লন্ডনের একটি বাসে ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। ভাবছেন, এখনকার কথা বলছি? না, সময়টা ১৯১৮ সাল। সেসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। একইসাথে মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছিল স্প্যানিশ ফ্লু। তাই যুক্তরাজ্য জুড়ে সতর্কতা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাসে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হতো।
মৃতের সংখ্যার হিসেবে আধুনিক যুগের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে ১৯১৮ সালে ধরা পড়া স্প্যানিশ ফ্লুর প্রাদুর্ভাব।
১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ পর্যায়ে। যুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ততদিনে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ঠিক সেসময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে স্প্যানিস ফ্লু নামের মহামারী। পরের ১৮ মাসে এই ভাইরাসের সংক্রমণে মারা যায় প্রায় ২ কোটি মানুষ। বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি ভাইরাসটির উৎস সম্পর্কে। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সংক্রমণের মূল উৎপত্তিস্থল। তবে ফ্রান্স, চীন কিংবা যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। আপনাদের হয়তো অবাক লাগতে পারে এটা ভেবে যে, ভাইরাসের নাম বলা হচ্ছে স্প্যানিশ ফ্লু, অথচ উৎপত্তিস্থলে স্পেনের নাম নেই কেন!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের যে অল্প কয়েকটি দেশ একদম নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল, তার মধ্যে স্পেন একটি। নিরপেক্ষ থাকার সুবিধায় দেশটির গণমাধ্যম বেশ স্বাধীনভাবেই সংবাদ প্রকাশ করতো। স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারীতে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম সেই সংবাদ প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও স্পেনের মিডিয়া ফলাও করে এই ফ্লুর কথা প্রচার করে। দেশটির রাজা ত্রয়োদশ আলফনসোও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এরপর পত্রিকাগুলো আরও বেশি করে সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে। অন্যান্য দেশের মানুষেরাও স্প্যানিশ গণমাধ্যম থেকে এই মহামারীর খবর জানতে পারতো। তাই দেশে দেশে মানুষের কাছে এই মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল এইচ১এন১ নামের একটি ভাইরাস।
এবার চলুন সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা যাক।
মধ্য চীনের উহান শহর থেকে করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে চীনা প্রশাসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি করোনার সংক্রমণে প্রথম একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। তবে তাদের ধারণা, কোনো প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোনো মানুষের দেহে ঢুকেছে, এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর সাথে উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজারে গিয়েছিল এমন লোকদের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।
ওই বাজারে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো। হয়তো সেই প্রাণীদেরই কোনো একটি থেকে এই নতুন ভাইরাস এসে থাকতে পারে। মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়ানোর পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোভিড-১৯ নামে ভাইরাসটির নতুন নামকরণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের ২২১ টিরও বেশি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় ২৯ লাখ।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্প্যানিশ ফ্লু নাকি কোভিড-১৯ এই দুয়ের মাঝে কোনটি বেশি ভয়ংকর? তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে এই লেখায় আমরা এই প্রশ্নেরই উত্তর জানার চেষ্টা করবো।
চলুন আবার ফিরে যাই ১৯১৮-১৯ সালের দিনগুলোয়। সেসময় মহামারী আকার ধারণ করা স্প্যানিশ ফ্লুয়ের লক্ষণগুলোয় নজর দেয়া যাক। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথমে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হতো, কারো কারো শুষ্ক কাশি, মাথায় ক্ষত হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। দেহে অক্সিজেনের অভাবে কিছুটা নীলবর্ণ ধারণ করার কথাও এসেছে কোনো কোনো সূত্রে। এরপর শ্বাসযন্ত্রে রক্ত জমে বমি ও নাক দিয়ে রক্তপড়া শুরু হতো। অনেকেই নিজেদের রক্তে গড়াগড়ি খেয়ে মারা যেতেন।
কিন্তু করোনাভাইরাস নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গে আটকে থাকেনি। শুরুতে জ্বর, সর্দি, কাশির মতো ভাইরাসজনিত সমস্যাগুলো লক্ষণ হিসেবে ভাবা হলেও ক্রমেই সময়ের সাথে বদলেছে এর উপসর্গ। শ্বাসকষ্ট, স্বাদ বা গন্ধ না পাওয়ার মতো উপসর্গ থেকে একেবারেই লক্ষণহীন ব্যাক্তিরও করোনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসার নজির মেলেছে। লক্ষণ বিবেচনায় তাই স্প্যানিশ ফ্লু থেকে অনেকাংশে পার্থক্য রয়েছে কোভিড-১৯ এর।
সাধারণত ভাইরাস একেবারেই বিদায় নেয় না। একেকটা ভাইরাসের বারবার ফিরে এসে ছড়িয়ে পড়ার নজির আছে ইতিহাসে। এই ছড়িয়ে পড়াকে ওয়েভ বলা হয়। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের কথাই ধরা যাক। ভাইরাসটির তিনটি ওয়েভের কথা জানা গেছে।
১৯১৮ সালের মার্চে প্রথম ওয়েভে স্প্যানিশ ফ্লু তেমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসের ক্যাম্প ফান্সটোনের সৈন্যদের থেকে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসটি। সে সময় ভাইরাসটির সংক্রমণ সৈন্যদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। সৈন্যদের থেকেই অন্যান্য স্থানে ছড়ায় ভাইরাসটি।
সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই বৈশ্বিক মহামারি দ্বিতীয় ওয়েভে প্রবেশ করে। পরের চার মাসে ভাইরাসটির সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেয়। বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল। শুধু অক্টোবরেই আমেরিকায় প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায় এর কারণে।
পরের বছরের জানুয়ারিতে তৃতীয় ওয়েভ শুরু হয়। তবে এই ওয়েভ ততটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারেনি। সেসময় এই ভাইরাসে মৃত্যুর হারও কমে আসে। ভাইরাসটিতে ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা যায়।
কোভিড-১৯ ও এই মুহূর্তে তৃতীয় ওয়েভ পার করছে মাত্র ১৬ মাসের ব্যবধানে। তবে সব দেশেই তৃতীয় ওয়েভ শুরু হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। মাসখানেক আগে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আবার মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।
ওয়েভের বিবেচনায় স্প্যানিশ ফ্লুই ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। করোনায় সে তুলনায় কম মৃত্যুকে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি এবং একইসাথে দেশে দেশে সচেতনতা সৃষ্টির সুফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্প্যানিশ ফ্লুুতে লোকজনকে অসুস্থ হলে ঘরে বসে থাকতে এবং বড় বড় সমাবেশ এড়াতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হলেও সরকারগুলো তা চেপে রেখেছিল। স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি জড়িত থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য কোনো চিকিৎসা এবং নিউমোনিয়ার মতো জটিলতার চিকিৎসার জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিকও ছিল না।
করোনার সংকটের সময় সংক্রমণের বিস্তার রোধে কেন্দ্রীয়ভাবে যেমন লকডাউন ছিল, স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রমণকালে এমন কোনো লকডাউন ছিল না। কিছু শহর ও নগরের রাস্তায় জীবাণুনাশক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং কিছু লোক তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় জীবাণুরোধী মাস্ক পরত। ওই সময়ে জনস্বাস্থ্যের বার্তাগুলো ছিল বিভ্রান্তিকর। এখনকার মতোই ভুয়া খবর, ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল।
এতসব কারণে স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যুহারও ছিল ভয়াবহ। কোভিড-১৯ মোকাবিলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোর পদক্ষেপ এই দিক বিবেচনায় বেশ সফল। দেশে দেশে লকডাউনের ফলে মাঝের কিছু মাস কমেছিল সংক্রমণ, মানুষের মাঝে বেড়েছিল সচেতনতা। একইসাথে চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দ্রুততর পদক্ষেপের ফলে সংক্রমণ কমে এসেছিল। তবে সেটি থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি সব দেশ। তাই অনেক দেশকেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারের উর্ধ্বগতি দেখতে হচ্ছে আবার।
স্প্যানিশ ফ্লুর আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মারা যান ২০-৪০ বছর বয়সীরা। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর হার ছিল তুলনামূলকভাবে কম। চিকিৎসকদের একাংশের ধারণা, ১৮৮৫ সালের আগে স্প্যানিশ ফ্লু-র মতো কোনো ভাইরাস হানা দিয়েছিল। সেই ভাইরাসের তীব্রতা কম থাকায় মহামারীর রূপ ধারণ করেনি। তবে অনেকেই সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ফলে অনেকের শরীরে ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। এ কারণেই প্রবীণদের মধ্যে বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি স্প্যানিশ ফ্লু। তাই স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃতের তালিকায় তরুণদের সংখ্যা এত বেশি ছিল।
করোনায় অবশ্য উল্টো চিত্রই দেখা গেছে। সারা পৃথিবীতেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ষাট বছরের উপরের বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি মারা গেছেন। বয়স্কদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গও করোনার সংক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এই ভাইরাসে নারীদের তুলনায় পুরুষের মৃত্যুই হচ্ছে বেশি।
স্প্যানিশ ফ্লুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানী ঘটেছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। সেখানে মৃত্যুর হার ইউরোপের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ছিল। অথচ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই হার ছিল সর্বনিম্ন। অন্যদিকে করোনায় এখন পর্যন্ত সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুই তালিকাতেই একেবারে উপরের স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া এবং স্পেনের মতো অভিজাত দেশগুলো। এই উপমহাদেশের দেশগুলোয় মধ্যে একমাত্র ভারতই আছে শীর্ষ পাঁচে।
প্রায় ১০০ বছর আগের স্প্যনিশ ফ্লু যে ভয়াবহতা নিয়ে দেশে দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল, অসচেতনতা আর রাষ্ট্রগুলোর উদাসীনতায় যেভাবে বেড়েছিল সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল, সেই তুলনায় সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ তার ভয়াবহতার চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। মানুষ থেকে মানুষে যেমন করোনা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, একইভাবে রাষ্ট্রগুলোর তড়িৎ সিদ্ধান্তে সংক্রমণ রোধে এসেছে সফলতা। আগামীর দিনগুলোয় এই কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখা এবং মানুষের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার উপর নির্ভর করছে করোনার ভবিষ্যত সংক্রমণ ভয়াবহতা।