রাজা কালাকাউয়ার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসার দুই বছরের মধ্যেই তার বোন, রানি লিলিউকালানি সিদ্ধান্ত নেন, স্বাধীন রাজ্য হাওয়াইয়ের জনগণের স্বার্থে তিনি নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন। উড়ে এসে জুড়ে বসা আমেরিকান এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের ক্ষমতা খর্বিত করে নতুন সংবিধানে তিনি ভোট দেওয়ার অধিকার দিবেন শুধুমাত্র হাওয়াইয়ান নাগরিকদেরকে।
রানি লিলিউকালানির এ সিদ্ধান্তটি ছিল শতাধিক বছর ধরে হাওয়াইয়ের অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে কুক্ষিগত করে রাখা শ্বেতাঙ্গ এলিট সম্প্রদায়ের জন্য এক অশনি সংকেত। এই এলিট সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশই ছিল আমেরিকান বংশোদ্ভূত। কাজেই সেদিন রাতেই তাদের একটি দল গিয়ে হাজির হয় হাওয়াইয়ে নিযুক্ত আমেরিকান দূত, জন এল. স্টিভেনসের বাড়িতে।
স্টিভেন্সের বাসায় বসে তারা তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে – হাওয়াইয়ে যদি আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করতে হয়, তাহলে এখন তাদের একটাই করNIয় আছে। তারা রানI লিলিউকালানিকে উৎখাত করে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে টিকে থাকা হাওয়াইকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একীভূত করে নেবে। আর পুরো ব্যাপারটিতে স্টিভেন্সের মাধ্যমে পেছন থেকে পূর্ণ সহায়তা দিয়ে যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সেনাবাহিনী।
ঐতিহাসিক এই দিনটি ছিল শনিবার, ১৪ই জানুয়ারি, ১৮৯৩। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ইরাক আক্রমণের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে কয়েকশ’ মার্কিন সেনার ইসরায়েলে পৌঁছার ঠিক ১১০ বছর আগের ঘটনা এটি। এবং এটিই ছিল আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনা, পরবর্তী সোয়াশ’ বছর ধরে যে ঘটনার পুরাবৃত্তি তারা করে এসেছে বিশ্বের বহু দেশে।
গত সোয়াশ’ বছরের ইতিহাসে আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শত শত অভিযান চালিয়েছে, অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। এর মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে কোনো দেশের সরকারকে উৎখাতের ঘটনাও কম নয়। মার্কিন লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক স্টিফেন কিনজারের (Stephen Kinzer) মতে, এখন পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে মোট ১৪টি, যার শুরু হয়েছিল হাওয়াইয়ের রানীকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে।
এই ১৪টি উৎখাতের ঘটনা নিয়েই স্টিফেন কিনজার ২০০৬ সালে প্রকাশ করেছিলেন তার বিখ্যাত বই Overthrow: America’s Century of Regime Change from Hawaii to Iraq। বইটির প্রথম অধ্যায় অবলম্বনে হাওয়াইয়ের রানীকে ক্ষমতাচ্যুত করার মার্কিন ষড়যন্ত্র নিয়েই আমাদের এই আয়োজন। চার পর্বে সমাপ্ত লেখাটির আজ পড়ুন প্রথম পর্ব। এ পর্বে রয়েছে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা হাওয়াই আবিষ্কারের কাহিনী। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব।
হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ড থেকে গড়ে ৩,২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একগুচ্ছ দ্বীপের সমষ্টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপটির নাম হাওয়াই (Hawaii)। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ থেকে অগ্নুৎপাতের মাধ্যমে উত্থানের পর থেকে পাঁচ মিলিয়ন বছর ধরে এটি ছিল পৃথিবীর বাকি অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে এর দক্ষিণে অবস্থিত পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে সর্বপ্রথম মানুষ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে পদার্পণ করে।
