আলাউদ্দিন খিলজি (পর্ব–১): যে ভারতীয় শাসক ৬ বার মোঙ্গলদের পরাজিত করেছিলেন

মানব ইতিহাসের বৃহত্তম রাষ্ট্র ছিল দুর্ধর্ষ বিজয়ী চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্য। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চেঙ্গিস খান মোঙ্গলদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলিয়া থেকে চেঙ্গিসের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গলরা বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছিল এবং অসংখ্য রাষ্ট্রকে ধ্বংস বা করতলগত করে তাদের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে জাপান সাগর পর্যন্ত মোঙ্গলদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। উত্তর দিকে উত্তর মেরুর অংশবিশেষ পর্যন্ত, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ইরানি মালভূমি পর্যন্ত এবং পশ্চিম দিকে লেভান্ট ও কার্পেথিয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল।

১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর সুবৃহৎ মোঙ্গল সাম্রাজ্য ৪টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই খণ্ডগুলো ছিল– চীনকেন্দ্রিক ইউয়ান সাম্রাজ্য, রাশিয়াকেন্দ্রিক সোনালি হোর্ড, ইরানকেন্দ্রিক ইলখানাত এবং মধ্য এশিয়াকেন্দ্রিক চাঘাতাই খানাত। ৪টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়লেও মোঙ্গলদের শৌর্যবীর্য অটুট ছিল, এবং তারা অন্যান্য রাষ্ট্রের নিকট ছিল ত্রাসস্বরূপ। যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল জাতিই কমবেশি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে থাকে, কিন্তু মোঙ্গলরা তাদের বিজিত অঞ্চলে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল।

কয়েকটি উদাহরণ থেকে মোঙ্গলদের যুদ্ধপ্রণালী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১২১৬–১২২২ সালে চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়ার খোরেজম সাম্রাজ্য দখল করে নেন এবং তার সৈন্যরা মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্য প্রসিদ্ধ বুখারা, মার্ভ, নিশাপুর, উরগেঞ্চ প্রভৃতি শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের ফলে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, যা ছিল খোরেজম সাম্রাজ্যের জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ। ১২৩৬–১২৪০ সালে চেঙ্গিসের নাতি বাতু খান রাশিয়া দখল করেন এবং এর ফলে বিলার, বুলগার, মস্কো, রিয়াজান, ভ্লাদিমির, কিয়েভ প্রভৃতি রুশ ও ভোলগা বুলগার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই আক্রমণের ফলে প্রায় ১৬ লক্ষ ভোলগা বুলগার এবং ৫ লক্ষ রুশ নিহত হয়। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান আব্বাসীয় খিলাফতকে ধ্বংস করেন এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বাগদাদ ধ্বংস করেন। এই আক্রমণের ফলে বাগদাদের ৮ লক্ষ থেকে ১৬ লক্ষ অধিবাসী নিহত হয়।

১২৫৮ সালে মোঙ্গল বাহিনী বাগদাদ আক্রমণ ও দখল করে শহরটির সিংহভাগ অধিবাসীকে খুন করেছিল; Source: The Detailed History via Medium

ভারতবর্ষেও মোঙ্গলরা বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু ভারতীয়দের জন্য সৌভাগ্যবশত এই আক্রমণগুলোর কোনোটিই ভারতবর্ষ দখল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি। ১২২১ সালে চেঙ্গিস খান খোরেজম সাম্রাজ্যের যুবরাজ জালালউদ্দিনের পশ্চাদ্ধাবন করে ভারতবর্ষের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সিন্ধু নদীর তীরে সংঘটিত এক যুদ্ধে তিনি জালালউদ্দিনকে পরাজিত করেন, কিন্তু এরপর ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২৩৫ সালে মোঙ্গলরা কাশ্মির দখল করে নেয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাশ্মিরে মোঙ্গল শাসন বজায় ছিল। ১২৪১ থেকে শুরু করে ১২৯০ সালের মধ্যে মোঙ্গল–কর্তৃত্বাধীন চাঘাতাই খানাত বেশ কয়েকবার ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালায়, কিন্তু এগুলোর কোনোটিই বড় মাত্রার আক্রমণ ছিল না এবং এই আক্রমণগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন।

