দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানে সংগঠিত হয় ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের দিক দিয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর বিমান হামলা- এই কথা শোনামাত্র যেকোনো ইতিহাসপ্রেমী পাঠকের মাথায় আসবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলে পারমাণবিক বোমা হামলার কথা। কিন্তু ঐ দুটি ঘটনায় ফেলা হয়েছিল একটিমাত্র বোমা। আবার পারমাণবিক বোমা ও সাধারণ বোমার শক্তিমত্তার পার্থক্য সম্পর্কে সকলেই জানেন।
ম্যানহ্যাটান প্রজেক্ট, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি-এর পরিসংখ্যান মতে, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে প্রায় ৬০ হাজারের মতো মানুষ বোমা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তী কয়েক মাসে তেজস্ক্রিয়তা ও জখম নিয়ে হতাহতের মোট সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ১.২৯ লাখ থেকে ২.২৬ লাখ, যা মূলত হামলার পরের হিসাব। আজকের লেখায় আপনাদের যে ঘটনা সম্পর্কে জানানো হবে, সেখানে এক রাতেই নিহত হয়েছিল প্রায় এক লাখের মতো জাপানি! পুড়ে ছারখার হয়ে যায় রাজধানী টোকিওর ৪১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। ধ্বংস হয় ২.৬৭ লাখ ভবন, ঘরবাড়ি হারায় এক মিলিয়নের বেশি মানুষ। চলুন জেনে নেয়া যাক ইতিহাসের ভয়াবহতম এই বিমান হামলা সম্পর্কে।
জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছিল মূলত তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনীর উপর ভরসা করে। কিন্তু একের পর এক যুদ্ধে হারতে হারতে জাপানের দখলে থাকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো মিত্রবাহিনীর হাতে আসতে থাকে। পার্ল হারবার হামলার জবাবে চালানো ডুলিটল রেইড নিয়ে রোর বাংলায় প্রকাশিত লেখায় বলা হয়েছিল যে, জাপানি হাইকমান্ড তাদের মেইনল্যান্ডে হামলা কোনোভাবেই বরদাশত করতে পারেননি। তাই যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৪ সালের জুন মাস থেকে এসব পুনঃদখলকৃত দ্বীপ এবং চীনের মুক্তাঞ্চল ব্যবহার করে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও সামরিক কারখানাগুলোতে হামলা চালানো শুরু করে। কিন্তু বোমারু বিমানের রেঞ্জ খুব বেশি নয়। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের অংশ হিসেবে Boeing B-29 Superfortress নামক লংরেঞ্জ বোমারু বিমান সার্ভিসে আসার পর জাপানে নিয়মিত বিমান হামলা চালাতে শুরু করে ইউএস আর্মি এয়ারফোর্স (আগে মার্কিন বিমানবাহিনী সেনাবাহিনীর অংশ ছিল)।
কিন্তু জার্মানি-ইতালিতে এ ধরনের প্রিসিশন বোম্বিং কৌশল অবলম্বন করে তেমন সাফল্য পাওয়া যায়নি। বিমানগুলোকে দিনের আলোতে খুব নিচে এসে বোমা ফেলতে হতো, যা এন্টি এয়ারক্রাফট কামানের গোলা ও শত্রুর ইন্টারসেপ্টর বিমানের গুলির মুখে বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। আর কোনো কারণে আবহাওয়া খারাপ থাকলে তো কথাই নেই, তীব্র বাতাসের কারণে বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। ফলে টার্গেট এলাকার শুধুমাত্র সামরিক স্থাপনায় হামলা (প্রিসিশন বোম্বিং) করার বদলে পুরো এলাকা জুড়ে হামলার (কার্পেট বোম্বিং) কৌশল বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এতে বেসামরিক প্রাণহানির সম্ভবনা বেশি থাকার পরও নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদে পারদর্শী প্রিসিশন বোমার বদলে ইন্সেন্ডিয়ারি তথা অগ্নিবোমার ব্যবহার শুরু হয়। ফলে একে firebombing raid নামেও আখ্যায়িত করা হয়। শত্রুর থেকে কম বাধা পেতে রাতের বেলা হামলা করা হয়। এতে বিমানের বোম্বারডিয়ার ক্রুগণ কম উচ্চতায় এসে বোমা ফেলার সুযোগ পান বটে, কিন্তু শত্রুর ব্ল্যাকআউট (বিমান হামলা থেকে বাঁচতে পুরো শহরের বাতি নিভিয়ে রাখা) কৌশলের কারণে বেছে বেছে শুধুমাত্র সামরিক টার্গেটে হামলা করা সম্ভব ছিল না। শত্রুর ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে ফায়ারবোম্বিং কৌশল মিত্রদেশগুলোর ভেতরে-বাইরে সমালোচিত হলেও জাপানের আত্মসমর্পণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এটাই ছিল একমাত্র কৌশল। এরই ধারাবাহিকতায় পরিচালিত হয় অপারেশন মিটিংহাউজ, যার মূল টার্গেট ছিল টোকিওর বেসামরিক নাগরিকরা।
প্রস্তুতি
হামবুর্গ, ড্রেসডেন শহরসহ পুরো জার্মানিতে হামলার ক্ষেত্রে মার্কিন ও ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স যথাক্রমে ১৪% ও ২১% হাই-এক্সপ্লোসিভ বোমা ব্যবহার করত। ১১ নভেম্বর, ১৯৪৪ সালের একটি অপারেশনে XXI Bomber Command এর মেজর জেনারেল হেনরি আর্নল্ড একই কৌশল প্রয়োগ করে ব্যর্থ হন। তিনি তার প্রাইমারি টার্গেটে (একটি জাপানি বিমান ও ইঞ্জিন নির্মাণ ফ্যাক্টরি) প্রিসিশন বোমা এবং আশেপাশের বেসামরিক এলাকায় হাই-এক্সপ্লোসিভ ইন্সেন্ডিয়ারি বোমা ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি আশানুরূপ না হওয়ায় তিনি পদচ্যুত হন। তার স্থলাভিষিক্ত মেজর জেনারেল কার্টিস লিম্যায় এবার গদি বাঁচনোর জন্য সাধারণ যুদ্ধনীতির ধারে-কাছে গেলেন না। সামরিক-বেসামরিক সব টার্গেটের উপর গণহারে ফায়ারবোম্বিং রেইড শুরু করেন।
এ ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে জাপানের প্রায় সব ধরনের শিল্প এলাকা ছিল খুবই নাজুক। দ্বীপরাষ্ট্রটিতে প্রচুর গাছপালা থাকায় হামলার পর আগুন ছড়াতে বেশি সময় লাগত না। আবার নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ হিমশিম খেতে হতো। যুক্তরাষ্ট্র আগেই পরিসংখ্যানবিদদের দিয়ে হিসাব করিয়ে দেখেছিল যে জাপানের ছয়টি বড় বড় শহরের মাত্র ৪০% ফ্যাক্টরিতে হামলা হলে প্রতি মাসে প্রায় ৭.৬ মিলিয়ন শ্রমিকের সমতুল্য শ্রম (man-months of labor) নষ্ট হবে, ৫ লাখ আহত-নিহত হবে, ৭.৭৫ মিলিয়ন লোক গৃহহীন এবং ৩.৫ মিলিয়ন লোককে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু জেনারেল কার্টিসের এ ধরনের সিধান্তের কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, জাপান যুদ্ধের শুরুর দিকে চীনে এভাবে ফায়ারবোম্বিং রেইড পরিচালনা করেছিল।
বি-২৯ বিমানকে সুপার ফোট্রেস বা দুর্গ বলা হত। এর চারদিকে প্রতিরক্ষার জন্য মোট ১০টি মেশিনগান বসানো ছিল। এটি তার ফ্লাইট উচ্চতা অনুযায়ী ২.৩ টন থেকে ১০ টন বোমা নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কি.মি. পাড়ি দিতে সক্ষম ছিল। XXI Bomber Command এর ঘাঁটি মারিয়ানা আইল্যান্ডে ১৯৪৫ সালের মার্চ থেকেই এম-৬৯ ইন্সেন্ডিয়ারি বোমার বিরাট মজুদ গড়ে তোলা হয়। এম-৬৯ বোমাতে Napalm নামক একপ্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করা হতো যা অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। আগুন লাগলে সহজে নেভানো যেত না, শরীরে কোনোভাবে আগুন লেগে গেলে হাড় পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলত। (ভিয়েতনাম যুদ্ধেও একই ধরনের বোমা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র।) ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ সালে জেনারেল কার্টিস তার কৌশল সঠিক কিনা পরীক্ষা করতে একটি টেস্ট ট্রায়াল দেন। এজন্য ১৭২টি বি-২৯ বোমারু বিমান দিয়ে টোকিওতে দিনের আলোতে হামলা চালান, যেখানে প্রায় ২৮ হাজার ভবন ধ্বংস/ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই সাফল্য আরো বড় আকারে হামলা চালানোর ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
অপারেশন মিটিংহাউজের জন্য মোট ৩২৫টি বোমারু বিমান প্রস্তুত করা হয়! অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, দিনের চেয়ে রাতে হামলা করলে কম উচ্চতায় এসে বোমা ফেলা সম্ভব। আবার কম উচ্চতায় বিমান উড়িয়ে আনলে বেশি পেলোড নেয়া সম্ভব। দেখা গেল, প্রতিটি বি-২৯ বিমান লো অ্যালটিটিউডে যে পরিমাণ বোমা বহন করতে পারবে, তা হাই অ্যালটিটিউড পেলোডের প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এটি করতে গেলে কম ফুয়েল নিতে হতো। জেনারেল কার্টিস এবার তাই পাইলটদের ফরমেশনে (ঝাঁক বেঁধে) না উড়ে আলাদা আলাদা ওড়ার অনুমতি দিলেন। কেননা, ফরমেশনে থাকতে বারবার গতির সমন্বয় করতে বেশি ফুয়েল খরচ হয়। মার্কিনিদের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল যে জাপানিদের মাত্র দুটি নাইট ফাইটার ইউনিট (রাতের যুদ্ধে পারদর্শী) তখন সক্রিয় ছিল, যাদের মোট বিমান সংখ্যা মাত্র ২৬টি। তাদের তরফ থেকে তেমন বাধা আসবে না জেনে বি-২৯ বিমানের মেশিনগান ও কম প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশগুলো সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন যেন, বেশি বোমা/ফুয়েল নেয়া যায়। তিনটি বোম্বার উইংয়ের দুটি ৬.৪ টন এবং একটি উইং ৪.৫ টন বোমা নিয়ে এই মিশনে অংশগ্রহণ করে। এই অপারেশনের বিভিন্ন আর্কাইভ ফুটেজ দেখুন এখানে।
এরই মধ্যে জাপানিরা রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে ধারণা করে যে মার্কিনিরা বড় ধরনের ‘নাইট রেইড’ এর পরিকল্পনা করছে। এজন্য তারা বাড়তি যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে আশেপাশের ঘাঁটি থেকে জরুরি ভিত্তিতে ৭৮০টি হেভি এন্টি এয়ারক্রাফট গান টোকিওতে মোতায়েন করে। প্রয়োজনে আরো ৬৩৮টি লাইট এন্টি এয়ারক্রাফট মেশিনগান জরুরি ভিত্তিতে মোতায়েন করা যাবে। এগুলোর সাহায্যকারী হিসেবে পর্যাপ্ত সংখ্যক সার্চলাইট ও বসানো হয় যা বিমান বিধ্বংসী কামানগুলোকে রাতের অন্ধকার আকাশে টার্গেট খুঁজে পেতে সহায়তা করত। কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে এই হামলায় মার্কিনীরা হাই অ্যালটিটিউড বোম্বিং ট্যাকটিক্স অনুসরণ করবে না। ফলে এন্টি এয়ারক্রাফট গান ও শক্তিশালী সার্চলাইট তেমন কাজেই আসবে না। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে টোকিও ফায়ার সার্ভিসে পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি ছিল না। ২৮৭টি স্টেশন মিলিয়ে মাত্র ৮ হাজার দমকলকর্মী ছিল।
আক্রমণ হলো শুরু
৮ মার্চ, ১৯৪৫ সালের সকালে জেনারেল কার্টিস হঠাৎ করে অপারেশন মিটিংহাইজের গ্রিন সিগন্যাল দেন। ক্রুদের জানানো হয় তারা আগামীকাল রাতে টোকিওর কিছু কারখানাতে ফায়ারবোম্বিং রেইড শুরু করবে। এজন্য ৩৬ ঘণ্টা ধরে বিমানগুলোকে প্রস্তুত করা হয়। হামলার স্থানকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে জোন ১ এর কথা আলাদাভাবে বলতে হবে।