পরবর্তী দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই স্থানীয় হাওয়াইয়ের অধিবাসীদের সাথে বাইরের পৃথিবীর মানুষের কোনো যোগাযোগ ছিল না। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বিচিত্র গাছপালা এবং পশুপাখিতে সমৃদ্ধ প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে হাওয়াইয়ানরা গড়ে তুলেছিল তাদের নিজস্ব সমাজব্যবস্থা। তাদের এই সমাজব্যবস্থার ছিল নিজস্ব রীতিনীতি, যার মাধ্যমে তারা তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার চেয়েও শান্তিপূর্ণভাবে টিকে ছিল হাজার বছর ধরে।
কিন্তু তাদের এই নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনে ছেদ পড়ে ১৭৭৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি। সেদিন সকালে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাউয়াই (Kauai) দ্বীপের দিগন্তরেখা থেকে ধীরে ধীরে উদিত হয় দুটি অদ্ভুতদর্শন বিশালাকার ভাসমান বস্তু। হাওয়াইয়ের অধিবাসীরা প্রথমে ভেবেছিল দুটি ভাসমান দ্বীপ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা সবাই কাজকর্ম ফেলে দৃশ্যটি দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল কাউয়াই দ্বীপের ওয়াইমিয়া (Waimea) উপত্যকায়। তাদের অনেকেই সেদিন উন্মত্ত আচরণ করছিল- কেউ উত্তেজনায়, কেউ ভয়ে।
ভাসমান বস্তু দুটি ছিল বাস্তবে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুকের (James Cook) নেতৃত্বাধীন দুটি জাহাজ। কাউয়াই দ্বীপের অধিবাসীরা তাদের জীবনে কখনও এত বড় জাহাজ দেখেনি। তারা এরকম ধবধবে সাদা চামড়ার দোপেয়ে প্রাণীও কখনও দেখেনি। তাদের পরনের জাঁকজমক পোশাক, ব্যবহার্য নানান অদ্ভুত যন্ত্রপাতি, তাদের হাতের রহস্যময় লাঠি সদৃশ বস্তু থেকে বজ্রপাতের মতো অগ্নিবর্ষণ- এ সবই ছিল তাদের কাছে কল্পনাতীত।
কাউয়াই দ্বীপের অধিবাসীরা ক্যাপ্টেন কুক এবং তার নাবিকদেরকে সসম্মানে তাদের দ্বীপে আমন্ত্রণ জানায়। দ্বীপবাসীদের সরলতার সুযোগে ক্যাপ্টেন কুক তাদের কাছে কিছু লোহা বিক্রি করে বিনিময়ে জাহাজের রসদ পূর্ণ করে নেন। আর ওদিকে তার নাবিকরা লোহার তারকাটার বিনিময়ে দ্বীপের নারীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে।
দুই সপ্তাহ থাকার পর ক্যাপ্টেন কুকের জাহাজ দুটি আরও উত্তরে অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে কাউয়াই দ্বীপ ত্যাগ করে। কিন্তু একবছর পরে, ১৭৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে তারা আবার ফেরত আসে। এবার তারা নোঙর ফেলে হাওয়াই দ্বীপের কিলাকেকুয়া (Kealakekua) উপসাগরে।
সে সময় হাওয়াই দ্বীপের অধিবাসীরা কৃষি, উর্বরতা ও শান্তির দেবতা লোনোর (Lono) সম্মানে ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করছিল। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী হাওয়াই দ্বীপের কিলাকেকুয়া উপসাগর ছিল একটি পবিত্র স্থান, যেখানে দেবতা লোনোর আবির্ভাব ঘটার কথা ছিল। ফলে ক্যাপ্টেন কুকদের জাহাজ দুটি যখন সেখানে নোঙর করে, তখন তারা তাদেরকেই দেবতা হিসেবে গ্রহণ করে। ক্যাপ্টেন কুক এবং তার সঙ্গীরা হাওয়াইয়ানদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে বিভিন্নভাবে শোষণ করতে থাকেন।
হাওয়াইয়ানদের ভুল ভাংতে খুব বেশি দেরি হয় না। ক্যাপ্টেন কুকের এবং তার নাবিকদের আচরণ মোটেও দেবতাসুলভ ছিল না। তারা স্থানীয়দের ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত কাঠের গুঁড়ি জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারের জন্য জোর করে দখল করতে গিয়ে তাদের বিরাগভাজন হন। এর মধ্যেই কুকের দলের এক সদস্য মারা গেলে হাওয়াইয়ানরা বুঝতে পারে, তারা দেবতা বা অন্য কিছু না, তাদের মতোই সাধারণ মানুষ। ফলে একমাস পরে, ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে যখন ক্যাপ্টেন কুক এবং তার সঙ্গীরা দ্বীপটি ত্যাগ করেন, তখন হাওয়াইবাসী একপ্রকার খুশিই হয়।
