১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বন্ধের ইশতেহার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দাসপ্রথা বন্ধ হয়ে গেলে তুলাভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে, এমন চিন্তা থেকে এই অমানবিক প্রথা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে দাসনির্ভর ১১টি অঙ্গরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যাবার ঘোষণা দিয়ে ১৮৬১ সালে গঠন করে ‘কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা’, যেটি পরিচিত হয়েছিল ‘কনফেডারেসি’ হিসেবে। আর লিংকনের নেতৃত্বকে স্বীকার করে নেয়া দাসপ্রথা নিষিদ্ধকারী ২৩টি ও দাসনির্ভর ৫টি অঙ্গরাজ্য মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচিত হয়েছিল ‘ইউনিয়ন’ হিসেবে। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ এই চার বছর ধরে ইউনিয়ন ও কনফেডারেসির মধ্যে চলে ‘আমেরিকান সিভিল ওয়ার’। যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় ৮ থেকে ১০ লক্ষ মানুষ। সিভিল ওয়ার শেষ হয় কনফেডারেসির পরাজয় ও বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে।
এই ভয়ঙ্কর প্রাণহানির যুদ্ধের একেবারে শেষ সময়ে আওতায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। সেই সময়, লিংকনের মৃত্যু, তার আততায়ীর ধরা পড়ার পর মৃত্যু আর কনফেডারেসি বাহিনীর প্রধানের আত্মসমর্পণ- পরপর এমন সব ঘটনার উত্তেজনার মাঝে, মানুষের অনেকটা অজান্তেই অসম্ভব হৃদয়বিদারক এক সমাধি রচিত হয়েছিল মিসিসিপি নদীর বুকে। সুলটানা নামের একটি জাহাজে করে কনফেডারেসির বন্দিশিবির থেকে বাড়ি ফিরছিল সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধবন্দীরা। মুক্তির আনন্দে পরিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে যখন তারা স্বপ্ন দেখছিল ভবিষ্যতের, তখন নিষ্ঠুর অর্থলোভ আর ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রাসাদের কূটকৌশলের বলি হয়ে এক হাজার আটশোটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছিল মিসিসিপির জলে। আজ থেকে দেড়শ বছর আগের সেই করুণ স্বপ্নসমাধি নিয়ে আজকের লেখা।
সুলটানা ছিল একটি বাষ্পচালিত ছোট জাহাজ যেগুলো স্টিমবোট নামেও পরিচিত। কাঠের তৈরি এই জাহাজটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৬৩ সালে। প্রথমে এর মালিক ছিল ক্যাপ্টেন প্রেস লোডউইক, পরবর্তীতে একটি কনসোর্টিয়াম জাহাজটি কিনে নেয়, ক্যাপ্টেন জন ক্যাস ম্যাসন ছিল অংশীদারদের একজন। দুই বছর ধরে এটি নিয়মিত সেন্ট লুইস বন্দর থেকে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স রুটে চলাচল করত, সে সময় যুদ্ধ চলার কারণে কখনো কখনো বহন করত সৈন্যদের।
