্যই তাকে তাদের মুক্তিদূত হিসেবে বেছে নেয়। মিথ্রিডেটসের এক জেনারেল আর্কেলাস নৌবহর নিয়ে গ্রিসে এসে পৌঁছেন। এশিয়া মাইনরের অনেক অঞ্চল রোমের পক্ষ ত্যাগ করে মিথ্রিডেটসের দলে যোগ দেয়। তার আদেশে ৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক নির্দিষ্ট তারিখে সেসব অঞ্চলের সমস্ত রোমান ও ইতালীয় অধিবাসীকে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন, প্রায় ৮০,০০০ মানুষ এই উন্মাদনার বলি হয়।

রোমান সিনেট নড়েচড়ে বসে। মিথ্রিডেটসকে সামলানোর উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এশিয়া মাইনর মানে অতুল ঐশ্বর্যের হাতছানি। কাজেই সুলা ও মারিয়াস দুজনেই এই অভিযানের সেনাদায়িত্ব নিতে চাইলেন। সুলা ছিলেন ওই বছরের কন্সাল এবং বাহ্যিকভাবে সিনেটের প্রতি অনুগত। অন্যদিকে মারিয়াস পরিচিত ছিলেন পপুলেয়ারদের নিকটবর্তী হিসেবে। আইন অনুযায়ী নির্দেশ প্রদানের অধিকার সিনেটের হাতে থাকায় শিকে ছিঁড়ল সুলার ভাগ্যে। সুলার সেনাদল তখন ক্যাম্পানিয়াতে, নোলা অবরোধ করে বসে আছে। সুলা সেদিকে রওনা হলেন তাদের নতুন অভিযানের জন্য প্রস্তুত করতে।

সিনেটে বিতর্ক; Image Source: neuraloutlet.wordpress.com

সুলার প্রথম গৃহযুদ্ধ

মারিয়াস দমে যাননি। তার বয়স তখন আটষট্টি, কিন্তু তিনি যেকোনো প্রকারে এশিয়া মাইনরে রোমান সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার ফিকির খুঁজছিলেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করল ইকুইটরা। সুলা অতিরিক্ত সিনেটঘেঁষা মনে করে তারা তাকে সন্দেহের চোখে দেখত। মারিয়াসের এসব সমর্থক, যাদের মারিয়ান নামে ডাকা হতো তারা ট্রিবিউন সাল্পিসিয়াসের সাথে ষড়যন্ত্র করল। সাল্পিসিয়াসের আইন করে নতুন সমস্ত রোমান নাগরিক আর মুক্ত হওয়া দাসদের বিরাজমান ৩৫টি গোত্র বা কিউরিয়াতে ভাগ করে দিলেন। এরা প্লেবেইয়ান কাউন্সিলে ভোট দিতে পারত। নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে রুফাস মারিয়াসের হাতে মিথ্রিডেটসের বিরুদ্ধে নির্দেশনা তুলে দিলেন। সিনেটের সিদ্ধান্তের সাথে কাউন্সিলের সরাসরি দ্বিমত প্রকাশ্যে দেখা দিল।

জনতার সামনে রোমান ট্রিবিউন; Image Source: thoughtco.com

মারিয়াস দ্রুত ঘর গোছাতে আরম্ভ করলেন। এদিকে সুলা এই ঘটনা জানতে পেরে এক চমকপ্রদ পরিকল্পনা করলেন। নোলাতে শিবির করে থাকা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে তার অনুগত ছিল। সুলা তাদের কাছে সরাসরি রোমের দিকে মার্চ করার সংকল্প প্রকাশ করেন। অনেক অফিসার এতে নিমরাজি থাকলেও সাধারণ সৈনিকেরা সুলার পক্ষে ছিল। ইতিহাসে এই প্রথম রোমান সেনাদল রোমান জেনারেলের অধীনে রোম দখলের মানসে সেদিকে যাত্রা করল।