কিন্তু ১২৯০ এবং ১৩০০–এর দশকে মোঙ্গলরা পরপর ৬ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এবং এর মধ্যে ২ বার দিল্লি দখলের চেষ্টা করে। মোঙ্গলদের প্রতিটি আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর ফলে ভারতবর্ষ মোঙ্গল আক্রমণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পায়। এবং ভারতবর্ষে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার মূল কৃতিত্ব একজন ভারতীয় মুসলিম শাসকের। এই শাসক হলেন দিল্লি সালতানাতের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি।

আলাউদ্দিন ভারতীয় ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা আলাউদ্দিনকে একজন ‘অত্যাচারী, হিন্দু–নিপীড়নকারী, বিদেশি মুসলিম’ শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু বাস্তবিক ইতিহাস এতটা সরল নয়। আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের অন্তর্গত, যাদের মধ্যে তুর্কি ও পশতুনদের সংমিশ্রণ ছিল বলে মনে করা হয়। ১২৬৬ সালে তিনি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১২৯০ সালে তার চাচা জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লি সালতানাতের শাসনক্ষমতা দখল করে নেন এবং এর ৬ বছর পর আলাউদ্দিন তাকে খুন করে নিজেই দিল্লির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আলাউদ্দিনের শাসনামল রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিভিন্ন রাজ্য জয়ের জন্য প্রসিদ্ধ।

আলাউদ্দিন খিলজি ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ সাল পর্যন্ত ২০ বছর দিল্লি সালতানাতের সুলতান ছিলেন; Source: Times of India

আলাউদ্দিনকে ‘বিদেশি শাসক’ হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক, কারণ আলাউদ্দিনের জন্ম ভারতে এবং তিনি বাইরে থেকে আক্রমণ চালিয়ে ভারত দখল করেননি, বরং সেসময় দিল্লি সালতানাত ছিল একটি মুসলিম–শাসিত স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র এবং আলাউদ্দিন ছিলেন সেটির শাসক। আলাউদ্দিন নিষ্ঠুর এবং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারী শাসক ছিলেন, এই বিষয়ে ইতিহাসবিদরা একমত। কিন্তু আলাউদ্দিনের অত্যাচার বা নিষ্পেষণ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি হিন্দু–মুসলিম নির্বিশেষে প্রজাদের অংশবিশেষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এজন্য আলাউদ্দিনকে ‘হিন্দু–নিপীড়নকারী মুসলিম শাসক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তদুপরি, আলাউদ্দিন ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান যিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছিলেন। এমনকি তিনি একটি নিজস্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন বলেও জানা যায়।

শাসক হিসেবে আলাউদ্দিন যেমনই হোন, তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল মোঙ্গলদের ছয় ছয়টি আক্রমণ প্রতিহত করা। উল্লেখ্য, আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনামলে ১২৯১–১২৯২ সালে মোঙ্গলরা ভারতবর্ষে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছিল এবং যুদ্ধের মাধ্যমে মোঙ্গলদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে জালালউদ্দিন মোঙ্গলদের প্রদত্ত শর্তানুযায়ী তাদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সংঘর্ষের সময় বহুসংখ্যক মোঙ্গল ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং দিল্লি সালতানাতে বসবাস করতে শুরু করেছিল।

কিন্তু আলাউদ্দিন ক্ষমতা লাভের পর জালালউদ্দিনের শান্তির নীতিকে পরিত্যাগ করেন এবং মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার নীতি গ্রহণ করেন।

প্রথম মোঙ্গল আক্রমণ (১২৯৭–১২৯৮)

