১
উশতুর করামের যুদ্ধে মির্জা কামরান সম্রাট হুমায়ুনের হাতে চরম মার খেয়ে কাবুল থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। তার সেনাবাহিনী উশতুর করামে বলতে গেলে একরকম ছিন্নভিন্নই হয়ে গেল।
কাবুল থেকে মাত্র ৮ জন সৈন্য নিয়ে মির্জা কামরান মন্দরাবরে পালিয়ে গেলেন। ভালো গুণ আর খারাপ গুণ মিলিয়ে মির্জা কামরান যেমন মানুষই হন না কেন, তিনি যে একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন তার সাক্ষর রাখলেন সেখানে। কয়েকদিনের মাঝেই প্রায় ১৫ হাজার সৈন্যের একটি মাঝারি সেনাবাহিনী গঠন করে ফেললেন। এই বাহিনী নিয়েই তিনি কাবুলের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলেন। তিনি কাবুল দখলের সুযোগ খুঁজছিলেন।
সম্রাট হুমায়ুন কামরান মির্জাকে আর কোনো সুযোগ দিতে চাননি। বাহাদুর খান আর মুহাম্মদ কুলি বারলাসকে তিনি নিযুক্ত করলেন কামরান মির্জাকে ধাওয়া করার জন্য। সম্রাটের প্রেরিত এ বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে কামরান মির্জা পালিয়ে গেলেন। আশ্রয় নিলেন আফগানদের কাছে।
আফগানদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে মির্জা কামরান এরপর হামলা চালালেন চারবাগ দুর্গে। দুর্গটি জালালাবাদ থেকে মাত্র বারো মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। চারবাগ দুর্গে কামরান মির্জার আক্রমণের সংবাদ পেয়েই সম্রাট হুমায়ুন ছুটলেন মির্জা কামরানের পেছনে। বিপদ বুঝে অবরোধ উঠিয়ে কামরান মির্জা পেশোয়ারে পিছু হটলেন।
এদিকে কাবুলে সম্রাটের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মির্জা কামরান আরেকবার কাবুল দখলের চেষ্টা করলেন। তবে কাবুলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবার বেশ শক্ত থাকায় তিনি ব্যর্থ হলেন। সম্রাট হুমায়ুন মির্জা কামরানের কাবুল দখলের চেষ্টার সংবাদ শুনে আবারো তাকে তাড়া করলেন। কামরান মির্জা এবার লাঘমান হয়ে সিন্ধু পাড়ি দিতে বাধ্য হলেন।
মির্জা কামরানের আচার-আচরণ এবার অনেকটা নাছোড়বান্দার মতো মতো মনে হলো। আবারও তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে কাবুলের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলেন। বিরক্ত সম্রাট আবারো তাকে ধাওয়া করলেন। কামরান আবারো পালালেন। ক্লান্ত সম্রাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাঙ্গারহার পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়ে শিবির ফেললেন।
২
২০ নভেম্বর, ১৫৫১ সাল। সম্রাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাঙ্গারহার পাহাড়ি অঞ্চলে ঘাটি গেড়ে বসে আছেন। কামরান মির্জা কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছিলেন। প্রতি ঘণ্টায় সম্রাট হুমায়ুনের কাছে গুপ্তচরদের দেওয়া রিপোর্ট আসছিল। তাতে বলা হচ্ছে, কামরান মির্জা এবার হয়তো মরণ কামড় দেবে। তিনি রাতের অন্ধকারে আফগান পশতুন যোদ্ধাদের নিয়ে সম্রাটের শিবিরে হামলা চালাতে পারেন। কাজেই সম্রাট পুরো সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দিলেন।
মির্জা হিন্দালও কামরান মির্জার এই আক্রমণ ঠেকাতে মরিয়া ছিলেন। তিনি সম্রাটকে গিয়ে বললেন,
আপনি আমার ভাস্তে আকবরকে নিয়ে সামনের উঁচু জায়গায় অবস্থান করুন। আমরা আপনাকে পাহাড়া দেবো।
এরপর তিনি নিজের বাহিনীর যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে তাদের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাতে লাগলেন। তিনি বললেন,
তোমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সেবা করছ। আজ রাতের প্রস্তুতিটা হবে একটু অন্যরকম। আল্লাহ আমাদের সহায় আছেন। আজকের রাতটি যদি তোমরা সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে পারো, তবে তোমরা যা চাইবে, তা-ই দেওয়া হবে।
