অভিনেত্রী মেরি এমপ্রেস: যার উধাও হয়ে যাওয়া এক রহস্যই থেকে গেল

সবার সাথে সমুদ্র পাড়ি দেবেন বলে জাহাজে উঠলেন। গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছালেন সবাই, অথচ পুরো জাহাজ তন্ন তন্ন করেও খোঁজ পাওয়া গেল না তার। তিনি হারিয়ে গেলেন, রেখে গেলেন রহস্যের ছাপ। ১৯১৯ সালে এভাবেই জাহাজ থেকে হারিয়ে যান ব্রিটিশ অভিনেত্রী মেরি এম্প্রেস। একশো বছর পরও তার হারিয়ে যাওয়ার রহস্যের সমাধান হয়নি। শুরুতেই তার সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

মেরি এম্প্রেসের জন্ম ১৮৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে। বেড়ে ওঠাও সেখানেই। ১৯০০ সালের শুরু থেকে তিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রামা ও থিয়েটার অঙ্গনে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯০২ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন স্থানীয় এক ডেন্টিস্টকে। অবশ্য চার বছর পরই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। 

চলচ্চিত্র জগতে মেরি এম্প্রেসের অভিষেক ঘটে ১৯১৫ সালে, কমেডি ঘরানার মুভি ‘ওল্ড ডাচ’ এর মাধ্যমে। পরের বছর ‘বিহাইন্ড ক্লোজড ডোর’ নামে একটি নাটকে অভিনয় তাকে অভিনয় জগতে সুপরিচিত করে তোলে। সে বছরই ‘দ্য গার্ল হু ডাজ নট নো’ নামের এক মেলো ড্রামায় তিনি সর্বশেষ অভিনয় করেন। অভিনয় ছাড়াও গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী হিসেবেও পরিচিতি পান তিনি। 

মেরি এমপ্রেস © history.com
মেরি এম্প্রেস; Image Source: history.com

১৯১৯ সালে লন্ডনে ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটারে শ্যুটিং শেষে তিনি জাহাজে করে ফিরছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেই যাত্রার শেষ হয়নি আর। জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাল ঠিকই, কিন্তু পৌঁছালেন না মেরি এম্প্রেস। 

১৯১৯ সালের ২৭ অক্টোবর; দিনটি ছিল সোমবার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের কানার্ড লাইন জেটিতে নোঙর করল ‘অর্ডুনা’ নামের একটি জাহাজ। এর ১১ দিন আগে ইংল্যান্ডের লিভারপুল থেকে যাত্রা করে জাহাজটি। পথে কানাডার নোভা স্কটিয়া রাজ্যের হ্যালিফ্যাক্সে কিছু সময়ের জন্য নোঙর ফেলেছিল অর্ডুনা। 

ভিআইপি, সাধারণ যাত্রী ও অভিবাসীতে ভরা জাহাজে সবচেয়ে আলোচিত যাত্রী ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী মেরি এম্প্রেস। কিন্তু নিউ ইয়র্কে যখন জাহাজ পৌঁছাল, তখন দেখা গেল, যাত্রীদের সবাই আছেন, শুধু মেরি ছাড়া। শোরগোল পড়ে গেল চারদিকে। একবার-দুইবার নয়, তিনবার খোঁজা হলো পুরো জাহাজ। কিন্তু তার কোনো অস্তিত্বই পাওয়া গেল না। এই খবর বাইরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। এত মানুষের মাঝখানে তিনি কখন, কীভাবে উধাও হয়ে গেলেন, সেই রহস্যের সমাধানে নামলেন গোয়েন্দারা। 

সাংবাদিকরা জাহাজে থাকা অন্য যাত্রীদের কাছে জানতে চান এম্প্রেসের উধাও হওয়া সম্পর্কে, জিজ্ঞেস করা হয় জাহাজের ক্রুদেরও। কিন্তু কেউই আশানুরূপ কিছু বলতে পারেননি।  

'অর্ডুনা' নামের এই জাহাজ থেকেই উধাও হন এমপ্রেস। © Liverpool Post and Echo Archive/Mirrorpix/Getty Images
‘অর্ডুনা’ নামের এই জাহাজ থেকেই উধাও হন এমপ্রেস; Image Source: Liverpool Post and Echo Archive/Mirrorpix/Getty Images

জাহাজের এক স্টুয়ার্ডেস সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, আগেরদিন সন্ধ্যায় এম্প্রেসের কেবিনে রাতের খাবার নিয়ে যান তিনি। তারপর কেবিন পরিষ্কার করতে আবারও যান সাড়ে ছয়টায়। তাকে তখন এম্প্রেস জানান, সাড়ে নয়টায় স্যান্ডউইচ খাবেন। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময়ে কেবিনে ঢুকে এম্প্রেসকে দেখতে পাননি তিনি। ফলে স্যান্ডউইচটি রেখে তিনি বেরিয়ে আসেন। সকালে কেবিনে ঢুকে দেখেন, খাবার যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনই পড়ে আছে। বিছানাও ছিল পরিপাটি।