রোমের দিকে সুলার মার্চ; Image Source: steemkr.com

মারিয়াস ও তার সমর্থকেরা সুলার এই কাজে পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে গেল। তারা কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি সুলা এরকম কিছু করতে পারেন। তড়িঘড়ি করে মারিয়াস কিছু সেনা যোগাড় করলেও সুলার সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীর সামনে তারা খড়কুটোর মতো উড়ে গেল। সুলা বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করলেন। প্রথমেই তিনি মারিয়াস ও তার আরো ১১ সমর্থককে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে তাদের মাথার উপর পুরস্কার ধার্য করলেন। সৌভাগ্যবশত মারিয়াস সুলার শহরে প্রবেশের আগেই পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি ইতালি ত্যাগ করে আফ্রিকাতে আশ্রয় নেন। সুলার করা তালিকার ভেতর থেকে কেবল সাল্পিসিয়াস ধরা পড়েন। তাকে হত্যা করা হয়।

সুলার হাতে সময় ছিল খুব কম। তিনি দ্রুত কিছু আইন সংশোধন করেন। এর ফলে প্লেবেইয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে ট্রিবিউনদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। সিনেটের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা হয় এবং সুলা কাউন্সিলের করা আইনে সিনেটের ভেটো প্রদানের অধিকার প্রদান করেন। রোমের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে দুজন আপদকালীন কন্সাল নির্বাচন করা হয়- সিনা এবং অক্টাভিয়াস। সব নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে মনে করে ৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুলা জাহাজ ভাসালেন গ্রিসের দিকে, যেখানে আর্কেলাস ইতোমধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নিজেকে সুসংহত করেছেন।

মারিয়াসের প্রত্যাবর্তন

সিনা ছিলেন মারিয়াসের প্রতি সহানুভূতিশীল। সুলা ইতালি ত্যাগ করা মাত্রই তিনি সাল্পিসিয়াসের প্রণীত আইন পুনর্বহাল করলেন। এর ফলে অক্টাভিয়াস ও সিনেটের সাথে বিবাদের জেরে সিনাকে উৎখাত করা হয়। কিন্তু ক্যাম্পানিয়াতে থাকা রোমান বাহিনী তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করে। সিনা স্যামনাইটদেরকেও নিজের দলে টেনে নিতে সমর্থ হন।

এদিকে মারিয়াস আফ্রিকাতে গিয়ে সেখানে সৈন্য জড়ো করছিলেন। জুগুর্থাইন যুদ্ধের পরে অনেক রোমান সেনা আফ্রিকাতে বসতি করেছিল, তাদের অনেকেই পুরনো সেনানায়ক মারিয়াসের প্রতি অনুগত। সিনার ডাকে এদেরকে নিয়ে মারিয়াস ইট্রুরিয়াতে এসে অবতরণ করেন। এখানে আরো সেনা তার দলে যোগ হয়। সিনা ও মারিয়াসের যৌথ বাহিনী রোমের দিকে যাত্রা করল। মোটামুটি বিনা বাধায় তারা রোমে প্রবেশ করে। সুলার সমর্থক বলে পরিচিত বহু রোমান মারিয়ানদের হাতে নিহত হয়, এদের মধ্যে কন্সাল অক্টাভিয়াস এবং অনেক সিনেটরও ছিলেন।

অস্ত্রের মুখে সিনেট মারিয়াসের উপর থেকে সকল অভিযোগ তুলে নেয় এবং সিনাকে কন্সাল হিসেবে স্বপদে বহাল করে। সুলাকেই উল্টো রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে তার জমিজমা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারিয়াস সপ্তম ও শেষবারের মতো নিজেকে কন্সাল ঘোষণা করেন, এর কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তার জায়গা নিলেন ফ্ল্যাকাস। সিনেট তাকে একটি বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে মিথ্রিডেটসের বিরুদ্ধে পাঠাল।  

