অ্যামিটিভিল আতঙ্ক: এক কুখ্যাত হানাবাড়ির গল্প

১৩ নভেম্বর, ১৯৭৪; লং আইল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক। অ্যামিটিভিল হাউসের এক শয্যাকক্ষে বন্দুকের আওয়াজ! একবার নয়, পরপর চারবার! এর আগে আরও চারবার আততায়ীর পয়েন্ট থার্টিফাইভ মার্লিন রাইফেলটা গর্জে উঠেছে। নিজেদের বিছানায় রক্তাক্ত দেহে পড়ে আছেন রোনাল্ড ডিফেও সিনিয়র, স্ত্রী লুইস ডিফেও এবং চার ছেলেমেয়ে- প্রত্যেকেই নিথর, নিস্পন্দ। গোটা ১১২ ওশান এভিনিউ আবারও সুনশান, শান্ত। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত তিনটে বেজে পনেরো মিনিট।

কুখ্যাত সেই অ্যামিটিভিল হাউস; Image Source: the-line-up.com

সেই বিভীষিকাময় রাত্রির পর প্রায় এক বছর বাড়িটি খালি থাকে। অবশ্য খালি থাকারই কথা। কেননা, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন মূলধারার মার্কিন সংস্কৃতি ছিল রাজ্যের কুসংস্কারের আখড়া। সে যা-ই হোক, সকল কুসংস্কার কাটিয়ে, এক মোটা অঙ্কের অর্থ বাঁচিয়ে সেই কুখ্যাত বাড়িটি কিনে নিলেন জর্জ লুটজ নামক এক ভদ্রলোক। কিছুদিন পর সপরিবারে এসে উঠলেনও সেখানে। কিন্তু তখন কি আর লুটজ মশাই জানতেন, অ্যামিটিভিল হাউসে তাদের মেয়াদকাল হবে মাত্র ২৮ দিন!

গোলমালের শুরু প্রথম রাত থেকেই। কী গোলমাল? এমন গোলমাল, যা হয়তো এর আগে অন্য কোনো হানাবাড়িতে ঘটেনি! অন্তত, ঘটেছে বলে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী প্রকাশ্যে দাবি করেননি। দরজার কি-হোল আর দেওয়াল থেকে সবুজ রঙের চটচটে পদার্থ নির্গত হওয়া থেকে শুরু করে জানালার শার্সি গলিয়ে এক অপার্থিব শূকরের রক্তরাঙা জ্বলজ্বলে উৎসুক দৃষ্টি! গভীর রাতে ঘুমন্ত মিসেস লুটজের বিছানা ছেড়ে শূন্যে ভেসে ওঠা, অবশ্য দুই ছেলে, ক্রিস্টোফার আর ড্যানিয়েলের সাথেও ঘটেছে এমনটা। প্রত্যেকদিন ভোর ৩:১৫-তে কোনো এক অশরীরীর ডাকে ঘুম ভেঙে যাওয়া। বাড়িময় উৎকট দুর্গন্ধ, সাথে প্রচণ্ডরকম মাছির উৎপাত আর জায়গায়-জায়গায় ভৌতিক শীতলতা। অবশেষে ধৈর্যের অগ্নিপরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে লুটজ পরিবারকে ছাড়তেই হলো সাধের বাড়িখানা। অবশ্য অধিকার ত্যাগ করার আগে শেষ চেষ্টা করেছিলেন মি. লুটজ, ডেকে এনেছিলেন একজন ধর্মযাজকে। ফল হয়নি তাতেও- সেই পুরোহিতকেই বরং পালাতে হয়েছে উর্ধ্বশ্বাসে।

লুটজ পরিবার; Image Source: frightful.com

লুটজ পরিবারের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা চাউর হচ্ছিল ক্রমে ক্রমে। সোজাসুজি বলতে গেলে, এই বিষয় ছাড়া অন্য কোনো আলোচনাতেই অ্যামিটিভিল অঞ্চলের আসরগুলো ঠিকঠাক জমছিল না। কেউ বলছিল, অ্যামিটিভিল হাউস সত্যি সত্যিই ভূতেদের আখড়া। আবার অন্য কেউ বলছিল গোটা ব্যাপারটাই স্রেফ ধাপ্পা- সবটাই পকেট গরম করার পাঁয়তারা। সত্যিটা যা-ই হোক, শেষমেশ পকেট তাদের গরম হয়েছিল বটে- তা-ও আবার এই গপ্পো বেচেই! 