কামরানের আক্রমণ থেকে সতর্ক থাকার জন্য রাজকীয় শিবিরের চারপাশে গভীর পরিখা খনন করা হলো। হিন্দাল মির্জা সেই পরিখা ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করছিলেন। তিনি আশা করছিলেন এত সতর্কতার খবর মির্জা কামরান নিশ্চয়ই পেয়েছেন। আজ রাতে তিনি অন্তত হামলা চালাবেন না।
কিন্তু মির্জা হিন্দালের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কামরান মির্জা তার আফগান বাহিনী নিয়ে বেপড়োয়া এক আক্রমণ চালালেন।
রাতের অন্ধকারেই চললো প্রচণ্ড যুদ্ধ। একপর্যায়ে মুঘল বাহিনীর একটি ইউনিটের উপর তীব্রভাবে ঝাপিয়ে পড়লো আফগানরা। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, সেই বাহিনীটির দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং মির্জা হিন্দালই। অসীম সাহসিকতার সাথে তিনি আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কোনো এক আফগান যোদ্ধার তরবারির সামনে পড়ে গেলেন সম্রাট বাবরের আদরের কনিষ্ঠ পুত্র মির্জা হিন্দাল। সেই আঘাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে প্রচণ্ড আঘাত হানলেও, প্রভূত ক্ষতি হলেও আফগানদের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হলো।
৩
মির্জা হিন্দাল তার বড় ভাই হুমায়ুনের পক্ষ নিয়ে বহু যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মির্জা হিন্দালের এই করুণ মৃত্যুর কথা তখনো সম্রাট জানতেন না। যুদ্ধের পর যখন সম্রাট মির্জা হিন্দালের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি যে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, এই সংবাদটি সম্রাটকে দেবার মতো সাহস কারোর হলো না।
কারো কাছ থেকে কোনো সংবাদ না পেয়ে সম্রাট হুমায়ুন মির আবদুল হাইকে পাঠালেন হিন্দালের খবর জোগাড় করে আনতে। মির্জা হিন্দালের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে তিনি ফিরে এলেন। তবে ফিরে এসে তিনিও সংবাদটি সম্রাটকে দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তিনি সম্রাটকে জানালেন, যুদ্ধে মির্জা হিন্দাল আহত হয়েছেন।
হিন্দালের আহত হওয়ার সংবাদে সম্রাট দ্রুত ঘোড়া আনতে নির্দেশ দিলেন। তিনি মির্জা হিন্দালকে দেখতে চাইলেন। উপায় না দেখে মির আবদুল হাই আবারও বললেন, তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। আপনার এখন সেখানে যাওয়া উচিত হবে না। সম্রাটকে বাঁধা দিতে মির আবদুল হাইয়ের তীব্র আকুতি বোধহয় সম্রাট এবার টের পেলেন। তিনি বুঝে গেলেন মির্জা হিন্দাল আর এই পৃথিবীতে নেই।
মির্জা হিন্দাল পৃথিবীতে নেই, সংবাদটি যত সহজে বলা হয়ে গেল, সংবাদটি হজম করা আসলে তত সহজ ছিল না। যখন সম্রাট এই ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারলেন, তখন প্রচণ্ড শোকের আবেগে তিনি অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন।
সম্রাট হুমায়ুনের মতো একই অবস্থা হয়েছিল মির্জা হিন্দালের ছোটবোন গুলবদন বেগমের। সম্রাট হুমায়ুনের জীবনীগ্রন্থ ‘হুমায়ুননামা’-তে তিনি লিখেছেন,
আমি দুঃখিনী গুলবদন জানতে পারিনি মির্জা হিন্দালের মতো সৎ ও সজ্জন একজন মানুষকে কে হত্যা করেছিল। এ হত্যাকাণ্ড আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। চোখ অশ্রুসিক্ত করে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল এর চেয়ে যদি আমার পুত্র সাদাত ইয়ার কিংবা আমার স্বামী খিজির খাজা খানের মৃত্যু সংবাদ পেতাম, তাতেও এত কষ্ট পেতাম না। নিষ্ঠুর তরবারি আমার প্রাণপ্রিয় ভাইকে কেড়ে নিল। এ কষ্ট আমি কীভাবে ভুলব?
