পিরামিড বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিসরের গিজায় অবস্থিত পিরামিডগুলোর দৃশ্য। সন্দেহ নেই, মিসরের পিরামিডগুলোই আকার-আকৃতিতে সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। কিন্তু এগুলোই বিশ্বের একমাত্র পিরামিড না। শুধুমাত্র মিসরের পার্শ্ববর্তী দেশ সুদানের একটি এলাকাতেই যতগুলো পিরামিড আছে, পুরো মিসর জুড়েও ততগুলো পিরামিড নেই। সুদানের পিরামিডগুলো আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট, বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন, পর্যটকদের কাছেও কম পরিচিত, কিন্তু ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে এগুলোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সুদানে অবস্থিত এই পিরামিডগুলোর পরিচিতি মেরো পিরামিড বা নুবিয়ান পিরামিড হিসেবে। এই পিরামিডগুলো নির্মাণ করেছিলেন প্রাচীন কুশ রাজবংশের শাসকরা, যারা কালো ফারাও নামেও পরিচিত। ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হলেও কুশ রাজবংশের সভ্যতা ছিল নীল নদের তীরে অবস্থিত প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কয়েক হাজার বছর ধরে তারা অত্যন্ত দাপটের সাথে এই অঞ্চলে রাজত্ব করেছিল এবং একপর্যায়ে মিসরীয় রাজবংশের পতন ঘটিয়ে মিসরের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিয়েছিল। সে সময়ই তারা মিসরীদের কাছ থেকে পিরামিড নির্মাণের সংস্কৃতি আত্মীকরণ করে বলে ধারণা করা হয়।
নুবিয়ান পিরামিডগুলোর অবস্থান প্রাচীন নুবিয়া নামক এলাকায়, যা বর্তমান সুদানের উত্তরাঞ্চলের নীল নদের তীরবর্তী উপত্যকায় অবস্থিত। এই নুবিয়া এলাকায় বিভিন্ন সময় তিনটি কুশ রাজবংশ শাসন করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রথম কুশ রাজবংশের, যাদের রাজধানী ছিল সেসময় কেরমা নগরে। তারা খ্রিস্টপূর্ব ১৫২০ সাল পর্যন্ত নুবিয়াকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রাজ্য হিসেবে পরিচালনা করেছিল। দ্বিতীয় কুশ রাজবংশ স্থায়ী হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ পর্যন্ত। এ সময় তাদের রাজধানী ছিল নাপাতা নগরে। সর্বশেষ কুশ রাজবংশের রাজধানী ছিল মেরো নগরীতে, যেখানে তারা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করে।
নুবিয়ান পিরামিডগুলো নির্মিত হয়েছিল নাপাতা এবং মেরো রাজবংশের সময়, যারা প্রাচীন মিসরীয় সংস্কৃতি দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিল। এ সময় মিসরের রাজবংশ ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে এবং নুবিয়ান রাজবংশ অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫১ অব্দে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২,৭৬৮ বছর পূর্বে নাপাতা রাজত্বের সময় কুশ রাজা পিয়াঙ্খী মিসরের ২৪ তম রাজবংশকে উৎখাত করেন এবং পুরো নীল নদের তীরবর্তী উপত্যকাগুলোকে নিজের অধীনে নিয়ে আসেন। পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে তারা ২৫ তম সাম্রাজ্যের ফারাও হিসেবে এই বিশাল এলাকা শাসন করেন। এ সময়ে তারা মিসরীয় বিভিন্ন প্রযুক্তি, ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি আয়ত্ত্ব করে নেন।
