দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: বিপদশঙ্কুল যাত্রা (পর্ব ৭)

ষষ্ঠ পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: দুর্গম ভারত

আলেকজান্ডার ফিরতে রাজি হলেও তার মাথায় অন্য পরিকল্পনা ছিল। যেদিক দিয়ে এসেছেন সেদিক দিয়েই ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন তিনি। তার বদলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ভারত মহাসাগর দেখার পর সেখানে আমুনের উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে তারপর মেসিডনে ফিরবেন। এই ঘোষণা শুনে মেসিডোনিয়ানরা নৌকা বানানো শুরু করে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই ইন্দু নদী দিয়ে ভারত মহাসাগরে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌকা তৈরি হয়ে গেল। বর্তমানে ইন্দু নদী পাকিস্তানের তারবেলা বাঁধে আটকে থাকা ছোট্ট নদীতে পরিবর্তন হলেও, আলেকজান্ডারের সময়ে এই নদী ছিল পৃথিবীর অন্যতম বিপদশঙ্কুল নদীপথ। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সবকিছু মোকাবেলা করার জন্যই আলেকজান্ডারের বাহিনী তৈরী হয়ে ছিল।

আলেকজান্ডারের ভারতের (বর্তমান পাকিস্তান) লোকেরাও অনুগত বা ভীরু প্রকৃতির ছিল না। আলেকজান্ডারের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ভারতীয়রাই। চেনাব আর ইন্দু নদীর মিলনস্থলে পৌঁছাতেই এর দুই পাশে থাকা দুই শহরে মুহূর্তের মধ্যে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করে দেয় মেসিডন বাহিনী। কয়েকশো মানুষকে হত্যা করা হয়। ভারতের কষ্টকর আবহাওয়া আর বছরের পর বছর ধরে চলা এই অভিযান আলেকজান্ডারের বাহিনীকে ধৈর্যের শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়েছিল। আলেকজান্ডারও তার দখল করা অঞ্চলের স্থানীয়দের সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন।

সিন্ধু এলাকার এক শহর দখলের সময় আলেকজান্ডার তার বাহিনীর অনাগ্রহ দেখে নিজেই সিজ টাওয়ারের (Siege Tower) উপরে উঠে একেবারে সামনে থেকে আক্রমণ চালাতে থাকেন আর নিজের পাশে মাত্র তিনজন মেসিডন সৈন্যকে দেখতে পান। বাকিরা পেছনে অপেক্ষা করছিল। এদিকে শহরের লোকজন আলেকজান্ডারকে মেসিডোনিয়ানদের নেতা হিসেবে চিনতে পেরে আগুনের তীর ছুঁড়তে শুরু করে। প্রবল বেগে আক্রমণ করা শুরু করে। আলেকজান্ডার পেছনে না ফিরে সরাসরি টাওয়ারের উপর থেকে লাফ দিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকে পড়েন, তিন সহযোগীও নেতার পথ অনুসরণ করে ঢুকে পড়েন। এবং মুহূর্তের মধ্যেই চারজন লড়তে থাকেন কয়েক ডজন শত্রুর সাথে।

দেয়াল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়া আলেকজান্ডার আর তার তিন সহচর; Image Source: Serious Science

হঠাৎ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেসিডন বাহিনীর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে আলেকজান্ডার শত্রুদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুহূর্তের মধ্যেই দেয়ালের সাথে ঝুলন্ত সিঁড়ি দিয়ে কয়েকশো মেসিডন সেনা ঢুকে পড়লো, বাকিরা শহরের ফটক ভেঙে সামনে যাকে পেল, তাকেই পরপারে পাঠিয়ে দিল, আলেকজান্ডার যে বেঁচে আছে, তা না জেনেই।

