বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণের অজানা কাহিনী

ইন্টারনেটে কোনোকিছু খুঁজতে গেলে প্রথমেই মাথায় আসে গুগলের নাম, কোনো ছবি এডিট করতে গেলে সবাই বলবে অ্যাডোবি ফটোশপের কথা, আবার জুতার দামি ব্র্যান্ডের কথা বললে নাইকি, রিবক, অ্যাডিডাসের কথা চলে আসবে অবধারিতভাবেই। কিন্তু কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জাগে নি কোম্পানিগুলো এমন নাম ঠিক করলো কীভাবে?

জিজ্ঞাসা করলে দেখা যাবে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বখ্যাত এসব ব্র্যান্ডকে চিনলেও সেগুলোর নামকরণের পেছনের কারণটি জানেন না। সেটা তাদের কোনো কাজে লাগবে না বলেই হয়তো তারা জানার চেষ্টা করেন নি। সেই কারণগুলো জানলে আপনার জ্ঞান কতটুকু বাড়বে তা বলা না গেলেও নির্মল বিনোদন যে আপনি পেতে যাচ্ছেন সে কথা হলফ করেই বলা সম্ভব!

১. IKEA

১৯৪৩ সালে সুইডেনে যাত্রা শুরু করা মাল্টিন্যাশনাল গ্রুপ IKEA মূলত বিভিন্ন রেডি-টু-অ্যাসেম্বল ফার্নিচার এবং গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত নানা যন্ত্রপাতি ডিজাইন ও বিক্রি করে থাকে। ২০১৬ সালের হিসেবে কোম্পানিটির কর্মী সংখ্যা ছিলো ১,৮৩,০০০।

Source: pittsburghearthday.org

IKEA প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইংভার ক্যাম্প্রাড (Ingvar Kamprad)। নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম খুঁজতে গিয়ে নিজের নাম থেকে তিনি নেন I ও K। E ও A এসেছে যথাক্রমে Elmtaryd ও Agunnaryd থেকে। এই খামার ও গ্রামেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন।

২. Canon

ক্যামেরা, ক্যামকর্ডার, ফটোকপি মেশিন ইত্যাদি নানা ধরনের ইমেজিং ও অপ্টিক্যাল প্রোডাক্ট তৈরির জন্য ক্যাননের সাথে আমাদের পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই। ১৯৩৭ সালের আগস্ট মাসে যাত্রা শুরু করে জাপানের এ মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন।

Source: Wikimedia Commons

মজার ব্যাপার হলো, শুরুতে কিন্তু ক্যানন যাত্রা শুরু করেছিলো ‘কোয়ানন (Kwanon)’ নামে। জাপানের উপকথা অনুযায়ী কোয়ানন হলো দয়ার দেবী। সেটা ১৯৩৪ সালের দিককার কথা। একসময় কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা মনে করলেন, বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে তুলে ধরতে হলে আরো স্টাইলিশ কোনো নামের দরকার। সেখান থেকেই আসে মূলত ‘ক্যানন’ নামটির ধারণা।

৩. Lego

আমাদের অনেকের শৈশবটা রঙিন হয়ে আছে লেগো দিয়ে নানাবিধ খেলাধুলার জন্য। হাতি, রবোকপ, বিল্ডিং, ব্রিজ ইত্যাদি নানা ধরনের জিনিসই আমরা বানাতাম রঙ-বেরঙের সেই খেলনাগুলো দিয়ে।

Source: youtube.com

১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে ড্যানিশ এ কোম্পানির পথ চলা শুরু হয়। তাদের এ নামটি এসেছে একজোড়া ড্যানিশ শব্দ ‘Leg got’-কে একীভূত করেই, যার অর্থ ‘ভালোমতো খেলা’।

৪. Sony

ক্যাননের মতো সনিও জাপানের আরেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। ইলেকট্রনিক্স, গেমিং, এন্টারটেইনমেন্ট, ফিনান্সিয়াল সার্ভিস- সবদিকেই ছড়িয়ে আছে তারা।

Source: Wikimedia Commons

কোম্পানিটি তাদের নাম বেছে নিয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘সোনাস (শব্দ)’ এবং ইংরেজি ‘সনি বয় (স্মার্ট ও নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারা যুবক)’ থেকে।

৫. Virgin

ভার্জিন গ্রুপ লিমিটেডের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। ২০১৬ সালে মাল্টিন্যাশনাল এ কর্পোরেশনটির মোট রেভিনিউ ছিলো ১৯.৫ বিলিয়ন পাউন্ড। অনেকেই বলে থাকেন, এমন বিচিত্র নাম তারা কেন নিলো?

