রাজপুত থেকে ভুট্টো

লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ জুলফিকার আলী ভুট্টোর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে একটা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো: দক্ষিণ এশিয়ার কুলীন রাজনীতির এক অধ্যায়’। বাতিঘর থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে লেখক সবিস্তারে ভুট্টোর রাজনৈতিক জীবনসহ ভুট্টো পরিবারে পরিক্রমা বর্ণনা করেছেন। এই বইয়ের শুরুর দিকে আছে কীভাবে ঐতিহ্যবাহী রাজপুত বংশ থেকে ভুট্টো গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয় সেই বিষয়ে।

রাজপুত

ভারতবর্ষ এক আশ্চর্য জায়গা। পৃথিবীর বৈচিত্র্যের মতো এখানকার মানুষও বিচিত্র কিসিমের। হরেক রকম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এমনই এক জাতি রাজপুত। প্রাচীন ভারতের জাতিগুলোর মধ্যে রাজপুত অন্যতম। তারা জাতে ক্ষত্রীয় অর্থাৎ যুদ্ধ করাই তাদের কাজ। প্রায় মধ্যযুগ পর্যন্ত উত্তর ভারতের একটা অংশ রাজত্ব করে রাজপুতরা। মোহাম্মদ ঘুরি ১১৯২ সালে সর্বশেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করলে রাজপুত সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। তবে মুসলিম শাসকদের সাথে রাজপুতদের সম্পর্ক যে সবসময় খারাপ ছিল তা বলা যায় না। মুসলিম শাসকরা যেসব হিন্দু শাসকদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন, তার মধ্যে রাজপুতরা শীর্ষে। রাজপুতদের মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও আছে। শুধু মুসলমানরাই না, রাজপুতদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছে ব্রিটিশরাও। 

Image source: Open Art

সম্রাট আকবরের সাথে রাজপুতদের ছিল বিশেষ সম্পর্ক। আকবরের শীর্ষ সামরিক বা বেসামরিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল রাজপুতদের দখলে। নবরত্ন ভগবান দাস, অর্থমন্ত্রী টোডরমল, প্রধান সেনাপতি মানসিংহ, সভাসদ বীরবল এরা সবাই ছিলেন রাজপুত। আকবরের স্ত্রী যোধাবাই, যিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের মা, তিনি ছিলেন রাজপুত। সম্রাট শাহজাহানের মা-ও রাজপুত ছিলেন। মোগলরা ভুট্টোদের ‘খান’ উপাধিতে ভুষিত করে। তারা এই ‘খান’ উপাধি নিয়ে বেশ গর্বিত ছিল। মোগলদের সাথে রাজপুতদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বেশ কয়েক বছর বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বাঁক পরিবর্তন ঘটে সম্রাট শাহজাহানের শেষবেলার তুমুল হট্টগোলের দিনগুলোতে।

দারা শিকোহ

উত্তরাধিকার নিয়ে শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে ভয়ংকর বিবাদ চলছিল। ছোট পুত্র আওরঙ্গজেবের সাথে তীব্র লড়াই চলছিল বড় পুত্র দারার। লড়াইয়ে দারা শিকোহর পাশে দাঁড়ায় রাজপুতদের একাংশ (রাজপুতদের এই গোষ্ঠীর নামই ভুট্টো)। ছোট ভাইয়ের সাথে মুকুটের লড়াইয়ে হেরে যান দারা। মোগল সাম্রাজ্যে আসেন আওরঙ্গজেব।

দারা শিকোহ যেমন ছিলেন সাহসী যোদ্ধা আবার তেমনই ছিলেন কবি। তরিকৎ-উল-হকিকৎ নামে কবিতার বই যখন বের হয়, তার বয়স একেবারেই কম। সুফিবাদের প্রতি দারার ছিল বিশেষ আকর্ষণ। হযরত মিয়া মির ছিলেন লাহোরের একজন বিশিষ্ট সুফি সাধক। তাকে নিয়ে সাফিনাতুল আউলিয়া বই লিখেছেন দারা।

দারা শিকোহ; Image source: Wikimedia commons

লড়াইয়ে হেরে করুণ মৃত্যু ঘটে দারা শিকোহর। একইসাথে কোণঠাসা হয়ে যায় দারাকে সমর্থন দেয়া রাজপুতদের এই ভুট্টো গোষ্ঠী। রাজস্থান থেকে বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধুতে পাড়ি জমায় তারা। এভাবে দারার মাধ্যমেই ইসলাম ও সুফিবাদের সাথে পরিচয় ভুট্টোদের। পরিবর্তীতে এই ভুট্টোদের মাঝেই আমরা দেখতে পাবো রাজনীতির পাশাপাশি সুফিবাদের ঘনিষ্ঠতা। এমনকি ভুট্টো পরিবারেই কমপক্ষে একজন শক্তিশালী কবি আছেন। তার নাম ফাতিমা ভুট্টো, তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনী।

ভুট্টো গোষ্ঠী

রাজপুত একটা বিশাল জাতি। তাদের মধ্যে আবার রকমফের আছে। যেমন তাদের প্রধান বংশ তিনটি- সূর্যবংশী, চন্দ্রবংশী এবং অগ্নিবংশী। তিন বংশে আবার মোট ৩৬টি গোত্র আছে। তার মধ্যে একটি ভুট্টো গোষ্ঠী। তারা ভাট্টি বা ভাটিয়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

ভুট্টোরা চন্দ্রবংশীয়। রাজস্থানের জয়সলমের শহরে তাদের মূল অবস্থান ছিল। তারা যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী। দুর্গ রক্ষা এবং ঘোড়া চালানোয় বিশেষ দক্ষ ছিল ভুট্টোরা। রাজস্তানের জয়সলমের শহর ছিল বাণিজ্যের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ভারত থেকে মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যের একটা প্রধান রুট ছিল এই শহর দিয়ে। আর এই জয়সলমের শহর পাহারা দিত ভুট্টোরা। লাহোরে একটি গেটের নাম রাখা আছে ভাটিয়া গেইট।

দারা শিকোহর মৃত্যুর পর ইসলামের সংস্পর্শে আসা ভুট্টোরা বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধুতে পাড়ি জমায়। এর আগেই, মোগল জমানা থেকে মুসলমানদের সাথে রাজপুতদের বিয়ের প্রচলন দেখা যায়। এটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, রাজপুত মেয়েরা ধর্ম পরিবর্তন না করেই তখন মুসলমানদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্দ হতে পারতো। এটা একধরনের বিরল সমঝোতা। পরবর্তীতে ভুট্টো পরিবারেই আমরা এর উদাহরণ দেখতে পাবো। 

ভুট্টোদের ইসলামের সাথে পরিচয় ও সিন্ধুতে আসার ঘটনাবলী ঘটে আওরঙ্গজেবের আমলে। ক্রমে তারা এখানেই গোষ্ঠীর একটা শক্তিশালী ছাপ রাখতে শুরু করে। জমিদারি থেকে শুরু করে রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে থাকে ভুট্টোরা। শুধু সিন্ধু নয়, বরং পাকিস্তানের ইতিহাসের একটা বড় অংশে জুড়ে বসে ভুট্টোদের নাম। জুলফিকার আলী ভুট্টো এই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাম। তিনি ছাড়াও শাহনেওয়াজ ভুট্টো আর বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের অন্য দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নাম। 

দোদা খান থেকে ভুট্টো

জুলফিকার যেমন ভালো বক্তা ছিলেন, একইসাথে একজন অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। এই অনুসন্ধিৎসু মনই তাকে সারাজীবন বাকি সবার চেয়ে আলাদা করে রেখেছিল। তিনি তার নিজ ইচ্ছায় ভুট্টো গোষ্ঠীর বারো বংশ পর্যন্ত ইতিহাস বের করেন। তার মতে, ভুট্টোরা সিন্ধু অঞ্চলে এসে প্রথমে জমির বিবাদ মেটানো শুরু করে। সেখান থেকে প্রথম দোদা খান নামে একজন অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যান। সেখান থেকে তাদের জমিদারী এবং প্রভাব প্রতিপত্তির শুরু। দোদার নাতির নাতিই হলেন জুলফিকার ভুট্টো।

Image source: Wikimedia commons

আগেই বলা হয়েছে যে হিন্দুরা তাদের ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই মুসলমানদের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতো তখন। তাছাড়া কোনো সংকোচ ছাড়াই একাধিক বিয়ের প্রচলন ছিলো। আবার, প্রভাব বাড়ানোর জন্য এক জমিদারের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হতো অন্য জমিদারের ছেলের সাথে। সবগুলো ঘটনারই সরাসরি সাক্ষী জুলফিকার আলী ভুট্টো। তার বাবা শাহনওয়াজ করেন একাধিক  বিয়ে। ভুট্টোর মা লক্ষ্ণীবাই (খুরশীদ বেগম) জন্মসূত্রে একজন হিন্দু। ভুট্টো সারাজীবন তার মায়ের পরিচয় নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও তার এই পরিচয় নিয়ে আক্রমণ করতো। ভুট্টোর দ্বিতীয় স্ত্রী নুসরাতও একজন শিয়া মুসলিম। এটা নিয়েও কথা শুনতে হতো ভুট্টোকে।

জুলফিকার আলী ভুট্টো

জুলফিকারের পিতা শাহনওয়াজ ভুট্টোও একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন। বিশেষ করে সিন্ধু অঞ্চলে তার প্রভাব ছিল অনেক। তিনি ছিলেন স্বাধীন পাকিস্তান গঠনের একজন শক্তিশালী কন্ঠস্বর। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র জুলফিকার। বড় হবার সকল উপকরণ দিয়ে ছেলেকে বড় করতে থাকেন বাবা। পড়ান ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ও অক্সফোর্ডের মতো জায়গায়। পড়া শেষে দেশে এসে রাজনীতিতে যোগ দেন ভুট্টো।

পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রেখে জুলফিকার ভুট্টোও একাধিক বিয়ে করেন। তার বয়স যখন ১২, বছর তখন তিনি ১০ বছরের বড় শিরিন আমিরকে বিয়ে করেন বা বিয়ে দেয়া হয়। এই বিয়ের উদ্দেশ্য ছিলো জমিদারী বৃদ্ধি। বিবাহিত থাকা অবস্থাতেই বোম্বেতে পরিচয় হয় জন্মসূত্রে ইরানী নুসরাতের সাথে। সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ইস্পাহানী পরিবারের মেয়ে নুসরাত। তার শিয়া পরিচয়ের কারণে বিপদে পড়তে হয় জুলফিকারকে, যদিও নুসরাতকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন তিনি। নুসরাত ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও আধুনিকমনা। রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি ছিল তার। নুসরাতের রাজনৈতিক জ্ঞান ও যোগাযোগ জুলফিকারকে অনেক সুবিধা এনে দিয়েছিল। জুলফিকার যখন বিপদে পড়েন, তার দল পিপিপির হাল ধরতে দেখা যায় নুসরাতকে।

জুলফিকারের সর্বশেষ স্ত্রী হুসনা শেখ। ঢাকার জনৈক আব্দুল আহাদের স্ত্রী হুসনা ছিলেন দুই সন্তানের জননী। কয়েকবছর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের রেশে জুলফিকারের টানে ঢাকা ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান হুসনা। শুধু এই তিনজনই না, আরো অনেক নারীর সাথে জুলফিকর আলী ভুট্টোর প্রেম ছিল। তিনি কখনো এ ব্যাপারে অস্বীকারও করতেন না। বরং অনেকটা গর্বের সাথেই স্বীকার করতেন।

রাজপুতদের এক বংশধরের পরিণতি

ইস্কান্দর মির্জা ছিলেন ব্রিটিশদের পলিটিক্যাল এজেন্ট, যার মূল ছিল কাজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার পরামর্শ দান। যখন ব্রিটিশরাজ থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান গঠিত হলো, মির্জাই হলেন দেশটির প্রথম সামরিক সচিব। প্রভাব খাটিয়ে প্রিয়পাত্র আইয়ুব খানকে তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। এই দুজনের আনুকূল্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনীতিতে আগমন ও বেড়ে ওঠা। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; Image source: Wikimedia commons

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করলে ভুট্টো এর বিরোধিতা করেন। ১৯৭০ সাল নাগাদ সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন পুরো পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমস্ত জনগণ একাট্টা হয়। এতটা না হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর ডাকে তরুণরা একত্র হয় ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে। যদিও দুই অংশের বাকি সব এজেন্ডা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

বাংলাদেশ জন্মলাভের ৪ দিন পর, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হন। পরবর্তীতে হন প্রধানমন্ত্রীও। ১৯৭৯ সালে ভুট্টোর নিয়োগ দেয়া জিয়াউল হকের সামরিক আদালতে ফাঁসি দেয়া হয় রাজপুতদের এই বংশধরের।

Language: Bangla
Topic: From Rajputs to Bhuttos
Reference:
1. জুলফিকার আলী ভুট্টো: দক্ষিণ এশিয়ার কুলীন রাজনীতির এক অধ্যায় - আলতাফ পারভেজ

Related Articles

Exit mobile version