এমপ্রেসের উধাও হওয়ার খবর পত্রিকায়। © history.com
এম্প্রেসের উধাও হওয়ার খবর পত্রিকায়; Image Source: history.com

ইন্টারন্যাশনাল ফিচার সার্ভিসের একজন প্রতিবেদক ঘুরে আসেন মেরি এম্প্রেসের সেই কেবিন থেকে। ‘স্টেটরুম ৪৮০’ নামের সেই কেবিনে গিয়ে তিনি দেখেন, বার্থের উপরের তাকে মেরির নিজের বেশ কয়েকটি ছবি, সম্ভবত নিউ ইয়র্কে আগমনের সময় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে দেওয়ার জন্য আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল। এছাড়া নিউ ইয়র্কের একটি হোটেলে তার পাঠানো একটি টেলিগ্রাফের কপিও পাওয়া যায়। তাতে লেখা, “সোমবার আসছি। আমার জন্য একটা রুম রাখবেন।

সেই প্রতিবেদক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ইন্টারিয়র প্যাসেজওয়ের এক দরজা ছিল কেবিনে। ১৩ ইঞ্চি প্রশস্ত সেই পথ দিয়ে এম্প্রেসের মতো মানুষের পক্ষে বের হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। তাছাড়া সেই দরজা ভেতর থেকে বন্ধও করা ছিল। কিন্তু এই পথ দিয়ে যদি না গিয়ে থাকেন, তাহলে কী করে জাহাজ থেকে লাপাত্তা হলেন তিনি?

তিনি বিভিন্ন সম্ভাবনাও তলিয়ে দেখেছেন। তার মতে, মেরি এম্প্রেসকে সেই স্টুয়ার্ডেস সাড়ে ছয়টায় দেখে থাকলেও সাড়ে নয়টায় গিয়ে আর দেখতে পাননি। সন্ধ্যার এই সময়ে জাহাজের ডেকসহ সব জায়গাতেই যাত্রীদের আনাগোনা থাকেই। এম্প্রেস যদি মূল দরজা দিয়ে বের হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে থাকেন, তাহলে অনেক যাত্রী, স্টুয়ার্ট ও অফিসারদের পাশ দিয়েই যেতে হতো তাকে, সেক্ষেত্রে কারো নজরে পড়বেন না তিনি, এই চিন্তা অসম্ভবই বলতে হয়। এমন বিখ্যাত একজন অভিনেত্রী কেবিন থেকে বের হলে কারোই চোখে পড়বেন না, তা তো হতে পারে না।

তিনি যখন জাহাজ থেকে নিখোঁজ হন, তখন বেশ কয়েক ঘন্টা অবধি সমস্ত ডেক এবং বার রুমগুলো জ্বলজ্বল করেছে। তাই তিনি অন্ধকারের ফায়দা নিয়েছেন সেটাও বলা যাবে না।   

সেই স্টুয়ার্ডেসের কাছে ফিরে যাওয়া যাক। সেদিন মেরি এম্প্রেস কী পোশাক পরেছিলেন এবং তার আনুষাঙ্গিক সাজপোশাক কেমন ছিল সেই সম্পর্কে বিশদ জানাতে গিয়ে স্টুয়ার্ডেস বললেন, সমুদ্রযাত্রা চলাকালে এম্প্রেস পুরোপুরি কালো পোশাক পরেছিলেন, একটি বড় পর্দার সাথে একটি ছোট টুপিসহ। তিনি অবশ্য প্রথমে এম্প্রেসকে চিনতে পারেননি। ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো যুদ্ধে স্বামীহারা কোনো স্ত্রী হতে পারেন। 

নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সহযাত্রীরাও এমপ্রেসকে কালো পোশাকেই দেখেছেন। তারা আরও বলেন, তারা প্রায়শই তাকে একরঙা কাপড়ে দেখতেন। এক যাত্রীর বরাত দিয়ে পত্রিকাটি বলছে, এম্প্রেস হাস্যরস পছন্দ করতেন, তাকে গম্ভীর মনে হয়নি। 

অন্য যাত্রীরাও এই অভিনেত্রীর আপাত ভাল মেজাজের বিষয়েই মন্তব্য করেন। কানাডিয়ান সংবাদমাধ্যম গ্লোব অ্যান্ড মেইল যাত্রীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, এম্প্রেস প্রাণবন্ত মেজাজেই জাহাজে উঠেছিলেন এবং তার আমেরিকান বন্ধুদের মধ্যে দেখা করার আরও একটি মৌসুম পাওয়ায় উৎসাহের সাথেই অপেক্ষা করেছিলেন।

কিন্তু কী এমন হলো মেরি এম্প্রেসের সাথে? হুট করে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কোথাও উধাও হয়ে যান তিনি?

