২৩ মার্চ, ১৬১৮; প্রাগ দুর্গের তৃতীয় তলায় প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের জমি নিয়ে মতবিরোধ মেটানোর জন্য চারজন ক্যাথলিক রাজপ্রতিনিধির সাথে বোহেমিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টদের বৈঠক হয়। এই বৈঠকের ফলাফল ইতিহাসের পাতায় ‘প্রাগের তৃতীয় ডিফেনেস্ট্রেশন’ নামে কুখ্যাত।
‘ডিফেনেস্ট্রেশন’ শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ হলো কাউকে জানালা থেকে বাইরে ফেলে দেওয়া। তবে ইতিহাসের পাতায় ‘ডিফেনেস্ট্রেশন‘ বলতে রাজনৈতিক মতবিরোধের জন্য প্রতিপক্ষকে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়াকে বোঝায়। প্রাগে মোট তিনবার এরকম জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে তৃতীয় ঘটনা, অর্থাৎ ১৬১৮ এর ঘটনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ ।
পটভূমি
এই ঘটনার পটভূমি জানতে হলে সবার আগে আমাদের হলি রোমান এম্পায়ার সম্পর্কে জানতে হবে। সাম্রাজ্যটি বর্তমান জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, ইতালি, চেক-প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সের কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। ভলতেয়ারের মতে, “হলি রোমান এম্পায়ার পবিত্র, রোমান বা সাম্রাজ্য- কোনোটাই না।“
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে, ‘হলি রোমান এম্পায়ার’ ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন সার্বভৌম রাজ্য, ডাচি, এমনকি অন্য সাম্রাজ্য অর্থাৎ বিভিন্ন কন্সটিচুয়েন্ট নিয়ে গঠিত ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং ক্ষমতাবানদের মধ্যে ছিল অস্ট্রিয়া, বারগান্ডি, ব্যাভারিয়া, বোহেমিয়া, সাক্সনি, মিলান, প্রাশিয়া ইত্যাদি। এসব সার্বভোম রাজার মধ্য থেকে সম্রাট নির্বাচন করা হতো। যে রাজ্য থেকে সম্রাট নির্বাচিত, সেই রাজ্যের রাজধানী সাম্রাজ্যের রাজধানী হতো এবং পার্লামেন্ট সেই রাজ্যে স্থানান্তরিত হতো।
মধ্যযুগে এসব অঞ্চলের মাঝে গভীর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজন ছিল। বিশেষত ষোড়শ শতাব্দীর মার্টিন লুথারের প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশনের পর ইউরোপ ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট- এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। হলি রোমান এম্পায়ারের ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে এই বিভাজন আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে সম্রাট ছিলেন পঞ্চম চার্লস, যিনি অস্ট্রিয়ান আর্চডিউক এবং হ্যাবসবার্গ রাজপরিবার সদস্য, যে রাজপরিবার ১৪৩৭-১৮০৬ (১৭৪১-৪৫ বাদে) সাল পর্যন্ত হলি রোমান এম্পায়ারের ক্ষমতায় ছিল।
হ্যাবসবার্গ পরিবার ছিল ক্যাথলিক। কিন্তু সাম্রাজ্যের অনেক অংশে, যেমন- বোহেমিয়া, স্যাক্সনি ইত্যাদি এলাকায় প্রোটেস্ট্যান্টদের আধিপত্য ছিল। এসব অঞ্চলে একদিকে ক্যাথলিক সম্রাট এবং অন্যদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট আধিপত্যের কারণে ক্ষমতার টানাপোড়েন দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্য বাঁচাতে সম্রাট পঞ্চম চার্লস ১৫৫৫ সালে অগসবার্গ শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী তৎকালীন প্রায় ২৪০ রাজ্যের শাসককে ঐ রাজ্যের প্রধান ধর্ম নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হয় এবং সবাইকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ফলে সাম্রাজ্যে একটি সেক্যুলার ব্যবস্থা চালু হয়।
তবে এই শান্তি বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। ১৬১৭ সালে সম্রাট, অস্ট্রিয়া এবং বোহেমিয়ার রাজা ম্যাথিয়াস দ্বিতীয় ফার্দিনান্দকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে বোহেমিয়া ও অস্ট্রিয়ার ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তাকে নির্বাচন করা হয় সম্রাট ম্যাথিয়াসের পর ক্ষমতা গ্রহণের জন্য।
