মঞ্চে দাঁড়ানো ভারিক্কি চেহারার বিশ্বনেতাদেরকে দেখলে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই যে তারাও আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো তারাও ভুলচুক করে ফেলেন কিংবা জড়িয়ে পড়েন বিব্রতকর বা মজার ঘটনার সাথে। তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে, এসব নেতাদের অনেকেই অগাধ ক্ষমতা হাতে পেয়ে হয়ে ওঠেন মদমত্ত স্বেচ্ছাচারী শাসক। জন্ম দেন নিষ্ঠুর অথবা অদ্ভুত সব কাহিনীর। আজকের আয়োজন তেমনই কিছু ঘটনা নিয়ে।
গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন গর্বাচেভ
সঙ্গীত জগতের সবথেকে সম্মানজনক পুরস্কার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন এমন কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞের সংখ্যাটা বড় কম নয়। কিন্তু এদের ভীড়ে মিখাইল গর্বাচেভের নাম থাকাটা একটু আশ্চর্যজনকই বটে। প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রনেতাকে যে মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মূল কারণ বলেই মনে করে।
ব্রেজনেভের আমলে সোভিয়েত অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। গর্বাচেভ রাজনৈতিক সংস্কার করে সংকট মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। তার গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকা নীতির ফলে সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোতে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তা তিনি সামলাতে পারেননি। ফলে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে যায়। গর্বাচেভ পরে রুশ ফেডারেশনের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি।
তো এই গর্বাচেভই ২০০৪ সালে রুশ রুপকথা ‘পিটার ও নেকড়ে’ এর অডিও ভার্সনে কন্ঠ দিয়েছিলেন। গ্র্যামিও জিতেছিলেন এই বদৌলতেই। অবশ্য গর্বাচেভ একা পুরস্কারটি জেতেননি, ভাগাভাগি করেছেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন এবং প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাথে।
রোমান্টিক উপন্যাস লিখেছিলেন নেপোলিয়ন
ফরাসি বিপ্লবের ঘনঘটায় ফ্রান্সের ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার আগপর্যন্ত ইউরোপে নেপোলিয়নই ছিলেন সর্বশক্তিমান নেতা। ইউরোপ আর আফ্রিকায় বহু সফল অভিযান পরিচালনা করে নেপোলিয়ন কুড়িয়েছেন সমরবিদদের শ্রদ্ধা।
১৭৯৬ সালে নেপোলিয়ন তখনো অজেয় হয়ে ওঠেননি। এ সময়েই তিনি লেখেন এক রোমান্টিক উপন্যাস- ‘ক্লিসোঁ এবং ইউজিন’। অনেকটা নাটুকে ধাঁচে লেখা এই উপন্যাসে উঠে এসেছে যুদ্ধের বিভীষিকা, সৈনিকের জীবন এবং পরকীয়া। ক্লিশে শোনালেও নেপোলিয়নের এই উপন্যাস কিন্তু তার নিজের জীবনের একটি অধ্যায়কে তুলে ধরে। সুইডেনের রানী ইউজিন ক্লারি একসময় তার প্রেয়সী ছিলেন, তাদের বাগদানও হয়েছিল। ফরাসি সম্রাটের উপন্যাস খুব সম্ভবত এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করেই লেখা হয়েছে।
ইয়েলতসিনের মাতলামো
বরিস ইয়েলতসিন নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে রাশিয়ার উদারপন্থী ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে সংসদ ভবনে ট্যাংক হামলা চালিয়ে এবং সোভিয়েত জমানা পরবর্তী উৎকট আর্থিক সংকট সামলাতে না পেরে তার জনপ্রিয়তা পরে তলানীতে ঠেকে। তার অত্যাধিক মার্কিনপ্রীতিও জাত্যাভিমানী রুশেরা ভাল চোখে দেখতো না।
বরিস ইয়েলতসিন বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন কারণ তিনি বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন মদ্যপ অবস্থায়। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ভাষ্যমতে, ১৯৯৫ সালের মার্কিন সফরের সময় একদিন দেখা গিয়েছিল ইয়েলতসিন শুধু অন্তর্বাস পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পিৎজা অর্ডার করবার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও বার্লিনে মাতাল হয়ে সঙ্গীত পরিচালনা করার চেষ্টা বা কিরগিজস্তান সফরের সময় কিরগিজ প্রেসিডেন্টের টেকো মাথায় তবলা বাজানোর ভঙ্গী করাটা রাশিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে।
তুর্কমেনবাসী সাপারমুরাত নিয়াজভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তুর্কমেনিস্তান স্বাধীন হয় ১৯৯১ সালের অক্টোবরে। মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রটির হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে বসেন সাপারমুরাত নিয়াজভ।
নিয়াজভ অত্যাচারী, দুর্নীতিগ্রস্থ এবং একনায়ক শাসক ছিলেন। তেলসমৃদ্ধ দেশটির আয়ের বড় একটা অংশ নিয়াজভ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে চলে যায়। তবে নিয়াজভ বিশ্বে নজর কেড়েছেন তার নারসিসিস্টিক পার্সোনালিটি কাল্ট এবং প্রকান্ড সব স্থাপত্যের পেছনে অকাতরে অর্থ খরচ করে। ১২ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বানিয়েছেন নিজের বিরাট স্বর্ণমূর্তি, যেটা কি না সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে ঘোরে। পাহাড়ের ওপরে বানিয়েছিলেন অসংখ্য সিঁড়ি। তার আশা এই সিঁড়ি ধরে হাঁটাহাঁটি করতে বাধ্য হওয়ায় সরকারী কর্মকর্তাদের ভুড়ি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
স্কুলের পাঠ্যবইয়ে নিয়াজভের লেখা রুহনামা বইটিও অন্তর্ভুক্ত থাকতো। নিয়াজভ নিজেকে উপাধি দিয়েছিলেন তুর্কমেনবাসী। এর অর্থ তিনিই সকল তুর্কমেনের নেতা। নিয়াজভ গোটা তুর্কমেনিস্তান নিজের অসংখ্য মূর্তি বানিয়েছেন, কয়েকটি গ্রাম ও শহরের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা নিয়াজভের মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে। তার আমলে তুর্কমেনিস্তানে দাঁড়ি, ব্যালে নৃত্য, সোনার বাধানো দাঁত প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বলাবাহুল্য, মিডিয়ার ওপরে অত্যাধিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় নিয়াজভের প্রকৃত জনপ্রিয়তা আচঁ করা কঠিন।
স্কটল্যান্ডের রাজা ইদি আমিন
পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডার শাসক ইদি আমিনের কথা কম-বেশি অনেকেই শুনেছেন। ব্রিটিশ সেনাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইদি আমিন সালে ১৯৭১ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উগান্ডার ক্ষমতা দখল করেন।
ইদি আমিন শুরুতে ভালই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু আর দশটা হঠকারী আফ্রিকান শাসকের মতো তিনিও দেখা গেল কূটনীতি বা দেশ শাসনের ব্যাপারে অজ্ঞ। ক্ষমতায় এসে হুট করে তিনি দেশের প্রায় আশি হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদেরকে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। উগান্ডার ব্যবসাপাতি ভারতীয়দের হাতেই ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর অর্থনীতিতে যে ধ্বস নামলো তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমিনের ছিল না।
পড়তি অর্থনীতির সাথে সাথে আমিনের অত্যাচারও বাড়তে থাকে। নিজেকে তিনি আজীবন প্রেসিডেন্ট, ফিল্ডমার্শাল, ডক্টর আমিন, আফ্রিকা আর বিশেষ করে উগান্ডায় ব্রিটিশদের পতনের হোতা, স্কটল্যান্ডের অঘোষিত রাজা, মাটির ওপরে বিচরণরত সমস্ত প্রাণী এবং পানির নিচে থাকা সমস্ত জীবের নেতা প্রভৃতি উপাধি দেন।
আমিন মাঝে মধ্যে একটা পালকি নিয়ে বের হতেন, আর পালকির বেহারা হিসেবে থাকতো সাদা চামড়ার ইউরোপীয়রা। প্রাক্তন শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের এই অদ্ভুত কৌশল তাকে বিশ্বজোড়া পরিচিতি এনে দেয়। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ইদি আমিনকে মানুষের মাংসখেকো উন্মাদ একজন শাসক হিসেবে প্রচার চালাতো। মানুষের মাংসে তার রুচি ছিল নাকি তা অবশ্য জানা যায় না। তবে এটা সত্যি যে তার আট বছরের শাসনামলে বহু লোককে মেরে কুমিরের পেটে চালান দেওয়া হয়েছিল। সৌদি আরবে নির্বাসনে থাকার সময় তার মৃত্যু হয়।
কিম জং ইল এবং একজন চলচ্চিত্র পরিচালক
উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাং এর ছেলে কিম জং ইল রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় আসেন নব্বইয়ের দশকে। তার আমলেই কোরিয়া পরমাণু বোমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের আব্দুল কাদির খানের সাথে উত্তর কোরিয়ার যোগাযোগ, ইরানসহ নানা দেশের কাছে ব্যালিস্টিক মিসাইলের প্রযুক্তি বিক্রয়, দুর্ভিক্ষ, কুশাসন আর দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান বা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিরন্তর শত্রুতা ও হুমকি-পাল্টা হুমকি কিম জং ইলের শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য।
অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণেই সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার চলচ্চিত্র শিল্পের দশা ছিল খুবই বেহাল। কিম জন ইলের এটা পছন্দ হওয়ার কথা না। দামী মদ এবং জাপানী সুশির পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের ভক্ত ছিলেন। কাজেই উত্তর কোরিয়াতে নিজস্ব চলচ্চিত্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন কিম জং ইল। সত্তরের দশকের শেষের দিকে এজন্য তিনি যে কাজটি করেছিলেন তা ছিল খুবই অদ্ভুত।
১৯৭৮ সালে হং কং থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত অভিনেত্রী চোই ইয়ুন হিকে অপহরণ করে উত্তরের এজেন্টরা। এর ছয় মাস পরে শিং সাং ওকে নামের এক বিখ্যাত দক্ষিণ কোরিয়ান পরিচালককেও অপহরণ করা হয়। চোই আর শিং আবার ছিলেন প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রী। কিম এদেরকে নিয়েই উত্তর কোরিয়ার চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। এই জুটি বেশ কিছু সিনেমা উপহার দেন উত্তর কোরিয়াকে। তার মধ্যে কয়েকটি বেশ সফলও হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে ভিয়েনা সফরকালে দুজনেই পালিয়ে মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় দিলে কিম জং ইলের এই বিদঘুটে পরিকল্পনার অবসান ঘটে। উল্লেখ্য, কিম যখন এসব কান্ড করছিলেন তখনও তার বাবা কিম ইল সাং দেশ চালাচ্ছিলেন।
ফিচার ইমেজ – history.com