এমনই এক দিন, ১৮৬৫ সালের ১৩ এপ্রিল, নিউ অরলিন্স এর উদ্দেশ্যে সেন্ট লুইস ছেড়ে যায় সুলটানা। সে সময় জাহাজের দায়িত্বে ছিল ক্যাপ্টেন জন ম্যাসন। ১৫ এপ্রিল ফোর্ড’স থিয়েটারে আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। জাহাজ তখন ইলনয়ের কাছাকাছি। কেয়ারো শহরে পৌঁছে লিংকনের মৃত্যুসংবাদ শুনে জাহাজ সেখানেই নোঙর করল ক্যাপ্টেন ম্যাসন। জাহাজ যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে দক্ষিণের স্টেটগুলোতে টেলিগ্রাফিক যোগাযোগ বন্ধ সিভিল ওয়ারের কারণে। তাই লিংকনের মৃত্যুর খবর ওদিকে যেতে সময় লাগবে। ম্যাসন একগাদা সংবাদপত্র কিনে নিল সেজন্য, যাতে দক্ষিণের দিকে যেতে যেতে খবরটা সবখানে পৌঁছে দিতে পারে।
মিসিসিপির ভিকসবার্গে পৌঁছানোর পর ম্যাসনের সাথে দেখা হল লেফট্যানেন্ট কর্নেল রুবেন হ্যাচের সাথে। হ্যাচ তখন ভিকসবার্গের চিফ কোয়ার্টারমাস্টার। ম্যাসন কথার এক ফাঁকে তাকে বলল, কিছুটা অর্থসংকটে আছে সে। হ্যাচ তখন ম্যাসনকে জানাল, একটা কাজ করতে পারলে বড় রকমের টাকা আয়ের সুযোগ আছে। কনফেডারেসি সম্প্রতি কয়েক হাজার যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিয়েছে। আলবামা আর জর্জিয়ার বন্দি শিবির থেকে মুক্তি দেয়া ইউনিয়নের এই অধিবাসীদের এনে রাখা হয়েছে ভিকসবার্গের কাছেই একটা প্যারোল ক্যাম্পে। সেখানে তারা অপেক্ষা করছে নিজেদের এলাকায় ফেরার জন্য। যে কোনো জাহাজ একদল বন্দিকে উত্তরে ফিরিয়ে নিলেই সেটার ক্যাপ্টেনকে প্রতিজন বন্দির বিনিময়ে ৫ ডলার আর প্রতি অফিসারের বিনিময়ে ১০ ডলার করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন সরকার। এখন হ্যাচ প্যারোল ক্যাম্প থেকে ১,৪০০ বন্দিকে ম্যাসনের জাহাজে করে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেবে। বিনিময়ে প্রতিজনের জন্য ম্যাসন তাকে দেবে দেড় ডলার। দুজনেরই পকেট ভারি হবে। এমনিই অর্থসংকট, সেখানে নিজের কাছে গোটা একটা জাহাজ থাকতে এত বড় দাঁও মারার সুযোগ ছাড়বে কেন ম্যাসন, সে রাজি হয়ে গেল হ্যাচের প্রস্তাবে।
জাহাজের মূল গন্তব্য ছিল নিউ অরলিন্স। তাই আগে ভিকসবার্গ থেকে জাহাজ নিয়ে সেদিকে গেল ম্যাসন। নিউ অরলিন্স থেকে প্রায় শ’খানেক যাত্রী তুলে নিল জাহাজে, সাথে নিল কিছু খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস। এবার ভিকসবার্গের দিকে রওনা হল সুলটানা। সেখানে পৌঁছাতে তখনও ঘণ্টাখানেক বাকি, এমন সময় জাহাজের চারটা বয়লারের একটাতে লিক ধরা পড়ল, খানিকটা ফাটল ধরেছে সেই বয়লারটিতে। জাহাজের গতি কমিয়ে দিল ম্যাসন যাতে বয়লারে বাষ্পের চাপ কম পড়ে, ধীরে ধীরে পৌঁছে গেল ভিকসবার্গে। এখান থেকেই বয়লার সারানো হবে আর জাহাজে তোলা হবে মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধবন্দিদের।
জাহাজ ভিড়ল ভিকসবার্গে। বন্দিদের নিয়ে আসা হল সেখানে। তাদের গন্তব্য উত্তরের বিভিন্ন স্টেট, তবে বেশিরভাগের বাড়ি ছিল ওহাইও, মিশিগান, ইন্ডিয়ানা, কিংবা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। একজন মেকানিক নিয়ে আসা হল বয়লারের ছিদ্র সারানোর জন্য। সেই মেকানিক চাইছিল বয়লারের ফেটে যাওয়া অংশটা পুরো খুলে নিয়ে নতুন অংশ জোড়া লাগিয়ে দিতে। কিন্তু ম্যাসন ভাবল, সেটা করতে গেলে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে। আর এর মধ্যে অন্য জাহাজ এসে নিয়ে যাবে বন্দিদের। এভাবে বয়লার সারাতে গেলে হাতছাড়া হয়ে যাবে বিশাল অঙ্কের টাকা। তাই ম্যাসন আর তার জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার নাথান উইনট্রিঙ্গার মিলে মেকানিককে বোঝালো, বয়লারের সেই অংশটা পাল্টানোর দরকার নেই, কেবল ফেটে গিয়ে বের হয়ে থাকা জায়গাটা হাতুড়ি দিয়ে সমান করে এরপর সেখানে হালকা একটা পাত লাগিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। তাদের কথামতই সারানো হল বয়লার। কাজ শেষ হয়ে গেল এক দিনের মধ্যেই। আর এই ফাঁকে বন্দিদের জাহাজে ওঠানোর কাজ সেরে ফেলল ম্যাসন।
এদিকে হ্যাচ আর ম্যাসনের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ১,৪০০ জনকে নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হ্যাচ ঐ প্যারোল ক্যাম্পে থাকা সকল বন্দিকে তুলে দিল জাহাজে। সুলটানার ধারণ ক্ষমতা ছিল ৩৭৬। এর মধ্যে নিউ অরলিন্স থেকে তোলা হয়েছে কিছু যাত্রী। আর প্যারোল ক্যাম্প থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি উঠল ২,১০০ জনেরও বেশি। জাহাজের এক কণা জায়গাও অবশিষ্ট রইল না, লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল সুলটানা। এদিকে দীর্ঘ দিন বন্দি থেকে তাদের অবস্থা তখন ভয়াবহ দুর্বল, অনেকেই ছিল অসুস্থ। জাহাজের প্রতিটি অংশ মানুষ দিয়ে ভরে আছে কানায় কানায়। এর সাথে আছে ১২০ টন ওজনের চিনির বস্তা যেগুলো নামানো হবে টেনেসি পৌঁছানোর পর। এদিকে প্রচণ্ড ওজন সইতে না পেরে জাহাজের ডেকের কোনো কোনো জায়গায় ফাটল ধরে ভেঙে পড়ে যাওয়ার দশা হল, কাঠের বিম দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হল সেগুলো। ১৮৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল ভিকসবার্গ থেকে রওনা হল সুলটানা।
তখন বন্যা চলছে। মিসিসিপির সমসাময়িক ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম বন্যা। কোথাও কোথাও কূল ছাপিয়ে তিন মাইল ছড়িয়ে পড়েছে নদীর পানি। ডুবে আছে সব, কূলের বড় বড় গাছের মাথাগুলো শুধু দেখা যাচ্ছে, বাকিটা পানির নিচে। ভয়ঙ্কর স্রোতের মধ্যে দিয়ে চলছে সুলটানা, দুই দিন ধরে চলতে হয়েছে স্রোতের প্রতিকূলে। ২৬ এপ্রিল জাহাজ পৌঁছাল আরকানসাসের হেলেনায়। সেখানে টি ডব্লিউ ব্যাঙ্কস নামের একজন ফটোগ্রাফার তুলে রাখলেন অতিরিক্ত যাত্রী দিয়ে পরিপূর্ণ জাহাজটির ছবি। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে টেনেসির মেমফিসে ভিড়ল সুলটানা। জাহাজের ক্রুরা সেখানে নামিয়ে দিল ১২০ টন চিনি। মধ্যরাতে মেমফিস ছেড়ে আবার রওনা হয়ে কিছু দূর গিয়ে একটা জায়গা থেকে কয়লা তোলা হল জাহাজে। এরপর উত্তরের দিকে শুরু হল মূল যাত্রা। যাত্রাপথ স্রোতের প্রতিকূলে।
