মেক্সিকোর উত্তর-মধ্য প্রদেশের ছোট্ট একটি শহর তাওস। জুলিয়া রবার্ট, ডেনিস হপার, ডি. এইচ. লরেন্স, ডোনাল্ড রামসফেল্ডের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের এলাকা এটি। তাওসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেকোনো পথিক চোখের দেখায় এটিকে আমেরিকার অন্য আর দশটি শহর থেকে আলাদা করতে পারবেন না। শান্ত, স্নিগ্ধ, গোছানো- এক কথায় মন ভালো করা একটি জায়গার নাম তাওস। চোখের কাজ শেষ, এবার কান খুলে শুনুন। তাওস মোটেই শান্ত-নিস্তব্ধ কোনো শহর নয়। ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে স্থানীয় অধিবাসীরা এবং বেশ কিছু পর্যটক দাবি করেন তারা অদ্ভুত এক ধরনের গুনগুন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। সেই থেকে অনবরত চলতে থাকা এই গুঞ্জনের নাম দেয়া হয়েছে ‘তাওস হাম’। কোথা থেকে আসছে এই আওয়াজ, কেনই বা হচ্ছে এমন অদ্ভুত গুঞ্জন? আজও সে শব্দের উৎসের কোনো সন্ধান মেলেনি, মেলেনি এই অমীমাংসিত রহস্যের কোনো কূলকিনারা।
তাওস হামের বর্ণনা দেয়া হয়েছে মৃদু, অনবরত গুনগুন করা একটি শব্দ হিসেবে। হঠাৎ করে শুনলে মনে হবে বেশ কাছেই কোনো ইঞ্জিনের গাড়ি বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আরো একটি মজার ব্যাপার হলো, স্থানীয়দের মধ্যে সবাই কিন্তু তা শুনতে পায় না। স্থানভেদে উৎসের সাথে দূরত্বের সাথে ভারসাম্য রেখেই হয়তো কারো কারো পৌঁছায়নি তাওস হাম। তবে যারা শুনতে পায় তাদের কাছে ব্যাপারটি খুবই কষ্টদায়ক। কখনো থামে না এই গুঞ্জন, কখনো না। ঘুমের মধ্যেও তারা শুনতে পান এই শব্দ, রাতের বেলা যেন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গুঞ্জরন। ঘরের মধ্যে কানে আঙুল দিয়ে বসে থেকে কিংবা কানে ইয়ার প্লাগ গুঁজেও শব্দ এড়াতে পারেননা তারা। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা- কোনোটিই বাদ যায়নি তাওস হামের ক্ষেত্রে। পাথরে পরিণত হওয়া হিপ্পিদের কান্না, সরকার কর্তৃক জনগণের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার কূটকৌশল, মাটির নিচে থাকা ভিনগ্রহবাসীদের ইউএফওর ইঞ্জিনের শব্দ- আরও কতো যুক্তি যে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে প্রথমবারের মতো হাম বা গুঞ্জনের ব্যাপারটি কর্তৃপক্ষের কানে তোলা হয় বলে জানা গেছে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটি এমন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে, বাধ্য হয়ে স্থানীয় অধিবাসীরা কংগ্রেসে তাওস হামের কথা উল্লেখ করেন। এমন অভূতপূর্ব সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায় তা নিয়ে বিপাকে পড়ে যান সংশ্লিষ্টরা। প্রথমে একটি জরিপ চালানো হয় এই সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে সেই বিষয়ে। স্থানীয়দের মধ্যে যারা শব্দটি ক্রমাগত শুনতে পেতেন তাদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। শহরব্যাপী বেশ কিছু যন্ত্রপাতি বসানো হয় যাতে শব্দের উৎসটুকু অন্তত খুঁজে পাওয়া যায়।
ইউনিভার্সিটি অফ নিউ মেক্সিকোর অধ্যাপক জো মুলিনস তাওস হাম নিয়ে একটি গবেষণা চালান। তাওসের বাসিন্দাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ তাওস হাম শুনতে পান বলে জানান, তারা অবশ্য কেউই এটিকে প্রাকৃতিক কোনো শব্দ বলে বিশ্বাস করতেন না। শ্রোতাদের অনেকের বাড়িতে শব্দ এবং কম্পন নির্ণায়ক সংবেদনশীল যন্ত্র স্থাপন করা হয়, কিন্তু বেশ কিছুদিন পরীক্ষা করেও অস্বাভাবিক এই শব্দের কোনো উৎস বা কারণ বের করতে পারেননি গবেষকরা। শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি এতোই কম যে কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যেহেতু ৪০০ মানুষের ওপর চালানো এই জরিপে মাত্র ২ শতাংশ শ্রোতা পাওয়া গেছে, কাজেই চিকিৎসকরা একে ‘গণমনস্তাত্ত্বিক রোগ’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা তা মানবে কেন?
এবার শুরু হয় একের পর এক প্রশ্নের খেলা। ২ শতাংশ শ্রোতা তো অনবরত শুনতে পান এই শব্দ, তাছাড়াও বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কিংবা কখনো কখনো শুনতে পান তাওস হাম। কেন এই শব্দ সবাই একসাথে শুনতে পায় না? জরিপে দেখা গেছে নারীদের মধ্যে এই শব্দ শুনতে পাওয়ার প্রবণতা বেশি, এটাই বা কেন হচ্ছে? ১৯৯০ সালের দিকে যদি এটি প্রথমবার শুনতে পাওয়া যায়, তাহলে তার আগে কী এটি ছিল না? যদি না-ই থাকবে তাহলে হঠাৎ করে কোত্থেকে এলো এই গুঞ্জন? যারা এই শব্দটি শুনতে পান তাদের কয়েকজন জানান, শব্দ শোনার পর তাদের ভুগতে হয়েছে নানা সমস্যায়। বমি বমি ভাব হয় কারো, কেউবা নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কথা জানিয়েছেন, কারো বা মাথা ঘোরে কিংবা ব্যথা করে। এই লক্ষণগুলোর কারণই বা কী?
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোতে ট্রিনিটি টেস্ট বা প্রথম পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল। এই বিস্ফোরণের ফলেই কি উৎপত্তি ঘটেছে এমন অদ্ভুত শব্দের? আবার কথিত আছে, ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন তাওসের কাছে অবস্থিত রসওয়েলে একটি ইউএফও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে মার্কিন বিমানবাহিনী। তাদের এই লুকোচুরি মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে সন্দেহ। এখন কথা উঠছে, ঐ ইউএফও ক্রাশ হওয়াই কি তবে তাওসের এই গুঞ্জনের জন্য দায়ী? প্রশ্ন অনেক, উত্তর মেলে না কোনোটিরই।
রহস্যের সমাধান করতে এগিয়ে আসেন গবেষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদসহ আরও অনেকেই। বলা হয়, মানুষ বাস করে এক অদ্ভুত শব্দময় মায়ার জগতে যার বেশির ভাগ শব্দই হারিয়ে যায় বেখেয়ালে। শুনে মনে হতে পারে, একটি শব্দের উৎস নির্ণয় করা এমন কী কঠিন কাজ? কিন্তু শুনতে সহজ মনে হলেও, কাজটি প্রায় দুঃসাধ্য। ট্রাফিক, নৌকা, উড়োজাহাজ, পোকামাকড়, শিল্প কারখানায় প্রতিনিয়ত চলমান যন্ত্র, বাতাস, খনি খনন- এতকিছুর শব্দ ছাপিয়ে খুব কম ফ্রিকোয়েন্সির একটি গুঞ্জন তাওস হামের উৎস নির্ণয় করা চাট্টিখানি কথা নয়। ধারণা করা হচ্ছে, তাওস হামের ফ্রিকোয়েন্সি মাত্র ২০ থেকে ১০০ হার্জ। একটি শব্দ শুনলাম আর তার পিছু নিয়ে দেখে আসলাম কোত্থেকে আসছে শব্দটি- এতো সহজ কোনো বিষয় নয় এটি।
গবেষকরা বলেন, বাইরের দুনিয়ার কাছে তাওস হামের ব্যাখ্যা না চেয়ে নিজের মনের কাছে আগে জিজ্ঞেস করুন কী হতে পারে এর কারণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো পেয়ে যাবেন সমাধান। আচ্ছা, আপনার জিহ্বার স্বাদ কেমন? নাকের গন্ধ কেমন হয়? কানের শব্দ কেমন শোনায়? বোকার মতো প্রশ্ন মনে হচ্ছে? এই সাধারণ প্রশ্নগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে কয়েক দশকের