দৃশ্যপটে সুলার পুনরাবির্ভাব

মারিয়ানরা রোমের দখল নেবার পর সৃষ্টি হলো এক অদ্ভুত পরিস্থিতির। রোমের শত্রু হিসেবে ঘোষিত সুলা লড়াই করছিলেন রোমেরই সুরক্ষার জন্য। ফ্ল্যাকাস মূলত তাকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য আদেশ পেলেও তিনি সুলার সাথে কোনো সংঘাত থেকে বিরত ছিলেন। সুলা গ্রিসে আর ফ্ল্যাকাস এশিয়া মাইনরে মনোনিবেশ করলেন। বিজয়ের পাল্লা রোমানদের দিকে হেলে পড়ে, মিথ্রিডেটস নিজের রাজ্যে পিছিয়ে যান।

সুলা রোমে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাই তিনি ৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিথ্রিডেটসের সাথে নমনীয় শর্তে শান্তিচুক্তি করেন। সেই বছর তিনি এশিয়া মাইনরে লুণ্ঠন চালান ও রোমান প্রদেশগুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেন। এর পরের বছর তিনি গ্রিসে পাড়ি জমান এবং মিথ্রিডেটসকে সমর্থনকারী রাজ্যগুলোর শাস্তিবিধান করলেন।

সিনার মৃত্যু

মারিয়ানরা জানত সুলার সাথে আরেকটি সংঘর্ষ আসন্ন। সুলা যখন মিথ্রিডেটসের সাথে চুক্তি সম্পাদন করলেন, তখন তার বুঝে গেল এবার তিনি রোমের দিকে নজর দেবেন। সেই বছরের কন্সাল ছিলেন সিনা ও কার্বো। তারা সুলাকে ইতালিতে আসার আগেই বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করলেন। সেইমত ব্রুন্দিসিয়ামে সেনা সমাবেশ করা হতে লাগল। নিয়মবিরুদ্ধভাবে পরবর্তী বছরও সিনা ও কার্বো কন্সালশিপ ধরে রাখলেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল অ্যাড্রিয়াটিক অতিক্রম করে মেসিডোনিয়াতে যাওয়া, যেখানে সুলার সাথে লড়াই হবে। কিন্তু সিনার বাড়াবাড়িতে সেনারা অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহ করল, তাদের হাতে সিনা নিহত হন। কার্বো নিজের প্রভাব খাটিয়ে সে বছর আর কোনো কন্সাল নির্বাচিত হতে দিলেন না, তিনি একাই সব কাজ চালিয়ে নিতে থাকলেন। কিন্তু সিনার মৃত্যুতে গ্রিসে সুলাকে বাধা দেবার ইচ্ছা বাতিল করতে হলো।

সেনাদের হাতে সিনার মৃত্যু; Image Source: lookandlearn.com

এদিকে নতুন করে রক্তক্ষয় এড়াতে সিনেট সুলার সাথে আলোচনা শুরু করল। সুলা দাবি করলেন, তিনি ও তার সাথীদের বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি ও সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। সিনেট সুলার দাবি মেনে নিতে ইচ্ছুক থাকলেও কার্বোর বাধায় তা ভেস্তে যায়।

সুলার দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ

বসন্ত, ৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

প্রায় চল্লিশ হাজার অভিজ্ঞ সেনা নিয়ে সুলার নৌবহর ব্রুন্দিসিয়ামে এসে ভিড়ল। ইতালীয় ও লাতিনদের দেয়া সমস্ত সুবিধা সুলা বজায় রাখার অঙ্গীকার করলেন। বেশিরভাগ এলাকা সুলার পক্ষ নিলেও স্যামনাইট আর ইট্রুস্কানরা মারিয়ানদের সাথে যোগ দিল।

তৎকালীন রোমান কন্সাল নর্বানাস এবং সিপিও এশিয়াটিকাস যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। সুলা ক্যাম্পানিয়াতে প্রবেশ করলে নর্বানাস তাকে বাধা দেন। কিন্তু মাউন্ট টিফিটার কাছে পরাজিত হয়ে তাকে কাপুয়াতে পিছিয়ে যেতে হলো। সেখানেও সুলা তাকে ধাওয়া করে আবার পরাস্ত করেন। এদিকে এশিয়াটিকাস তার সেনাদল নিয়ে টিনাম সিডিসিনাম শহরের কাছে এসে সুলার সাথে আলোচনায় বসেন। তার সেনাদল সুলার প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে লড়াই করতে অনিচ্ছুক ছিল। তারা সুলার দলে গিয়ে যোগ দিল।

মাউন্ট টিফিটার যুদ্ধ; Image Source: Wikimedia Commons

অনেক প্রভাবশালী রোমান সুলার পক্ষাবলম্বন করল। পিসেনাম থেকে উঠে এলেন ২৩ বছরের এক তরুণ উচ্চাভিলাষী রোমান, পম্পেই। তার পিতা পম্পেই স্ট্র্যাবোর অধীনে কাজ করা সেনাদের এক করে তিনি নিজের বাহিনী গঠন করলেন। স্পেন থেকে সুলার সাহায্যে অগ্রসর হলেন ক্রাসুস।

৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কার্বো পুনরায় কন্সালের দায়িত্ব নিলেন। অপর কন্সাল হিসেবে মারিয়াসের ছাব্বিশ বছর বয়স্ক পুত্র, কনিষ্ঠ মারিয়াস নির্বাচিত হন। উদ্দেশ্য ছিল, মারিয়াসের নামে তার সব সমর্থককে একাট্টা করা। সুলার সমর্থকদের বিরুদ্ধে নতুন করে রক্তপাত শুরু হয়। ডেমাসিপাস নামে এক প্রিটর এতে নেতৃত্ব দেন। সুলার প্রতি সহানুভূতির অভিযোগে অনেক সিনেটর এই অনর্থক হত্যার শিকার হন।

কার্বো তার বাহিনী নিয়ে উত্তরে পম্পেইয়ের দিকে আর মারিয়াস দক্ষিণে সুলার উদ্দেশে মার্চ করলেন। কার্বো ব্যর্থ হন। তিনি পিছিয়ে গিয়ে ইট্রুরিয়াতে ঢুকে পড়েন এবং রোম ও পম্পেইয়ের বাহিনীর মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেন।

মারিয়াস স্যামনাইটদের সাথে নিয়ে সুলার সাথে স্যাক্রিপোর্টাস নামক এলাকাতে যুদ্ধে লিপ্ত হন। অনেকক্ষণ ধরে প্রচণ্ড লড়াই চলল। অবশেষে মারিয়াস পিছু হটে যেতে বাধ্য হন। তিনি প্রেনেস্টেতে আশ্রয় নেন। সুলা সেখানে কিছু সেনা রেখে নিজে উত্তর দিকে ঘুরে ইট্রুরিয়াতে কার্বোর উপর হামলা করলেন। বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের পরে সুলার বিজয় নিশ্চিত বুঝে কার্বো আফ্রিকা পালিয়ে যান।

ব্যাটল অফ স্যাক্রিপোর্টাস © Giovanni Battista Tiepolo/ The Metropolitan Museum of Art

মারিয়াস ছিলেন তার সমর্থকদের শেষ ভরসা। তারা টেলেসিনাসের অধীনে থাকা স্যামনাইটদের সাথে একত্র হয়ে তাকে উদ্ধারের জন্যে প্রেনেস্টেতে আক্রমণ করে। কিন্তু সুলার বাহিনী তাদের প্রতিহত করল। চূড়ান্ত আশ্রয় হিসেবে মারিয়ানরা রোমের দিকে ছুটে গেল। সুলা পম্পেই ও ক্রাসুসকে নিয়ে তাদের পিছু নিলেন। এখানে রোমে ঠিক বাইরে কলিন গেটের কাছে অনুষ্ঠিত হল এক রক্তক্ষয়ী লড়াই, যা রাত পর্যন্ত গড়ায়। মারিয়ান ও স্যামনাইট যৌথ বাহিনী সুলার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু সুলার ডানবাহুতে ক্রাসুস তার সেনাদের নিয়ে যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে যুদ্ধের ফলাফল সুলার পক্ষে চলে আসে। প্রায় ৫০,০০০ রোমান সেনা এখানে নিহত হয়; ৪,০০০ এর মতো মারিয়ান বন্দি হয়।

কলিন গেটের লড়াই; Image Source: brewminate.com

পরবর্তী দিন বেলনা মন্দিরে সুলা সিনেটরদের সামনে নিজের বিজয় ঘোষণা করেন। বহু যুদ্ধবন্দিকে সেদিন হত্যা করা হয়। ডেমাসিপাসের শিরশ্ছেদ করে তার মাথা প্রেনেস্টের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হয়। কনিষ্ঠ মারিয়াস আত্মহত্যা করলেন। সুলার বিরোধিতা করার মতো আর কেউ ইতালিতে অবশিষ্ট রইল না।

সুলার প্রতিশোধ

মারিয়ানদের নির্মূল করতে সুলা এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি প্রসক্রিপশন নামে একটি আইন প্রবর্তন করেন। এর মাধ্যমে প্রতিদিন মারিয়ানদের তালিকা ফোরামে টাঙিয়ে দেয়া হতো। তাদের হত্যা করতে বা খুঁজে দিতে পারলে পুরস্কার দেয়া হতো। নিহত সমস্ত মারিয়ানদের সম্পত্তি নিলাম করে অল্প দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি সবার জন্য সরকারি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিষিদ্ধ করা হয়।

মারিয়ানদের তালিকা টাঙ্গানো হচ্ছে; Image Source: Wikimedia Commons

রোমে বয়ে যায় রক্তের বন্যা। ইকুইটরা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের প্রায় ২,৬০০ লোক প্রসক্রিপশনের শিকার হয়। নব্বইজন রোমান সিনেটর নিহত হন। এ আইনের সুযোগ নিয়ে সুলার সমর্থকেরা ব্যক্তিগত শত্রুতার ফয়সালা করতে থাকে। তাদের অনেকে মারিয়ানদের সহায়-সম্পত্তি দখল করে নেয়। ক্রাসুস পরিণত হন রোমের অন্যতম ধনবান ব্যক্তিতে। মারিয়াসের প্রতি সুলার ঘৃণা ছিল প্রবল। তার মৃতদেহ কবর থেকে তুলে শহরের মাঝ দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়।

রোমে রক্তপাত; Image Source: cogitansiuvenis.blogspot.com

এক তরুণ রোমান প্রসক্রিপশন তালিকাতে উপরের দিকে ছিলেন। তার অপরাধ তিনি মারিয়াসের ভাগ্নে এবং সিনার জামাতা। তার ঘনিষ্ঠজনদের অনুরোধে সুলা তাকে রেহাই দিতে রাজি হন, শর্ত তার স্ত্রীকে ত্যাগ করতে হবে। সে রোমান তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তারপরেও বিচিত্র কোনো কারণে সুলা তাকে হত্যা করেননি, যদিও তিনি বলতেন, এই রোমানের ভেতর তিনি অজস্র মারিয়াসের ছায়া দেখতে পান। এই রোমান তরুণের নাম গাইয়াস জুলিয়াস সিজার।

কার্বোর পতন

সিসিলি ও আফ্রিকাতে কার্বোর নেতৃত্বে মারিয়ানদের প্রতিরোধ টিমটিম করে জ্বলছিল। সুলা পম্পেইকে তাদের মাটিতে মিশিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। পম্পেই সাফল্যের সাথে এই কাজ সম্পন্ন করেন। ৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কার্বো আটক হন, তাকে হত্যা করা হয়। পম্পেই সুলার কাছে ট্রায়াম্ফের দাবি করেন। অনিচ্ছুক থাকলেও সমস্যা এড়াতে সুলা তার দাবি মেনে নেন। ১২ মার্চ, ৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পেই ট্রায়াম্ফ পেলেন। তার উপাধি হলো ম্যাগনাস (দ্য গ্রেট)।

সুলার সংস্কার

সুলা প্রায় ১২০ বছর পর রিপাবলিকে একনায়কের অফিস পুনর্জীবিত করলেন। তবে তিনি এতে দুটি পরিবর্তন আনেন। আগের মতো ছয়মাস মেয়াদ না ধরে সুলা যতদিন ইচ্ছা ততদিন একনায়ক থাকার আইন করে নেন। এছাড়াও তিনি নিজেকে রোমান আইন নতুন করে লেখার অনন্য ক্ষমতা প্রদান করেন।

সুলা সিনেট পুনর্গঠন করে অনেক অভিজাত ইকুইটকে সেখানে বসান। তিনি ট্রিবিউনদের ব্যাপারে তার পূর্বের আইন পুনরায় বলবত করলেন। ট্রিবিউনদের জন্য মেয়াদ ফুরোনোর পরে যেকোনো সরকারি পদে নির্বাচন নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হলো। প্লেবেইয়ান কাউন্সিলের যেকোনো আইনে সিনেটের ভেটো আবার আইনসম্মত করা হয়। রোমান রাজনৈতিক পদে নির্বাচিত হবার ক্রমিক প্রক্রিয়া, বা কার্সাস অনারাম সুলা শক্তভাবে প্রয়োগ করেন। এ প্রক্রিয়াতে একজন রোমান নাগরিক সবথেকে নিচের পদে প্রথমে নির্বাচিত না হলে এর উপরের পদের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না।

সুলা প্রতিটি সরকারি পদের জন্যে বয়সসীমা বেঁধে দেন। একই পদে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের আগে দশ বছরের বিরতির বিধি জারি করা হল। সুলা বিচারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। ইকুইটদের জুরিতে বসার আদেশ বাতিল করে সিনেটরদের পুনরায় বিচারকার্যের দায়িত্ব দেয়া হয়। ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের বিচারে ভিন্ন ভিন্ন আদালত স্থাপিত হয়।

সুলা রোমের প্রদেশ দশে উন্নীত করেন। নিয়ম করা হয়, রোমে দায়িত্ব পালন করার পরে কন্সাল ও প্রিটররা এক বছরের জন্য প্রদেশে প্রোকন্সাল ও প্রোপ্রিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

সুলা কিন্তু তার একনায়কত্ব দীর্ঘদিন ধরে রাখেননি। ৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর ৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু হয়। সুলা রোমকে স্থিতিশীল করে রেখে যাবার স্বপ্ন দেখলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবং তার মৃত্যুর নয় বছরের মধ্যেই তার করা বেশিরভাগ আইন বাতিল হয়ে যায়।  

ইতিহাসের বিচার

লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুলা প্রাচীন রোমের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। তাকে নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু একনায়ক বলে অনেকে মনে করেন। সিনেটকে শক্তিশালী করার কথা বললেও সুলার সংস্কার প্রকৃতপক্ষে রোমান প্রজাতন্ত্রের কাঠামোকে আরো দুর্বল করে ফেলেছিল। তার কিছু কাজ হয়ত প্রশংসার দাবি রাখে, যেমন বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রদেশের প্রশাসনিক কাঠামো সুদৃঢ়করণ ইত্যাদি। তবে এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত রোমকে ঠেলে দিয়েছিলেন একনায়ককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে।

ট্রিবিউনদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে এবং প্লেবেইয়ান কাউন্সিলের উপর সিনেটের ভেটো ক্ষমতা চাপিয়ে সুলা প্রজাতন্ত্রকে অন্তত কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য যতই মহৎ থাকুক না কেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সুলার দেখানো পথ ধরেই পরবর্তী রোমান একনায়কদের উদ্ভব ঘটে।

This is a Bengali language article as a part of the series on the rise of Ancient Rome. This article describes the events of the civil war between Marius and Sulla.

References

  1. Professor Garrett G. Fagan (1999), The History of Ancient Rome: Course Guidebook; The great Courses; Virginia, USA. Pp. 61-64
  2. Boak, A. E. R. (1921) History of Rome to 565 A. D. The Macmillan Company, New York, USA.
  3. Hyden, M (2017). Gaius Marius
  4. Hyden, M (2015). Lucius Cornelius Sulla: Guardian or Enemy of the Roman Republic?
  5. Lucius Cornelius Sulla

Featured Image: imgur.com

Related Articles

Exit mobile version