জাহাজ চলছে। ২৬ পেরিয়ে ২৭ এপ্রিল দিবাগত রাত তখন। খরস্রোতা মিসিসিপির ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজ দুলে দুলে উঠছে খানিক পর পর। নদীর স্রোতের প্রচণ্ড গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বারবার হেলে পড়ছে এপাশ-ওপাশ। আর স্রোতের শক্তিও তো কম নয়, সেটা মোকাবেলা করার জন্য বয়লারে বাষ্পের চাপ বাড়িয়ে দিতে হয়েছে অনেকখানি। এমন করে এগুতে এগুতে জাহাজ তখন মেমফিস থেকে ৭ মাইল উত্তরে প্রমত্ত নদীর বুকে। রাত বাজে ২টা। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ হল বিস্ফোরণের। ফেটে গেল জাহাজের একটা বয়লার, সেকেন্ডের মধ্যে ফাটল আরও দুটো। সেই বিস্ফোরণ ডেক থেকে কিছু যাত্রীকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল নদীতে। জাহাজের একপাশ ভেঙে পড়ল। জাহাজের সামনের অংশে নিচে আছে ফার্নেস বক্স। সেদিকের ডেক ভেঙে পড়ল সেই বাক্সগুলোর উপর। আগুন ধরে গেল সেখানে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল আগুন। পানির উপরে সুলটানার গোটা কাঠামোটা পরিণত হল ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকুণ্ডে। বয়লার বিস্ফোরণের শব্দ আর আগুনের গরম হলকায় যাত্রীরা দিশেহারা হয়ে গেল, ছুটোছুটি শুরু করল পাগলের মত। সবাই ঝাঁপ দিতে থাকল নদীতে। খরস্রোতা নদীর বুকে তখন হাজারও মানুষ, অনেকেই সাঁতার জানে না, ডুবে যেতে লাগল তখনই। বাকিরা সাঁতরাচ্ছে প্রাণপনে। একে তো দুর্বল শরীর, তার উপর মৃত্যুভয়, একটু সাঁতরেই দ্রুত শক্তি ফুরিয়ে এল সবার। মাথায় তখন তাদের কেবল একটু কিছু আঁকড়ে ধরে বাঁচার তাগিদ। সেই মরণসাগরে আর কী আছে তখন, কেবল মানুষের শরীর ছাড়া, জাপটে ধরতে লাগল একজন আরেকজনকে। প্রবল স্রোতের গভীরে তলিয়ে যেতে লাগল শত শত মানুষ।
এদিকে ‘বোস্টনা টু’ নামের দক্ষিণের একটি জাহাজ তখন ছিল নদীতে। সেবারই প্রথম নদীতে নেমেছিল জাহাজটি, যাত্রা শেষে ফিরে আসছিল সেটি। বয়লার বিস্ফোরণের প্রায় এক ঘণ্টা পর রাত ৩টার দিকে সেটি পৌঁছাল জ্বলন্ত সুলটানার কাছে। বোস্টনা টু থেকে উদ্ধার করা হল তখনও বেঁচে থাকা কিছু মানুষকে। জাহাজের ভাঙা টুকরো ধরে ভাসছিল যারা, তারা স্রোতের সাথে এগিয়ে গেল মেমফিস সংলগ্ন কূলের দিকে। সেখানে নোঙর করা ছিল কতগুলো স্টিমবোট আর যুদ্ধজাহাজ। প্রাণে বাঁচতে চিৎকার করতে লাগল পানিতে ভাসতে থাকা মানুষগুলো। এক সময় তীরে থাকা জাহাজের ক্রুদের কানে গেল চিৎকারের শব্দ। প্রায় ডুবতে থাকা মানুষগুলোকে উদ্ধার করল তারা। এদিকে সুলটানার পুড়ে যাওয়া কাঠামোটা ভাসতে ভাসতে গেল আরও ছয় মাইল পশ্চিমে, বিস্ফোরণের সাত ঘণ্টা পর রাত প্রায় ৯টার দিকে ডুবে গেল গোটা জাহাজ। বেশ কয়েকটি জাহাজ, স্টিমবোট, নৌ বাহিনীর গানবোট নদীতে নেমে গেল উদ্ধারকাজে।