রহস্যের সমাধান। আমরা খেয়াল না করলেও আমাদের কান কিন্তু নিজেই অনেক শব্দ তৈরি করে। কিন্তু শব্দগুলো যেহেতু খুব সূক্ষ্ম আর আমরা সারাক্ষণ গান, টেলিভিশন, ভিডিও গেম বা কোলাহলময় নাগরিক জীবনের শব্দের সাগরেই ডুবে থাকি, খুব মনোযোগ দিয়ে না শুনলে আলাদা করে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। এই ঘটনাকে বলে ‘স্পন্টেনিয়াস অটোঅ্যাকুইস্টিক এমিশন’। অনেকের কান বাজে বা কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে শব্দ হয় বলে ‘টিনিটাস’ নামক যে রোগের কথা আমরা জানি, তার থেকে এই ব্যাপারটি একটু আলাদা। কান খাড়া করে আশপাশের শব্দের প্রতি মনোযোগ দেয়ার কারণে শ্রোতারা হয়তো শুনতে পেয়েছেন তাওস হাম।
তাওসের বাসিন্দাদের মধ্যে ছোট্ট একটি অংশের তাওস হাম শুনতে পাওয়ার বিষয়টিও গোলমেলে। মাত্র ২ শতাংশ লোক এটি শুনতে পেয়েছে। তার মানে নিশ্চয় এই না যে বাকি ৯৮ শতাংশ লোক কানে কম শোনে। বরং যারা তাওস হাম শুনতে পেয়েছেন তাদেরকে অস্বাভাবিক প্রখর শ্রবণ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আখ্যা দিলেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। গবেষকদের অনেকেই অবশ্য গোটা ব্যাপারটিকে ‘অডিটরি হ্যালুসিনেশন’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এটি কোনো মানসিক অসুখের ইঙ্গিত দেয় না, বরং খুব স্বাভাবিক একটি শারীরিক সমস্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিউরোলজিস্ট অলিভ্র স্যাকস বিষয়টিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার ‘হ্যালুসিনেশনস’ (২০১২) বইটিতে। তাওস হামের শ্রোতাদের কয়েকজন তাওসের বাইরে গিয়েও শব্দটি শুনতে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। কাজেই একে হ্যালুসিনেশন বলাও অমূলক নয়, যদিও এতো মানুষের একসাথে একইরকম হ্যালুসিনেশন কীভাবে হয় সে প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি। অন্যদিকে তাওসের নিচে ভূমির অভ্যন্তরে যে ম্যাগমা আছে তা থেকেও হতে পারে এমন শব্দ- এমনটাই দাবি করেছেন নিউজিল্যান্ডের কতিপয় বিজ্ঞানী।
তাওস হাম ছাড়াও বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু অমীমাংসিত শব্দ রহস্যের এখনো সমাধান পাওয়া যায়নি। ১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে শোনা যায় ‘ব্রিস্টল হাম’। ২০০৪ সালে কানাডার ভ্যাংকুবারে, ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর নিউ জিল্যান্ডের অকল্যান্ডে এবং ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় রহস্যময় হাম বা গুঞ্জন শোনা যায়। বিজ্ঞানের ভাষায়, কোনোকিছু ‘ব্যাখ্যা করা হয়নি’ মানেই এই নয় যে তা ‘ব্যাখ্যাতীত’। একদিন হয়তো ‘তাওস হাম’ রহস্যের সমাধান হবে এমনটাই প্রত্যাশা গুঞ্জন শ্রোতাদের।
ফিচার ইমেজ: mysterybooms.com