১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ সালে লুটজ দম্পতি প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সামনে আসেন। গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেন তাদের জীবনের চরম দুর্বিষহ ২৮ দিনের খুঁটিনাটি। ব্যস, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। রোমাঞ্চপ্রেমী আমেরিকাবাসীর মুখে মুখে ফিরতে থাকে অ্যামিটিভিলের চটকদার কাহিনী। বাড়িটির ওপর গবেষণা করার জন্য গঠন করা হয় রিসার্চ টিম, দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে ১১২ ওশান এভিনিউয়ের সংকীর্ণ রাস্তাগুলোকে হিমশিম খেতে হয়।

কাকতালীয়ভাবে, গবেষণার ফলাফলও অ্যামিটিভিল আতঙ্ককে ভীষণভাবে সমর্থন করে। জানা যায়, ডিফেও হত্যাযজ্ঞের অনেক আগে সিনেকক ইন্ডিয়ান জাতির কেউ বা কারা এই বাড়িতেই পাগলাগারদ গোছের একটি প্রতিষ্ঠান চালাতো। লুটজ পরিবার বর্ণিত গল্পকে কিংবদন্তির পর্যায়ে যেতে এই খবরটিই ছিল পর্যাপ্ত। কেননা সেই আদ্যিকাল থেকেই প্রায় সকল আমেরিকান ভৌতিক গল্পে উপজাতি সংক্রান্ত উপাদান ছিল একটি অবিচ্ছেদ্য এবং অশুভ অঙ্গ, যার প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি স্বয়ং স্টিফেন কিংও। 

জে অ্যানসনের বই; Image Source: amazon.com

এই যখন পরিস্থিতি, তখন দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে ভৌতিক-অলৌকিক কাহিনীকার জে অ্যানসনের। তিনি দেখা করলেন লুটজ দম্পতির সাথে। কিনে নিলেন তাদের অ্যামিটিভিল অভিজ্ঞতার কপিরাইট। এমনটিই হয়তো প্রত্যাশা ছিল ঋণগ্ৰস্ত জর্জ ও ক্যাথলিনের। 

১৯৭৭ এর শেষার্ধে বাজারে এলো ‘দ্য অ্যামিটিভিল হরর: অ্যা ট্রু স্টোরি’। এই একটি বইয়ের জন্যই অ্যানসন পরিচিতি পেলেন পৃথিবীব্যাপী। তবে সেই পরিচিতির কতটুকু তার সাহিত্য প্রতিভার জন্য, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ট। কারণ, অ্যামিটিভিল হাউস সম্পর্কে তখনকার জনসাধারণের মনে আগে থেকেই আগ্রহ ছিল। তাই এই বাড়ির ওপর যখন বই লেখা হলো, পাঠকমহল সেটা লুফে নিলো। তাছাড়া এই একটি বই বাদে অ্যানসনের অন্য কোনো কাজ এতটা পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। সে যা-ই হোক, ‘দ্য অ্যামিটিভিল হরর’ ৪২ সপ্তাহ পর্যন্ত বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বইটির ৩৭টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, বিক্রি হয় ৬.৫ মিলিয়ন কপি। এখানেই শেষ নয়, বইটির চলচ্চিত্র শর্তটি বিক্রি হয় চড়া দামে। সিনেমাটির চিত্রনাট্যটিও লেখানো হয় খোদ অ্যানসনকে দিয়ে। 

