১৯১৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর। আমেরিকার টেনেসি অঙ্গরাজ্যের আরউইন শহরে সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে। অন্যান্য দিনের মতো কর্মব্যস্ততায় নিজেকে ভুলিয়ে না রেখে দলে দলে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে স্থানীয় রেল স্টেশনের কাছে।
একজন দু’জন করে প্রায় আড়াই হাজার মানুষে ভরে উঠলো রেল স্টেশনটি। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি সেদিন আসেননি। বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুরাও এসে উপস্থিত হয়েছিল সেখানে।
সবার চাপা কথার স্বরে গমগম করছে পুরো এলাকা। প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে একটি ফাঁসি কার্যকর করার আয়োজন চলছে মহা সমারোহে। আর এটি অন্যান্য ফাঁসির ন্যায় কোনো সাধারণ ফাঁসির ঘটনা ছিল না। তার জন্যেই টেনেসি শহরের দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ নিজের কর্মব্যস্ততা ভুলে, চলে এসেছিল ইতিহাসের সাক্ষী হতে। মানবতা সেদিন ম্যারি নামক এক হাতির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল ফাঁসির মঞ্চ সাজিয়ে!
বিশেষভাবে ভারবহনে সক্ষম- এমন একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেনকে ট্রেনের সাথে যুক্ত করে নিয়ে আসা হল মঞ্চের কাছে। হাতিটির মালিক চার্লস স্পাইকস জনসম্মুখে ম্যারির অপরাধের বর্ণনা করলেন। আর সেটি শুনেই ভিড় করা হাজারো উৎসুক জনতা হয়ে উঠলেন জিঘাংসাপরায়ণ। চাপা গুঞ্জন এবার গর্জনের দিকে মোড় নিতে থাকলো।
উপায়ান্তর না দেখে দ্রুত হাতিটির গলায় ক্রেনের শেকল শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হলো। অপারেটরকে নির্দেশ দেওয়া মাত্রই চোখের পলকেই শক্তিশালী ক্রেনটি প্রায় পাঁচ টন ওজনের ম্যারিকে মাটি থেকে বিশ ফুট সমান উচ্চতায় উঠিয়ে ফেললো। আর ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তিটা।
ক্রেনের শেকল ছিঁড়ে বিশ ফুট উচ্চতা থেকে ভারি শরীর নিয়ে ম্যারি আছড়ে পড়ে মাটিতে। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়, শরীরের কয়েক জায়গা থেঁতলে যায় এবং গলায় শেকলের জন্যে চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।
উঠে দাঁড়াতে পারে না ম্যারি। চার্লি স্পাইকস ভাবে, হয়তো মানুষের মনে খানিকটা মায়া হবে, এবারের মতো ছেড়ে দেবে পঙ্গুপ্রায় এই হাতিটিকে। মুমূর্ষু ম্যারিকে বাঁচাতে হাত জোড় করে উপস্থিত জনতার কাছে মিনতি করতে থাকলেন চার্লি।
কিন্তু সেদিন মানবতার ঘাড়ে হিংস্রতা আর বর্বরতা ভর করেছিল। মুহূর্তেই জনসমাবেশ ফেটে পড়লো ম্যারির ফাঁসি কার্যকরের জন্য। অর্ধমৃত ম্যারিকে আবার শেকল পরানো হয়।
এবার আরও শক্ত করে বাঁধা হলো শেকল, যেন ছিঁড়ে না যায়। আবারও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ক্রেনের সাহায্যে মুহূর্তেই আগেরবারের চাইতেও বেশি উচ্চতায় উঠে গেলো ম্যারির শরীর। এবার যেন যন্ত্রেরও মায়া হলো না আর, না শেকল ছিঁড়লো, না অন্য কোনো বিপত্তি ঘটলো।
গলায় ফাঁস লেগে ছটফট করতে শুরু করলো ম্যারি। উপস্থিত দর্শক যেন তখন আচ্ছন্ন ছিল আদিম বন্যতায়। একটা বোবা প্রাণীর ছটফটানি, তাদের মনে কোনো মায়া সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং এই ছটফটানিকেই উপভোগ করছিলেন তারা।
অবশেষে গলায় ফাঁস লেগে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ম্যারি। উপস্থিত জনতাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবার মাধ্যমে কলঙ্কিত করে মানব-সভ্যতার ইতিহাস।
ম্যারির জীবনগল্পের শুরুটা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে চার্লি স্পাইকস নামে একজন লোকের মাধ্যমে। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই সার্কাস দলে খেলা দেখাতো চার্লি। অবশ্য পরবর্তীকালে সে খুলে বসে নিজেরই একটি সার্কাস কোম্পানি, যার নাম ছিল স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো। ভ্রাম্যমাণ এ দলটি কসরত প্রদর্শনের পাশাপাশি ভাঁড়ামো, দড়াবাজিকর, সিংহের খেলা, এমনকি হাতিদের খেলাও দেখাতো।
ম্যারির বয়স যখন চার বছর, তখন ওকে কিনে এনেছিল স্পার্কসের বাবা। পরে স্পার্কস ও তার স্ত্রী অ্যাডি মিচেল মিলে নিজেদের সন্তানের মতো করে আদর-যত্নে লালন পালন করেছেন ম্যারিকে।
ম্যারি নাম হলেও বিগ ম্যারি নামেই বেশি পরিচিত পেয়েছিল এশিয়ান প্রজাতির এই হাতিটি। পাঁচ টন ওজনের ম্যারি শুধুমাত্র দৈহিকভাবেই বড় ছিল না, বরং অন্য যেকোনো হাতির চাইতেও অনেক বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল এই মেয়ে হাতিটি।
মাথার উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো, বাদ্যযন্ত্র বাজানো এবং এমনকি উড়ে আসা বেসবল ধরতে পারার জন্য এই দৈত্যাকৃতির হাতিটিকে দেখতে প্রচুর লোকজনের ভিড় হতো, যা সামাল দেয়াটাও মুশকিল হয়ে যেতো। নিঃসন্দেহে ম্যারি ছিল যেকোনো কোম্পানির একমাত্র প্রধান আকর্ষণের মতো কিছু। আর তাই বছরের পর বছর জুড়ে ম্যারি নিজের কসরত দেখিয়ে স্পার্কস সার্কাস শো’র জন্যে লোকজনকে আকৃষ্ট করতো।
স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো’র জনপ্রিয়তা বাড়ছিল দিগ্বিদিকে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ দল হওয়ায় নানা জায়গায় এমনিও খেলা দেখাতো তারা। এসবের অংশ হিসেবেই একবার তারা ভার্জিনিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। সাথে সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ ম্যারিও ছিল। কিন্তু কে জানত, এটাই হবে ম্যারির শেষ যাত্রা?
ম্যারি যেমন স্পার্কস সার্কাস দলের প্রধান আকর্ষণ ছিল, ঠিক তেমনি নিঃসন্তান চার্লি স্পার্কস ও অ্যাডি র্যাচেল দম্পতির কাছেও নিজের সন্তানের মতোই ছিল। তাই ম্যারিকে দেখভালের জন্য যে মাহুতই রাখা হোক না কেন, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হতো, যত্নআত্তির কোনো কমতি যাতে না হয়। উদ্দেশ্য- ভুলেও যাতে রেগে না যায় পাঁচ টনের এই বিশালদেহী হাতিটি।
কিন্তু ভার্জিনিয়া যাওয়ার আগে, কোনো এক অদ্ভুত কারণে, ম্যারির পুরনো মাহুত কাজ থেকে অব্যাহতি নেয়। যদিও চার্লির কথাতেই ম্যারি উঠতো-বসতো এবং এমনকি শান্তও থাকতো, তবুও ম্যারির জন্য একজন মাহুত আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। তবে ম্যারির ট্রেইনার পল জ্যাকোবি সার্বক্ষণিক ম্যারির দেখাশোনা করতো।
১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্য স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো সার্কাস কোম্পানিটি ম্যারিসহ আরো কয়েকটি হাতি নিয়ে ভার্জিনিয়ার সেইন্ট পল এলাকায় আসে। আস্তে আস্তে লোকেরা ম্যারিকে দেখতে ভিড় জমাতে শুরু করে মূল অনুষ্ঠান হওয়ার আগেই।
চার্লি তার লোকবল দিয়ে শহরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালসমূহে রঙিন পোস্টার লাগিয়ে সার্কাসের দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছিলেন। শহরের দেয়ালে লাগানো সেইসব পোস্টার চোখে পড়ে স্থানীয় এক হোটেলের কর্মচারী ওয়াল্টার রেড এলড্রিজের।
পল জ্যাকোবির কাছে মাহুত হওয়ার আবদার নিয়ে যায় রেড এলড্রিজ। যেহেতু তখন কোনো মাহুত ছিল না, তাই চার্লির সাথে পরামর্শ করে হাতিগুলোর দেখাশোনা, পরিচর্যা ও খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে ‘আন্ডারকিপার’ হিসেবে রেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মূল কাজের পাশাপাশি হাতিগুলোকে প্যারেডে পাঠানোর জন্য কীভাবে প্রস্তুত করতে হবে, তাও শিখিয়ে দেওয়া রেডকে। সেইসাথে রেডকে এও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হাতিগুলোকে কোনোভাবেই যেন চটিয়ে দেওয়া না হয়, তাতে ঘটে যেতে পারে তুলকালাম কাণ্ড!
স্পার্কস সার্কাস দল ভার্জিনিয়া ছেড়ে টেনেসি প্রদেশের কিংসপোর্ট এলাকায় আসে নতুন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্যে। শহরের সমস্ত লোকজন রাস্তার দু’পাশে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিগ ম্যারি, টোপ্সি, ওলি, ম্যাটের সাথে দুটো বাচ্চা হাতিকে দেখার জন্যে। হাতিগুলোও নিজেদের শুঁড় নাড়িয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল।
১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ। জমজমাট সার্কাস প্রদর্শনীর গেট খুললো নির্ধারিতে সময়েই। মুহূর্তেই বিগ ম্যারিকে দেখার জন্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল অনুষ্ঠানের জায়গাটি। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। হাতিগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখে দর্শকরা আনন্দে হাততালি দিচ্ছিল আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল।
ম্যারি দর্শকদের উদ্দেশে পেছনের দু’ পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মতো সোজা দাঁড়িয়ে যায়, আবার সামনের পায়ে ভর দিয়ে পেছনের পা দুটো শূন্যে তুলে দেয়। অন্য হাতির পিঠে সামনের দুই পা উঠিয়ে দিয়ে রেলগাড়ির মতো চলে এবং দর্শকদের উদ্দেশে আবার সালামও দেয় ম্যারি। এসব দেখে বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ফেটে পড়েন দর্শকেরা। ম্যারি যতই কসরত দেখায়, দর্শকদের চাহিদাও যেন আরও বেড়ে যায়।
সবকিছুই ঠিকই ছিল, যতক্ষণ অবধি না একটা পড়ে থাকা তরমুজ ম্যারির চোখে পড়ে। ম্যারি আচমকাই খেলা দেখানো বন্ধ করে নিচু হয়ে তরমুজটা নিজের শুঁড় দিয়ে উঠাতে চেষ্টা করে।
ম্যারির থমকে যাওয়াতে অনুষ্ঠানটাও কেমন মিইয়ে যাচ্ছিল। সে সময়টায় ম্যারির উপরে আসীন ছিল নতুন নিয়োগ দেওয়া আন্ডারকিপার রেড এল্ড্রিজ। দর্শকদের চেঁচামেচির এক পর্যায়ে ম্যারিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খায় রেড। উপায়ান্তর না দেখে পল জ্যাকোবির দেওয়া প্রশিক্ষণ ভুলে হাতে থাকা লোহার হুক দিয়ে ম্যারির মাথার উপরে এবং কানের পেছনে বারবার আঘাত করতে থাকে।
ম্যারি প্রথমদিকে কেবল মাথা ঝাড়া দিয়ে এবং শুঁড় তুলে আওয়াজ করে রেডকে সাবধান করে। কিন্তু ততক্ষণে রেড জ্ঞানশূন্য হয়ে এলোপাতাড়ি হুক দিয়ে ম্যারিকে জখম করছে এবং পা দিয়ে কানে ব্যাপকভাবে আঘাত করছে ম্যারিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে।
সাবধান করা সত্ত্বেও বারংবার আঘাতে ম্যারির ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ভয়ঙ্কর এক আওয়াজ তুলে মুহূর্তেই শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রেডকে, শুঁড়ের সাহায্যেই শূন্যে তুলে মাটিতে আছাড় দেয় এবং নিজের পা দিয়ে তরমুজ পেষার মতোই রেডের মাথাটা পিষে ফেলে। আবার, অন্য একদল প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, ম্যারির আকস্মিক নড়াচড়ায় রেড মাটিতে পড়ে যায় এবং ম্যারি সাথে সাথে পা তুলে পিষে মেরে ফেলে রেডকে।
যেভাবেই হোক না কেন, ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত জনতা আতঙ্কিত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক সেদিক ছুটতে শুরু করে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে, কেউ একজন ঐ ভিড়ের মধ্য থেকে ম্যারিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল, কিন্তু ম্যারির গায়ের চামড়া এতটাই পুরু ছিল যে বুলেট তা ভেদ করতে পারেনি।
চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে চার্লি স্পার্কস ছুটে আসে। এসেই দৌড়ে যায় ম্যারির কাছে। ম্যারি তখনো রাগে ফুঁসছে, আশেপাশে কাউকে আসতে দিচ্ছে না। চার্লিকে দেখে ম্যারি কিছুটা শান্ত হয়। আর তখনই রেডের বিকৃত শরীরটা দেখে চার্লি।
এতক্ষণ যেসব দর্শক “ম্যারি, ম্যারি” বলে উল্লাস করছিল, তারাই অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলো “খুনী হাতির মৃত্যু চাই”।
তখনকার সময়টাতে যেহেতু সার্কাসটা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল, তাই হাতিগুলোর ন্যূনতম ভুলেই হাতিগুলো অন্য কোনো দেশের সার্কাস কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো। কিন্তু ম্যারি যা করেছে, সেটি ভয়ঙ্কর এবং জনসম্মুখে ঘটবার কারণে, লোকজনের মধ্যে রেষ ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুতই।
ইতোমধ্যে এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও শুরু হয়ে গেল। ম্যারিকে জনতা ‘খুনি ম্যারি’ নাম দিল এবং সাথে এও প্রচার করলো যে, এই হাতিটি নিয়মিতই লোক খুন করে। জনতা ফুঁসে উঠলো আক্রোশে।
চার্লি স্পার্কস পড়লেন বিপাকে। যাদের কাছেই বোঝাতে গেলেন যে, দোষ ম্যারির নয় বরং রেডের, তারাই চার্লিকে ম্যারির শাস্তির অনুযোগ করলেন এবং সাথে এও বলে দিলেন যে, ম্যারিকে জনসম্মুখে শাস্তি না দিয়ে এই টেনেসি শহর ছেড়ে বের হতে পারবে না ওরা! এমনকি স্থানীয় পুলিশও এই বিষয়ে নিশ্চুপতা অবলম্বন করল।
চার্লি স্পার্কস বুঝে গেলেন, ম্যারিকে শাস্তি দেওয়া ব্যতিরেকে তার আর কোনো উপায় নেই। তাই সার্কাস কোম্পানির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বুকে পাথর চেপেই ম্যারিকে শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন।
প্রথমে বলা হলো, খাবারের সাথে সায়ানাইড মিশিয়ে মারা হোক। কিন্তু চার্লি জানালেন, খাবারটা নষ্ট কিনা, সেটি পরীক্ষা করার ক্ষমতা ম্যারির নিজেরই আছে। এরপর বলা হলো, জনসম্মুখে গুলি করে মারা হোক। কিন্তু এত বিশাল মাথায় একসাথে অনেকগুলো গুলি করা অসম্ভব, আবার ভরা জনতার সামনে ম্যারি উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেলে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়বে।
তারপর ভাবা হলো, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মেরে ফেলা হবে ম্যারিকে। কিন্তু টেনেসি শহরের সমস্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়েও ম্যারিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মারা সম্ভব নয়। শেষমেষ চার্লি নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সবাইকে জানালেন যে, ম্যারিকে মানুষের মতো করেই সাজা দেওয়া হবে। ঝুলিয়ে দেওয়া হবে ফাঁসির মঞ্চে, যতক্ষণ অবধি না ম্যারির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
চার্লির এই সিদ্ধান্তে সবাই একমত হলো। সেদিন সকালে অঘোষিত একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করে সার্কাস কোম্পানিটি; যেখানে ম্যারিকে বাদ দিয়েই সার্কাস দেখানো হয়। ম্যারিকে পাশেই বেশ মোটা শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখা গিয়েছিল।
সার্কাস শেষে সবাই-ই কিংসপোর্টের রেলস্টেশনটিতে জড়ো হতে শুরু করে। মুহূর্তেই মানুষ দিয়ে ভরে যায় জায়গাটা। নিয়ে আসা হয় ম্যারিকে। উপস্থিত জনতার ‘খুনি ম্যারি’ শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ।
পাঁচ টন ভারি হাতিটিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্যে বিশেষ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেন আনা হয়। তারপরের জঘন্য আর মর্মান্তিক ঘটনা তো উপরেই জেনেছি আমরা। দ্বিতীয়বার ক্রেনে ত্রিশ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর একজন পশু-চিকিৎসক ম্যারিকে মৃত ঘোষণা করেন এবং ম্যারিকে নামিয়ে আনা হয়।
উপস্থিত জনতা জঘন্য আর বর্বর এই হত্যাকাণ্ড দেখা শেষে ধীরে ধীরে নিজেদের কাজেকর্মে ফিরে যায়। ম্যারিকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অন্য হাতিগুলোকেও ধীরে ধীরে খোঁয়াড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ম্যারির সাথে কাজ করা হাতিগুলো শুঁড় তুলে কান্নার সুরে অদ্ভুত এক আওয়াজ করে যেন জানান দিচ্ছিল, তাদের বন্ধু ম্যারি আর নেই! এমনকি, সেদিন রাতেই ম্যারির সাথে বছরের পর বছর কাজ করা একটা হাতি, খোঁয়াড় ছেড়ে পালিয়ে রেলস্টেশনে ছুটে আসে ম্যারির খোঁজেই।
পরদিন পত্রিকার শিরোনামে আসে ম্যারির নাম। তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় পুরো দেশ, এমনকি পুরো বিশ্ব জুড়ে। ম্যারির ফাঁসি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সার্কাসে এমন বন্য পশুর ব্যবহার নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বেশিরভাগ আলোচনাতেই ম্যারিকে নির্দোষ এবং রেডকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
পুরো বিশ্ব যখন ম্যারিকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন টেনেসির লোকজন নিশ্চুপভাবে দেখেও না দেখার ভান করে, এড়িয়ে যায় পত্রিকাতে থাকা ম্যারির সংবাদ কিংবা শুনেও না শোনার ভান করে রেডিও কিংবা টেলিভিশনের সংবাদ।
ম্যারিকে নিয়ে আলোচনা হয়, সমালোচনা হয়, কিন্তু শেষমেশ যেটি যেমন ছিল, সেটি তেমনই রয়ে যায়। টেনেসির লোকজন বেমালুম ভুলে যায় সেই বর্বরতার কথা। চার্লি এবং র্যাচেল ভুলে যায় নিজেদের সন্তানতুল্য ম্যারির কথা। লোকেরা ভুলে যায় বিগ ম্যারি নামক আনন্দ দেওয়া সেই হাতিটির কথা। দ্য স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো নতুন গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা করে। আর ম্যারি রয়ে যায় গুটিকয়েক মানুষের মুখে আর লেখায়, ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায়।