ফার্দিনান্দ ছিলেন একজন ক্যাথলিক চরমপন্থী। বোহেমিয়ার প্রোটেস্টেন্টরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে থাকে। এর ওপর ফার্দিনান্দ ১৬১৮ সালে রাজকীয় জমিতে প্রোটেস্ট্যান্ট চ্যাপেল তৈরির নির্মাণাদেশ বাতিল করেন। বোহেমিয়ার প্রোটেস্ট্যান্ট সংসদ এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানালে ফার্দিনান্দ সংসদ বাতিল করার ঘোষণা দেন।
১৬১৮ সালের ২৩ মে, চারজন ক্যাথলিক রাজ প্রতিনিধি, কাউন্ট জারোস্লাভ বরিতা অফ মারটিনিস, কাউন্ট ভিলেম স্লাভাতা অফ ক্লাম, দ্বিতীয় এডাম ভন স্টার্নবার্গ এবং ম্যাথিও লেওপল্ড পোপেল লোবকোভিটয সকাল সাড়ে ৮ টায় প্রাগ চার্চে এসে পৌঁছান। সকাল ৯ টার দিকে বাতিল করা তিনটি মূল এস্টেটের সংসদ কাউন্ট থার্নের নেতৃত্বে মিটিং হলে আসেন এবং প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চান সম্রাট তাদের উপদেশ অনুযায়ী কাজ করেছেন কি না।
প্রতিনিধিরা কোনো উত্তর দেওয়ার আগে উর্ধ্বতন এডাম ভন ওয়াল্ডস্টেইনের সাথে কথা বলার সুযোগের জন্য অনুরোধ করেন। তবে তিনি উপস্থিত না থাকায় তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট লর্ডরা এডাম ভন স্টার্নবার্গ এবং ম্যাথিও লেওপল্ডকে নির্দোষ ঘোষণা করেন, কারণ তাদের মতে এই দুজন এরকম কাজ করার জন্য খুব বেশি ধার্মিক। বাকি দুই কাউন্ট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের মতো ক্যাথলিক উগ্রবাদী ছিলেন এবং চ্যাপেল নির্মাণ বন্ধের সিদ্ধান্তের পেছনে নিজেদের ভূমিকার কথা স্বীকার করে নেন।
কাউন্ট থার্ন তাদের বলেন,
আপনারা আমাদের এবং আমাদের ধর্মের শত্রু, আপনারা প্রোটেস্ট্যান্ট প্রজাদেরকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছেন .. এবং তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনার ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাদের বাধ্য করার চেষ্টা করেছেন এবং তারা মেনে না নিলে তাদের নির্বাসিত করার চেষ্টা করছেন।
তারপরে প্রোটেস্ট্যান্টদের ভিড়ের দিকে ঘুরে তিনি বলতে থাকেন,
আমরা যদি এই লোকদের বাঁচিয়ে রাখি, তবে আমরা আমাদের ধর্ম হারিয়ে ফেলব, কারণ তাদের কাছ থেকে কোনো ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব না।
এর পর দুই কাউন্ট এবং তাদের সেক্রেটারিকে মিটিং হলের জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। মিটিং হল দুর্গের তৃতীয় তলায় অবস্থিত ছিল এবং এর উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট (২১ মিটার)। এত ওপর থেকে পড়েও তারা বেঁচে যান এবং ভিয়েনা ফিরে যেতে সক্ষম হন। ক্যাথলিকদের মতে, তাদের দেবতারা বাঁচিয়েছিল এবং প্রটেস্ট্যান্টদের মতে, টাওয়ারের নিচে রাখা গোবরের গাদায় পড়ার কারণে তারা বেঁচে যান।
প্রভাব
ইউরোপ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাগের তৃতীয় ডিফেনেস্ট্রেশন খুবই প্রভাবশালী একটি ঘটনা। এই ঘটনার পর পরই অস্ট্রিয়া হলি রোমান এম্পায়ারeর ক্যাথলিক এবং বোহেমিয়া প্রোটেস্ট্যান্ট স্টেটগুলোর সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে থাকে এবং বোহেমিয়া ও অস্ট্রিয়ার নেতৃত্বে স্টেটগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে ধর্মীয় যুদ্ধ হলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্যায়ে ইউরোপের প্রায় সব দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে এটি ৩০ বছর ধরে চলা ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার সংঘাতে রূপ নেয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ত্রিশ বছরের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধের মধ্যে একটি, যাতে হলি রোমান এম্পায়ারের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক পুরুষই মারা যায়। ইউরোপের ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যায়, যা আরো অন্যান্য ঘটনাকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্টিজম ছড়িয়ে পড়ার পথ সুগম হয়। এসব কিছুই হয় প্রাগের দুর্গের জানালা দিয়ে তিনজন ব্যক্তিকে বাইরে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে!