প্রতিটি আদি গোত্রের গল্পেই আমরা পেয়ে থাকি কিছু ভয়ঙ্কর দানবাকার প্রাণীর কথা, তাদের বধের গল্প। এই মিথলজিক্যাল প্রাণীগুলো আদতে শুধু গল্পই নয়, বরং এর দ্বারা আমাদের আদি গোত্রের লোকজনের চোখের দেখা পৃথিবী কিংবা কীভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা-ও শিখতে পারি। মানুষের কল্পনার তৈরি এসব মিথোলজিক্যাল প্রাণীর মধ্য থেকে আজ আমরা জানবো কিছু ভয়ঙ্কর প্রাণী সম্পর্কে।
ওয়েন্ডিগো
মানুষখেকো দানব হিসেবে সুপরিচিত ওয়েন্ডিগো নামের এই কাল্পনিক প্রাণী। মিথোলজি অনুযায়ী, গ্রেট লেকের আশেপাশে ওয়েন্ডিগোদের বসবাস ছিলো। ওয়েন্ডিগো দেখতে অনেকটা গোরস্থান থেকে উঠে আসা কঙ্কালসার মানুষের মতো। পাতলা ও বিবর্ণ চামড়ার সাথে তাদের বুকের ও পাঁজরের হাড়গুলো লেগে থাকতো বিধায় খালি চোখেও সেগুলো দৃশ্যমান ছিলো। চোখগুলো একেবারে গর্তে ঢোকানো এই প্রাণীকে দেখলে মনে হবে, অনেকদিনের অনাহারে তাদের এই অবস্থা।
আদতে মোটেও তা নয়। উপকথা মতে, ওয়েন্ডিগোর ক্ষুধা কখনোই নিবারণযোগ্য নয়। মানুষের মাংস খাওয়ার সাথে সাথে দৈহিক বৃদ্ধির সাথে তাদের খাওয়ার চাহিদাও পাল্লা দিয়ে বাড়ে।
বলা হয়ে থাকে, ১৬৬১ সালে একদল মিশনারি গ্রুপ এলগনকুইন্স নামের এক স্থানে তাবু গাড়ে। জায়গাটি ছিলো ওটোয়া নদীর তীরবর্তী এক বনের সাথে। সেখানে কয়েকজন মানুষ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তারাই পরবর্তীতে ওয়েন্ডিগোতে রূপান্তর হয় এবং নিজ গোত্রের মানুষদের খাওয়া শুরু করে। তবে বেশিরভাগের মতেই ওয়েন্ডিগো বলতে আসলে কিছুই নেই, বরং ক্ষুধার তাড়নায় সেই মিশনারি দল মানুষখেকো হয়ে উঠে।
মিনোটার
গ্রিক উপকথায় মানুষ ও ষাড়ের সম্মিলিত এক রুপকে মিনোটার আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মিনোটারের উপকথা সর্বপ্রথম শুরু হয় ১৪ জন এথেনিয়ান শিশুর উৎসর্গের মাধ্যমে। এর হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই ১৪ শিশুকে ক্রিট দ্বীপের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখানে বাস করতো মিনোটার। শিশুরা যতই সতর্ক থাকুক না কেন, মিনোটারের হাত থেকে তাদের নিস্তার ছিলো না। বরং চিৎকার করার আগেই মিনোটার তাদের শরীর ছিড়ে গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখতো।
গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী, ক্রিটের রানী ও ষাড়ের মিলনে জন্ম হয় এই ধর্মহীন সন্তান মিনোটারের। এসটেরিয়ন নামেও ডাকা হয় তাকে। তবে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারেনি সে। ক্রিটের রাজা রানীর এহেন কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে মিনোটারকে অন্ধকার গুহায় বন্দী করেন।
তবে প্লুটার্ক দাবি করেন, মিনোটার নামে আদৌ কিছু ছিলো না। রাজা মিনোস প্রতি বছর তার মৃত সন্তানকে স্মরণের জন্য এক উৎসব আয়োজন করতেন। উৎসবে থাকা বিভিন্ন খেলার বিজয়ীকে এথেনিয়ান শিশু উপহার দেওয়া হতো। টাউরাস নামের এক নিষ্ঠুর লোক উপহার পাওয়া সেই শিশুদের জঘন্যভাবে অত্যাচার করতো বলে তাকে মানুষ আক্ষরিকভাবেই দানব ভাবা শুরু করে।
আবার অনেকের মতে, এথেন্সের রাজা থিসাস নিজ হাতে মিনোটারকে হত্যা করতে সক্ষম হন।
বাসিলিস্ক
সরীসৃপের মতো এই মিথোলজিক্যাল প্রাণীটি এতটাই বিষাক্ত ছিলো যে, তার সামান্য চোখের দৃষ্টিতেই প্রাণ হারাতো যে কেউ। রোমানদের মতে, বাসিলিস্কের প্রাচুর্য ছিলো সাইরেন নামক এক স্থানে, যা এখন পরিচিত লিবিয়া নামে। রোমান লেখক পিনির মতে, বাসিলিস্ককে হত্যা করার ক্ষমতা কারোরই ছিলো না। এর গায়ে বর্শা নিক্ষেপ করলেও শরীর থেকে পানির মতো করে বিষ পড়তো, যাতে করে ওই এলাকার সবাই জীবন হারাতো।
অনেকের ধারণা, এই বাসিলিস্কই বিবর্তনে কোবরা সাপে রুপান্তর হয়েছে, যার দরুন লিবিয়াতে কোবরা সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে ১৫৮৭ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ’-তে এক মহিলা দাবী করেন, তার মেয়েকে বাসিলিস্কের মতো এক সরীসৃপ হত্যা করেছে। যদিও সেই দাবীর যৌক্তিক কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
নিয়ান
নিয়ান নামের এই প্রাণীকে ঘিরে ভৌতিক সব কাহিনী শোনা যেত প্রাচীন চীনে। তৎকালীন সময়ে চীনের বাসিন্দারা বিশ্বাস করতো, খাবারের জন্য যেকোনো সময় পাহাড় থেকে নেমে আসতে পারে নিয়ান। তাদের মতে, নিয়ান ছিলো চিরঞ্জীব। কোনো অস্ত্রের সাধ্য নেই নিয়ানকে বধ করার। তাই তারা নিজেদের বাসস্থানে লুকানোর জন্য গর্ত কিংবা গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করে রাখতো। এই ধরনের ভীতি প্রায় শত বছর ধরেই টিকে ছিলো প্রাচীন চীনে।
পরবর্তীতে এক লোক দাবী করেন, তিনি মানুষের ছদ্মবেশে একজন ঈশ্বর। তিনি দাবী করেন, নিয়ানকে হত্যা না করা গেলেও তাকে জনবহুল এলাকায় আসা থেকে বিরত রাখা সম্ভব। তিনি বলেন, নিয়ান কোলাহল কিংবা অদ্ভুত জীবজন্তু ভয় পায়। সেই থেকে প্রতিবছর চীনে এ ধরনের একটি উৎসব পালন শুরু হয়, যেখানে ড্রামের বাদ্য বাজনা এবং অদ্ভুত লাল রঙের কস্টিউম পরে নেচে-গেয়ে বেড়ায় লোকজন। তাদের ধারণা, এই উৎসব পালন বন্ধ করে দিলেই নিয়ান আবার ফিরে আসবে।
কাইমেরা
গ্রিক উপকথা অনুযায়ী কাইমেরা হচ্ছে টাইফুন নামের দানবাকার সাপ ও তার অর্ধ-মানবী স্ত্রীর সন্তান। হোমারের বিখ্যাত ইলিয়াড গ্রন্থে কাইমেরার বিবরণ দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, কাইমেরা দেখতে অনেকটা সিংহের মতো। তবে পিঠের দিকে রয়েছে আরো একটি অতিরিক্ত মাথা। হোমার লিখেছেন, সেটি দেখতে অনেকটা ছাগলের মাথার মতো। সাথে তার ছিলো ঈগলের ডানা। লেজের বদলে ছিলো হলুদ চোখযুক্ত সর্পাকৃতির মাথা, যা দিয়ে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতো কাইমেরা।
তবে এই কাইমেরাকেই হত্যা করেছিলেন বেলেরোফোন নামের এক যোদ্ধা। পাখাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাসে ভর করে কাইমেরার দিকে বল্লম ছুড়ে মারেন তিনি। বল্লমটি কাইমেরার গলার দিকে বিধলে পেটের আগুনে তা গলে যায়। আর তাতেই শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে কাইমেরা নামের এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটি।
ক্রাকেন
পাইরেটস অফ দ্য ক্যারাবিয়ান মুভি দেখে থাকলে আপনিও ক্রাকেন সম্পর্কে জেনে থাকবেন। ক্রাকেনকে বলা হয় সাগরের সবচেয়ে বড় ও ভয়ঙ্কর প্রাণী। কিছুটা অক্টোপাসের ন্যায় বিশালাকৃতির কর্ষিকা রয়েছে এর। তবে ক্রাকেনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কর্ষিকা কেটে ফেললে তার জায়গায় আরো কয়েকটি কর্ষিকার পুনর্জন্ম হয়।
বিজ্ঞানীরা এই সাগর দানবের সন্ধান এখনো পর্যন্ত না পেলেও ১৮ শতকে এরিক পন্টোপপিডন নামের এক নরওয়েজিয়ান বিশপ দাবী করেছিলেন, তিনি স্বচক্ষে সমুদ্রে ক্রাকেন দেখেছেন। একই কথা কয়েকজন নরওয়েজিয়ান জেলে বললেও ক্রাকেনের প্রমাণ এখনো মেলেনি।
গ্রুটস্ল্যাং
দক্ষিণ আফ্রিকার উপকথা মতে, গ্রুটস্ল্যাং হচ্ছে ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্টি। তাদের মতে, মানুষ সৃষ্টির আগে হাতির চেয়ে বড় বিশালাকৃতির এই সাপ সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। পরবর্তীতে মানুষ সৃষ্টির পর ঈশ্বর বুঝতে পারেন, গ্রুটস্ল্যাং মানবজাতির জন্য বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এর ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার জন্য ঈশ্বর গ্রুটস্ল্যাংকে দুটি গোত্রে আলাদা করেন। পরবর্তীতে এই দুই গোত্র থেকেই উদ্ভব হয় সাপ ও হাতির। কিন্তু একটি গ্রুটস্ল্যাং এই পরিত্রাণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পালিয়ে যায়। আর তা থেকেই আস্তে আস্তে বংশ বিস্তার করে গ্রুটস্ল্যাং। উপকথা অনুযায়ী, এই প্রাণীটি গুহার অনেক ভেতরে বসবাস করে। আর তাদের আশেপাশে হীরার ভান্ডার থাকে।
বর্তমানে অনেকে বিশ্বাস করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার রিচটারভেল্ড গুহায় এদের বসবাস। উল্লেখ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা হীরা ও সাপের জন্য বিখ্যাত।
হাইড্রা
বহু মাথা বিশিষ্ট হাইড্রা গ্রিক মিথোলজির এক জনপ্রিয় ও ভয়ঙ্কর প্রাণী। হাইড্রাকে বলা হয় চিরঞ্জীব প্রাণী। এর যেকোনো একটি মাথা কাটলে সেখানে জন্ম নেয় আরো দুটি মাথা। তবে মাথার পুনর্জন্ম থেকে রক্ষা পেতে হলে হাইড্রার মাথা কাটতে হবে আগুনের শিখা দিয়ে। তারপরও তার আসল মাথাটি কখনোই মেরে ফেলা যাবে না। হাইড্রার বিষাক্ত শ্বাস-প্রশ্বাস যেকোনো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।
এই হাইড্রার মাথা কাটার দায়িত্ব দেওয়া হয় হেরাক্লিসকে। জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে সব মাথা কাটার পর মূল মাথা কাটার জন্য হেরাক্লিস ব্যবহার করেন দেবী এথেনার দেওয়া বিশেষ এক তরবারী। যদিও হেরাক্লিস হাইড্রার মূল মাথা কাটতে সক্ষম হন, তবুও এটি একেবারে মরে যায়নি। তাই হেরাক্লিস একে বিশাল পাথরের নীচে চাপা দেন। মিথোলজি অনুযায়ী, যেকোনো মূহুর্তেই জেগে উঠতে পারে হাইড্রা নামের এই দানবাকার প্রাণী।
স্ফিংক্স
স্ফিংক্স নিয়ে ঘিরে থাকা মিথগুলোকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মিথ। সিংহের মাথা যুক্ত মানুষদেরই স্ফিংক্স নামে সম্বোধন করা হয়। প্রাচীন মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০০ বছর আগে এই মিথ গড়ে উঠে। পরবর্তীতে স্ফিংক্স গ্রিক মিথোলজিতেও প্রবেশ করে। তবে তারা স্ফিংক্সের সাথে লেজ ও পাখা জুড়ে দেয়।
ফারাওদের মুকুটে স্ফিংক্সের প্রতিচ্ছবি ছিলো। বর্তমানে পিরামিডের চূড়ায়ও স্ফিংক্সের মূর্তির দেখা মিলে। তাদের নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ঘটনাটি ইডিপাসের সাথে সম্পর্কিত। ইডিপাস যখন থিবেসের উদ্দেশ্যে রওনা হন, তখন তার সাথে ছিলো একটি স্ফিংক্স। স্ফিংক্স ইডিপাসকে একটি ধাঁধাঁ দেন। ধাঁধাঁটি ছিলো অনেকটা এরকম, “কোন জিনিসটি জন্মের সময় চার পায়ে, মধ্য বয়সে দুই পায়ে এবং শেষ বয়সে তিন পায়ে হাঁটে?” স্ফিংক্স ভেবেছিলো, ‘মানুষ’ উত্তরটি ইডিপাস দিতে পারবেন না। কিন্তু তিনি সঠিক উত্তর দেওয়ায় পীড়নের যন্ত্রণায় নিজেকেই নিজে শেষ করে দেয় স্ফিংক্স। বর্তমানে স্ফিংক্সকে মিশরে দেখা হয় সাহস ও শৌর্যের প্রতীক হিসেবে।