ক্রোমার্টি দম্পতি; Image Source: courierpostonline.com

এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। লুটজ পরিবারের অর্থমন্দা ঘুচেছিল, অ্যানসনও ছিলেন বহাল তবিয়তে। কিন্তু গোল বাঁধালো নবাগত আরেক দম্পতি- ক্রোমার্টি দম্পতি। জিম ও বারবারা ক্রোমার্টি অ্যামিটিভিল হাউসে উঠেছিলেন ১৯৭৭ এর বসন্তে। লুটজ পরিবার বাড়িটি খালি করে দেয় ঠিক তার ১৪ মাস আগে। যে বাড়িকে ঘিরে এত কাণ্ড, সেই বাড়ি ক্রোমার্টি যুগলকে কিন্তু কোনোপ্রকার অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করেনি। তারা প্রায় এক দশকের দীর্ঘ সময় সেই তথাকথিত হানাবাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাটে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাটে থাকা হয়নি লুটজ পরিবার আর অ্যানসনের। কারণ ক্রোমার্টি দম্পতি তাদের বিরুদ্ধে ছোট্ট একটি মামলা ঠুকে দেয়। মামলার বিষয় ছিল, বইটির শিরোনামে ‘অ্যা ট্রু স্টোরি’ কথাটি ব্যবহার করা। এই ঘটনা সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের মনেই লুটজ দম্পতি ও জে অ্যানসনের প্রতি সন্দেহের উদ্রেক করে। আর এই সন্দেহের আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে আইনজীবী উইলিয়াম ওয়েবারের উস্কানি- তিনি তার এক বক্তব্যে লুটজ দম্পতির কাহিনীকে সম্পূর্ণ গাঁজাখুরি আখ্যা দেন। বলে রাখা ভালো, এই উকিলের অফিসেই লুটজ দম্পতি প্রথমবার গণমাধ্যমের সামনে আসেন। আর এই একই ব্যক্তি ডিফেও হত্যাকাণ্ডের আসামি পক্ষের উকিলও ছিলেন। 

অ্যানসন ও জর্জ লুটজকে মুখোমুখি হতে হয় নানা প্রশ্নের। অ্যানসন এসব প্রশ্নের উত্তর কিছুটা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দিলেও লুটজ বরাবরই দৃঢ়তার সাথে এসব পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। এমনকি মিস্টার এবং মিসেস লুটজ উতরে যান লাই ডিটেক্টর টেস্টেও। যদিও অ্যানসন অথবা লুটজ দম্পতির কেউই এখন আর বেঁচে নেই, কিন্তু ড্যানিয়েল লুটজকে আপনি পেয়ে যাবেন নিউ ইয়র্কের কুইন্সে। তিনি আপনাকে শোনাবেন, কীভাবে ঐ অভিশপ্ত বাড়ি তার গোটা পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে আর কেমন কেমন বীভৎস দুঃস্বপ্ন তাকে আজও তাড়া করে ফেরে! 

রোনাল্ড ডিফেও জুনিয়র; Image Source: alchetron.com

সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, অ্যামিটিভিল আতঙ্কের যে কাহিনী লোকমুখে শোনা যায়, বইয়ে পড়া যায় অথবা রুপোলি পর্দায় দেখা যায়- তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা, তা এই ২০১৯ সালে বসেও ধার্য করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মানদণ্ডে না মেপে আপনি যদি শুধুমাত্র এই ঘটনার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়ে ভাবেন, তবুও রীতিমতো গবেষণা করার মতো রসদ পেয়ে যাবেন। কেননা, এই একটি বাড়ি আর তাতে কাটানো ২৮টি দিনের ওপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র সিনেমাই নির্মাণ হয়েছে ২৩টি! তাছাড়া বই, ডকুমেন্টারি এসব তো আছেই!

এবার চলুন চিনে নেওয়া যাক সেই কুখ্যাত আততায়ীকে, যার নির্দয় বুলেট কেড়ে নিয়েছিল ডিফেও পরিবারের ছ’জন সদস্যের প্রাণ। তার নাম রোনাল্ড ডিফেও জুনিয়র- মৃত ডিফেও সিনিয়রের একমাত্র জীবিত উত্তরসূরী! জীবনবীমার দু’লক্ষ ডলার পাওয়ার জন্য সে ঘটিয়েছিল এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। তার বর্তমান ঠিকানা, ফলসবার্গের কারাগার।

This Bangla article is about the Amityville House, an alleged haunted one. 

References:

1. The True, Twisted Story of Amityville Horror - Topic 

2. Inside the IRL 'Amityville Horror' House - Cosmopolitan 

3. The Real Amityville Horror - Biography

Featured Image: movies.film-cine.com

Related Articles

Exit mobile version