Behind Closed Door সিনেমায় এম্প্রেস; Image Source: imdb

 

পত্রিকাগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই এম্প্রেসের ব্যাপারে ভিন্ন ধারণা পোষণ করে সেটি নিয়েই লিখতে শুরু করে। তাকে প্রতারক হিসেবেও আখ্যা দেয় কিছু পত্রিকা। তারা বলছিল, তিনি আগেও প্রচারণা পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করতেন। তার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াও সম্ভবত সেই পাবলিসিটি স্ট্যান্টের অংশ। একটি পত্রিকা সে সময় ভবিষ্যদ্বাণীও করে ফেলেছিল যে, তিনি হয়তো শীঘ্রই নিউ ইয়র্কের একটি প্রেক্ষাগৃহে এসে উপস্থিত হবেন। তার মাথার চারপাশে সামুদ্রিক শৈবাল থাকবে এবং নতুন ধরনের পোশাক বা অঙ্গসজ্জায় তিনি জনগণের প্রশংসাও কুড়োবেন। 

বেশ কিছু নাবিকের বরাত দিয়ে থিয়েটারভিত্তিক মাসিক পত্রিকা নিউইয়র্ক ক্লিপ জানিয়েছিল, মেরি এম্প্রেস উপরের ডেকের নাবিকদের ইউনিফর্ম রুম সম্পর্কে জানতেন। জাহাজ নিউ ইয়র্ক পৌঁছার আগের রাতে তিনি সম্ভবত সেখানেই চলে যান। পরে নাবিকদের ইউনিফর্ম পরেই সম্ভবত বেরিয়ে যান জাহাজ থেকে। 

জাহাজের এক পেটি অফিসার তো আরও একধাপ এগিয়েছিলেন তার নিজের তত্ত্ব নিয়ে। এক সাংবাদিককে তিনি জানান, মেরি এম্প্রেস হয়তো পুরুষদের পোশাক পরে থাকতে পারেন এবং লুকিয়ে ছিলেন সেভাবেই। তার জিনিসপত্রগুলোতে পুরুষদের পোশাক ছিল। হতে পারে তিনি নারী হয়ে বেঁচে থাকা জীবনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য একজন পুরুষ হওয়া যাক। মেরি এম্প্রেসকে ঘিরে নিখোঁজের পরের কয়েকদিন এভাবেই নানা তত্ত্ব, আলোচনা আর সম্ভাবনার কথা সর্বত্র প্রচারিত ছিল।

মেরি এমপ্রেসের সাথে থাকা ট্রাঙ্কটি নিউ ইয়র্কে একমাস পড়ে ছিল। কেউ সেটির দাবি না করায় পরবর্তীতে ট্রাঙ্কটি লিভারপুলে ফিরিয়ে আনা হয়।  

সময়ের সাথে ধীরে ধীরে মেরি এম্প্রেস নিজেও উধাও হয়ে যাওয়ার মতোই উধাও হয়ে যেতে থাকেন আলোচনার টেবিল থেকে। ব্রিটিশ সরকারও এই সংক্রান্ত মামলা বন্ধ করে দেয়। বিদেশে মারা যাওয়া নাগরিকদের সরকারি রেজিস্ট্রিতে তার মৃত্যুর কারণকে ‘ওভারবোর্ডে লাফিয়ে ডুবে যাওয়া‘ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেপ কোড থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরের আটলান্টিকের এক জায়গা এই অভিনেত্রীর মৃত্যুস্থল বলে উল্লেখ করা হয়। এটি একটি পরিপাটি উপসংহার, অনুমান ব্যতীত আর কিছুই নয়। কিন্তু তার উধাও হবার রহস্য রহস্যই থেকে গেল। 

২০১৯ সালে মেরি এম্প্রেস উধাও হওয়ার শততম বর্ষ অতিবাহিত হলো। এই সময়ের মধ্যে তাকে প্রায় ভুলেই গেছে পুরো বিশ্ব। তিনি হারিয়ে গেছেন রহস্য রেখে, তার অভিনয় করা চলচ্চিত্র-নাটকগুলোও হারিয়ে গেছে সময়ের অতল গহ্বরে। তিনি গান গেয়েছিলেন অনেক, তবে সেগুলো কখনও রেকর্ড করা হয়নি। তাই তার গানের অস্তিত্বও আর পাওয়া যায় না। তিনি শুধু বেঁচে আছেন কিছু স্থির ছবি আর পত্রিকার কাটিংয়ের মাঝেই। এসবও হয়তো হারিয়ে যাবে এক সময়। কিন্তু তার সাথে ঠিক কী হয়েছিল তা হয়তো জানা যাবে না কখনোই। 

Related Articles

Exit mobile version