অনেক অনেক কাল আগে পারস্যের রাজা ছিলেন খসরু পারভেজ। গল্প নয়, সত্যিই। তাকে বলা হত রাজা দ্বিতীয় খসরু, প্রথম খসরু ছিলেন তার দাদা। শাহেনশাহ খসরুর এক রানী ছিলেন আর্মেনীয় রাজকন্যা শিরিন, যি নি কিনা আমাদের আজকের ‘শিরি-ফরহাদ’ গল্পের নায়িকা। কিন্তু সে গল্পের নায়ক কে? খসরুই? নাকি কোথাকার এক ভাস্কর ফরহাদ? চলুন জেনে নেয়া যাক পুরো কাহিনী- হোক সেটা প্রেমের কিংবা নিষ্ঠুরতার। গল্পের কতটা ঐতিহাসিক, আর কতটা কাল্পনিক? আর এ গল্পের ঠিক কোন বিন্দুতে গিয়ে ইসলামি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মিলে যায়?
লাইলি মজনুর রচয়িতা পারস্যের কবি নিজামি গঞ্জবিই (১১৪১-১২০৯) এ কাহিনীর রচয়িতা। তবে আমাদের দেশে এটা ‘শিরি-ফরহাদ’ নামে পরিচিত হলেও, এ প্রেমকাহিনীর আসল নাম ‘খসরু ওয়া শিরিন’। অর্থাৎ, নিজামি তার গল্পে ফরহাদকে বেশি গুরুত্বই দেননি। কিন্তু, নিজামি কিন্তু এ কাহিনীর স্রষ্টা নয়, এর আগেই মহাকবি ফেরদৌসি (৯৪০-১০২০) তার ঐতিহাসিক মহাকাব্য ‘শাহনামা’-তে এ গল্প বলে ফেলেছেন, এছাড়া অন্যান্য লেখকেরাও লিখে গিয়েছিলেন। নিজামি কেবল একে নিজের মতো করে বড় করে লেখেন, আর তার মাধ্যমেই জনপ্রিয়তা পায় গল্পটি। তবে কাহিনী শুরু করবার আগে জেনে রাখা ভালো, শিরিন ও খসরু দুজনেই ঐতিহাসিক চরিত্র এবং পরস্পরের সাথে বিবাহিত হলেও এই গল্পে বর্ণিত কোনো প্রেমকাহিনীরই কোনো ভিত্তি নেই, এ নিছক গল্পই- বিখ্যাত গল্প।
নিজামির গল্পের শুরু খসরুর জন্মের বর্ণনা দিয়ে। ইসলামের আবির্ভাবের আগে পারস্যের শেষ সাম্রাজ্য সাসানীয়দের সর্বশেষ দীর্ঘকালীন সময়জুড়ে টিকে থাকা রাজা বা শাহেনশাহ (রাজাদের রাজা) ছিলেন এই দ্বিতীয় খসরু পারভেজ (خسرو پرویز)। ৬৫১ সালে পতন হয় এ সাম্রাজ্যের। খসরুর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে, তখন পারস্য সাম্রাজ্যে জরথুস্ত্র ধর্মের প্রাধান্য।
যতই অমর প্রেমকাহিনীর কথাই বলা হোক না কেন, ইতিহাস আমাদের জানায়, খসরুর স্ত্রী কেবল শিরিনই ছিলেন না, এছাড়া মারিয়াম আর গর্দিয়া নামের অন্তত আরও দুজন ছিলেন।
বড় হতে হতে খসরু লেখাপড়া ভালোই চালিয়ে যান। একবার এক কৃষকের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করায় তার বাবা তাকে খুব বকে দেন। খসরু মাফ চাইলে রাজা চতুর্থ হরমিজ তাকে ক্ষমা করে দেন।
সে রাতেই খসরু স্বপ্নে দেখেন, তার দাদা প্রথম খসরু এসে তাকে বলছেন, তার ভাগ্যে জুটবে পরমা সুন্দরী এক স্ত্রী যার নাম হবে শিরিন (شيرين), চমৎকার এক ঘোড়া যার নাম শাবদিজ, দক্ষ এক গায়ক যার নাম বারবাদ, আর বিশাল এক রাজ্য যার নাম পারস্য। আদতে খসরু তখন আক্ষরিক অর্থেই ‘প্রিন্স অফ পারসিয়া’, অর্থাৎ পারস্যের রাজপুত্র।
খসরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম ছিল শাপুর। শাপুরের কাছে খসরু শুনতে পেলেন, আর্মেনিয়ার রানী শামিরা মাহিন বানুর গল্প। আরো জানতে পারলেন, মাহিন বানুর ভাতিজি শিরিনের সৌন্দর্যের কথা- এগুলো শুনেই খসরু না দেখেই প্রেমে পড়ে যান শিরিনের।
আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন শাপুর শিরিনকে খুঁজে বের করতে। তাকে খুঁজে পাবার পর তাকে খসরুর প্রতিচ্ছবি দেখান। শিরিন ছবি দেখে প্রেমে পড়ে যান খসরুর। এতই প্রেমে পাগল যে, শিরিন তখনই আর্মেনিয়া থেকে পালিয়ে চলে যান খসরুর রাজধানী মাদাইনে (এখন সেটি ইরাকে)। কিন্তু খসরু জানতেন না যে শিরিন পালিয়ে আসছেন এদিকে। বাবার রাগ উপেক্ষা করে খসরু বেরিয়ে পড়েন আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্যে।
পথিমধ্যে, খসরু গোসলরত বিবস্ত্র শিরিনকে আবিষ্কার করেন, শিরিন তখন চুল শুকাচ্ছিলেন। তবে খসরু দরিদ্র প্রজার ছদ্মবেশে থাকায় শিরিন বুঝতে পারেননি ওটা কে ছিল। অবশ্য খসরুও বুঝতে পারেননি ওটাই যে শিরিন।
খসরু আর্মেনিয়া পৌঁছালে রানী শামিরা তাকে স্বাগত জানান। কিন্তু এরপরই খসরু আবিষ্কার করলেন, শিরিন তো এ রাজ্যেই নেই! জানতে পারলেন, তারই খোঁজে শিরিন মাদাইন গিয়েছেন। বন্ধুবর শাপুরের ওপর এবার দায়িত্ব পড়লো শিরিনকে নিয়ে আসার, এবার আর্মেনিয়াতে। শিরিন যখন আর্মেনিয়া পৌঁছালেন তখন খসরু আর নেই এ রাজ্যে। কারণ, খসরুর পিতা মারা গেছেন। তাই রাজ্যের হাল ধরতে তাকে ফিরতে হয়েছে মাদাইনে।
এভাবে একে অন্যের সাথে দেখাই হচ্ছিলো না খসরু আর শিরিনের। শিরিন খসরুর কাছে যেতে চাইলে খসরুর ডাক পড়ে অন্যত্র- কিংবা ঘটে উল্টো ঘটনা।
কিন্তু এর মাঝে ঘটে যায় অঘটন। বাহরাম চবিন (بهرام چوبین) নামের এক সেনা কমান্ডার খসরুকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে নিলেন ৫৯০ সালে। এক বছর পর্যন্ত শাসনও করেছিলেন তিনি, যেটি ঐতিহাসিক সত্য। বিশ বছরের তরুণ খসরু তখন পালিয়ে গেলেন আর্মেনিয়াতে।
অবশেষে শিরিনের সাথে দেখা হলো খসরুর। তবে এবার শিরিন আর তাকে বিয়ে করতে রাজি না। এক শর্তে তাকে বিয়ে করবেন শিরিন, যদি রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারেন খসরু।
খসরু শিরিনকে আর্মেনিয়াতে রেখে কনস্টান্টিনোপলে যান। তিনি সম্রাটের কাছে সাহায্য চান বাহরামের কাছ থেকে রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য। সম্রাট শর্ত জুড়ে দিলেন, সাহায্য তিনি করবেন বটে, যদি খসরু সম্রাটের মেয়ে মারিয়ামকে বিবাহ করেন। আর যতদিন মারিয়াম জীবিত থাকবে, ততদিন খসরু আর কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না। খসরু মেনে নিলেন।
৫৯১ সালে সম্রাটের সহায়তায় নিজের রাজ্য উদ্ধার করলেন তিনি। কিন্তু শিরিনকে তার পাওয়া হলো না। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মারিয়াম নিশ্চিত করলেন যেন শিরিন থেকে খসরু যোজন যোজন দূরে থাকেন।
এমন সময়েই দৃশ্যপটে আগমন ফরহাদ নামের আর্মেনিয়ার এক ভাস্করের। তার সুনাম ছিল পাথর খোদাই করে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য।
শিরিন খোঁজ করছিলেন পাহাড় থেকে প্রাসাদ পর্যন্ত সরাসরি কোনো তরল পরিবাহক সুড়ঙ্গ বানাবার জন্য কাউকে, যেন তিনি সহজে দুধ আনাতে পারেন। প্রথম দর্শনেই ফরহাদ প্রেমে পড়ে যান শিরিনের। তাকে খুশি করতে দুধের ছোটখাট খাল বানিয়ে ফেলেন তিনি প্রাসাদের কাছে। খুশি হয়ে শিরিন তাকে তার কানের দুল উপহার দেন।
ফরহাদ শিরিনকে নিয়ে কবিতা আর প্রেমপত্র লিখতে শুরু করলেন। তার এই প্রেমের খবর চাউড় হয়ে গেল রাজ্যজুড়ে।
কিন্তু এ খবর খসরুর কানে পৌঁছালে রেগে গেলেন তিনি। যে করেই হোক ফরহাদকে সরাতেই হবে রাস্তা থেকে। ফরহাদকে তিনি তলব করলেন বেহিস্তান পাহাড়ের পাথর কেটে সিঁড়ি নির্মাণের জন্য, যদি করতে পারে এ কাজ, তবে ফরহাদ শিরিনকে বিয়ে করতে পারবেন- খসরুর কোনো আপত্তি থাকবে না। মোটামুটি অসম্ভব কাজ, যার মানে তাকে দূরে থাকতে হবে শিরিন থেকে। তবে এ কাজ শুরু করবার আগে পাহাড় খোদাই করে ফরহাদ শিরিনের চেহারা বানিয়ে ফেলেন।
কাজ চলাকালীন ফরহাদের কাছে খসরু দূত পাঠিয়ে জানালেন, শিরিন মারা গেছেন। ফরহাদ এ কথা শুনে মনের কষ্টে সে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে মারা যান। কিন্তু খসরু ইচ্ছে করে তাকে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিলেন। আসলে শিরিন মারা যাননি, ছিলেন বহাল তবিয়তেই। ফরহাদের মৃত্যুতে খসরু শোকাবহ পত্র দিলেন শিরিনকে।
এ ঘটনার পরপর শিরিন গোপনে বিষ পান করিয়ে মেরে ফেলেন খসরুর স্ত্রী মারিয়ামকে। এ নিয়ে চললো শিরিন আর খসরুর পত্র চালাচালি।
খসরু শিরিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেবার আগে ইস্পাহানের শেকার নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে যান, তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করেন। শেকারের আবির্ভাব খসরু-শিরিনের মিলনকে বিলম্বিত করে। তবে একপর্যায়ে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয় শেকার।
অবশেষে খসরু যান শিরিনের প্রাসাদে। শিরিন যখন দেখলেন খসরু মাতাল অবস্থায় আছেন, তখন তিনি তাকে ঢুকতেই দিলেন না। শেকারের সাথে দহরম-মহরম নিয়ে তাকে তিরস্কার করে তাকে বের করে দেন শিরিন। ব্যর্থ মনোরথে নিজের প্রাসাদে ফিরে আসেন খসরু।
একের পর এক বীরোচিত কার্যকলাপ করে খসরু চেষ্টা করতে থাকেন শিরিনের মন জয় করবার। একপর্যায়ে শিরিন রাজি হন তাকে বিয়ে করতে।
ওদিকে খসরু ও প্রয়াত মারিয়ামের ছেলে শিরুয়া (شیرویه) নিজেও ছিলেন শিরিনের প্রেমে মগ্ন। পিতা খসরুকে খুন করে নিজে রাজা হয়ে যান শিরুয়া। এরপর শিরিনের কাছে দূত পাঠান এই জানিয়ে যে, এক সপ্তাহ পরে তার সাথে শিরিনের বিয়ে। শিরুয়ার সাথে বিয়ে ঠেকাতে শিরিন আত্মহত্যা করেন।
খসরু আর শিরিনকে একই কবরে সমাহিত করা হয়।
খসরু-শিরিনের উপাখ্যান এখানেই শেষ। সেলজুক সুলতান আরসালান শাহ অনুরোধ করেছিলেন কবি নিজামিকে একটি রোমান্টিক মহাকাব্য রচনা করতে। তখন নিজামি এ খসরু শিরিনের গল্পই বেছে নেন। তবে এ কাজে তিনি ইতিহাস থেকে কেবল চরিত্রগুলো ধার করেন, কাহিনী রচনা করেন নিজের মতো আর কিছুটা শাহনামা থেকে নিয়ে। নিজামির নিজের মতে, এ গল্পটি পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর গল্প।
উপমহাদেশে শিরিন নামটি অনেক ক্ষেত্রেই শিরি-তে পরিণত হয়। আর গল্পের প্রধান প্রেমিক যেখানে খসরু সেখানে ফরহাদের ‘সাবপ্লট’টি বেশি জনপ্রিয়তা পায়; তাই ‘খসরু ওয়া শিরিন’ এখানে জনপ্রিয় শিরি-ফরহাদ নামেই। মজার ব্যাপার, ২০১১ সালে ৮৩১ বছর ধরে পাঠকপ্রিয় এ কবিতার অষ্টম সংস্করণ প্রকাশ করতে বাধা দেয় ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি দিকনির্দেশনা মন্ত্রণালয়, কারণ এতে নায়িকা শিরিনের কর্মকাণ্ডে অশালীনতার পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু আসল ইতিহাস কী ছিল শিরিন-খসরুর? চলুন এবার সেটা জেনে নেয়া যাক।
একদম গোড়ার দিকের সিরিয়াক ভাষার সূত্রে আমরা জানতে পারি শিরিন ‘আরামীয়’ ছিলেন, আর্মেনীয় নন। এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকা অনুযায়ী, আর্মেনীয় হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা শুরু হয় অনেক পরে। প্রকৃত আরামীয় বলতে নির্দেশ করে তার মাতৃভূমি আসলে বেথ আরামাই-তে। বর্তমান ইরাকে এ জায়গাটি অবস্থিত আসোরিস্তান প্রদেশে, আরবিতে এ জায়গাকে ডাকা হতো বালাদ আল-নাবাত। ৬৩৬ সালে আরবরা অধিকার করে নেয় এ ভূমি।
শিরিন ছিলেন খ্রিস্টান, জরথুস্ত্র ধর্মে খ্রিস্টান বিয়ে করা বৈধ ছিল না, তবুও খসরু তাকে বিয়ে করেন। ইতিহাস অনুযায়ী, খসরু বলেছিলেন, “আমার স্ত্রীদের মাঝে আমি তার প্রতি বেশি অনুরক্ত, তার প্রতি সম্মানার্থে আমি আমার ধর্মের আইন উপেক্ষা করেছি। সে আমারই।”
খসরু শিরিনের সম্মানার্থে ইরানের কার্মানশাহ প্রদেশের ক্বাসর-এ-শিরিন (قصرشيرين) শহরের নাম রাখেন, যার অর্থ শিরিনের প্রাসাদ। ২০০৬ সালের আদমশুমারি মাফিক এ শহরে ৩,৮৯৩টি পরিবারের বাস।
গল্পের খসরু যদিও শিরিনকে বিয়ে করতে পারেননি, আসলে কিন্তু তারা বিবাহিতই ছিলেন। বাহরাম চবিন যখন খসরুকে উৎখাত করেন, তখন শিরিনকে নিয়েই খসরু পালিয়ে যান সিরিয়াতে। বাইজান্টাইন সম্রাট মরিস তাদেরকে নিরাপত্তা দিতেন। ৫৯১ সালে খসরু রাজ্য পুনরুদ্ধার করলে শিরিন পারস্যের রানী হন। তবে পারস্যের সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের প্রতি তার দরদ ছিল বেশ। ৬১৪ সালে বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধে পারসিকরা ট্রু ক্রস অধিকার করে। ট্রু ক্রস হলো খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী সেই ক্রুশকাষ্ঠ, যাতে যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। শিরিন সেই ক্রুশ রাজধানীতে নিয়ে আসেন, নিজের প্রাসাদে রাখেন। ৬২৮ সালে শিরিন মারা যান। খসরুও একই বছর মারা গিয়েছিলেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি ৬২৮ তারিখে খসরুর ছেলে শিরুয়া রাজধানী দখল করে খসরুকে বন্দী করেন। এরপর নিজের নাম রাজা দ্বিতীয় কাভাধ ঘোষণা করে তিনি রাজ্যের অধিকার নিয়ে নেন। এরপর নিজের সব ভাই ও সৎভাইদের হত্যা করবার আদেশ জারি করেন তিনি। খসরুর প্রিয় পুত্র মারদানশাহকেও হত্যা করা হয়। তিন দিন পর কাভাধ বাবা খসরুকে হত্যা করার আদেশ দেন। তাকে ধীরে ধীরে তীর মেরে মেরে হত্যা করা হয়।
রাজত্ব দখল করে শত্রু বাইজান্টাইনদের সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সাথে শান্তিচুক্তি করে ফেলেন তিনি। তিনি ট্রু ক্রস থেকে শুরু করে বন্দী বাইজান্টাইন সেনাদেরও ফিরিয়ে দেন। এর ফলে পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়, আর হেরাক্লিয়াস বিজয়ী বেশে কনস্টান্টিনোপল ফিরে আসেন।