নুবিয়ান এলাকাগুলোতে কুশ রাজাদের রাজত্বের কয়েকশ বছর ধরে সর্বমোট ২৫৫টি পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। এই সংখ্যা মিসরের পিরামিডের চেয়ে অনেক বেশি। মিসরে প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে মাত্র ১২০টির মতো পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। মিসরের পিরামিডগুলোর মতোই সুদানের নুবিয়ান পিরামিডগুলোও তৈরি করা হয়েছিল রাজপরিবারের সদস্যদের সমাধিক্ষেত্র হিসেবে। এসব পিরামিডে শায়িত আছে নাপাতা এবং মেরো রাজ্যের রাজা-রানী এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনরা।
প্রথম নুবিয়ান পিরামিডগুলো নির্মিত হয়েছিল আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মিসরীয় পিরামিডগুলোর অনেক পরে। এগুলো নির্মিত হয়েছিল নুবিয়ান সাম্রাজ্যের আল-খুরু এলাকায়। এখানে শায়িত আছেন রাজা পিয়াঙ্খী, তার পিতা রাজা কাস্থা, পিয়াঙ্খীর উত্তরাধিকারী শাবাকা, শাবাকাতা এবং তানওয়েতামানি। এছাড়াও এখানে ১৪টি পিরামিড আছে রাজ্যগুলোর রানীদের জন্য, যাদের মধ্যে আছেন কয়েকজন নারী যোদ্ধা। রাজা পিয়াঙ্খী ছিলেন ৮০০ বছরের মধ্যে প্রথম রাজা, যাকে পিরামিডের মধ্যে সমাহিত করা হয়েছিল।
নাপাতা যুগের পরবর্তীকালের পিরামিডগুলো নির্মিত হয় নীলনদের পশ্চিম তীরে, যেখানে ২১ জন রাজা এবং তাদের ৫২ জন স্ত্রী ও সন্তানদের সমাধি রচিত হয়েছিল। এখানের মৃতদেহগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছিল গ্রানাইটের তৈরি বিশাল বাক্সের ভেতর, যার মধ্যে একটি বক্সের ওজন প্রায় ১৫.৫ টন। শুধুমাত্র এর ঢাকনাটিরই ওজন প্রায় ৪ টন। তবে নুবিয়ান পিরামিডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময় পিরামিডগুলোর অবস্থান মেরোতে, যা বর্তমান সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মেরো রাজবংশের সময় সেখানে প্রায় ৪০ জন রাজা-রানীকে সমাহিত করা হয়েছিল।
নুবিয়ান পিরামিডগুলো মিসরের পিরামিডগুলোর চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। এগুলো আকৃতিতে অনেকটা ছোট। অধিকাংশের উচ্চতাই ৩০ মিটারের চেয়ে কম, যেখানে মিসরের গিজার বৃহত্তম পিরামিডের উচ্চতা ১৪৬ মিটার। নুবিয়ান পিরামিডগুলো খাড়া ঢাল বিশিষ্ট। উচ্চতার তুলনায় ভূমির ক্ষেত্রফল কম হওয়ার কারণে নুবিয়ান পিরামিডগুলোর অধিকাংশেরই ঢাল প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ডিগ্রি, যেখানে কাছাকাছি উচ্চতার মিসরীয় পিরামিডগুলোর ঢাল প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি।
এই খাড়া ঢালের কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়, পিরামিডগুলো নির্মিত হতো বিশেষ ধরনের শাদুফ ক্রেনের সাহায্যে। ক্রেনগুলোকে পিরামিডের অভ্যন্তরে কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করা হতো এবং ধীরে ধীরে চারপাশের দেয়াল নির্মাণ করা হতো। ক্রেনের বাহুর দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে পিরামিডের ভূমির ক্ষেত্রফল তাই খুব বেশি হতে পারতো না। ফলে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছার জন্য বাধ্যতামূলকভাবেই এদেরকে খাড়া ঢাল বিশিষ্ট হতে হতো।