১২৯৭ সালের শীতকালে চাঘাতাই খানাতের ‘খান’ (মোঙ্গল শাসকদের উপাধি) দুয়া ভারতবর্ষ আক্রমণের জন্য ১ লক্ষ সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। বাহিনীটির নেতৃত্বে ছিলেন মোঙ্গল সেনানায়ক কদর। কদরের নেতৃত্বে মোঙ্গল সৈন্যরা সুলাইমান পর্বতমালা অতিক্রম করে এবং দিল্লি সালতানাতের অন্তর্গত পাঞ্জাব অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। এটি ছিল ভারতবর্ষে প্রথম বড় মাত্রার মোঙ্গল আক্রমণ। মোঙ্গল সৈন্যরা পাঞ্জাবে ব্যাপক হারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালায় এবং কাসুর শহর পর্যন্ত অগ্রসর হয় শহরটি জ্বালিয়ে দেয়।

১২৯৪ সালে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি; Source: The Wire

মোঙ্গল আক্রমণ সম্পর্ক অবগত হওয়ার পর আলাউদ্দিন মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করার জন্য তার ভাই উলুঘ খান এবং সেনাপতি জাফর খানের নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। দিল্লির সৈন্যরা ত্বড়িৎ গতিতে পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হয় এবং সুৎলেজ নদীর তীরে এসে পৌঁছায়। নদী অতিক্রম করার জন্য দিল্লির সৈন্যদের কোনো নৌকা ছিল না, ফলে উলুঘ খানের নির্দেশক্রমে সৈন্যদের সাঁতরে নদী পাড়ি দিতে হয়েছিল। নদীটি অতিক্রম করার পর নদীটির অপর তীরে অবস্থিত ‘জারান মাঞ্জুর’ নামক স্থানে দিল্লির সৈন্যরা মোঙ্গল সৈন্যদের মুখোমুখি হয়। ১২৯৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত এই যুদ্ধে মোঙ্গল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

প্রায় ২০,০০০ মোঙ্গল সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং আরো প্রায় ২০,০০০ মোঙ্গল সৈন্য দিল্লির সৈন্যদের হাতে বন্দি হয়। অবশিষ্ট মোঙ্গল বাহিনী দিল্লি সালতানাতের ভূমি থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। দিল্লির সৈন্যরা আহত মোঙ্গল সৈন্যদের হত্যা করে এবং অবশিষ্টদের শিকলে বেঁধে রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যায়। আলাউদ্দিন যুদ্ধবন্দিদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন এবং বন্দি মোঙ্গল সৈন্যদের হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম বৃহৎ মোঙ্গল আক্রমণের অবসান ঘটে। এই বিজয়ের ফলে দিল্লি সালতানাতের অভিজাত শ্রেণী ও জনসাধারণের মধ্যে নতুন সুলতান আলাউদ্দিনের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং দিল্লির সিংহাসনে তার অবস্থান মজবুত হয়।

দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণ (১২৯৮–১২৯৯)

১২৯৮ সালের শেষদিকে একটি মোঙ্গল সৈন্যদল দিল্লি সালতানাতের পশ্চিম সীমান্ত অবস্থিত সিন্ধু প্রদেশে আক্রমণ চালায় এবং সিভিস্তান দুর্গ (বর্তমান পাকিস্তানের সেহওয়ান শহর) দখল করে নেয়। এই মোঙ্গলরা চাঘাতাই খানাতের অধীনস্থ ছিল না। এরা ছিল আফগানিস্তানে বসতি স্থাপনকারী ‘নেগুদেরি’ নামক একটি মোঙ্গল শাখা জাতির সদস্য। ধারণা করা হয় যে, আফগানিস্তানে তাদের আবাসস্থল থেকে বিতাড়িত একদল নেগুরেদি মোঙ্গল ভারতবর্ষের সীমান্ত অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল এবং এরই অংশ হিসেবে সিন্ধু আক্রমণ করেছিল। আক্রমণকারী মোঙ্গলদের নেতা ছিলেন সালদি বা সোগেতেই নামক এক ব্যক্তি।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে চাঘাতাই খানাতের মানচিত্র; Source: Wikimedia Commons