ইসলামি ইতিহাস ও হাদিসশাস্ত্রে খসরুকে আরবিতে কিসরা (كسرى) ডাকা হয়। হুদায়বিয়া সন্ধির পর ৬২৮ সালেই মহানবী মুহাম্মাদ (সা) ইসলামের আহ্বান জানিয়ে খসরু পারভেজকে পত্র লিখেন, যে পত্র নিয়ে যান সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাফা আস-সাহমি (রা)। ইবনে কাসির রচিত ইতিহাসগ্রন্থ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। পত্রে লিখা ছিল-
“এ পত্র মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে পারস্যের মহান সম্রাট কিসরার প্রতি। যারা সত্য-কঠিন পথের অনুসরণ করেছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদের প্রতি সালাম। আমি আপনাকে মহান আল্লাহর আহ্বানের দ্বারাই আহ্বান জানাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি গোটা মানবজাতির প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসেবে এসেছি। যাতে, যারা জীবিত আছে তাদেরকে সতর্ক করতে পারি এবং অবিশ্বাসীদেরকে আল্লাহর বাণী সত্যে পরিণত হবার ব্যাপারে সতর্ক করতে পারি। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তি ও নিরাপদে থাকুন (ইহকাল ও পরকালে)। যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন তাহলে এই মাজুসীদের (অগ্নি উপাসক) সকল পাপ আপনার ওপর বর্তাবে।”
পত্রবাহক সাহাবী চিঠি পুরো পড়ে শেষ করবার আগেই খসরু চিৎকার করে উঠলেন আর চিঠিটি ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। বললেন, “দেখ অবস্থা! সে আমার নামের আগে নিজের নাম লিখেছে!”
প্রাসাদ থেকে সাহাবী আব্দুল্লাহ (রা)-কে এরপর বের করে দেয়া হয়। তিনি মদিনায় উপস্থিত হয়ে ঘটনা জানালে, নবী (সা) বললেন, “কিসরা (খসরু) তার সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে দিল।”
খসরুর অধীনস্ত ইয়েমেনের গভর্নর ছিলেন বাযান (باذان ابن ساسان), তবে ইসলামি ইতিহাস বইগুলোতে তার নাম বাযাম (باذام) উচ্চারণ করা হয়। তিনি ইয়েমেনের সান’আ (صَنْعَاء) থেকে শাসন করতেন।
খসরু বাযামকে নির্দেশ দেন পত্রমারফত মুহাম্মাদ (সা)-কে তার দরবারে হাজির হবার নির্দেশ দিতে। বাযামের নিকট থেকে পত্র নিয়ে দুজন লোক আগমন করে মদিনাতে, যেখানে লিখা ছিল মহানবী (সা) যেন খসরুর দরবারে গমন করেন। তায়েফ ও মক্কাবাসীরা যখন জানতে পারলো যে খসরু স্বয়ং মুহাম্মাদ (সা)-কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তখন তাদের মাঝে খুশি ছড়িয়ে পড়লো।
দুই ব্যক্তির একজন (যার নাম ছিল আবু যুওয়াহ কিংবা বাবুয়েহ) নবী (সা) এর সাথে কথা বললেন। তারা জানালেন, “এটা শাহানশাহ রাজাধিরাজ কিসরার নির্দেশ। আপনি আমাদের সাথে না গেলে আপনি ইতোমধ্যে জেনে নিয়েছেন যে, এটা হবে আপনার, আপনার সম্প্রদায় ও দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ও ধ্বংসের কারণ।”
নবী (সা) উত্তরে বললেন, “তোমরা ফিরে যাও, কাল এসো আবার।”