মেসিডোনিয়ানরা যখন আলেকজান্ডারকে উদ্ধার করল, তখন আলেকজান্ডারের মুমূর্ষু অবস্থা। কোনো অঙ্গহানি না ঘটলেও শত্রুপক্ষের এক সৈন্য তার বিশাল কুঠার তার বুকে ঢুকিয়ে ফুসফুস ফুটো করে দিয়েছে! আলেকজান্ডারকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো তার তাঁবুতে। অন্য যে কেউ হলে হয়তো সেদিন বিকালের মধ্যেই মারা যেত, কিন্তু মনের জোরের কারণেই শেষমেশ ঐ যাত্রা বেঁচে গেলেন আলেকজান্ডার।

চারদিন পর তিনি যখন তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে সৈন্যদের সামনে আবার ভাষণ দিতে হাজির হলেন, তখন সেই পুরনো আলেকজান্ডার অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ফুসফুস ফুটো করে দেওয়া কুঠার দক্ষ সার্জন আলাদা করলেও, তার সাথে আরো অনেক কিছুই আলাদা হয়ে গিয়েছে। ভারি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিলে কিংবা জোরে কথা বললেই বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন তিনি। নিজের ব্যথা অন্যদের কাছ থেকে লুকোতে পারলেও সেই ব্যথা নিয়েই নিজের বাকি জীবন চলতে হলো আলেকজান্ডারকে।

আহত আলেকজান্ডার; Image Source: Ancient Great Leaders – Alexander The Great

আলেকজান্ডার বাহিনী নিয়ে ইন্দু নদী দিয়ে আরো দক্ষিণে এগিয়ে গেলেন এবং অবশেষে ভারত মহাসাগরের দেখা পেলেন। ভারতের শেষ মাথায় পৌঁছাতে না পারলেও মহাসাগর তো পেয়েছেন। কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে মূল ভূমি থেকে ২০ মাইল দূরে এক দ্বীপে গিয়ে সমুদ্র দেবতা পসাইডন আর জিউসের উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে আবারো ফেরত আসলেন আলেকজান্ডার।

ফিরে আসার পর সবাইকে এবার তার পরিকল্পনা খুলে বললেন। মেসিডন বাহিনীর অর্ধেক নৌকায় করে পাকিস্তান ও ইরানের উপকূল দিয়ে পারস্যে যাবে। অন্যদিকে বাকি অর্ধেক আলেকজান্ডারের সাথে যাবে পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে। নৌকায় যারা যাবে, তাদের জন্য উপকূলে খাবার রেখে আসার দায়িত্বে থাকবে আরেকটি দল। নয় বছর ধরে একসাথে থাকা মেসিডন বাহিনীর দুই দল একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিল। এরপর প্রস্তুতি নিতে থাকল যার যার গন্তব্যের জন্য।

ইন্দু নদীর তীর দিয়ে আলেকজান্ডার সরাসরি উত্তর দিকে যাওয়া শুরু করলেন। তারপর পশ্চিম দিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখোমুখি হলেন মাকরান মরুভূমি বা গেদরোশিয়া মরুভূমির। আলেকজান্ডার তখনো জানেন না, কোন বিপদের মুখোমুখি তিনি হতে চলেছেন। এমনকি এই একবিংশ শতাব্দীতেও কোনো পথচারী পারতপক্ষে বেলুচিস্তান প্রদেশের আশেপাশে ঘেঁষতে চান না। বেলুচের স্থানীয় গোত্ররা আতিথেয়তা করলেও মরুভূমির তীব্র গরম সহ্য করতে পারেনি আলেকজান্ডারের সৈন্যরা।

বেশিরভাগ সময়েই তীব্র রোদ এই মরুভূমিতে মরীচিকা তৈরি করে। আলেকজান্ডারের সৈন্যদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ হয়েছিল। প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যেই সৈন্যদের বেশিরভাগ ঘোড়া পানির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেল। আর সৈন্যরা যারা বেঁচে রইল, তারাও যখন পানি পেল, যতটা সম্ভব খরচ না করে পানি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করল। আলেকজান্ডারের বাহিনী যেন সাক্ষাৎ নরকের স্বাদ পেল। মাকরান উপকূলের মতো খাবার পানিহীন জায়গা পৃথিবীতে খুব কমই আছে।