এসময় দিল্লির সৈন্যবাহিনীর মূল অংশ উলুঘ খান ও নুসরাত খানের নেতৃত্বে গুজরাট অভিযানে ব্যস্ত ছিল, ফলে আলাউদ্দিন সিভিস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য জাফর খানের নেতৃত্বে একটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করেন। ১২৯৯ সালের প্রথম দিকে দিল্লির সৈন্যদল সিভিস্তান দুর্গের নিকটে পৌঁছে এবং দুর্গটি অবরোধ করে। জাফর খান দুর্গ অবরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম ছাড়াই দুর্গটি অবরোধ করেছিলেন এবং মোঙ্গল সৈন্যদের তীরবৃষ্টির ফলে দিল্লির সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তা সত্ত্বেও দিল্লির সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় এবং মোঙ্গলদের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যেটিতে ব্যবহৃত হয়েছিল কুঠার, তলোয়ার, বর্শা ও বল্লম। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর দিল্লির সৈন্যরা দুর্গটি পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হয়।

মোঙ্গল নেতা সালদি/সোগেতেইসহ বহুসংখ্যক মোঙ্গল সৈন্য দিল্লির সৈন্যদের হাতে বন্দি হয় এবং তাদের শিকলবন্দি অবস্থায় দিল্লিতে প্রেরণ করা হয়। তাদের পরিণতি কী হয়েছিল সে সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে এই যুদ্ধে বিজয়ের ফলে জাফর খান একজন সুদক্ষ সেনানায়ক হিসেবে সম্মান অর্জন করেন এবং তার পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

মোঙ্গল সৈন্যদের বিদ্রোহ (১২৯৯)

জালালউদ্দিনের শাসনামলে যেসব বন্দি মোঙ্গল সৈন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং দিল্লিতে বসতি স্থাপন করেছিল, তাদেরকে দিল্লির সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছিল। ১২৯৯ সালে দিল্লির সৈন্যরা উলুঘ খান ও নুসরাত খানের নেতৃত্বে গুজরাট জয় করে এবং বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে। এই অভিযানে উক্ত মোঙ্গল সৈন্যরাও অংশগ্রহণ করেছিল। গুজরাট থেকে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের পথে জালোরে পৌঁছে দিল্লির সেনানায়করা ‘খুমস’ (লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক–পঞ্চমাংশ) জমা দেয়ার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দেয়। কিছু মোঙ্গল সৈন্য লুণ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রী লুকানোর চেষ্টা করলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়। এর ফলে দিল্লির সেনাবাহিনীর অন্তর্গত প্রধানত মোঙ্গল সৈন্যদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহ করে।

আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে দিল্লি সালতানাতের ব্যাপ্তি। গাঢ় সবুজ রং চিহ্নিত অংশটি ছিল সরাসরি দিল্লি সালতানাতের শাসনাধীন এবং হালকা সবুজ রং চিহ্নিত অংশটি ছিল সালতানাতের অধীনস্থ করদ রাজ্যগুলো; Source: Wikimedia Commons

বিদ্রোহের প্রথম দিনে বিদ্রোহী সৈন্যরা নুসরাত খানের ভাই মালিক আইজউদ্দিনকে খুন করে এবং দ্বিতীয় দিনে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ বিদ্রোহী মোঙ্গল সৈন্য উলুঘ খানের তাঁবু আক্রমণ করে। এসময় তারা সুলতান আলাউদ্দিনের এক ভাগ্নেকে খুন করে, কিন্তু উলুঘ খান পালিয়ে নুসরাত খানের তাঁবুতে আশ্রয় নেন এবং অনুগত সৈন্যদের একত্র করতে সক্ষম হন। পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে অনুগত সৈন্যরা মোঙ্গল বিদ্রোহীদের পরাজিত করে এবং পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে। এই বিদ্রোহ দিল্লির সেনানায়কদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল এবং তারা আর সৈন্যদের কাছে ‘খুমস’ দাবি না করে দ্রুত দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। বিদ্রোহী মোঙ্গল নেতাদের মধ্যে মুহম্মাদ শাহ ও কাভরু রণস্তম্ভপুরের (বর্তমান রণথম্বোর) রাজা হাম্মির দেবের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং অন্য দুই বিদ্রোহী নেতা ইয়ালহাক ও বুররাক গুজরাটের পরাজিত রাজা কর্ণের সঙ্গে যোগ দেন।