এরপর তারা দুজন এলে নবী (সা) তাদের জানালেন, “খসরুর বিরুদ্ধে আল্লাহ তার ছেলে শিরুয়াকে আধিপত্য দিয়েছেন, সে তার পিতাকে অমুক মাসে, অমুক রাত্রিতে হত্যা করেছে।” (জুমাদাল আখিরা মাসের তের তারিখ রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে)
তারা বললো, “আপনি জানেন আপনি এসব কী বলছেন? আমরা এর প্রতিশোধ নেব। আপনার এ মন্তব্য আমরা জানাবো ইয়েমেনের শাসক বাযামকে।”
নবী (সা) বললেন, “হ্যাঁ, জানাও। আর তোমরা তাকে বলে দিবে, আমার প্রচারিত ধর্ম ও আধিপত্য কিসরার মতো খ্যাতি লাভ করবে আর পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছাবে। এটাও তাকে বলবে, তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো, তাহলে তোমার রাজত্ব ও আধিপত্য তোমার হাতেই থাকতে দেয়া হবে।”
সোনা-রূপাখচিত কোমরবন্ধ উপহার হিসেবে তাদের প্রদান করা হলো, যেটা অন্য কোনো এক রাজার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি।
ইয়েমেনে পৌঁছে তারা দুজন ঘটনা খুলে বলল বাযামকে। বাযাম বললেন, “খবর সত্য হলে তিনি আসলেই রাসুল। আর মিথ্যে হলে আমরা তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।”
কিছুদিনের মাঝে শিরুয়ার কাছ থেকে পত্র এলো বাযামের কাছে, সেখানে লেখা, “আমি খসরুকে হত্যা করেছি। আর তা করেছি পারস্যবাসীর স্বার্থেই। তোমার কাছে যখন আমার এ চিঠি পৌঁছাবে তখন তুমি তোমার লোকদের থেকে আমার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবে। আর ঐ ব্যক্তির কাছে যাবে, যাকে খসরু পত্র লিখেছিলেন (মুহাম্মাদ সাঃ)। এ ব্যাপারে আমার পরবর্তী নির্দেশ আসা না পর্যন্ত তাকে বিরক্ত করবে না।”
আল বিদায়া ইতিহাস গ্রন্থ অনুযায়ী, এ চিঠি পাবার পর বাযাম বলে ওঠেন, “নিশ্চয়ই ইনি আল্লাহর রাসুল।” এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইয়েমেনের পারসিক কর্মকর্তারা সবাই ইসলাম কবুল করেছিলেন। উল্লেখ্য, ৬২৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসের মতো শিরুয়া কাভাধ নাম নিয়ে রাজত্ব করেছিলেন, এরপর মারা যান প্লেগ রোগে। তার আট বছরের ছেলে এরপর রাজা হন (নাম হয় তৃতীয় আর্দাশির), যার প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগপর্যন্ত অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন স্বয়ং সম্রাট হেরাক্লিয়াস। সম্রাট হেরাক্লিয়াসকেও পত্রদান করেন নবী মুহাম্মাদ (সা), যেটি তিনি সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন।
এ তো গেলো ইতিহাসের কথাবার্তা। তবে নিজামির উপাখ্যান বিষয়ে এটুকু বলতেই হয়, ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে লিখিত এ কাব্যের যতটা না ‘ভালোবাসা’-কেন্দ্রিক, তার থেকে বেশি যেন স্বার্থ চরিতায়ন। মারিয়ামকে যেমন শিরিন সরিয়ে দেন দুনিয়া থেকে, তেমনই ফরহাদকে সরিয়ে দেন খসরু। কিন্তু দুজনের কেউ কারো হননি, অন্তত গল্পে হননি। বাস্তবে তারা ছিলেন স্বামী-স্ত্রীই। ইতিহাসের সাথে উপাখ্যানের পার্থক্যটা এখানেই। আর ফরহাদের সাথে যে অন্তত শিরিনের অমর প্রেমকাহিনীর কিছুই ছিল না, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিরি-ফরহাদের চেয়ে খসরু-শিরিনই সই!
ফিচার ইমেজ: Majeed Beenteha (YouTube)