দুর্গম মাকরান মরুভূমি; Image Source: Wikimedia Commons

তিন সপ্তাহ পর আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন তার হিসাবে বেশ বড় রকমের ভুল হয়েছে। এখন ভারতে ফিরে যাবারও কোনো উপায় নেই। কারণ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ঘোড়াবিহীন এই মেসিডন বাহিনী যেকোনো ভারতীয় রাজার সহজ শিকার হবে। সুতরাং সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সৈন্যদের অবস্থা দেখে আলেকজান্ডার নিজেও ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেন। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করলেও তিনি তা বুঝতে দিলেন না, কারণ তার সৈন্যদের কাছে তিনি আলেকজান্ডার, মেসিডোনিয়ার রাজা, এশিয়ার মালিক এবং তার যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।

ক্লান্ত আলেকজান্ডারকে সৈন্যরা হেলমেটভর্তি পানি খেতে দিলে আলেকজান্ডার পুরোটুকুই মরুভূমিতে ঢেলে দেন। শুধু রাজা হওয়ার কারণে তিনি অতিরিক্ত সুবিধা পাবেন, এরকম হতে পারে না। মেসিডোনিয়ানদের সবাইকে এক হেলমেট ভর্তি পানি খেতে দিলেও হয়তো এতটা কাজ হতো না, আলেকজান্ডার যা করে দেখালেন। নিজের সৈন্যদের সাথে একাত্ম আলেকজান্ডার আবারো নিজের সৈন্যদের ভালোবাসা ফিরে পেলেন। তবে সৈন্যরা কেউ বুঝতেই পারেনি, তাদের নেতা কতটা কষ্ট করে হেঁটে চলছেন। অবশেষে দীর্ঘ ৬০ দিনের পর মেসিডন বাহিনী হরমুজ প্রণালীর দেখা পেল।

বর্তমানে তেলের সমুদ্র হিসেবে পরিচিত এ জায়গায় তখন কিছু না থাকলেও প্রচুর পানির ব্যবস্থা ছিল। ক্লান্ত—পরিশ্রান্ত, ভেঙে পড়া মেসিডন বাহিনী মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার আনন্দে এক সপ্তাহ ধরে উৎসব পালন করলো। দেবতা ডায়োনিসাসের উদ্দেশ্যে বিশাল ভোজউৎসব পালন করা হলো। সৈন্যদের সাথে আলেকজান্ডারও উৎসবে যোগ দিলেন। তবে আহত জায়গার আঘাত আর মরুভূমির মধ্যে নিজের সৈন্যদেরকে টেনে নিয়ে আসার ফলে আলেকজান্ডারের সেই স্পৃহা আর কর্মক্ষমতা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।

মাকরান মরুভূমিতে হেলমেটভর্তি পানি ফেলে দিচ্ছেন আলেকজান্ডার; Image Source: How Great Was Alexander

এদিকে মেসিডনের বাকি অর্ধেক দলও বেশ কিছু ঝামেলার মুখোমুখি হলেও তাদেরকে বেলুচিস্তানের মরুভূমির পাল্লায় পড়তে হয়নি। নৌকাতে করে তারা বেশ নিরাপদেই এসেছে। আলেকজান্ডার তার একত্র বাহিনী নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন পারস্যের দিকে। প্রথমে পার্সেপোলিস, সেখান থেকে সুসা। মেসিডোনিয়ানরা বুঝতে পারল, আলেকজান্ডার তার নতুন রাজধানী এখানেই গড়তে যাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো, মেসিডোনিয়ানরাও কি এখানেই থেকে যাবে?

শেষ পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: মহত্ত্বের মূল্য

Related Articles

Exit mobile version