সেভেন ইয়ার্স ওয়ারে ইউরোপের সংঘর্ষ ছিল সবথেকে রক্তক্ষয়ী। এর বাইরে আমেরিকা এবং ভারতে উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের মধ্যে ঝগড়া চলছিল, যা নৌবাহিনীর সংঘর্ষেও রূপ নেয়। ইউরোপিয়ান থিয়েটারে প্রুশিয়া মূলত একাই লড়ছিল ফরাসি-অস্ট্রো-রাশান সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে,ইংল্যান্ড প্রধানত অর্থ দিয়েই সহায়তা করছিল। সেদিকে যাবার আগে একটু বাইরের লড়াইগুলো গতিপথ দেখে নেয়া যাক, এতে পুরো সংঘাতের একটি চিত্র পাওয়া যাবে, যার সাথে যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
ফরাসি-ইন্ডিয়ান যুদ্ধ
আমেরিকাতে ফরাসি আর ব্রিটিশদের লড়াই পরিচিত ফরাসি-ইন্ডিয়ান যুদ্ধ নামে, যা সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের একটি অংশ। ফরাসি আর ইন্ডিয়ান গোত্রগুলো মিলিতভাবে ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, যাদের সাথে ছিল আমেরিকান মিলিশিয়া। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই নানা কারণে দুই পক্ষের মধ্যে বিরাজ করছিল থমথমে ভাব। সপ্তদশ শতক থেকেই ফরাসি কানাডা থেকে শুরু করে আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফ্রান্সের কলোনি ছিল। একে তারা বলত নতুন ফ্রান্স (New France)। পেনসিলভ্যানিয়া আর ভার্জিনিয়ার অধিকাংশ এলাকা ছিল ব্রিটিশদের। নিকটবর্তী ওহাইয়ো নদীর অববাহিকাও তারা নিজেদের দাবি করত। এই এলাকা ছিল মিসিসিপির উপত্যকায়, যেখানে আবার ফরাসিদের শক্ত অবস্থান ছিল। তবে অ্যালেঘেনি (Allegheny River) আর ওহাইয়ো নদীর দিকে তাদের তেমন উপস্থিতি ছিল না। ফরাসিরা একেও তাদের জায়গা দাবি করত। এসব অঞ্চলে স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের সাথে ফরাসিদের সুসম্পর্কের সূত্রে ফরাসি বণিকদের প্রচুর ব্যবসা বাণিজ্য হচ্ছিল।
ব্যবসার গন্ধ পেয়ে ব্রিটিশ অনেক লোকজন এসে হাজির হলো ওহাইয়োর অববাহিকায়। তারাও ইন্ডিয়ানদের পটিয়ে পাটিয়ে বিক্রিবাট্টা আরম্ভ করলে ১৭৪৯ সালে ফরাসি গভর্নর জেনারেল অবিলম্বে তাদের এলাকা ছেড়ে যেতে আদেশ করলেন। কে শোনে কার কথা! ফলে ১৭৫২ সালে ফরাসিরা শক্তি প্রয়োগ করে। নিজেদের সৈন্য আর ইন্ডিয়ান মিত্রদের সাথে নিয়ে অ্যালেঘেনি আর ওহাইয়ো নদীর আশেপাশে যত ব্রিটিশ বানিজ্য বসতি ছিল সব তারা ধ্বংস করে দেয় এবং বাসিন্দাদের হত্যা করে। নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে ১৭৫৩ সালের মধ্যে অ্যালেঘেনির পার্বত্য এলাকাতে ফরাসিরা বেশ কয়েকটি দুর্গ গড়ে তোলে।
ব্রিটিশ বণিকেরা ছিল ভার্জিনিয়ার ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট গভর্নর ডিনউইডির দায়িত্বে। তিনি রাজধানী উইলিয়ামসবার্গে বসে প্রশাসনিক কাউন্সিলের সাথে তখন আলোচনায় ব্যস্ত। সেখান থেকে তারা ১৭৫২ সালের শেষদিকে ওহাইয়ো নদীর অববাহিকা জুড়ে প্রায় ২,৩০০ বর্গ মাইল জায়গা বসতি স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেন, যার মধ্যে অ্যালেঘেনির পার্বত্য অঞ্চলও ছিল। বসতি বানাবার দায়িত্ব পেল ওহাইয়ো ল্যান্ড কোম্পানি, যাতে ভার্জিনিয়ার প্রায় সমস্ত বনেদি পরিবারেরই শেয়ার আছে, যার মধ্যে ছিল ওয়াশিংটন এবং লি পরিবার।