শোকের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সম্রাট নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন। এরপর মির্জা হিন্দালের মৃতদেহ জুইশাহীতে (জালালাবাদ) নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। অত্যন্ত যত্ন আর রাজকীয় মর্যাদার সাথে মির্জা হিন্দালের মৃতদেহ উটের পিঠে চড়ানো হলো। এরপর উট চললো জুইশাহীর পথে। যাত্রাপথে আরেকটি হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো।
যে উটের পিঠে মির্জা হিন্দালের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই উটের রশি ধরে আগে আগে হাঁটছিলেন গুলবদন বেগমের স্বামী খিজির খাজা খান। মির্জা হিন্দালের মৃত্যু শোকে তিনিও হতবিহ্বল ছিলেন।
উটের রশি ধরে হাঁটার সময় তিনি শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। খিজির খাজা খানের কান্নার এই খবর সম্রাটের কাছে পৌঁছালো। সম্রাট তখন দ্রুত তাকে উদ্দেশ্য করে একটি বার্তা পাঠালেন। গুলবদন বেগম তার বইতে সেই বার্তাটি লিখে গেছেন। বার্তায় সম্রাট লিখেছিলেন,
আমাদের সকলকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। এ দুঃখ তোমার চেয়ে আমাকে গভীরভাবে আঘাত করেছে। কিন্তু রক্তপিপাশু শত্রুদের কথা মনে রেখে আমাদের কষ্টগুলোকে চাপা দিতে হবে। শত্রুরা এখনো কাছেই ওঁৎ পেতে আছে। সুতরাং আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে।
মির্জা হিন্দালকে প্রথমে জুইশাহীতে (জালালাবাদ) দাফন করা হলো। পরে তার মৃতদেহ পুনরায় সম্রাট বাবরের পাশে কাবুলের বাগ-ই-বাবুরে দাফন করা হয়েছিল।
মির্জা হিন্দালকে দাফনের পর কাবুলে সম্রাট তার বোন ও আত্মীয়দের কাছে এই হৃদয় বিদারক ঘটনার বার্তা পাঠালেন। বার্তা পেয়ে কাবুল মুহূর্তেই শোকের নগরীতে পরিণত হলো।
গুলচেহারা বেগম হিন্দাল মির্জার মৃত্যু সংবাদ শুনেই কান্না শুরু করলেন। তার কান্না একসময় বিলাপে পরিণত হলো। হিন্দাল মির্জার মৃত্যুতে শোকাভূত হয়ে তিনি এতটাই কেঁদেছিলেন যে, কাঁদতে কাঁদতে তিনি একসময় অসুস্থই হয়ে পড়েন।
৪
সম্রাট হুমায়ুন মসনদ লাভের পর তার তিন ভাই-ই তাকে প্রচণ্ড বিরক্ত আর বিব্রত করেছিলেন। তবে এই তিনজনের মাঝে সবচেয়ে কম বিরক্ত করেছিলেন মির্জা হিন্দালই। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন বিশ্বস্ততার সাথে সম্রাটকে সাহায্যও করেছিলেন।
হিন্দুস্তানের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর মৃতুবরণ করেন ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে সম্রাটের মৃত্যুর ৪ দিন পর ৩০ ডিসেম্বর সম্রাটেরই ইচ্ছানুযায়ী মুঘল সালতানাতের মসনদে বসেন বাবর পুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন।
মসনদ লাভ করে পিতার ইচ্ছানুযায়ী সম্রাট হুয়ায়ুন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ তার ভাইদের মাঝে ভাগ করে দেন। সাম্রাজ্যের এই ভাগাভাগিতে কামরান মির্জা কাবুল, কান্দাহার আর পশ্চিম পাঞ্জাবের শাসনভার পান। মির্জা আসকারী পান সম্ভলের শাসনভার। আর সম্রাট বাবরের কনিষ্ঠ পুত্র হিন্দাল মির্জা পেয়েছিলেন আলোয়ারের শাসনভার।
শুরুতে নতুন মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সাথে মির্জা হিন্দালের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। তবে ঝামেলা শুরু হয় সম্রাটের বাংলা অভিযানের সময়। ১৫৩৭ সালের দিকের কথা। শের খান তখনো শের শাহ হয়ে উঠেননি। প্রচণ্ড মেধাবী আর সুদক্ষ জেনারেল এই শের শাহ তখন ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছিলেন। ১৫৩৭ সালের শুরুতে তিনি বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করতে যখন সামরিক অভিযান শুরু করেন, তখন সম্রাট হুমায়ুন মুঘল সালতানাতের জন্য শের শাহের হুমকি উপলব্ধি করে সে বছরেই ২৭ জুলাই বাংলা আর বিহার দখলের জন্য আগ্রা ত্যাগ করেন। এই সেনাবাহিনীতে মির্জা হিন্দালও ছিলেন।