অনেক মানুষ জাহাজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার আগেই মারা গিয়েছিল অগ্নিদগ্ধ হয়ে, অনেকে মারা গিয়েছিল মিসিসিপির রক্ত হিম করা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে, আর অনেকে স্রোতে তলিয়ে গিয়ে। অনেকেই শরীরে আগুন লাগার পরেও ঝাঁপ দিয়েছিল পানিতে। আরকানসাসের উপকূলে ডুবে থাকা গাছগুলোর মাথায় আটকে বেঁচে গিয়েছিল কেউ কেউ, সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের। সব মিলিয়ে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল প্রায় ৭০০ জন মানুষকে। দ্রুত তাদের পাঠানো হয় মেমফিসের হাসপাতালগুলোতে। তাদের মধ্যেও আরও দুইশ জন মারা যায় নদীতে পড়ার আগেই শরীরের অনেক অংশ আগুনে ঝলসে গিয়েছিল বলে। একটানা কয়েক মাস ধরে নদীতীরে ভেসে এসেছিল লাশ। অনেকের লাশও পাওয়া যায় নি আর। সুলটানার অফিসারেরা, যাদের মধ্যে ছিল ক্যাপ্টেন ম্যাসনও, সবাই তলিয়ে গিয়েছিল মিসিসিপির স্রোতের মধ্যে।
যদিও কদিন আগে এই যুদ্ধবন্দীরা ছিল শত্রুপক্ষের লোক, তবুও মেমফিসের মানুষ এই ভয়াবহ ঘটনায় শোকাহত হয়েছিল। বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে সেখানে নিয়ে আসার পর তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিল তারা, এমনটাই লিখেছে সে সময়ের পত্রিকাগুলো। শিকাগো অপেরা ট্রুপ নামের একটা গানের দল আয়োজন করেছিল চ্যারিটি শো’র, যেখানে সে সময় উত্তোলন করা হয় ১,০০০ ডলার।
এই মর্মান্তিক ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে পরবর্তীতে জানা যায় কেন বিস্ফোরিত হয়েছিল বয়লারগুলো। মূল কারণ ছিল দুটি। বয়লারের মধ্যকার পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা আর ধারণক্ষমতার চেয়েও মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বহন করা। বিশাল সংখ্যক যাত্রী থাকায় জাহাজের উপরের অংশ খুব ভারি হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে নদীর বাঁক ও ঢেউয়ের ধাক্কা এ দুয়ের ফলেই জাহাজ বারবার যে কোনো এক দিকে হেলে পড়ছিল। জাহাজের কাঠামোর মধ্যে পাশাপাশি বসানো চারটা বয়লার ছিল ভেতর দিয়ে সংযুক্ত। বয়লাগুলোর ভেতরের পানির উচ্চতা খুব বেশি ছিল না। যখন জাহাজ কোনো এক পাশে ঝুঁকে পড়ছিল বয়লারের পানিও সাথে সাথে সেদিকে হেলে পড়ছিল। ফলে বয়লারগুলোর একপাশ খালি হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে আগুন তো জ্বলছেই বয়লারের ভেতর। পানি ছাড়াই খালি বয়লারের একপাশ তাই উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। এমন সময় যখন জাহাজ আবার অন্যদিকে ঝুঁকে পড়ল, হুট করে পানি এসে পড়ল বয়লারের খালি অংশে। সেটা তখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকায় অনেক পরিমাণ পানি বয়লারের গা স্পর্শ করার সাথে বাষ্পীভূত হয়ে গেল। হঠাৎ অমন করে বাষ্প তৈরি হওয়ায় চাপ পড়ল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