Source: virgin.com

ভার্জিন গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতাদ্বয়ের একজন হলেন স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তার কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। অনেকেই তার নানা কথাবার্তা-কাজকর্মে অনুপ্রাণিতও হয়ে থাকেন। যখন ভার্জিন গ্রুপ চালু হতে যাচ্ছে, যখন পর্যন্ত এ গ্রুপটির কোনো নামই ছিলো না, তখন ব্র্যানসনের একজন সহকর্মী তাকে এ নামটি প্রস্তাব করেছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্যে আমরা একেবারেই ভার্জিন!

এমন পরামর্শ মনে ধরে যায় ব্র্যানসনের। তাই আজ বিশ্ব একে চেনে ভার্জিন গ্রুপ লিমিটেড হিসেবেই।

৬. Google

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেট যখন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তখন এই ইন্টারনেটের রাজ্যে বিচরণের এক অদ্বিতীয় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে সার্চ ইঞ্জিন গুগল। মানুষ যে ঠিক কোন জিনিসটা গুগলে গিয়ে সার্চ করে না সেটা আসলেই বলা দায়।

Source: The Verge

গুগল তার নামটি নিয়েছে ম্যাথমেটিক্যাল টার্ম ‘Googol’ থেকে। Googol দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ১ এর পর ১০০টি শূন্যকে বসালে আমরা যে সংখ্যা পাবো, সেটাকে বোঝায়। ১৯২০ সালে নয় বছর বয়সী মিল্টন সিরোটা সর্বপ্রথম এত বড় একটি সংখ্যাকে বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহার করেছিলো।

৭. Yahoo

Source: fontsinuse.com

১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে জেরি ইয়াং ও ডেভিড ফাইলোর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে একটি ওয়েবসাইট, যার নাম ‘Jerry and David’s Guide to the World Wide Web’। এটি ছিলো বিভিন্ন ওয়েবসাইটের একটি ডিরেক্টরি যেখানে ওয়েবসাইটগুলো ক্রমাধিকারে (Hierarchy) সাজানো ছিলো। পরবর্তীতে একই বছরের এপ্রিলে তারা এর নাম পাল্টে রাখেন ‘Yahoo’, যা ছিলো ‘Yet Another Hierarchical Officious Oracle’ এর আদ্যক্ষরগুলো দিয়ে গঠিত শব্দ।

৮. BlackBerry

Source: Wikimedia Commons

কানাডিয়ান কোম্পানি ব্ল্যাকবেরি লিমিটেডের স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ব্ল্যাকবেরির নাম আমরা কম-বেশি অনেকেই শুনেছি। আজ থেকে ১৮ বছর আগে ১৯৯৯ সালে তাদের হ্যান্ডসেট প্রথম বাজারে আসে। এর নাম কেন কালোজামের মতো একটি ফলের নামে দেয়া হলো এর পেছনের ব্যাখ্যাটা অদ্ভুত। বলা হয়ে থাকে, ফোনগুলোর কী-প্যাড অনেকটা কালোজামের থোকা থোকা ফলের মতোই দেখাচ্ছিলো। এজন্যই অমন অদ্ভুত নাম বেছে নেয়া!

৯. Reebok

Source: underconsideration.com

অ্যাথলেটিক ফুটওয়্যার ও অ্যাপারেল কোম্পানি রিবক তার যাত্রা শুরু করে ১৯৫৮ সালে। ২০০৫ সাল থেকে কোম্পানিটি অ্যাডিডাসের অধীনে চলে যায়। Reebok এর আরেকটি বানান হলো ‘Rhebok’। আফ্রিকান-ডাচ এ শব্দটি দিয়ে একধরনের এন্টিলোপকে (হরিণজাতীয় প্রাণী) বোঝানো হয়। তাদের প্রস্তুতকৃত পণ্য পরিধানে পরিধানকারীর গতি ও সাবলীলতা দুটোই বৃদ্ধি পাবে- এমনটা বোঝাতেই মূলত এ নাম বেছে নেয়া হয়েছিলো।