ঝড়ের কবলে পড়ে এর এক সপ্তাহ পরেই যখন ক্যাপ্টেন কুকের জাহাজ দুটি পুনরায় হাওয়াইয়ের কিলাকেকুয়া বন্দরে ভিড়তে চেষ্টা করে, তখন ক্ষিপ্ত হাওয়াইয়ানরা পাথর ছুঁড়ে তাদেরকে বাধা দেয়। কুকের ক্ষুধার্ত নাবিকরা জোরপূর্বক স্থানীয়দের খাবার দখল করতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। হাওয়াইয়ানরা জাহাজ থেকে তীরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বজরা দুটির একটি চুরি করে নিয়ে গেলে ক্ষিপ্ত ক্যাপ্টেন কুক পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার উদ্দেশ্যে স্থানীয় রাজা কালানিওপুকে (Kalaniopuu) অপহরণ করার চেষ্টা করেন। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।
একপর্যায়ে কুকের অধীনস্থ এক সৈন্যের গুলিতে স্থানীয় এক গোত্রপ্রধান নিহত হলে হাজার হাজার হাওয়াইয়ান আদিবাসী একযোগে কুকের বাহিনীর দিকে ছুটে আসে। কুক এবং তার সঙ্গীরা তাদের ওপর গুলি চালায়, কিন্তু শীঘ্রই হাওয়াইয়ানদের বিপুল সংখ্যার কাছে তারা পরাজিত হয়। অল্প কিছু নাবিক নিরাপদে জাহাজে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারলেও কুকসহ বেশ কয়েকজন ধরা পড়েন হাওয়াইয়ানদের হাতে। তারা কুকের শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে তাকে হত্যা করে।
বহিরাগত শ্বেতাঙ্গদের ওপর এটি ছিল আদিবাসী হাওয়াইনদের সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ সফল প্রতিরোধ। পরদিন জাহাজ দুটি ক্যাপ্টেন কুককে ছাড়াই ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যাওয়ার আগে তারা জাহাজের কামান থেকে হাওয়াইবাসীদের ওপর নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে অন্তত ত্রিশজনকে হত্যা করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন কুকের হাওয়াই আবিষ্কার দ্বীপটির নির্বিবাদী জনগণের ওপর যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল, তার তুলনায় এই মৃতের সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য।
হাজার হাজার বছর ধরে বহির্বিশ্বের রোগ-জীবাণুর সাথে পরিচয় না থাকায় হাওয়াইয়ান অধিবাসীদের রক্তে সেসব রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। ফলে ক্যাপ্টেন কুক এবং তার নাবিকরা যখন তাদের সাথে করমর্দন করেন, তাদেরকে নিজেদের হাত রুমাল উপহার দেন, কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের নারীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, তখন তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের রোগ-জীবাণু।
ক্যাপ্টেন কুক নিজেই তার ডায়েরিতে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন, তার লোকেরা দ্বীপগুলোতে যে যৌনরোগ ছড়িয়ে দিয়েছে, তা পরবর্তীতে মহামারী আকার ধারণ করবে। বাস্তবেও সেটাই হয়েছিল। প্লেগ এবং যৌনরোগ ছাড়াও তাদের সংস্পর্শের ফলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া জ্বর, আমাশয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডায়রিয়া, রিকেটস, মেনিনজাইটিস, টাইফাস, কুষ্ঠসহ নানাবিধ রোগের কারণে পরবর্তী দশকগুলোতে মারা যায় হাওয়াইয়ের কয়েক লাখ মানুষ।
সেখানেই শেষ ছিল না। ক্যাপ্টেন কুকের দেখানো পথ ধরে পরবর্তী দশকগুলোতে হাওয়াই হয়ে ওঠে সমুদ্রগামী নাবিকদের নিয়মিত গন্তব্যস্থল। তাদের সাথে সাথে আমেরিকা থেকে সেখানে আসতে থাকে খ্রিস্টান মিশনারীর দল, যাদের লক্ষ্য ছিল হাওয়াইয়ের ‘বর্বর’ আদিবাসীদেরকে আলোর পথ দেখানো। আর এই মিশনারীদের বংশধরদের অনেকেই পরবর্তী শতকে কুক্ষিগত করতে শুরু করে হাওয়াইয়ের ব্যবসা-বাণিজ্য। স্থানীয় আদিবাসীদের জায়গা-জমি, ধন-সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারাই হয়ে উঠতে থাকে এই স্বর্গরাজ্যের বিধাতা।
এই মিশনারীদের কথাই আমরা জানব এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব।