ভারতবর্ষে বাংলা নামে যে এলাকাটি দীর্ঘকাল ধরে মানুষের কাছে পরিচিত তার সাথে যুক্ত হয়ে আছে সুজলা সুফলা এক ভূমি, দিগন্তজুড়ে সবুজের স্বর্গরাজ্যের ছবি। মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে আছে সবুজ ধানের ক্ষেত। সেই ধান পাকার মৌসুমে সোনালী আভা ছড়িয়ে যায় চারদিকে। তাই যখনই ইতিহাসে বাংলা আর বাঙালির অর্থনীতির কথা আসে ‘সোনার বাংলা’ শব্দটি যেন আমাদের নিজেদেরকে বর্ণনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।
তবে সত্যিকার সোনার খনি না থাকলেও এখানে আছে নদী নালা বেষ্টিত নরম মাটি। এমন উর্বর মাটিতে বীজ পুঁতে দিলে মাটি প্রতিদান দেয় বুকভরে। তবে বাঙালির মাটিতে এমন জাদু থাকার পরেও দারিদ্রতা বাঙালির পিছু ছাড়েনি। বরং চাপা পড়ে থাকা পাতায় দুর্ভিক্ষ, মহামারী আর খাদ্য সংকটের মতো সমস্যায় জর্জরিত বাংলার ইতিহাস।
তাই সামাজিক আর অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের মনে প্রশ্ন, বাংলার ইতিহাসে সমৃদ্ধির এই বহুল উচ্চারিত ‘সোনার বাংলা’র সময়কালটি কখন? ইতিহাসে এর অস্তিত্ব কি আদৌ ছিল? ব্রিটিশ শাসনে আমরা দেখেছি দুর্ভিক্ষের অগ্নিমূর্তি, ব্রিটিশ শাসনের আগেই কি তাহলে সেই ‘সোনার বাংলা’ ছিল?
ইতিহাসের পিঠে চড়ে মধ্যযুগে কিংবা তারও আগে ফিরে গেলে নানা ঐতিহাসিক আর পর্যটকদের বর্ণনায় দেখা যায় বাংলা এক স্বর্গরাজ্য। বাজারে প্রাচুর্য, সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে, এমন বর্ণনাও আছে অনেক। তবে অর্থনীতিবিদদের অনেকের মতে বাংলায় এত প্রাচুর্য কোনোকালেই ছিল না, অর্থনীতির বাস্তবতায় অন্তত ব্যাপারটি সম্ভব ছিল না। এমনকি প্রাক-ব্রিটিশ আমলে বাংলায় কোনোদিন দুর্ভিক্ষ হয়নি এমন প্রচলিত ধারণাও ঠিক নয়।
ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল কি?
প্রচলি আছে বাংলায় প্রাক-ব্রিটিশ আমলে দুর্ভিক্ষ ছিল না। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণে বাংলার অবস্থার অবনতি হয়েছে, তবে বাংলার দারিদ্র্যের আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এমনকি ব্রিটিশরা চলে আসার পরেও বাংলার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই কৃষিভিত্তিক সমাজে যখন কলকারখানা গড়ে উঠেনি, তখন অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক ছিল জনসংখ্যা।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমের দামের সাথে জনসংখ্যার সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান। কোনো সমাজে কাজের মজুরী বাড়লে জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়বে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়লে মজুরীর পরিমাণ আবার কমে যাবে।
ম্যালথাসের তত্ত্ব অনুসারে, অনুকূল পরিবেশে বেশি মজুরী দিলে জনসংখ্যা বাড়বে, খাদ্যশস্যের উৎপাদন গাণিতিক হারে বাড়লেও জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। সুতরাং সমাজে খাদ্যাভাব অবশ্যাম্ভাবী, শুরু হবে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের পরে জনসংখ্যা কমে গেলে আবার মজুরীর হার বাড়বে। এভাবেই দুর্ভিক্ষ কৃষিভিত্তিক সমাজে পণ্যের চাহিদা, কৃষকের মজুরী কিংবা লভ্যাংশের সাথে জনসংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখে।
তাই ইতিহাসের অনুসন্ধানে দেখা যায় প্রাক-ব্রিটিশ শাসনামলেও বাংলায় বড় বড় দুর্ভিক্ষের প্রমাণ আছে। মহাস্থানগড়ের লিপিতে প্রাচীন এক দুর্ভিক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়, সেই দুর্ভিক্ষে পুণ্ড্রনগরের মহাজাতককে ত্রাণ সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে দেখা যায়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরের অস্থির সময়ে বাংলায় আরেকটি দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। আর তৃতীয় আরেকটি দেখা যায় ১৬৬১ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে।
তবে বড়সড় দুর্ভিক্ষের পাশপাশি অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে খাদ্য সংকটের ঘটনা খুব দুর্লভ ছিল না। তবে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে বন্যা, খরার নিদর্শন পাওয়া গেলেও এর ফলে সৃষ্ট খাদ্য সংকট কিংবা অর্থনৈতিক সংকটের উল্লেখ করা হয়েছে খুবই কম। এর একটি কারণ বাংলার ইতিহাস লিখিত হয়েছে দুইটি ধারায়। একটি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, সত্যকে দ্বিতীয় স্থানে রেখে শাসকের গুণগান আর সমৃদ্ধির ইতিহাসকে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। আর অন্যটি লিখিত হয়েছে পর্যটকদের দ্বারা, পর্যটকেরা বেশিরভাগ সময়েই সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের সাথে মিশে অভ্যস্ত, একদম সাধারণ মানুষের সাথে তাদের যোগাযোগ কতটুকু ছিল তা নিয়েও সন্দিহান অনেকেই।
মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণে আছে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এই দেশে পণ্য সস্তা। প্রায় একই বর্ণনা পাওয়া যাবে সিবাস্তিয়ান ম্যানেরিক, ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের কিংবা ওয়াং তু ওয়ানের ভ্রমণ কাহিনীতে।
তবে এই পর্যটকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো পথে চলাচল করতেন, বড় বড় বাজার আর শহরের মধ্য দিয়ে রাস্তা বেছে নিতেন। পাশাপাশি অনেকেই রাজকোষ থেকে ভাতাও পেতেন পথের খরচ নির্বাহের জন্য। দিল্লী থেকে ইবনে বতুতাকে সতের হাজার দিনার বাৎসরিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তাই তার কাছে যা সস্তা মনে হতে পারে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকাও অসম্ভব নয়। আবার তার বর্ণনা থেকে দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে ভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই তিনি লিখছিলেন, “আমি তাদের বলতে শুনেছি, এ দামও তাদের কাছে অত্যন্ত বেশি।”
তাই পর্যটকদের ভ্রমণ কাহিনী আর দিনলিপি থেকে ইতিহাসের যে খণ্ডচিত্র পাওয়া যায় তা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা জরুরী। বিদেশি পর্যটক আর ঐতিহাসিকেরা যখনই বাংলার পণ্যকে সস্তা বলছেন তা স্বাভাবিকভাবেই অন্য দেশের কিংবা এলাকার সাথে তুলনা করে বলছেন। আর পণ্যের বাজার মূল্যের সাথে শ্রমিক, কৃষক কিংবা উৎপাদনকারীর মজুরী সরাসরি জড়িত। পণ্যের দাম কম হওয়ার পরোক্ষ অর্থ দাঁড়ায় উৎপাদনকারীর হাতেও কম অর্থ পৌঁছাবে।
বাংলার অন্যতম সমৃদ্ধ শিল্প মসলিনের কথায় যদি আসা যায় সেখানেও তাঁতিদের মজুরী ছিল অস্বাভাবিক রকমের কম। ১৭৩৫ সালের তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় ভারতীয় শ্রমিকদের ছয়গুণ মজুরী পেত ফরাসী শ্রমিকেরা। মজুরীর অর্থে জীবন নির্বাহ করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে শ্রমিকদের, পেটের দায়ে অন্য পেশায় চলে যায় অনেকেই। যে পণ্যের জন্য বাংলার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, সেই শিল্পে মজুরীর এমন দুর্দশা হলে অন্যান্য শিল্পে কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।
তবে বাংলার সমৃদ্ধি আর সাফল্যের আরেকটি উদাহরণ হলো শায়েস্তা খানের আমলে বাংলায় পণ্যমূল্যের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া। বাংলা প্রবাদ আর বাগধারায় শায়েস্তা খানের আমল বলতেই প্রাচুর্য বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু শায়েস্তা খানের আমলে পণ্যের দাম কীভাবে কমে গেল সেই ব্যাখ্যা অনেকটাই অস্পষ্ট। জলদস্যুদের বিতাড়ন, নৌপথে পণ্য আনা নেওয়ার সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যেতে পারে। তবে এর কোনোটিই পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বিশেষজ্ঞরা এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া। মানুষের আয় কমে গেলে পণ্যমূল্য কেনার ক্ষমতাও কমে আসে। সুতরাং বাজারে একটি কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি হয়, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদাও কমে আসে। এমনইভাবে সেই আমলে ক্রেতার অভাবে চালের দামও কমতে থাকে। সাধারণ মানুষের আয় কমে আসার একটি কারণ হিসেবে দেখা হয় শায়েস্তা খানের আমলে উচ্চ রাজস্ব আদায়।
শায়েস্তা খান থেকে আরো পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও অনাহারের নিদর্শন আছে,
“টালিতে মোর ঘর নাই পড়িবেশী
হাঁড়ীতে মোড় ভাত নাহি নিতি আবেশী”
যার অর্থ দাঁড়ায় টিলাতে আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্যই ক্ষুধিত। তবে শুধু চর্যাপদেই নয় চৈতন্যমঙ্গল আর ময়মনসিংহের লোকগীতিতেও আছে দুর্ভিক্ষের কথা। অনাহার আর দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি বাংলার ইতিহাসে দেখা যায় দাসপ্রথাও। বাবা মায়ের দ্বারা সন্তান বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘চৈতন্য চরনামৃত’এ পাওয়া যায় এই শ্লোকটি,
“নাহা লুহা লবণ বেচিবে ব্রাহ্মণে
কন্যা বেচিবেক যে সর্ব শাস্ত্রে জানে।”
তবে দাসদের বিক্রয়মূল্যের দলিল দস্তাবেজের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের দামও তুলনামূলক কম। ইবনে বতুতা নিজেই আড়াই দিনারে ক্রীতদাসী ক্রয় করেছিলেন, বাজারে কম দামে প্রচুর দাস-দাসী বিক্রি হতে দেখেছেন তিনি। অনাহার আর দুর্ভিক্ষ কিংবা ঋণের কারণে নিজেকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও পাওয়া যায় সেই সব রেকর্ডে।
আবার দাসের মূল্য নির্ধারিত হয় তার সারা জীবনে যা আয় করবে তার উপর, অর্থাৎ তার মজুরীর উপর। সুতরাং একজন দাসের এককালীন বাজারমূল্য কম হওয়ার থেকে সহজেই অনুমান করা যায় মানুষের দৈনিক শ্রমের মজুরী কত কমে গিয়েছিল।
তাই অর্থনৈতিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সোনার বাংলার যে সমৃদ্ধ প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে ভেসে উঠে বাংলা ঠিক তেমন ছিল না কখনোই। তবে দারিদ্র্যের পাশাপাশি এখানে সমৃদ্ধিও ছিল, তবে তা নিরবচ্ছিন্ন নয় মোটেও। দুর্ভিক্ষ, অতিবৃষ্টি ছিল, বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। বন্যা, খরা আর দুর্ভিক্ষের মতো দুর্যোগের পর জনসংখ্যা কমে আসতো, নতুনভাবে শুরু হতো মানুষের লড়াই। সময় আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই বাংলায় যুগ যুগান্তর ধরে টিকে আছে মানুষ। ইংরেজ শাসনের পর থেকে সেই লড়াই আরো তীব্র হয়েছে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে লড়াই ছিল তা ছড়িয়ে পড়েছে মানুষে মানুষে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়েছে।
সুজলা সুফলা গ্রাম বাংলার অনাহার আর দারিদ্র্যের ঘরে যে শান্তির প্রতিচ্ছবি সেটিই আসল ‘সোনার বাংলা’।