১৯৪২ সালের ডিসেম্বর। আমেরিকান মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব দেওয়া হয় আসাম থেকে কুনমিং পর্যন্ত লেটো রোড (স্টিলওয়েল রোড) তৈরি করার জন্য, যাতে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চীনাদের যুদ্ধ উপকরণ সরবরাহ করা সহজ হয়। রাস্তা বানানোর কাজের সময় ব্রিটিশ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের এক জরিপ তাদের কাজকে অনেকখানি সহজ করে দেয়, যা করা হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে।
জরিপটি করা হয় ১৮৯৪-৯৫ সালে, লক্ষ্য বার্মা এবং আসামকে রেলওয়ে লাইনের মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া। এর নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী আরএ ওয়ে, সাথে ব্রিটিশ প্রকৌশলী এবং সেনা কর্মকর্তারা। তবে আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে খাসিয়াসহ উত্তর-পূর্ব ভারত ও বার্মার অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর সাহায্য নেওয়া হয় এই রুক্ষ-কর্কশ পরিবেশ ভালোভাবে চেনা-বোঝার জন্য।
১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ভারত সরকারের গণপূর্ত বিভাগ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে সাম্রাজ্যে যুক্ত হওয়া নতুন অঞ্চলে অভিযানের বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ভারত এবং বার্মাকে রেলপথে সংযুক্ত করার সর্বোত্তম উপায় হলো ৪৫৭ কিলোমিটার রেলওয়ে তৈরি, যা আসামের তিনসুকিয়া জেলার ছোট শহর লেডো থেকে শুরু হবে এবং বার্মায় প্রবেশের আগে আধুনিক অরুণাচল এবং পাটকাই রেঞ্জে প্রবেশ করবে। রুটের ২৪১ কিলোমিটার জমির আশপাশ চাষযোগ্য, তবে খুব কম জনবসতিপূর্ণ। রেলওয়ের বাকি অংশ যাবে পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। তিনটি আলাদা রুট জরিপ করার পর গণপূর্ত বিভাগ এই রুটকেই সবচেয়ে ভালো বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে উত্তর বার্মাকে বাণিজ্যিকভাবে শোষণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য নিখুঁত ছিল এই পরিকল্পনা।
আদর্শ রুটের সন্ধান
ভারত রেলযুগে প্রবেশ করে ১৮৫৩ সালে, যখন বোম্বের বোরিবন্দর থেকে থানা পর্যন্ত ট্রেন চালু হয়। পরবর্তী কয়েক দশকে রেলপথ ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক অংশে প্রসারিত হয়, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এলাকা থেকে ইংরেজদের বন্দর পর্যন্ত, যাতে ইংরেজরা সেগুলো সহজে পাচার করতে পারে।
আসাম প্রথম রেললাইনের সাথে সংযুক্ত হয় ১৮৭১ সালে। ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটার গেজ লাইন দিব্রুগড়কে মাকুমের সাথে সংযুক্ত করে। বার্মায় প্রথম রেললাইন যোগ হয় এর ছয় বছর পর ১৮৭৭ সালে, রেঙ্গুন থেকে প্রমে পর্যন্ত ২৫৯ কিলোমিটার লাইন প্রস্তুত হয়। যদিও ব্রিটিশরা প্রথমদিকে স্টিমার সার্ভিসের মাধ্যমে ভারত থেকে বার্মার দক্ষিণ অংশে প্রবেশ করা সহজ বলে মনে করলেও ১৮৮৫ সাল নাগাদ সমস্ত বার্মার নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর পুরো অঞ্চলকে সংযুক্ত করার জন্য রেললাইন নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করে। সে সময় বার্মা ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ।
১৮৯৬ সালের গণপূর্ত বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়,
১৮৯৩ সালে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আসাম এবং বার্মাকে সংযুক্ত করার রেলপথ নির্মাণ করার জন্য একটি জরিপ চালানো হবে, তখন ধারণা করা হয়েছিল যে, আসাম-বাংলার প্রান্ত চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণে গেলেই সবচেয়ে কাঙ্খিত রুটটি পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম থেকে আরাকান উপকূল ঘেঁষে আকিয়াব পর্যন্ত, এবং সেখান থেকে পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ইরাবতীর আয়েং পাস হয়ে মিনহলা পর্যন্ত, এবং আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে টংগু-মান্দালয় লাইনের মেকটিলা রোড পর্যন্ত সংযোগ দেওয়া হলেই বার্মা-ভারত সংযুক্ত হবে।
ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যও বঙ্গোপসাগরের উপকূলের সমান্তরাল একটি রেলওয়ে লাইন নির্মাণ করা সহজ এবং আরও লাভজনক ছিল। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল না সামরিক কর্তৃপক্ষ। ১৮৯৪ সালে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়াররা রাখাইন রাজ্যের এং পাসের উপর করে জরিপ করে জানান যে, এলাকাটি রেললাইনের জন্য অনুপযুক্ত।
ভারত-বার্মা রেলওয়ে লাইনের জন্য দ্বিতীয় বিকল্পটি ছিল মণিপুরের ওপর দিয়ে। গণপূর্ত বিভাগের প্রতিবেদনেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়। প্রকৌশলীরা এই পথকে একেবারে অসম্ভব হিসেবে রায় না দিলেও এর মূল সমস্যা ছিল এই রুটে তিনটি পর্বত চূড়া অতিক্রম করতে হবে। এই রুটের রাস্তা ৩৮৫ মাইল দূরত্বের হলেও রেললাইনের জন্য আদর্শ রাস্তা তৈরি করতে হলে মাইল প্রতি ১.৬৯ লক্ষ টাকা (সবমিলিয়ে ৬.৫ কোটি রূপি) খরচ হবে। ফলে এই রুটকেও বাদ দেওয়া হয়।
মারণাত্মক পথ
প্রধান প্রকৌশলী আরএ ওয়ের কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছিল উত্তর বার্মার হুকং (হুকাওং) উপত্যকার সাথে আসামকে সংযুক্ত করবে এমন একটি রেলওয়ে লাইন। ঘন পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই অঞ্চলের সম্পদের দিকেও ব্রিটিশদের নজর ছিল।
ওয়ে তার দল নিয়ে ১৮৯৫ সালের বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৩৫০ জন খাসিয়া শ্রমিকসহ ৫০০ জনের বিশাল এক দলকে তৈরি করা হয় আসামের লেডো থেকে হুকং উপত্যকায় পাড়ি জমানোর জন্য, সময় তিন মাস।
গণপূর্ত বিভাগের প্রতিবেদনে লেখা হয়, অভিযানটি আসাম থেকে শুরু করা উচিৎ বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একজন ব্রিটিশ অফিসারের নেতৃত্বে ১০০ জন রাইফেলবাহী সেনা তাদেরকে এসকর্ট করে হুকং উপত্যকার নিংবাইন পর্যন্ত নিয়ে যাবে, যেখানে বার্মা থেকে আসা অনুরূপ আরেকটি দল উল্টোদিক থেকে এসে তাদের সাথে মিলিত হবে।
তবে যাদের নাম অভিযানে যুক্ত করা হয়েছিল, তাদের অনেকেই বার্মা পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেনি। আসামের মার্গেরিটায় খাসিয়া শ্রমিকদের একটি বড় দল কলেরায় আক্রান্ত হয়। সবাইকে রুশ ইহুদি ডাক্তার ভাল্ডেমার হাফকাইনের তৈরি কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও ৩৫ জন কলেরায় মারা যায়। প্রতিবেদনে লেখা হয়, একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল, খাসিয়া শ্রমিকরা তাদের চারপাশে তাদের সহযাত্রীদেরকে মারা যেতে দেখলেও আশ্চর্যজনকভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে অপারগতা দেখায়নি। তবে এর কারণ সম্ভবত ছিল ব্রিটিশ মেডিক্যাল অফিসারের অবিরাম উপস্থিতি। চন্দ্র কিশোর দে নামের একজন হাসপাতাল সহকারী ক্যাম্পেই থাকতেন এবং ক্রমাগত শ্রমিকদেরকে অনুপ্রাণিত করছিলেন যে, যা যা করা সম্ভব তার সবকিছুই করা হচ্ছে এবং করা হবে। প্রতিবেদনে খাসিয়াদেরকে উল্লেখ করা হয় ‘শৃঙ্খলার জন্য একেবারে উপযুক্ত’ হিসেবে।
বেঁচে থাকা খাসি শ্রমিকরা সুস্থ হওয়ার পর দলটি জমি জরিপ চালিয়ে বার্মার দিকে এগোতে থাকে। এই এলাকা দিয়ে যে রেললাইন তৈরি সম্ভব তা নিয়ে ইতিবাচক মতামত পাওয়া যায় জরিপকারীদের কাছ থেকে। এছাড়াও এলাকায় অন্যান্য সম্পদ থেকে শুরু করে কীভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করা যায় তা নিয়েও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন: তাদের পরিকল্পনায় মার্গেরিটা কয়লাক্ষেত্র সম্প্রসারণ এবং রেললাইনের জন্য খননকৃত কয়লা ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
