১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। অন্ধ্র প্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম চুনড্রু (Tsunduru)। সামাজিক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে এক রক্তাক্ত সংঘর্ষের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। নিচুতলার মানুষের মানবিক অধিকারের বিষয়টি মেনে নেবার মতো উদারতা উঁচু জাতের সমাজপতি ও গ্রামপ্রধানরা দেখাতে পারেনি। এছাড়া যুগ যুগ ধরে চলে আসা কুসংস্কার ও তার সামাজিক প্রয়োগের বেড়াজাল তো ছিলই। সেসবের রাজনৈতিক প্রয়োগ করে স্বার্থ হাসিল খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে সে সময়।
স্বার্থ হাসিলের এসব পদ্ধতি অনেকসময় রক্তক্ষয় ও লাশের মিছিলে পরিণত হতো। সাধারণ মানুষ এসব ঘটনায় শিওরে ওঠে বটে, তবে এই আতঙ্ক মিলিয়ে যেতেও সময় লাগে না। এই মানসিকতা বিভাজন আর হিংসাকে জিইয়ে রাখতে আরো সাহায্য করে।
অন্ধ্র প্রদেশের সেই চুনড্রু গ্রামে ভারতের অন্যান্য অনেক স্থানের মতো বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা কম কঠোর ছিল না। উপরন্তু- প্রচলিত আছে যে, ভারতবর্ষের উত্তরাংশের চেয়ে দক্ষিণখণ্ডে এই বিভেদের গোঁড়ামি আরো বেশি। আর তাকে নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে আরো অনুকূল। এসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থা সাধারণত উচ্চবর্ণের পক্ষে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মূল ঘটনাটি খুবই সাধারণ। ১৯৯১ সালের ৭ জুলাই। অন্ধ্র প্রদেশের কোনো এক সিনেমা হলে সেদিনও দর্শকরা ভিড় করেছিল সিনেমা দেখার জন্য। সেখানে রবি নামের এক শিক্ষিত দলিত যুবকও গিয়েছিল আর সবার মতো। দর্শকের আসন নিয়ে শ্রীনিবাস রেড্ডী নামের এক উচ্চবর্ণের যুবকের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়। ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হয়নি।
৮ জুলাই রেড্ডী পদবীধারী উচ্চবর্ণের একদল লোক রবির বাড়িতে চড়াও হয়ে তার বাবা ভাস্কর রাওকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তার ছেলে দলিত যুবক রবির সেদিনই মাদ্রাজ-হাওড়া মেইল ট্রেনে গ্রামে ফিরে আসার কথা। এ কথা আক্রমণকারীরা তার বাবা ভাস্করের কাছ থেকে জেনে নেয়। এদিকে ট্রেন থেকে নামার পরই একদল দলিত যুবক রবিকে ঘটে যাওয়া অঘটন সম্পর্কে জানিয়ে দেয়।
বিপদ আঁচ করতে পেরে রবি নিজের গ্রামের বাড়ি না গিয়ে পাশের পেদাগজুলাপল্লী গ্রামে এক দলিত পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। উচ্চবর্ণের লোকের রবির বিরুদ্ধে গয়না চুরির মিথ্যে অভিযোগ এনে তাকে নির্দয়ভাবে মারধোর করে। পরে একটি ট্র্যাক্টরে বেঁধে তাকে চুনড্রু গ্রামে নিয়ে আসা হয়। এখানে রেভিনিউ অফিসে এনে আবার তাকে মারধোর করে জোর করে মদ পান করানো হয়।
গুরুতর মারধোরের ফলে তার অবস্থা খুব খারাপের দিকে গেল। তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তার উপর নির্যাতনের জন্য পুলিশ কোনো ব্যবস্থা তো নেয়নি, উপরন্তু তার বিরুদ্ধে চুরির মিথ্যে মামলা ঠুকে দেওয়া হলো। এসব ঘটনার পেছনে উচ্চবর্ণের যেসব লোক প্রকাশ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন, তাদের নেতা ছিলেন গ্রামের প্রধান মদুগুলা সাম্বি রেড্ডী।
পরিস্থিতির চাপে রবি ও তার বাবা ভাস্কর রাও খুব ভীত হয়ে পড়েছিল। এমনকি পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ জানানোর মতো ভরসাও তারা পায়নি। এ কারণে গ্রামের অন্যান্য দলিত মানুষ তাদের উপর কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল।
এর মধ্যে ৯ জুলাই চলে এলো। এ ঘটনায় এলাকায় থমথমে ভাব চলে এসেছিল। উচ্চবর্ণের রেড্ডী ও তেলাগা সম্প্রদায়ের লোকেরা দলিতদের এই বাড়বাড়ন্ত সাহস রুখে দিতে একত্রিত হলো। তাদের সভায় সিদ্ধান্ত হলো, দলিতদের দমন করার উপায় হচ্ছে তাদের একঘরে করে রাখা। গ্রামের দলিতদের বেশিরভাগ লোকের পেশা ছিল উচ্চবর্ণের লোকেদের ক্ষেত খামারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করা। রোজগারে বাধা দিলে দলিতরা হয়তো উচ্চবর্ণের লোকেদের আবার দেবতাদের মতো সম্মান করবে- হয়তো এই উদ্দেশ্যই ছিল।
গ্রামের দলিতদের স্থানে উচ্চবর্ণের লোকেরা অন্য স্থান হতে ক্ষেতমজুর আনার ব্যবস্থা করেছিল। এদিকে কাজের অনিশ্চয়তা কমানোর দায়ে গ্রামের দলিতরা অন্যত্র কাজের সন্ধান করতে লাগল।
পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরো বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এর মধ্যে চলে এলো ১২ জুলাই। মডুকুর, ডিন্ডিপেলাম ও ভালিভেরু গ্রামের রেড্ডী সম্প্রদায়ের লোকজন একত্রে চুনড্রু গ্রামের দলিত বসতির উপর হামলা চালায়। দলিতরাও একেবারে অপ্রস্তুত ছিল না। অনিবার্যভাবে এক সংঘর্ষ হলো। পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে দুই পক্ষকেই ছত্রভঙ্গ করে দিল। উচ্চবর্ণের লোকেদের ছুঁড়ে মারা বোতলের আঘাতে পুলিশের একজন কনস্টেবল আহত হলো।
এই ঘটনার জন্য পুলিশ ১৮ জন দলিত ও ১৮ জন রেড্ডী সম্প্রদায়ের লোককে গ্রেফতার করলো। তাদের বিরুদ্ধে কেস করা হলো। পরে আরো ৮ জন রেড্ডী ও ২ জন দলিতকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ জুলাই বিশেষ শর্তের অধীনে তাদের সবাই জামিনে ছাড়া পায়।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হলো না। ৪ আগস্ট রাজাবাবু নামের এক দলিত যুবক এক চায়ের দোকানে খবরের কাগজ পড়ার সময় রেড্ডী সম্প্রদায়ের আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশ এই ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং উচ্চবর্ণের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার মিথ্যে অজুহাতে রাজাবাবুর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ৫ আগস্ট ইয়াকব নামের এক দলিত যুবক রেড্ডী সম্প্রদায়ের লোকেদের হাতে ছুরিকাহত হয়। স্থানীয় পুলিশের এসআই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
পরের দিন, অর্থাৎ ৬ আগস্ট ছিল সেই রক্তাক্ত দিন। চুনড্রু গ্রামে সেদিন হঠাৎ করে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রেড্ডী সম্প্রদায়ের তিনজন লোক নাকি দলিত যুবকদের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছে। পরবর্তীতে যা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু তার ফলে বারুদে আগুন লাগতে একটুও দেরি হলো না। ভাইলভেরু, মাঞ্চালা, মুন্নাঙ্গিভারিপালাম ও ভেল্লাতুরু গ্রামের উচ্চবর্ণের লোকেরা হিংস্র হয়ে উঠে।
সকাল ১১টা নাগাদ স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সাবইন্সপেক্টর চুনড্রু গ্রামে এসে স্থানীয় দলিতদের প্রাণ বাঁচাতে পলায়নের উপদেশ দিলেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব আন্দাজ করে দলিত পরিবারগুলোর পুরুষরা গ্রাম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। নারীরা বাড়িতেই রয়ে গেল।
দলিতরা ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালানোর সময় টের পায়নি, যে এটা একটা সাজানো ফাঁদ ছিল। ক্ষেতে চলমান ট্র্যাক্টরে করে উচ্চবর্ণের লোকেরা চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেললো। লোহার রড, কুড়াল আর ছুরি দিয়ে তাদের উপর রক্তাক্ত আক্রমণ করা হলো। নিহত দলিতদের লাশ ব্যাগে ভরে তুঙ্গভদ্রা নদীর মোহনায় ফেলে দেওয়া হলো। দলিতদের নেতা মোজেসের পরিবারের তিনজন নিহত হয়, যার মধ্যে তার পিতাও ছিলেন।
কিছু দলিত গৃহবধূ লক্ষ্য করেছিলেন যে, যেসব ট্র্যাক্টরে করে উচ্চবর্ণের লোকেরা এসেছিলো, তাতে পুলিশের লোকজনও ছিল। এমনকি ক্ষেতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সময়ও পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন ছাড়া আর কিছুই করেনি। মৃত্যুর আগে নিহতদের আর্তচিৎকার শুনে কয়েকজন উপস্থিত পুলিশ সদস্যের কাছে আকুলভাবে নিবেদন করলেও তারা একেবারে নির্বিকার হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত ছিল।
১৮ বছরের দলিত কিশোর দিয়ারি ধনরাজও সেদিন প্রাণভয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। ধানক্ষেত পেরিয়ে সে কোনোভাবে স্থানীয় রেল স্টেশন এলাকায় যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু সশস্ত্র রেড্ডী সম্প্রদায়ের লোকজন তার পিছু ছাড়েনি। একসময় সেও ধরা পড়ে। প্রথমে রড দিয়ে মেরে তার পা ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর কোনোভাবে সে প্রাণপণে তাদের হাত থেকে পালিয়ে এক খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেখান থেকে কয়েকজন দলিত মহিলা তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু বিপদ তখনও পিছু ছাড়েনি। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তাকে মহিলার ছদ্মবেশে স্থানীয় এক সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে।
চুনড্রু গ্রামের এই সংঘর্ষে দলিত সম্প্রদায়ের ৮ জন মানুষ নৃশংসভাবে খুন হয়। নিখোঁজ হয় আরো ৭ জন মানুষ। গুরুতর আহত হয় আরো ৩ জন মানুষ। এই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্ট অব ইন্ডিয়া পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে এই মামলা খারিজ করে দেয়। বিচারক নরসিংহ রাও এবং এম এস জ্যাসওয়ালের সমন্বয়ে গঠিত এক ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় যে, বাদীপক্ষ ঘটনার সময়, স্থান ও হত্যাকারীদের পরিচয় ঠিকভাবে দিতে না পারায় এই মামলা ভিত্তিহীন বলে গণ্য হয়েছে।