এভাবেই বারবার জাহাজটি এদিক ওদিক কাত হচ্ছিল আর বয়লারগুলোর ভেতর একই ঘটনা ঘটছিল। এক সময় গিয়ে প্রচণ্ড চাপের কারণে বিস্ফোরিত হয় সেগুলো। আর দুদিন আগে একটা বয়লারের ফাটল ঠিক করতে গিয়ে তো ভালো মত কাজই করা হয় নি। যদি বয়লারের ভেতরে পানির উচ্চতা বেশি রাখা যেত সব সময়, তাহলে কাত হলেও পানি কোনো এক পাশে সরে গিয়ে অন্য পাশকে অতিরিক্ত উত্তপ্ত করে দিত না, হয়ত তখন রক্ষা পাওয়া যেত এই বিস্ফোরণ থেকে।
সে রাতের প্রলয়ঙ্করী ঘটনায় মারা গিয়েছিল ১,৭০০’রও বেশি মানুষ, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গণনা অনুসারে ১৮০০ জন। উত্তর আটলান্টিকে এর ৪৭ বছর পর টাইটানিক ডুবে মারা গিয়েছিল ১,৫১২ জন। আর সে রাতে প্রবল লড়াই করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিল সাড়ে পাঁচশো মানুষ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যুদ্ধ ব্যতীত নদীপথে প্রাণহানির ঘটনাগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। অথচ সে সময়কার সংবাদপত্রগুলো এই খবরটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে নি। একদিকে যুদ্ধ শেষ হচ্ছিল, অন্যদিকে খুন হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট লিংকন। লিংকনের আততায়ী জন উইকস বুথ ধরা পড়ার পর মারা গিয়েছিল এক ইউনিয়ন সৈন্যের গুলিতে, আত্মসমর্পন করেছিল কনফেডারেসির জেনারেল রবার্ট এডোয়ার্ড লি। এমন যখন পরিস্থিতি, তখন “প্রেসিডেন্ট খুন!” কিংবা “লি’র আত্মসমর্পণ!” অথবা “বুথ নিহত!” এই ধরনের শিরোনামের ভীড়ে সুলটানার করুণ পরিণতির কথা আর ঠাঁই পায় নি পত্রিকার কাটতির বাজারে।
The Sultana Tragedy: America’s Greatest Maritime Disaster বইয়ের লেখক জেরি পটার লিখেন, “এই ঘটনাটি খুব একটা প্রেস কাভারেজ পায় নি, কারণ, যে স্থানে এবং যখন এটি ঘটেছিল এবং যারা এর শিকার হয়েছিল- এসবের কোনোটিই জানার আগ্রহ সৃষ্টির মত ছিল না। যারা মারা গিয়েছিল তারা কেবল কিছু তালিকাভুক্ত মানুষই ছিল, তাদের কোনো কীর্তি ছিল না ইতিহাসের পাতায়।” তিনি আরও লিখেন, গোটা জাতি তখন কেবল একটা দীর্ঘ চার বছরের রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষ করেছে। সে যুদ্ধে মারা গেছে ছয় লাখের বেশি মানুষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে, গেটিসবার্গ, এন্টিয়েটাম, চিকামোগা আর শিলোর ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর কথা পড়তে পড়তে। মনে হয় মৃত্যু তাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল।”
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার দায়ে বিচার হয় নি কারোরই। ক্যাপ্টেন ফ্রেডেরিক স্পিড নামের একজন ইউনিয়ন অফিসার, যে একুশশো বন্দিকে প্যারোল ক্যাম্প থেকে ভিকসবার্গে পাঠিয়েছিল, তাকে সুলটানার অতিরিক্ত যাত্রীবহনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে সামরিক আদালতে রায় দেয়া হয়। কিন্তু সে রায় খারিজ করে দেন সেই আদালতের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে দায়িত্বরত একজন বিচারক। প্যারোল ক্যাম্প থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের ভিকসবার্গে পাঠালেও ক্যাপ্টেন স্পিড সারা দিন ক্যাম্পেই ছিল এবং একজনকেও সে নিজে জাহাজে তুলে দেয় নি, এ কারণেই নির্দোষ খালাস পায় সে। ক্যাপ্টেন উইলিয়ামস, যে সরাসরি তাদেরকে জাহাজে তুলে দিয়েছিল, সে ছিল সেনাবাহিনীর অফিসার। এ কারণে নিজেদের লোক হিসেবে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলতে আগ্রহী হয় নি সেনাবাহিনী। এদিকে লেফট্যানেন্ট কর্নেল হ্যাচ, যে ছিল ঘটনার অন্যতম মূল হোতা, ক্যাপ্টেন ম্যাসনের সাথে যে ঘুষের বিনিময়ে বন্দিবহনের চুক্তি করেছিল, সে ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে। ফলে তাকে আর সামরিক আদালতের মুখোমুখি করা যায় নি। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি দাঁড়িয়েছিল এই যে, ইতিহাসের এই করুণতম মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী ছিল না কেউই।
১৮৮৯ সাল থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো একসাথে ‘ন্যাশনাল সুলটানা সারভাইভারস এসোসিয়েশন’ সংগঠনের সদস্য হিসেবে নিয়মিত একত্রিত হতেন। ১৯২০ এর দশকের শেষ দিকে তাদের প্রায় কেউই আর বেঁচে ছিলেন না। ১৯৩৬ সালে সুলটানার ডুবে যাওয়ার ৭১ বছর পর মারা যান জাহাজের যাত্রী হিসেবে বেঁচে থাকা শেষ ব্যক্তি অ্যালবার্ট নরিস, ৯৪ বছর বয়সে।
সুলটানা ডুবে যাবার দেড়শ বছর পর, ২০১৪ সালে হিস্ট্রি ডিটেকটিভস নামের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের অনুসন্ধানে বের হয়েছে সুলটানার দুর্ঘটনার পেছনে দায়ীদের ভয়ঙ্কর সব প্রাসাদ রাজনীতির তথ্য। ১৮৬২ সালে রুবেন হ্যাচ কোয়ার্টারমাস্টার থাকাকালীন তাকে চাকরিচ্যুত করে তার বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে অভিযোগ আনা হয়েছিল দুর্নীতি ও অযোগ্যতার কারণে। তার বড় ভাই ওজিয়াস হ্যাচ সে সময় ছিল ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট, একই সাথে প্রেসিডেন্ট লিংকনের ঘনিষ্ট বন্ধু ও উপদেষ্টা। ওজিয়াস হ্যাচ লিংকনের নির্বাচনের সময় অর্থ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই সূত্রে ওজিয়াস তার ছোট ভাইয়ের জন্য লিংকনের কাছ থেকে একটা চিঠি লিখিয়ে নেয় যাতে লেখা ছিল, রুবেন হ্যাচের বিচারকাজ বন্ধ করে তাকে যেন আবার দায়িত্বে ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং তাকে লেফট্যানেন্ট কর্নেলের পদে উন্নীত করা হয়। রুবেন হ্যাচকে সরাসরি না চিনলেও রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত রাখতে সেই চিঠি লিখে দিয়েছিলেন লিংকন। একই রকম আরও দুটি চিঠি লিখিয়ে নেয়া হয় তৎকালীন মার্কিন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল ইউলিসেস এস গ্রান্ট ও সামরিক সচিব এডউইন স্ট্যানটনের কাছ থেকে। সুলটানার দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে লিংকনের কাছ থেকে আরেকটি চিঠি লিখিয়ে নেয়া হয়েছিল রুবেন হ্যাচকে কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার জন্য।
