জীবনটা বেশ ছোট। মাঝে মাঝেই মনে হয়, এই তো সেদিন ছোট ছিলাম, আজ তরুণ বয়সে এসে দাঁড়িয়েছি। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আর কিছুদিন পরেই মাঝবয়সে গিয়ে দাঁড়াবো। এরপর শেষ বয়স থেকে ফুট্টুশ! যেন চোখের পলকেই ঘটে গেলো সবকিছু। এজন্য মানুষ সবসময়ই চেয়েছে অমর হতে। সৃজনশীল মানুষেরা তাদের সৃজনশীল কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের ভালোবাসায় অমর হয়ে আছেন। ইতিহাসের খলনায়কেরা তাদের হীন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের ঘৃণার মাঝে অমর হয়ে আছে।
তবে কিছু কিছু মানুষ ছিলেন যারা আসলে কাজকর্মের মধ্য দিয়ে অমর হওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা একেবারে দৈহিকভাবেই অমর হতে চাইতেন। অর্থাৎ তাদের স্বপ্ন ছিলো শত শত বছর বেঁচে থাকা, পৃথিবী ধ্বংসের আগপর্যন্ত পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা। এমন অমরত্ব সন্ধানী মানুষেরা তাই অমর হতে গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন উদ্ভট বিভিন্ন পদ্ধতি।
অমর হতে চাওয়া মানুষদের তেমনি কিছু উদ্ভট পন্থা নিয়েই তাই আলোচনা করছি আজ।
অমরত্বের মাশরুম
অমরত্বের সন্ধানে মাশরুমের দ্বারস্থ হবার ব্যাপারে চীনারা অনেক গবেষণা করেছে। তাদের অ্যালকেমিস্টরা শত শত বছর কাটিয়ে দিয়েছে এর পেছনে। তাদের সম্রাটগণ ছিলেন এ সংক্রান্ত গবেষণার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। বিষাক্ত পারদ, স্বর্ণ, সালফার, বিভিন্ন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে তারা। চীনাদের দেশীয় ঔষধ এবং শত বছরের পুরনো অ্যালকেমির মাঝে বেশ ভালোই যোগসূত্র আছে। এজন্য আয়ু বর্ধক হিসেবে বিভিন্ন গাছ, ছত্রাক ও খনিজ পদার্থ তারা আজও ব্যবহার করে থাকে।
৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বিভিন্ন কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায় যে, তখন থেকেই তারা অমরত্ব লাভের জন্য মাশরুম ব্যবহার করতো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাশরুমটির নাম ছিলো ‘লিংঝি’, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘অতিপ্রাকৃত মাশরুম’। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে এটিই সবচেয়ে পুরনো মাশরুম যা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত চীনে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একদল লোক ছিলেন যাদের বলা হতো ফাংশি। তাদের মাঝে আলকেমিস্ট, জ্যোতিষী, চিকিৎসক, জাদুকর, বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষই ছিলেন। অনেকেই বিশ্বাস করতো যে, পেংলাই পর্বতের কোন জায়গায় লিংঝি মাশরুম পাওয়া যায় তা জানতেন সেই ফাংশিরা। মজার ব্যাপার হলো, এই পেংলাই পর্বতও আসলে এক প্রাচীন কিংবদন্তী যার সন্ধান মেলে কেবল প্রাচীন চীনা রুপকথাগুলোতেই। হান ও কিন রাজবংশের অনেক সম্রাটই লিংঝির খোঁজে অনেক অর্থ ব্যয় করে অভিযান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছিলো।
অমৃত, অ্যাম্ব্রোসিয়া, সোমা ও নেক্টার
ঋগ্বেদের ভাষ্যমতে, অমৃত এমন একটি পানীয় যা খেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে সক্ষম। সনাতন ধর্মসহ অন্যান্য আরো সংস্কৃতিতে একে ‘সোমা’ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র এবং অনলের দেবতা অগ্নিও অমৃত পান করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। এরপর তারা বলেছিলেন- “We have drunk Soma and become immortal; we have attained the light, the Gods discovered. Now what may foeman’s malice do to harm us? What, O Immortal, mortal man’s deception?” (Rigveda 8.48.3)