মিসরের পিরামিডের সাথে নুবিয়ান পিরামিডের পার্থক্য এখানেই শেষ না। ১৮৯৭ সালে জেবেল বারকাল নামক পর্বতে কিছু পিরামিডের অভ্যন্তরে ব্রিটিশদের দ্বারা পরিচালিত এক খনন কাজে দেখা গেছে যে, মিসরের পিরামিডগুলোর মতো এখানে মূল পিরামিডের অভ্যন্তরে কোনো মমি নেই। বরং এখানে মমি রাখা হয়েছে পিরামিডের কেন্দ্রে মাটির নিচে অবস্থিত বিশেষ প্রকোষ্ঠে। সুতরাং নুবিয়ান পিরামিডগুলো প্রকৃতপক্ষে যতটা না সমাধিকক্ষ, তার চেয়ে অনেক বেশি সমাধির মাথার ওপর নির্মিত বিশাল আকৃতির স্মৃতিফলক।
নুবিয়ান পিরামিডগুলো পরস্পর থেকে অনেক কাছাকাছি অবস্থিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের পারস্পরিক অবস্থান কিছু কিছু নক্ষত্রের পারস্পরিক অবস্থানের আদলে নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছোট এবং মাঝারি বিভিন্ন আকারের পিরামিড আছে। সবচেয়ে বড় পিরামিডটির ভূমির প্রস্থ ৭ মিটার। অন্যদিকে সবচেয়ে ছোট পিরামিডটির ভূমি মাত্র ৭৫ সেন্টিমিটার চওড়া। ধারণা করা হয়, এখানে রাজপরিবারের কোনো শিশুকে সমাহিত করা হয়েছিল।
মিসরের মতোই নুবিয়ান পিরামিডগুলোর ভেতরে অবস্থিত রাজপরিবারের সদস্যদেরকেও মমিতে রূপান্তরিত করে কাঠের অথবা মার্বেলের বাক্সে সংরক্ষণ করা হতো। মিসরীয়দের মতোই কুশ রাজারাও বিশ্বাস করতেন যে, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে ধন সম্পত্তি এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্রের প্রয়োজন হবে। তাই বাক্সের ভেতর তাদের সাথে দিয়ে দেওয়া হতো মূল্যবান স্বর্ণালঙ্কার। কিছু কিছু পিরামিডের ভেতরে স্বর্ণালঙ্কার ছাড়াও তীর, ধনুক, তীরন্দাজের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে পরিধান করার রিং, ঘোড়ার জিন, কাঠ এবং ধাতুর তৈরি বিভিন্ন পাত্র ও আসবাবপত্র প্রভৃতি পাওয়া গেছে।
নুবিয়ান পিরামিডগুলো দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মোটামুটি অক্ষত অবস্থায় ছিল। কিন্তু ১৮৩৪ সালে ইতালিয়ান পরিব্রাজক এবং গুপ্তধন শিকারী গুইসেপ ফেরলিনি যখন একটি পিরামিডের অভ্যন্তরে কিছু স্বর্ণের সন্ধান পান, তখন মূল্যবান অলঙ্কার এবং গুপ্তধনের লোভে তিনি বাকি পিরামিডগুলোতেও অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। খননকার্যের জন্য লোকবল নিয়ে ফিরে আসার আগেই যেন অন্য কেউ স্বর্ণের খোঁজে পিরামিডগুলোতে প্রবেশ না করে, সেজন্য তিনি অন্তত ৪০টি পিরামিডের চূড়া ধ্বংস করে দেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী গুপ্তধন শিকারীদেরকে বিভ্রান্ত করা, যেন তারা মনে করে যে, পিরামিডগুলো আগেই লুট হয়ে গেছে। এছাড়াও, পিরামিডগুলো যে ধরনের ছোট আকৃতির পাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো ছিল বেশ মূল্যবান। দালান নির্মাণের জন্য বিভিন্ন সময় অনেকে কয়েকটি পিরামিড থেকে এরকম কিছু পাথরও খুলে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কিছু কিছু পিরামিড সংস্কার এবং সংরক্ষণ করা হয়েছে, কিন্তু অনেকগুলো এখনও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে।
নুবিয়ান পিরামিডগুলোকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুদানের ভঙ্গুর অর্থনীতি, অস্থিতিশীল রাজনীতি প্রভৃতি কারণে এই পিরামিডগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই এতদিন পরেও উত্তর আফ্রিকার ইতিহাস এবং প্রাচীন স্থপত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই পিরামিডগুলো বিশ্বের কাছে অনেকটাই অজানা রয়ে গেছে।