তখনকার মার্কিন সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টারদের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মন্টেগোমারি মেইজ রুবেন হ্যাচকে দায়িত্বে ফিরিয়ে নেবার বিরুদ্ধে থাকলেও প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান ও সামরিক সচিবের এই তিন চিঠির বদৌলতে হ্যাচকে কোয়ার্টারমাস্টারের দায়িত্বে বহাল রাখা হয়। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে চিঠিগুলো। সামরিক আদালতে তিনবার তলব করা হলেও সে আসে নি কেবল এই ক্ষমতার জোরে, তাছাড়া তখনও তো জানা যায় নি হ্যাচের অর্থলোভই ছিল এই প্রাণহানির অন্যতম কারণ।
ভিকসবার্গের কাছে স্থাপিত প্যারোল ক্যাম্প থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের জাহাজে করে ফেরত পাঠানোর তদারকিতে ছিল রুবেন হ্যাচ। সে সময় সুলটানার মত আরও দুটো স্টিমবোট সেখানে এসেছিল তাদের নিয়ে যেতে। কিন্তু নিজের পকেট ভারি করার জন্য হ্যাচ সবাইকে তুলে দেয় ক্যাপ্টেন ম্যাসনের জাহাজ সুলটানায়। এমনকি সুলটানার এই অবস্থা দেখে সহকারি কোয়ার্টার মাস্টার উইলিয়াম কার্নস তাকে বলেছিল ছয় থেকে আটশ যাত্রী অন্য জাহাজে তুলে দিতে, কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করে নি হ্যাচ।
আব্রাহাম লিংকন ইতিহাসের প্রশংসিত এক প্রশাসক ছিলেন, হয়ত এমন কোনো দুর্ঘটনার কথা তার চিন্তায় আসে নি। কিন্তু এই প্রাণহানির দায় বর্তায় তার উপরেও, কেননা অযোগ্য আর দুর্নীতিবাজ এক সৈন্যের অবস্থান পাকাপোক্ত হয়েছিল তারই অনুমোদনে। হ্যাচের টাকার লোভ আর মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাজনীতি এই দুইয়ে মিলে শেষ করে দিয়েছিল এক হাজার আটশো মানুষের প্রাণ। লিংকন নিহত হয়েছিলেন আততায়ীর হাতে, হ্যাচের কিছুই হয় নি, ১৮৭১ সালে তার মৃত্যু হয় স্বাভাবিক ভাবেই। লিংকনের মৃত্যুর চার বছর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন সেনাপ্রধান ইউলিসেস এস গ্রান্ট। তার মানে, দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠিতে চারিত্রিক সততার স্বীকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল সুলটানার সলিলসমাধির অন্যতম কারিগর রুবেন হ্যাচ।
ওহাইওর এক ইউনিয়ন সৈন্য ছিল জন ক্লার্ক এলাই। বন্দিশিবিরে ডায়রি লিখত সে। ক্ষুধার্ত, নোংরা আর অসুস্থ হয়ে দিন কাটাতে কাটাতে সে ডায়রিতে লিখেছিল, “বন্ধু আর ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে আর একটা ক্রিস্টমাসও কি পাব না?” মুক্তির বার্তা পাবার পর যখন সে উঠল সুলটানায়, জাহাজ ছাড়বার আগে ডায়রিতে লিখেছিল, “ওহ! আজকে আমার আমার জীবনে মনে রাখবার মত উজ্জ্বলতম দিন।” সেই ডায়রিটি পাওয়া যায় মিসিসিপির জলে ডুবে এলাইয়ের মৃত্যুর পর। তার উজ্জ্বলতম দিনের স্মৃতি আর আনন্দময় আরেক ক্রিস্টমাসের স্বপ্ন এক নিমিষেই শেষ করে দিয়েছিল অর্থলোভ আর ক্ষমতার কূটকৌশল।