মাত্র এক বছরের মাথায় ১৫৩৮ সালের জুলাই নাগাদ মুঘল সেনাবাহিনীর গৌড় তথা বাংলা বিজয় সম্পন্ন হয়ে যায়। বাংলা বিজয়ের পর সেনাবাহিনীর রসদ সংগ্রহের জন্য সম্রাট মির্জা হিন্দালকে তিরহুত আর পূর্নিয়ার দিকে পাঠালেন।
কিন্তু কী মনে করে কে জানে, তিনি সম্রাটের আদেশ অমান্য করে তিরহুত আর পূর্নিয়ার বদলে আগ্রার রাস্তা ধরলেন। আগ্রায় এসে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বসলেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। তবে গৌড় থেকে সম্রাট হুমায়ুন ব্যপারটিকে ছোট ভাইয়ের পাগলামী হিসেবেই নিলেন।
অবশ্য পরে পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মির্জা হিন্দাল পিছু হটেছিলেন এবং সম্রাটের নিকট ক্ষমাও চেয়েছিলেন। সম্রাট ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন।
এদিকে, ১৫৩৯ সালে চৌসায় আর ১৫৪০ সালে কনৌজে সম্রাট হুমায়ুন খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি যুদ্ধে শের শাহের কাছে পরাজিত হন। মাশুল হিসেবে তাকে হিন্দুস্তানের মসনদ হারাতে হয়। সম্রাটের এই দুঃসময়ে মির্জা কামরান আর মির্জা আসকারির অবস্থান পরিষ্কার না হলেও মির্জা হিন্দাল যে সম্রাটের অনুগত ছিলেন তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।
অবশ্য কনৌজের যুদ্ধে পরাজয়ের পরের বছরের ২৯ আগস্ট সম্রাটের হামিদা বানুকে বিয়ের প্রেক্ষাপটে তিনি অভিমান করে সম্রাটকে ছেড়ে কান্দাহার চলে যান। হিন্দাল মির্জার অভিমান অবশ্য অহেতুক ছিল না।তবে কিছুদিন পর তিনি ফিরেও আসেন।
মির্জা কামরান আর মির্জা আসকারির তাড়া খেয়ে ১৫৪৪ সালের শুরুর দিকে সম্রাট হুমায়ুন যখন পারস্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, মির্জা হিন্দাল তখনো কাবুল আর কান্দাহারের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন। পরে তিনি মির্জা কামরানের হাতেও বন্দী হন।
১৫৪৫ সালের জানুয়ারীতে সম্রাট পারস্য ত্যাগ করে কান্দাহারে চলে আসেন। মির্জা হিন্দাল এর কিছুদিন পরেই মুক্তি পেয়ে সম্রাটের কাছে ছুটে আসেন। তিনি আবারো সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তার ভাই সম্রাট হুমায়ুনের অনুগত ছিলেন। এমনকি তিনি মারাও গিয়েছিলেন ভাইকে রক্ষা করতে গিয়েই।
৫
মির্জা হিন্দাল সম্রাট বাবর ও দিলদার বেগমের কোল আলো করে ১৫১৯ সালে ৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সম্রাট বাবর তার কনিষ্ঠ এই পুত্রের নাম রেখেছিলেন হিন্দাল। তুর্কি ভাষার এই শব্দটির মানে ‘হিন্দুস্তান বিজেতা’। মির্জা হিন্দাল কখনো নিজে হিন্দুস্তান বিজয় করতে পারেননি, এটা সত্য। তবে সম্রাট হুমায়ুনের মসনদ হারানোর পর তিনি তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের কাজেই।
মির্জা হিন্দালের জন্মদাত্রী মা ছিলেন দিলদার বেগম, তবে তিনি ও তার ছোটবোন গুলবদন বেগম লালিত-পালিত হয়েছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের মা মাহম বেগমের কাছে। সম্ভবত এ কারণেই দুই ভাই-বোনের সাথে সম্রাট হুমায়ুনের আত্মীক বন্ধনটিও বেশ জোড়ালো ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সৎ। তার ভেতরে যে স্বভাবজাত তেজ ছিল তা বোঝা যায় মাত্র ১৯ বছর বয়সে আগ্রা অধিকার করে নিজেকে স্বাধীন শাসক ঘোষণা দেয়ার মধ্য দিয়ে। অবশ্য তার সামরিক জীবন শুরু হয়েছিল আরো অনেক আগেই, মাত্র ১০ বছর বয়সেই বাদাখশান অভিযানের মধ্য দিয়ে।
তার প্রশাসনিক জীবনের শুরুও মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই। এ সময় তিনি বাদাখশানের শাসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১১ বছর বয়সে তিনি কাবুল আর কান্দাহারের প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৫৩০ সালে সম্রাট হুমায়ুন মুঘল মসনদে বসার সময় তিনি আলোয়ারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এছাড়াও পরবর্তীতে মালওয়া, গজনী আর মেওয়াতের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
মির্জা হিন্দাল ১৫৩৭ সালে মেহেদী খ্বাজার ছোট বোন সুলতানম খানমকে বিয়ে করেছিলেন। তার কন্যা রুকাইয়া বেগম ১৫৫৬ সালে সম্রাট হুমায়ুনের পুত্র সম্রাট আকবরকে বিয়ে করেছিলেন। সেই হিসেবে মির্জা হিন্দাল ছিলেন পরবর্তী মুঘল সম্রাট আকবরের শশুর।
মৃত্যুকালে মির্জা হিন্দালের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর।
৬
মির্জা কামরানকে কি মির্জা হিন্দালের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা যায়? আসলে সরাসরি দায়ী করা যায় না। মির্জা হিন্দালকে হত্যা করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল সম্রাট হুমায়ুনকে সরিয়ে কাবুল-কান্দাহার আর এর আশেপাশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধেই মৃত্যুবরণ করেন মির্জা হিন্দাল।
মির্জা কামরানের এমন আক্রমণাত্মক উদ্ভট আচরণ কিছুটা আশ্চর্যজনকই ছিল। কারণ এটা তো অনেকটা অনুমেয় ব্যাপারই ছিল যে, তিনি যদি তার পূর্বের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তাহলে সম্রাট হুমায়ুন তার মসনদ পুনরুদ্ধার করতে পারলে তাকে কাবুল, কান্দাহার দিয়ে দিতেন। বরং তার চাহিদানুযায়ী তিনি আরও কিছু ভূখণ্ড পেয়ে যেতেন।
কিন্তু তিনি তা না করে সবসময়ই সম্রাটকে পেছন থেকে টেনে ধরেছিলেন। আর তার এই অহেতুক শত্রুতার দায় মেটাতে মৃত্যুবরণ করেছিল হাজার হাজার মুঘল যোদ্ধা। শেষপর্যন্ত তার এই অহেতুক রক্তপাতের শিকার হতে হলো সম্রাট বাবরের আদরের পুত্র আবুল নাসির মুহাম্মদ হিন্দাল মির্জাকে।
যা-ই হোক, মির্জা হিন্দালের মৃত্যুর পর মির্জা কামরান পালিয়ে আফগানদের আশ্রয়ে আফগানদের বসতিগুলোতে অবস্থান করতে থাকেন। সতর্কতার জন্য তিনি কিছুদিন পর পরই অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকেন। ফলে তার অবস্থান সপর্কে মুঘল গোয়েন্দারা ধাঁধায় পড়ে যান।
অবশ্য সম্রাট তখনো নিশ্চিত ছিলেন কামরান আফগান বসতিতেই আছেন। সম্রাট শুরুতে আফগানদের ঘাঁটাতে চাইছিলেন না। কিন্তু হিন্দাল মির্জার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। ১৫৫১ সালের বাকি সময়টুকু বেহসুদ (হাজারা প্রদেশ)-এ বসে থেকে পরের বছর আঘাত হানলেন আফগানদের উপর। ১২ হাজার সৈন্য নিয়েও কামরান শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। পিছু হটে সম্রাটকে এড়িয়ে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন।
কামরান পালিয়ে গেলেন, কিন্তু সম্রাটের ক্রোধের বাকি অংশটুকু হজম করতে হলো আফগানদের। ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যখন আফগানরা উপলব্ধি করতে পারলো যে তাদের এই ক্ষয়ক্ষতির একমাত্র কারণ মির্জা কামরান, তখন তারা মির্জা কামরানকে সহায়তা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
এদিকে মিত্রবিহীন মির্জা কামরান নতুন মিত্রের সন্ধানে বের হলেন। দিল্লির মসনদে তখন শের শাহ সুরির পুত্র ইসলাম শাহ সুরি। শের শাহ সুরির কী হলো তাহলে? সেই আলাপ তোলা রইলো পরবর্তী কোনো এক দিনের জন্য।
[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]
এই সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোঘল রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ
২) আকবর (এক মোঘল সম্রাটের রোমাঞ্চকর জীবনকাহিনী)
৩) দ্য হিস্ট্রি অব রয়্যাল লেডিস ইন মোঘল এমপায়ার