আলাউদ্দিন এই বিদ্রোহের সংবাদ শোনার পর দিল্লিতে বসবাসরত মোঙ্গল বিদ্রোহীদের স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দি করার নির্দেশ দেন। নুসরাত খানের ভাইকে হত্যার সঙ্গে যেসব মোঙ্গল বিদ্রোহী জড়িত ছিল, তাদের পরিবারের সদস্যদের নুসরাত খান নির্মম শাস্তি প্রদান করেন। তার নির্দেশে এই বিদ্রোহীদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয় ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়, আর তাদের সন্তানদের টুকরো টুকরো করা হয়। দিল্লি সালতানাতের ঐতিহাসিকরা তাদের লেখনীতে এই ঘটনাটির তীব্র নিন্দা করেছিলেন।

তৃতীয় মোঙ্গল আক্রমণ (১২৯৯)

১২৯৯ সালের মাঝামাঝিতে চাঘাতাই খানাত পূর্ণ শক্তিতে দিল্লি সালতানাতের ওপর আক্রমণ চালায়। মোঙ্গল খান দুয়ার ছেলে কুৎলুঘ খাজার নেতৃত্বে প্রায় ২ লক্ষ সৈন্য এই আক্রমণে অংশ নিয়েছিল, যদিও এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মোঙ্গলদের এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল দিল্লি সালতানাতকে ধ্বংস করা এবং ভারতবর্ষে চাঘাতাই খানাতের কর্তৃত্ব স্থাপন করা। এজন্য মোঙ্গলরা দীর্ঘমেয়াদী একটি অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য ও রসদপত্র নিয়ে এসেছিল। তদুপরি, স্থানীয়ভাবে রসদপত্র সংগ্রহের সুবিধার জন্য অন্যান্য বারের মতো দুর্গ দখল বা শহর লুণ্ঠন থেকে এবার তারা বিরত ছিল।

‘সুলতান-এ-হিন্দ’ আলাউদ্দিন খিলজি; Source: WikiBio

মুলতান, সামান ও দিল্ল সালতানাতের সীমান্তে অবস্থিত অন্যান্য ঘাঁটিতে মোতায়েনকৃত সৈন্যরা আক্রমণকারী মোঙ্গলদের বাধা প্রদানের চেষ্টা করে, কিন্তু মোঙ্গলরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ক্ষয়ক্ষতি না বাড়িয়ে দ্রুতগতিতে দিল্লির দিকে ধাবিত হয়। এসময় আলাউদ্দিনের সেনাপতি জাফর খান পাঞ্জাবের ঘুরামে অবস্থান করছিলেন এবং তিনি তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে কুৎলুঘ খাজার কাছে একজন বার্তাবাহককে প্রেরণ করেন, কিন্তু কুৎলুঘ এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, ‘কেবল রাজারাই রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে’।

মোঙ্গলরা দিল্লির উপকণ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কি.মি. দূরে কিলি নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে এবং তাদের ভয়ে স্থানীয় জনসাধারণ দিল্লি শহরে আশ্রয় নেয়, যার ফলে দিল্লিতে শরণার্থী সমস্যা দেখা দেয়। মোঙ্গলরা দিল্লির উদ্দেশ্যে আগত সকল বাণিজ্য কাফেলাকে আটক করে, ফলে দিল্লির জনসাধারণ অশেষ ভোগান্তির সম্মুখীন হয়। মোঙ্গলদের বিশাল সৈন্যবাহিনী দেখে আলাউদ্দিনের উপদেষ্টারা আতঙ্কিত হন এবং মোঙ্গলদের সঙ্গে সন্ধি করার জন্য আলাউদ্দিনকে পরামর্শ দেন। আলাউদ্দিন এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন যে, ‘যদি আমি হানাদারদের মোকাবেলা করতে ভয় পাই, তাহলে আমি কীভাবে দিল্লির শাসনক্ষমতা ধরে রাখব?’ আলাউদ্দিন মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হন।

যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হলেও আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে মোঙ্গলদের আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন না। তার সৈন্যসংখ্যা ছিল মোঙ্গলদের চেয়ে বেশি, কিন্তু তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পর্যাপ্ত সময় পাননি এবং এজন্য যুদ্ধ বিলম্বিত করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, বিলম্বের ফলে পূর্ব দিক থেকে আরো সৈন্য এসে তার সঙ্গে যোগ দিতে পারবে এবং মোঙ্গলদের রসদপত্র হ্রাস পাবে। কিন্তু আলাউদ্দিনের অনুমতি ছাড়াই জাফর খান মোঙ্গলদের আক্রমণ করেন এবং মোঙ্গল সৈন্যবাহিনীর একাংশ পশ্চাৎপসরণের অভিনয় করে জাফর খান ও তার সৈন্যদলকে দিল্লির মূল সৈন্যবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তা সত্ত্বেও জাফর বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং যুদ্ধরত অবস্থায় নিহত হন, কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি ও তার সৈন্যরা মোঙ্গল সৈন্যদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি কর‍তে সক্ষম হয়।

আলাউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে সাহসী ও সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এবং বহু অভিযানে তিনি স্বয়ং দিল্লির সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; Source: WikiBio

জাফর খানের ছেলে দিলির খানের নেতৃত্বে দিল্লির অপর একটি সৈন্যদল মোঙ্গলদের আরেকটি বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে। অন্যদিকে, মোঙ্গলদের আরেকটি সৈন্যদল আলাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দিল্লির মূল সৈন্যদলের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে মোঙ্গল নেতা কুৎলুঘ খাজা গুরুতরভাবে আহত হন। পরবর্তী দুই দিন মোঙ্গল ও দিল্লি সালতানাতের সৈন্যবাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি ছিল, কিন্তু একে অপরকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। জাফর খানের মৃত্যুতে দিল্লির সেনানায়করা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং আলাউদ্দিনকে পশ্চাৎপসরণের পরামর্শ দেন, কিন্তু আলাউদ্দিন মন্তব্য করেন যে, জাফর খান তার নির্দেশ অমান্য করার কারণে প্রাণ হারিয়েছে এবং তিনি কোনো অবস্থাতেই পিছু হটবেন না।

এদিকে আহত কুৎলুঘ খাজার পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এবং যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় মোঙ্গলরা পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য যুদ্ধের ২ দিন পর তারা চাঘাতাই খানাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং পথিমধ্যে আহত কুৎলুঘ মৃত্যুবরণ করেন। দিল্লির সেনাবাহিনী পশ্চাৎপসরণরত মোঙ্গলদের ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ থেকে বিরত ছিল, কারণ যুদ্ধে তাদেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এভাবে মোঙ্গলদের এই আক্রমণটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জাফর খান এই যুদ্ধে বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন, কিন্তু নির্দেশ অমান্য করায় আলাউদ্দিন তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং তার আমলে রাজকীয় সকল নথিপত্র থেকে জাফর খানের নাম সরিয়ে ফেলা হয়।

This is a Bengali article about the Mongol invasions of India in 1297–1306.

Sources:

1. Peter Jackson. "The Delhi Sultanate: A Political and Military History." Cambridge University Press, 2010.

2. Konstantin Nossov and Brian Delf. "Indian Castles 1206–1526: The Rise and Fall of the Delhi Sultanate." Osprey Publishing, 2006.

3. Seshadri Kumar. "India Should Be Grateful to Alauddin Khilji for Thwarting the Mongol Invasions." The Wire, December 9, 2017. https://www.google.com/amp/s/m.thewire.in/article/history/india-grateful-alauddin-khilji-thwarting-mongol-invasions/amp

Source of the featured image: Glogster

Related Articles

Exit mobile version