সনাতন, জোরোয়াস্ট্রিয়ান এবং ইন্দো-ইউরোপীয় বিভিন্ন লিপিতে অমৃত ও সোমার কথা উল্লেখ আছে। গ্রীক দেবতারা অমরত্ব লাভের জন্য অমৃতের মতো বেছে নিয়েছিলেন অ্যাম্ব্রোসিয়াকে। দুটোই একই ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ‘ন-মৃ-ত’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘মৃত্যু নয়’। একইভাবে গ্রীক দেবতারা বেছে নিয়েছিলেন ‘নেক্টার (Néktar)’ নামে আরেকটি পানীয়কেও যার অর্থ মৃত্যুকে (Nek) জয় করা (Tar)। যোগব্যায়াম করা লোকেদের এক বিশ্বাস থেকে জানা যায় যে, গভীর ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে অমৃতের নিঃসরণ ঘটতে পারে।
যে অমৃত নিয়ে এত কথাবার্তা, সেটা দেখতে কেমন? এর প্রাপ্তিস্থানই বা কোথায়? অনেকের মতেই এটি একটি গাছ, কারো কারো মতে ছত্রাক। প্রথমে এটিকে চূর্ণ করে ভর্তা করা হয় কিংবা এর নির্যাসটুকু বের করা হয়। এরপর গরুর দুধের সাথে মিশিয়ে পান করে নেয়া হয় মিশ্রণটিকে। এমনটাই ভাবা হয় অমৃত সম্পর্কে। লিংঝির মতো এটিও কোনো পর্বতে জন্মায় বলে ধারণা বিশ্বাসীদের। তবে ঠিক কোন পর্বতে এটি পাওয়া যাবে আর এর সঠিক আকারই বা কেমন তা নিয়ে বিস্তারিত এবং নির্ভরযোগ্য কিছুই জানা যায় না।
বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও ওঝারা সবসময়ই এ অমৃত গাছের সন্ধান করে গিয়েছেন। তাদের অনেকের মতেই, এটি হতে পারে সাইবেরিয়ার ওঝাদের ব্যবহৃত Fly Agaric (Amanita Muscaria) নামক একটি হালকা হ্যালুসিনোজেনিক অর্থাৎ বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী মাশরুম। এন্থোবোটানিস্ট টেরেন্স ম্যাককেনার মতে, এই অমৃত হতে পারে Psilocybe Cubensis নামের একটি হ্যালুসিনোজেনিক মাশরুম যা গরুর গোবরে জন্মে থাকে। তার মতো কেউ কেউ মনে করেন যে, এই মাশরুমটিই সনাতন ধর্মে গরুর এত উচ্চ মর্যাদার জন্য দায়ী।
অনেকে আবার মনে করেন অমৃত তৈরির জন্য দরকারি গাছটি Ephedra গণের অন্তর্ভুক্ত। ইরানের জোরোয়াস্ট্রিয়ান কমিউনিটি, চীনের দেশীয় ঔষধ এবং আধুনিক নানা ঔষধে এ গণের গাছ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ গণের গাছগুলোর মাঝে আছে Ephedrine ও Pseudoephedrine নামক রাসায়নিক পদার্থ যা অনেকটা মেটাঅ্যাম্ফিটামিনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। রক্তচাপ কমানো, ক্ষুধা নিবারণ ও উত্তেজক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এগুলো।
ধাতু ও খনিজ পদার্থ
সুদীর্ঘ জীবন লাভের জন্য তরল ধাতু পানের মতো বিচিত্র প্রথা চীন থেকে শুরু করে মেসোপটেমিয়া হয়ে একেবারে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। এর পেছনে তাদের যুক্তিও ছিলো বেশ অদ্ভুত। তৎকালে বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো যে, আপনি যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন, সেটির বৈশিষ্ট্য আপনার শরীরের মাঝেও প্রতিফলিত হবে। যেহেতু ধাতব পদার্থগুলো সাধারণত বেশ শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে, তাই লোকে মনে করতো এর তরল রুপটি গলাধঃকরণ করলে বুঝি ধাতুর মতোই দীর্ঘস্থায়ী হবে তাদের নশ্বর শরীরটি। অর্থাৎ নশ্বর দেহকে অবিশ্বর করতেই তারা বেছে নিয়েছিলো বিভিন্ন ধাতুর তরলীকৃত রুপকে।
সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় পারদ তরল বলে এককালে তা অনেক অ্যালকেমিস্টকেই মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। ফলে অমরত্ব লাভের জন্য অনেকে টার্গেট করা শুরু করেছিলো বিষাক্ত এ ধাতব পদার্থটিকেই। পারদ নিয়ে অত্যাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষার দরুন মারা গিয়েছিলো অনেকেই। এ প্রচেষ্টা থেকে বাদ পড়ে নি সোনাও। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় অনেক অ্যালকেমিস্টও সোনাকে গলিয়ে পানযোগ্য তরলে রুপান্তরিত করতে চেষ্টা করছিলেন। পাশাপাশি সোনা ও পারদ মিশিয়ে একটি ককটেল ড্রিঙ্ক তৈরির কাজও তারা করছিলেন!