এর ভেতরেই ব্রিটিশ বণিকদের হত্যাকাণ্ডের খবর এসে পৌঁছলে ডিনউইডি বিচলিত হয়ে পড়লেন। ১৭৫৩ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বার্তা নিয়ে একদল লোক রওনা হলো পেনসিলভ্যানিয়াতে ফরাসিদের লেবুফ দুর্গ অভিমুখে। তাদের নেতৃত্বে ভার্জিনিয়া মিলিশিয়া দলের তরুণ এক মেজর, জর্জ ওয়াশিংটন। ডিনউইডির আল্টিমেটাম ছিল হয় ফরাসিরা দুর্গ ত্যাগ করে নিজেদের এলাকায় সরে যাবে, নাহয় তাদের সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্গের কমান্ডার তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন বটে, কিন্তু সাফ জানিয়ে দিলেন ফরাসিরা পুরো ওহাইয়োই হস্তগত করবে।
ওয়াশিংটনের মুখ থেকে ফরাসিদের পরিকল্পনা শুনে ডিনউইডি পরের বছর চল্লিশজনের একটি দল পাঠালেন বর্তমান পিটসবার্গ অঞ্চলে প্রিন্স জর্জ নামে একটি দুর্গ বানানোর জন্য। ভার্জিনিয়া মিলিশিয়ার কর্নেল জশুয়া ফ্রাইয়ের উপর দায়িত্ব ছিল তাদের নিরাপত্তা বিধান করা। কিন্তু তিনি দল গুছিয়ে আসতে আসতে অ্যালঘেনির পার্বত্য এলাকা থেকে স্রোতের মত ফরাসিরা নেমে এল। তারা ডিনউইডির লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের একটি দুর্গ তৈরি করল, নাম দিল জুকে (Duquesne) দুর্গ।
এদিকে মে মাসে ফ্রাইয়ের মৃত্যু হলে ভার্জিনিয়া মিলিশিয়াদের প্রধান নির্বাচিত হলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তিনি জুকে থেকে চল্লিশ মাইলের মতো দূরে ৩০০ মিলিশিয়া নিয়ে একটি ঘাঁটি তৈরি করেন যা পরে পরিচিত হয় ফোর্ট নেসেসিটি (Fort Necessity) নামে। ফরাসিদের একটি ছোট দল মে মাসের ২৮ তারিখে খোঁজখবর নিতে কাছাকাছি চলে এলে ওয়াশিংটন আগপিছু না ভেবেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফরাসি দলপতি নিহত হন, বিশজনের মতো ফরাসিকে আমেরিকানরা বন্দি করে। মূল ফরাসি বাহিনী ইন্ডিয়ান মিত্রদের নিয়ে প্রতিশোধ নিতে জুলাই মাসের ৩ তারিখে মিলিশিয়াদের ঘিরে ফেলে। ইতোমধ্যে ওয়াশিংটনের সাথে আরো মিলিশিয়া যোগ দিয়েছে, এবং উত্তর ক্যারোলিনার একদল ব্রিটিশ সৈন্যও ঘাঁটিতে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা সংখ্যায় ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ছোটখাট কিছু সংঘর্ষের পরে ওয়াশিংটন অনুধাবন করলেন তার জেতার কোনো রাস্তা নেই। তিনি আত্মসমর্পণ করলে ফরাসিরা তাকে এবং জীবিত সেনাদের চলে যাবার সুযোগ দেয়। এরপর তারা দুর্গ পুড়িয়ে দিল।
ওয়াশিংটন উইলিয়ামসবার্গ ফিরে এলেন। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে পরিপূর্ণ একটি রিপোর্ট পেশ করলেন তিনি। তার ধারণা ছিল আত্মসমর্পণ করায় তাকে কঠিন তিরস্কারের মুখোমুখি হতে হবে। কীসের কী! কর্মকর্তারা পরাজয়ের দোষ চাপালেন অপ্রতুল সেনা আর সরঞ্জামাদির উপর। তিরস্কারের জায়গায় অনেক সেনাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য ওয়াশিংটনের ভাগ্যে জুটল আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ পত্র।
সাহায্যের আবেদন
ডিনউইডি ভার্জিনিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর উপর খুব বেশি আস্থা পাচ্ছিলেন না। স্বল্প প্রশিক্ষিত মিলিশিয়া বাহিনী পেশাদার ফরাসি সৈনিকদের সামনে পাত্তাই পাবে না বলে তার ধারণা ছিল। তার হাতে আমেরিকাতে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় রাজকীয় সেনারও কমতি রয়েছে। সাত-পাঁচ ভেবে তিনি দ্বিতীয় জর্জের কাছে সহায়তা চাইলেন। ফ্রান্সের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে রাজা ইতস্তত করছিলেন। তার প্রধানমন্ত্রী থমাস পেলহ্যাম-হলিসেরও মতো ছিল আমেরিকার লড়াই আমেরিকানদের দিয়েই লড়তে হবে। কিন্তু দ্রুতই পরিস্কার হয়ে যায় মিলিশিয়া বাহিনী সুদক্ষ এবং অভিজ্ঞ ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রতুল। ফলে ১৭৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা রাজার সায় নিয়ে আমেরিকাতে সেনা পাঠানোর প্রস্তাব অনুমোদন করেন।
দুই রেজিমেন্ট ব্রিটিশ সেনা ১৭৫৫ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার দিকে রওনা হয়, তাদের সাথে স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর জন্য দশ হাজার পাউন্ড এবং দুই হাজার মাস্কেট ছিল। স্থলবাহিনীর ঠিক পেছনেই ছিল অ্যাডমিরাল বস্ক্যাওয়েনের নেতৃত্বে শক্তিশালী একটি নৌবহর যাদের দায়িত্ব সেন্ট লরেন্স উপসাগরে পাহারা বসানো, যাতে ফ্রান্স থেকে আমেরিকাতে কোনো সহায়তা না পৌঁছতে পারে। কিন্তু চতুর ফরাসিরা ব্রিটিশ নৌবহরকে ফাঁকি দিয়ে ৫,০০০ সেনা জুনের মধ্যে আমেরিকাতে নামিয়ে দেয়।
ফোর্ট জুকে দখলের চেষ্টা
ঠিক যে সময় ফরাসি রিইনফোর্সমেন্ট এসে পৌঁছেছে, তখন ১,৩৭০ রাজকীয় সেনার একটি এক্সপেডিশনারি ফোর্স নিয়ে মেজর জেনারেল ব্র্যাডক জুকের দিকে চললেন। জুকের প্রতিরক্ষায় ছিল ১০০ ফরাসি মেরিন, ২০০ ফরাসি-কানাডিয়ান মিলিশিয়া আর ৯০০ ইন্ডিয়ান। জুলাই মাসের ৬ তারিখ ব্রিটিশদের অগ্রবর্তী একটি দল হঠাৎ করেই ফরাসি-ইন্ডিয়ানদের সম্মিলিত এক বাহিনীর সম্মুখীন হয়। লড়াই শুরু হলে ব্রিটিশরা বেকায়দায় পড়ে যায়। ব্রিটিশ রণকৌশল ছিল আর্টিলারির ছত্রচ্ছায়ায় সারিবদ্ধভাবে শত্রুসেনার দিকে অগ্রসর হওয়ার।
সমতল ভূমিতে এই কৌশল কার্যকরী, কিন্তু জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি অ্যালেঘেনি অঞ্চলে কামান মোতায়েন করে সারি বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তদুপরি শত্রুরা প্রকাশ্যে দেখা না দিয়ে আড়াল থেকে গুলি চালিয়েই বার বার সরে যাচ্ছিল, ফলে ব্রিটিশ সেনারা গুলি চালানোর মতো লক্ষ্যবস্তুই খুঁজে পাচ্ছিল না। ব্র্যাডক কয়েকবার সেনা পাঠিয়ে অগ্রবর্তী বাহিনীকে শক্তি যোগানোর চেষ্টা করেন। দু’ঘণ্টা নিস্ফল চেষ্টার পর অবশেষে ব্রিটিশরা পিছু হটে। তাদের মাত্র ৪৫৯ জন সেনা অক্ষত ছিল। ব্র্যাডক নিজে এই সংঘর্ষে নিহত হন। বিপরীতে ফরাসিদের হতাহত ছিল বিশজনেরও কম, তবে অত্যুৎসাহী ইন্ডিয়ান মিত্ররা ১০০ লোক হারিয়েছিল।
ব্যর্থ ১৭৫৫ সাল
জুকের দুঃখ ভুলতে ব্রিটিশরা অভিযান চালালো লেক জর্জ এবং ফোর্ট নায়াগ্রার এলাকাতে। ৮ সেপ্টেম্বর লেক জর্জে ইংলিশ দখলদারিত্ব সফল হলেও নায়াগ্রা অভিযানের কর্ণধার উইলিয়াম শার্লি সেখানে ফরাসি সামর্থ্য দেখে আর না এগোনোর ফয়সালা করলেন। তিনি অন্টারিও লেকের তীরবর্তী অসওয়েগ দুর্গ অবধি কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। কিন্তু অদক্ষ মিলিশিয়া আর অনুপযোগী সমরকৌশল নিয়ে ব্রিটিশদের এ বছর ভাল কাটেনি। বলার মতো সফলতা ছিল কানাডার নোভা স্কোশিয়ার কিছু এলাকা দখল করা। এই জমি কানাডার মূল ভূখণ্ডের সাথে নোভা স্কোশিয়ার যোগাযোগ রক্ষা করছিল বিধায় এর কৌশলগত কিছু গুরুত্ব ছিল।
ফরাসি সাফল্য
ব্রিটিশরা আমেরিকাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা পাঠায়নি। স্থানীয় মিলিশিয়াদের উপর তাদের নির্ভরশীলতাও প্রত্যাশিত ফল দিতে ব্যর্থ হয়। আমেরিকান থিয়েটারে ব্রিটিশদের কমান্ড ন্যস্ত করা ছিল জেনারেল ক্যাম্পবেলের হাতে। তার মোকাবেলায় ফ্রান্স থেকে এক হাজার সেনা আর ছয়টি জাহাজ নিয়ে জেনারেল মন্টক্যাল্মকে পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো। ফরাসি সেনাদল অসওয়েগ দুর্গ পুনরুদ্ধার করে ফেলে ১৭৫৬ সালের আগস্টে। শ্যাম্পলেইন লেকের অঞ্চলেও তাদের ক্ষমতা কায়েম হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনের চেষ্টায় কানাডাতে ফরাসি মূল ঘাঁটি নোভা স্কোশিয়ার লুইজবার্গ দুর্গে করা দুঃসাহসী ব্রিটিশ হামলা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল।
এই দুর্গ পাহারা দিচ্ছিল সেন্ট লরেন্স উপসাগর এবং কানাডাতে ফরাসিদের অঞ্চলের মূল প্রবেশপথ। এরপর ১৭৫৮ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ জেনারেল অ্যাবারক্রম্বি চার গুণ বেশি লোক নিয়েও লেক জর্জের উত্তরে ক্যারিওন দুর্গের সংঘর্ষে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন। ফরাসি অগ্রাভিযানের ভয়ে নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভ্যানিয়া, মেরিল্যান্ড আর পশ্চিম ভার্জিনিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ বাসিন্দা সরে যায়।
ইংল্যান্ডের ভাগ্য পরিবর্তন
যুদ্ধ পরিচালনায় পেলহ্যাম-হলিসের ব্যর্থতায় বিরক্ত ইংলিশ পার্লামেন্ট তাকে অপসারণ করে। উইলিয়াম পিট নামে এক বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ লড়াইয়ের ভাগ্য ফেরানোর ভার নেন। স্থলে ফরাসিরা সাফল্য পেলেও সাগরে তখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জয়জয়কার। কাজেই তাদের ব্যবহার করে পিট আমেরিকাতে নতুন সেনা, প্রচুর অর্থ আর মালামাল পাঠাতে শুরু করলেন। পাশাপাশি ফরাসিরা যাতে কোনোভাবেই আমেরিকার উপকূলে রিইনফোর্সমেন্ট নামাতে না পারে সে ব্যাপারে কড়া নির্দেশ জারি করেন। কয়েকবার চেষ্টা করেও ফরাসি জাহাজ ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে কোনো সহায়তা আমেরিকাতে পাঠাতে পারল না, বরং কয়েকবার তাদের বহর ধ্বংস হয়ে যায়। এদিকে কয়েক বছর যুদ্ধ করার পর আমেরিকান মিলিশিয়ারাও ঝানু হয়ে ওঠে।
লুইজবার্গের পতন
১৭৫৮ সালের জুলাইয়ে ১৫৭টি জাহাজে ১১,০০০ সেনা নিয়ে জেনারেল অ্যামহার্স্ট ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন। উদ্দেশ্য লুইজবার্গের দুর্গ, যেখান থেকে সাগরপথে উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জুনের ৮ তারিখ তারা দুর্গের পশ্চিমে গ্যাবারাস উপসাগরে এসে পৌঁছেন। তীর থেকে ফরাসিরা তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তবে কিছু সেনা অবশেষে তীরে নামতে সক্ষম হল এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশদের পুরো সেনাদলই দুর্গের সামনে অবস্থান নেয়। তারা উপর্যুপুরি গোলা ছুঁড়তে থাকলে জুলাই মাসের ২৬ তারিখ ফরাসিদের শেষ কামানটিও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পতন হলো লুইজবার্গের। মাসকয়েক পর জুকে দুর্গ এবং পরের বছর নায়াগ্রাও ব্রিটিশদের হস্তগত হলে ফরাসিরা কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। ক্যারিওন দুর্গ এবং নিউ ইয়র্কের উত্তর-পূর্ব এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
ব্যাটল অফ কুইবেক
ক্যানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখনও ফরাসিদের আওতাধীন। তাদের প্রধান ঘাঁটি কুইবেক দখল করতে লুইজবার্গ দুর্গে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জেনারেল উলফ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে সেন্ট লরেন্স উপসাগর ব্যবহার করে ইংলিশ সেনাবাহিনী এবং আমেরিকান মিলিশিয়ারা পৌঁছে যায় কুইবেকের সামনে, সেখানে ফরাসি সর্বাধিনায়ক মন্টক্যাল্ম তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। জল-স্থল থেকে গোলাবর্ষণ করেও ফরাসিদের টলানো যাচ্ছিল না। তবে ব্রিটিশ জাহাজ জলপথে মন্টক্যাল্মের কাছে কোনো সাহায্য যাতে না আসতে পারে তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হলো।
অবরোধের ইতি টানতে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ কুইবেকের উত্তরদিকে খাড়া পাহাড়ের ঢালে উলফ একদল সেনা নিয়ে অবস্থান নিলেন। পাহাড়ের উপর থেকে শত্রুদের অগ্রসর হতে দেখে মন্টক্যাল্ম শহর প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত তিনটি কামান গভর্নরের অনুমতিসাপেক্ষে সেদিকে ঘুরিয়ে দেন। ব্রিটিশদের সাথে ছিল একটি মাত্র কামান, তা দিয়েই তারা জবাব দিতে থাকে। এদিকে ফরাসি ইনফ্যান্ট্রি তাড়াহুড়া করে অনেক দূর থেকেই গুলি ছুঁড়তে থাকলেও ব্রিটিশরা ফরাসিদের কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। ফলে ব্রিটিশদের নিশানা তুলনামূলকভাবে নির্ভুল প্রমাণিত হয়। ফরাসি লাইন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। জেনারেল উলফ নিজে সেনাদের সাথে আগাচ্ছিলেন, তিনি পায়ে এবং বুকে চোট পান। জেনারেল মন্টক্যাল্মও বিশৃঙ্খলার মধ্যে আহত হন। দুই জেনারেলই শেষ পর্যন্ত মারা যান।
কানাডার পতন এবং লড়াইয়ের সমাপ্তি
কুইবেক হারানোর পর ১৭৬০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ফরাসি গভর্নর জেনারেল আর কোনো উপায় না দেখে মন্ট্রিয়লসহ ক্যানাডার সমস্ত ফরাসি এলাকাই ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করলেন। শেষ হয়ে গেল সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের আমেরিকান থিয়েটারের সংঘর্ষ। কানাডা সেই থেকে চলে যায় সম্পূর্ণ ব্রিটিশ কর্তৃত্বে।