নয়নাভিরাম দৃশ্য
গণপূর্ত বিভাগের প্রতিবেদন আমলাতান্ত্রিক নথি হলেও এতে পূর্ব ভারত আর বার্মার প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সম্ভবত ওয়েই এই অংশ লিখেছেন, যেখানে পাটকাইসহ বর্তমান অরুণাচল, নাগাল্যান্ড এবং উত্তর বার্মার প্রকৃতি নিয়ে লেখা হয়েছে।
পাটকাই রিজের (৩,৯৭৭ ফুট) চূড়া থেকে এক চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়: উত্তরে, নামক্রির উপত্যকা এবং নামফুকের কিছু অংশ, তার সামনে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়; পশ্চিমে, নামচিকের উন্মুক্ত উপত্যকা আর নিচু পাহাড়। ব্রহ্মপুত্র নদকে দূর থেকে দেখা যায় এবং সেটি ছাড়িয়ে মিশমি অঞ্চলের গাছপালা চোখে পড়ে, একইসাথে পুরো উত্তর দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১৫০ থেকে ২০০ মাইল দূরের হিমালয়ের তুষারময় অঞ্চল এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করে।
দলটি বার্মা পৌঁছানোর আগপর্যন্ত ঘন জঙ্গল এবং দুর্গম পাহাড়ের ভেতর দিয়ে কীভাবে ভবিষ্যতে রেলপথ স্থাপন করা যায়, তা নিয়ে ভালোভাবে জরিপ চালিয়ে আসে। তবে হুকং উপত্যকায় প্রবেশ করার পর পথ অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। প্রতিবেদনে লেখা হয়,
হুকং উপত্যকায় পৌঁছানোর পর (১৪৬ মাইল) রেললাইন নির্মাণে আর বড় কোনো বাধা নেই। পাহাড়গুলো ক্রমেই নিচু হয়েছে, আর তারপরে একটি সমতল অঞ্চল শুরু হয়েছে, যেটি মোগাং পর্যন্ত বাকি পথে রেললাইন বসানোর কাজ সহজ করে দিয়েছে।
ব্যয়বহুল প্রকল্প
১৮৯৬ সালে ২৮৪ মাইল বা ৪৫৭ কিলোমিটারের এই রেললাইন বসাতে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল তৎকালীন হিসেবে ৩.৮৮ কোটি টাকা। গ্রহের সবচেয়ে নয়নাভিরাম পরিবেশের রেলপথগুলোর একটি হয়ে উঠতে পারে ভেবে প্রকৌশলীরাও এটি নির্মাণ করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্রস্তাবটি আটকে যায় ব্রিটিশ-ভারতীয় আমলাতন্ত্রের ঘুরপাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করা হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ভারত সরকার ১৯১৯ সালে হুকং উপত্যকা রুটের ওপর আবারো একটি প্রাথমিক সমীক্ষা চালায়, যেখানে রেললাইনের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় আনুমানিক ৭ কোটি টাকায়।
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারত থেকে বার্মা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রকল্প আমলাদের আলোচনায় থাকলেও লাভ হয়নি। প্রস্তাবিত রেললাইনের একটি বড় অংশকে লেডো রোডের সড়কপথে অন্তর্ভুক্ত করা হয, যা ইম্পেরিয়াল জাপানের বিরুদ্ধে চীনা প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে বিশ্বযুদ্ধের পরে রাস্তাটির ব্যবহার কমে যায় এবং একপর্যায়ে জঙ্গল গ্রাস করে নেয়।
ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত এবং বার্মা মুক্ত হওয়ার ৭০ বছর পর আবারও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সহজ করতে এই পথ আবার আলোচনায় এসেছে। আসিয়ান দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে ভারত, মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডকে সংযোগ করে এমন একটি ত্রিপক্ষীয় হাইওয়ে নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশও এই মহাসড়কে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ জানিয়েছে। এই মহাসড়কের সমান্তরালে রেল সংযোগ স্থাপনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সংযোগ কেবল ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর পূর্বে থাকা প্রতিবেশিদের মধ্যে বাণিজ্য এবং ভ্রমণই বাড়াবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযোগ করার স্বপ্নও পূরণ হবে।