১০. Amazon

Source: Business Insider

আমেরিকান উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেফ বেজোসের হাত ধরে ১৯৯৪ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হয় ই-কমার্স ও ক্লাউড কম্পিউটিং কোম্পানি অ্যামাজনের যাত্রা। জেফ বেজোস তার কোম্পানির জন্য এমন একটি নাম খুঁজছিলেন যেন বর্ণানুক্রম অনুসরণ করে কোনো তালিকা বানালে সেটা সেই তালিকার সবার উপরে থাকে। ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়লো বিশ্বের দীর্ঘতম নদী অ্যামাজনের কথা। সাথে সাথেই তিনি বুঝতে পারলেন এমন একটি নামই তিনি খুঁজছিলেন। কারণ তিনিও চাচ্ছিলেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বুকে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াক। আর এভাবেই নিজের নাম পেয়ে যায় আজকের বিশ্বখ্যাত কোম্পানি অ্যামাজন।

১১. Nike

Source: obfuscata.com

ফুটওয়্যার, অ্যাপারেল, খেলাধুলার সামগ্রী প্রস্তুতকারী আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন নাইকির যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ‘Just Do It’ ট্রেডমার্কে বিশ্বাসী এ কোম্পানি তাদের নামটি নিয়েছে গ্রীক দেবী নাইকির কাছ থেকে। প্রাচীনকালে গ্রীকরা তাকে বিজয়ের দেবী হিসেবেই জানতো।

১২. Adidas

ইউরোপের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খেলাধুলার সামগ্রী নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি হলো জার্মান মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন অ্যাডিডাস। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৪৯ সালে অ্যাডিডাস নাম নিয়ে অ্যাডলফ ড্যাজলারের হাত ধরে শুরু হয় কোম্পানির যাত্রা।

Source: Pinterest

IKEA’র মতো অ্যাডিডাসের নামেও এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডলফের নাম জড়িয়ে আছে। নিজের নামের দুই অংশ Adolf ও Dassler-কে একত্রিত করে তিনি নাম ঠিক করেন ‘Addas’। কিন্তু এ নামে আগে থেকেই আরেকটি শিশুদের জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠানের নাম নিবন্ধন করা ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি ‘Adidas’ নামটিকে বেছে নেন

১৩. Adobe

Source: gadgetnmore.com

অ্যাডোবি ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, অ্যাক্রোব্যাট রিডার ইত্যাদি নানা রকম সফটওয়্যারের জন্য আমেরিকার এ মাল্টিন্যাশনাল কম্পিউটার সফটওয়্যার কোম্পানিটির নাম আমাদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। এর একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা হলেন জন ওয়ারনক। তার বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে একটি ছোট নদী, নাম তার অ্যাডোবি। সেখান থেকেই নিজের কোম্পানির নাম বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

১৪. Ebay

বিশ্বের ৩০টি দেশে বর্তমানে নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করছে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের আমেরিকান ই-কমার্স কর্পোরেশন ইবে। ১৯৯৫ সালে পিয়েরে অমিডায়ারের হাত ধরে চলতে শুরু করেছিলো আজকের এ বিশাল প্রতিষ্ঠানটি।

Source: Wikimedia Commons

অমিডায়ার চেয়েছিলেন ডোমেইনের নাম হিসেবে echobay.com ব্যবহার করতে। কিন্তু পরে দেখেন এ ডোমেইনটি ততদিনে ইকো বে মাইনস নামে একটি গোল্ড মাইনিং কোম্পানি নিয়ে গেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি তাই নামটাকে ছোট করে ebay বানিয়ে ফেলেন। আর সেখান থেকেই আমরা আজ পেয়েছি বহুল পরিচিত ইবের সন্ধান।

১৫. Vodafone

Source: vodafone.co.uk

এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও ওশেনিয়া অঞ্চলে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ব্রিটিশ মাল্টিন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি ভোডাফোন গ্রুপ। কাজের সাথে মিল রেখেই নিজেদের কোম্পানির নাম বেছে নিয়েছে তারা। কারণ VODAFONE = Voice + Data + telephone!

ফিচার ইমেজ- all4desktop.com

Related Articles

Exit mobile version