সোনা ও পারদের পাশাপাশি আর্সেনিকও এককালে অ্যালকেমিস্টদের মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। প্রাচীন চীনের সম্রাটগণ এই অমরত্বের আকাঙ্ক্ষায় প্রায়ই হাবিজাবি বিভিন্ন জিনিস খেতেন বা পান করতেন। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জোসেফ নীডহাম সম্রাটদের এমনই একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন যারা কিনা অমরত্বের সুধার সন্ধানেই জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। জেড, সিনাবার, হেমাটাইট এবং অন্যান্য এমন আরো দীর্ঘস্থায়ী খনিজ ব্যবহৃত হতো অমরত্বের সুধা বানানোর ঔষধগুলোতে।
পরশ পাথর ও অমরত্বের সুধা
মধ্যযুগে সকল অ্যালকেমিস্টের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিলো ফিলোসফার’স স্টোন তথা পরশ পাথর তৈরি করা। আর তাদের এ প্রচেষ্টা পরিচিত ছিলো ‘ম্যাগনাম ওপাস’ বা ‘গ্রেট ওয়ার্ক’ নামে। পরশ পাথরের সাহায্যে কম দামি ধাতুগুলোকে স্বর্ণ-রৌপ্যের মতো মূল্যবান ধাতুতে পরিবর্তন করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন তারা। এর সাহায্যে অমরত্ব লাভ করাও সম্ভব বলে বিশ্বাস ছিলো তাদের। কিংবদন্তী আছে যে, যার কাছে পরশ পাথর থাকবে, মৃত্যু নাকি তাকে কোনোদিনও ছুঁতে পারবে না! কারো কারো মতে, পরশ পাথরের সাহায্যেই বানানো সম্ভব বহুল প্রচলিত সেই Elixir of Life তথা অমরত্বের সুধা।
এই পরশ পাথরের থিওরির উদ্ভব ঘটেছিলো ৪টি মৌলিক পদার্থ বিষয়ক গ্রীক তত্ত্ব থেকে। প্লেটোর Timaeus অনুসারে মাটি, পানি, বাতাস ও আগুনের উৎপত্তি হয়েছিলো প্রাইমা ম্যাটারিয়া (Prima Materia) তথা প্রথম পদার্থ থেকে। এই প্রাইমা ম্যাটারিয়াকেই ধারণা করা হতো সকল কিছুর উৎসমূল হিসেবে। অ্যালকেমিস্টেরা মনে করতেন যে, এই প্রাইমা ম্যাটারিয়া দিয়েই বানানো সম্ভব পরশ পাথর। তাই বিভিন্ন পদার্থের সংমিশ্রণে তারা এটি বানানোর মহোৎসবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, সন্ধান করছিলেন অমরত্বের।
অষ্টম শতকের অ্যালকেমিস্ট জাবির ইবন হাইয়ান আবার এ চারটি মৌলিক পদার্থকে উষ্ণতা, শীতলতা, শুষ্কতা ও আর্দ্রতা- এ চারটি গুণাবলীর দিক থেকেও পৃথক করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, কোনো পদার্থের মৌলিক গুণাবলী পরিবর্তনের মাধ্যমে সেটিকে অন্য কোনো নতুন পদার্থে রুপান্তরিত করা সম্ভব। তবে এজন্য দরকার কোনো প্রভাবকের। কেবলমাত্র তত্ত্বের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকা সেই প্রভাবকের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘আল-ইক্সির’। কালক্রমে পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে গিয়ে এই আল-ইক্সিরই হয়ে ওঠে এলিক্সির (Elixir) তথা অমরত্বের সুধা।
পরশ পাথর তৈরি করতে কেউ কেউ সক্ষম হয়েছেন বলেও প্রচলিত আছে কিংবদন্তী। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীর পলিম্যাথ অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস একটি পরশ পাথর থমাস অ্যাকুইনাসকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার নানা নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি নিজেই নাকি সীসাকে পরশ পাথরের সাহায্যে স্বর্ণে রুপান্তরিত হতে দেখেছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, আঠারো শতকের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কোঁত দ্য সেইন্ট জার্মেইনের কাছে একটি পরশ পাথর ছিলো। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, তখন তার বয়স ছিলো কয়েকশ বছর! অবশ্য অনেকে মনে করে এ বিষয়টি গুজব হিসেবে তার নিজেরই ছড়ানো।
পরশ পাথর নিয়ে আরেকটি বিখ্যাত রহস্য প্রচলিত আছে ফরাসী বই বিক্রেতা নিকোলাস ফ্ল্যামেলকে (১৩৩০-১৪১৮) নিয়ে। তার মৃত্যুর প্রায় দু’শ বছর পর কিছু কাগজপত্র উদ্ধার হয় যা থেকে জানা যায় যে, স্পেনে ভ্রমণকালে তিনি ইহুদী অ্যালকেমিস্টদের কাছ থেকে অ্যালকেমির গোপন বিভিন্ন জিনিস শিখেছিলেন। এর মাঝে অমরত্বের সুধা কিভাবে বানাতে হয় এবং এক পদার্থকে ভিন্ন পদার্থে রুপান্তরের বিষয়টিও ছিলো। অবশ্য অনেকেই বলে থাকেন যে, সতের শতকের বিভিন্ন পুস্তক বিক্রেতা তাদের বইয়ের কাটতি বাড়াতেই ফ্ল্যামেলকে নিয়ে এমন গল্প বানিয়েছিলেন।
ফিচার ইমেজ: anekashu.deviantart.com