‘আর্য’ শব্দটির পেছনে রয়েছে বিপুল বিতর্কিত ইতিহাস। এই শব্দটির মূল উৎপত্তি সংস্কৃত ভাষা থেকে। অর্থ ‘নোবেল’ বা ‘উচ্চ বংশজাত’। প্রাচীন ভারতবর্ষকে আক্রমণকারী এই আর্য জাতির মানুষেরা অনেক উচ্চ বংশের অংশ ছিল বলে দাবি করা হয়। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন কীভাবে হলো, কখন ও কেন হলো তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের কোনো শেষ নেই। এর মধ্যে আরেকটা ঝামেলা বাঁধিয়ে গিয়েছেন তৎকালীন নাৎসি প্রধান এবং জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার।
হিটলারের নাৎসি পার্টি ‘আর্য’ শব্দটিকে জার্মান শব্দ ‘এহরে’ এর অর্থের সমতুল্য ধরতেন, যার মানে সম্মান। এর সুবাদে ‘আর্য’ শব্দটির অর্থ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। জাতিগত বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী হিটলার আর্যকে ‘বিশুদ্ধ জার্মান জাতি’ হিসেবে ঘোষণা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কেননা তার মতে, বিশ্বে আর্য জাতির মানুষদের রক্তই সবচেয়ে বেশি পবিত্র। আর জার্মান জাতি আর্যদের মতোই বিশুদ্ধ রক্তের বলে হিটলার মনে করতেন। অনার্য জাতি তার কাছে নিতান্তই হেয় করার পাত্র ছিল। এমনকি বাকি সব বর্ণ ও জাতি তার নিকট অপবিত্র এবং শয়তানের থেকেও অধিক নিকৃষ্ট ছিল।
অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন বর্ণ, জাতি তথা জাতিগত বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। তিনি তার বক্তৃতা ও লেখায় একটি জাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং জার্মান জাতির উৎকৃষ্টতার কথা উল্লেখ করেন। জার্মান জাতিকে তিনি আর্য জাতির পরবর্তী বংশধর এবং বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাতি হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, জার্মানরা যদি এই বিশ্বকে জয় করতে চায় তবে একে অবশ্যই জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। হিটলারের আর্যদের সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাদের আদি আবাসস্থল কোথায় ছিল কিংবা তাদের পূর্বপুরুষদের পরিচয়ের রহস্য উন্মোচনের জন্য হিটলার বেশ ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তিনি এ সম্পর্কে নিজের কিছু যুক্তিও যথাসম্ভব উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। তবে তা আসলেই সত্য নাকি সেই বিষয়ে ঐতিহাসসিকদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ গুসতাফ কোসিনার সব যুগোপযোগী যুক্তিকে ঘুরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, আর্যরা ইন্দো-ইউরোপিয়ানদের মধ্যে প্রধান জাতি ছিলেন।
হিটলারের মতে, আর্যরা লম্বা, ফর্সা এবং নীল চোখের অধিকারী ছিলেন। তিনি দাবি করেন, আর্যরা নর্ডিক হলেও তারা মূলত জার্মানির অধিবাসীই ছিলেন। উল্লেখ্য, নর্ডিক বলতে মূলত নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের অধিবাসীদের বোঝানো হয়। অবশ্য মাঝে মাঝে জার্মানির কিছু অংশও নর্ডিকের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। এসকল নর্ডিক আক্রমণকারী দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের থেকে আচার-আচরণ, অভ্যাস, শারীরিক গঠনের দিক থেকে একদম বিপরীত ছিলেন। তৎকালীন দক্ষিণ এশিয়ার মূল জাতি ছিল দ্রাবিড়রা, যারা কৃষ্ণ বর্ণের ছিলেন। তারা শারীরিকভাবে বেশ সবল ছিলেন।
হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনী যখন ক্ষমতায় আসে তখন তারা আর্য জাতি বিষয়ক এসকল ভাবাদর্শ সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। এই চিন্তাধারা ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্যও করেনি তৎকালীন সরকার। পোস্টার, রেডিও, সিনেমা, খবরের কাগজ, শ্রেণীকক্ষ তথা সবধরনের সামাজিক ও যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রচার ঘটানো হয়। নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা এসব মতবাদ সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য জার্মান বিজ্ঞানীদের সাহায্য নেন। সেই সময় জার্মান কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন, মানবজাতিকে আরও উন্নত করার একমাত্র পন্থা হলো ‘নিম্নজাতি’র বৃদ্ধি কমিয়ে দেওয়া।
১৯৩৩ সালে মানবজাতি উন্নত করার নামে এসব জার্মান চিকিৎসক তথাকথিত নিম্নজাতিদের শারীরিকভাবে অক্ষম করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করা শুরু করেন। এই মিশনের মূল ভুক্তভোগীরা ছিল ইহুদি। তাছাড়া জার্মানির ৩০,০০০ জনের ছোট একটি জাতি রোমার জনগণকেও হিটলারের নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। এমনকি প্রায় ৫০০ আফ্রিকান-জার্মান সন্তানও রেহাই পায়নি নাৎসি পার্টির অমানবিক অত্যাচার থেকে।
নাৎসি বাহিনীর শাসনামলে হিটলারের নির্দেশে জার্মানির বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। যেমন- মাথার খুলির আকার, নাকের আকার, চোখের ও চুলের রঙ পরীক্ষা করতেন। আর এসকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাদের মধ্যে যারা আর্য জাতির বংশধর তাদেরকে খুঁজে বের করা। ইহুদি এবং রোমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথাকথিত আর্যদের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেত না বলে তাদের বিভিন্ন বৈষম্য, অপমান ও অত্যাচারের স্বীকার হতে হতো। যে আর্য জাতি নিয়ে হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীর এত চিন্তা ও গবেষণা ছিল তাদের আগমন ভারতবর্ষে কখন ও কীভাবে তা সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু জেনে নেওয়া যাক।
ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন
ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের আগেই এখানে একটি উন্নত সভ্যতা ছিল। এই প্রাচীন সভ্যতার নাম সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু নদের তীরবর্তী পাকিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের উর্বর জমিতে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রমাণ অনুসারে এসব সভ্যতার উৎপত্তি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০০ অব্দে। ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বে তারা ভারতবর্ষে কৃষিকাজ করা শুরু করে ও ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে প্রথমবারের মতো এই সভ্যতা আধুনিক হতে শুরু করে।
খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালের মধ্যে এই সভ্যতায় বড় বড় শহরও প্রতিষ্ঠিত হয়। আর খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ এবং ২০০০ এর মাঝামাঝিতে সিন্ধু সভ্যতা উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে যায়। সিন্ধু সভ্যতার যেসব নজির পাওয়া যায় তাতে একে সুমেরীয় সভ্যতার সমতুল্য মনে করা হয়। তাছাড়া এর সমকালীন ব্যবিলনীয় ও মিশরীয় সভ্যতার তুলনায় সিন্ধু সভ্যতা উন্নত ছিল। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। মধ্য এশিয়া দিয়ে ঢুকে হিন্দুকুশ পার করে তারা সিন্ধু সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। এটি ইতিহাসের অন্যতম বিশাল অভিপ্রয়াণ ছিল।
আর্যদের এই দেশান্তরকে অনেকেই আক্রমণ বলে মনে করেন। আর্যদের আগমনকে হিটলারের মতো কিছু ইতিহাসবিদ সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ হিসেবে দেখেন। তবে এর আসল কারণ কী তা নিয়ে এখনও তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালের একটি রিপোর্টে আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড অ্যালেন হার্ভে আর্য পুরাণের বৃদ্ধি এবং উন্নতির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। হার্ভের গবেষণা এবং বিবরণী মূলত ১৮ শতকের ফরাসি বহুবিদ্যাজ্ঞ জিন-সিলভেন বেইলি (১৭৩৬-১৭৯৩) এর বিশদ গবেষণাকে বিশ্লেষণ করে লেখা।
১৯ শতকের দিকে প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতা সম্পর্কে জানার জন্য অনেক ইউরোপিয় পর্যটক, গবেষক এবং ধর্মপ্রচারক সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় পুরনো ইতিহাস পর্যালোচনা করে অতীতকে জানার প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করেন। যে দেশটি সবার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং রহস্যে ঘেরা মনে হয় তা হলো তৎকালীন ভারতবর্ষ (মূলত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান)। এ বিষয়ে ফ্রান্সের ধর্মপ্রচারক আবে ডুবোইস পুরনো বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পড়ে তা অনুবাদ ও সংক্ষেপণ করেন। অনুবাদ করা বইটি খুব ভালো না হলেও ভারতের বিশাল ইতিহাসের কিছু অংশ ভালো করেই জানা যায়। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তত্ত্বাবধানে আবার বইটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।
হিটলার বিশ্বাস করতেন, আর্যরাই ভারতবর্ষে আক্রমণ করে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। পূর্বে এবং বর্তমানেও এমন কিছু ইতিহাসবিদ রয়েছেন যারা এই যুক্তিতেই বিশ্বাসী। এসব তর্ক-বিতর্কের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, বেদ পাণ্ডুলিপিতে আর্য জাতির আক্রমণের বিষয়ে কিছু লেখা নেই। আর সংস্কৃত শব্দ ‘আর্য’ এর অর্থ কোনো উৎকৃষ্ট সাংস্কৃতিক জাতি নয় বরং উন্নত চরিত্র বা উচ্চ বংশজাত। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিককালে পাওয়া কিছু প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন দেখে মনে করা হচ্ছে যে, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ প্রচণ্ড খরা ও বন্যা।
ভয়াবহ আক্রমণের কোনো নজির মেলেনি ইতিহাসের পাতায়। বর্তমানের প্রত্নতাত্ত্বিক পাণ্ডুলিপি আবার প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার মানুষজন সরস্বতী নদীর তীরেই মূলত বাস করতেন। তাছাড়া এত বড় সভ্যতার উপর যদি আর্য সভ্যতা আসলেই আক্রমণ করে থাকতো তাহলে এর জীবতত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অবশ্যই পাওয়া যেতো। অন্যদিকে, আর্যদের দৈহিক গঠনের ক্ষেত্রে নাৎসি বাহিনী ও হিটলারের ধারণা সঠিক বলেই অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন।
এসব সমস্যার কারণেই আর্যদের নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এখনও কোনো উপসংহার ঘটেনি। আবার দেখা যায়, যে প্রতিষ্ঠান বা দেশ কোনো প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে কাজ করে বা এসব কাজের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, তারা এসব ইতিহাস নিজেদের স্বার্থে বা পছন্দমতো অনেক সময় ব্যবহার করেন। বর্ণবাদ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বাধা হয়ে দাঁড়ায় এক্ষেত্রে। আর্য জাতির ইতিহাসের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা মতবাদের পেছনে এরকম সমস্যাই দেখা যায়।