এটি আসলে ৪×৩ মাইলব্যাপী আয়তাকার অঞ্চল। এখানে প্রায় ১.১ মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল যা তৎকালীন টোকিওর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। জোন ১-এ সামান্য কয়েকটি ফ্যাক্টরি ছিল যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট নয়। এই অঞ্চলে যারা বাস করত তাদের প্রায় সকলেই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। রাজধানীতে অবস্থান হলেও এদের বাসস্থানগুলো বাঁশ-কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী জাপানি বাড়িঘর যা ফায়ারবোম্বিংয়ের আগুন দ্রুত ছড়ানোর জন্য আদর্শ এলাকা। হাজারো মানুষের মৃত্যু পরোয়ানায় সাইন করা জেনারেল কার্টিস অপারেশন শুরুর পর নিজে আর নেতৃত্ব দিতে পারেননি। কেননা পারমাণবিক বোমা তৈরির খবর দেয়ার পর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তাকে XXI Bomber Command থেকে সাময়িক প্রত্যাহার করা হয়।
৯ আগস্ট, ১৯৪৫ সালের বিকাল সাড়ে পাঁচটায় গুয়াম, তিনিয়ান ও সাইপান ঘাঁটি থেকে বি-২৯ বিমানগুলো আকাশে উড়তে শুরু করে। ৩২৫টি বিমান উড়তে মোট সোয়া তিন ঘণ্টা সময় লাগে। বিমানগুলো ৫-৭ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল যেন হামলার সময় লাইট মেশিনগানের রেঞ্জের উপরে থাকে আবার হেভি এন্টি এয়ারক্রাফট গানের ইফেক্টিভ রেঞ্জের নিচে থাকে। বোমারু বিমানগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া চারটি বি-২৯ বিমান অবশ্য ২৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকায় ১৬ কি.মি. দূর থেকেও টার্গেট দেখা যাচ্ছিল। তবে বাতাস ছিল খুবই বেশি যা আগুন ছড়ানোর জন্য আদর্শ অবস্থা।
১৯৪৫ সালের ১০ মার্চ রাত ১২টা ৮ মিনিটে শুরু হয় স্মরণকালের ভয়াবহতম এই বিমান হামলা। XXI Bomber Command এর বি-২৯-গুলো তাদের টার্গেট এরিয়ায় এমনভাবে বোমা ফেলতে শুরু করে যেন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন উপর থেকে দেখতে X এর মতো দেখায়। বিমানগুলো আড়াই ঘণ্টা যাবত তাণ্ডব চালিয়ে টোকিওকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ‘এক্স’ আকৃতিতে দুই দিক থেকে বোমা ফেলে আগুন জ্বালানোর পর ‘এক্স’ এর বাইরের অংশে আগুন না ছড়ালে সেখানে পুনরায় বোমা ফেলা হয়েছিল। ধোঁয়ার মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে সিরিয়ালের শেষের দিকের বিমানগুলো তাদের টার্গেটে বোমা ফেলতে ব্যর্থ হয়। অনেক বিমানের ক্রু তীব্র ধোঁয়া ও মানুষের মাংসের তীব্র পোড়া গন্ধের কারণে অক্সিজেন মাস্ক পরতে বাধ্য হয়। শেষদিকের কয়েকটি বিমান আক্রমণ বাতিল করে ফিরে যায়। মোট ২৭৯টি বিমান আক্রমণে অংশ নেয়। এরা সব মিলিয়ে ১,৫১০ টন বোমা ফেলে!
জাপানিরা ধরেই নিয়েছিল যে বড় ধরণের আক্রমণ আসন্ন। এজন্য সাগরে একাধিক পর্যবেক্ষণ বোট পাঠানো হয়েছিল। এরা সময়মতো আগত শত্রুবিমান বহর সম্পর্কে সতর্ক করলেও দুর্বল রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সবাইকে সতর্ক করা সম্ভব হয়নি। জাপানি রাডার ইউনিট দুর্বল হলেও তারা মার্কিনীদের হাই অ্যালটিটিউড বোম্বিং ট্যাক্টিসের কারণে অধিক উচ্চতায় বিমান শনাক্তে বেশি মনোযোগ দিয়েছিল। একটি উপকূলীয় রাডার স্টেশন এজন্য কম উচ্চতায় কয়েকটি বি-২৯ শনাক্ত করলেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কারণ তারা ভেবেছিল মার্কিনীরা এরিয়াল রিকনসিস তথা গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে। রাত সোয়া বারোটার পর এয়ার রেইড সাইরেন বেজে ওঠে। জ্বলে উঠে এন্টি এয়ারক্রাফট গানের সার্চলাইট, আকাশে ওঠে মোট ৯০টি নাইট ফাইটার ইন্টারসেপ্টর। কিন্তু তাদের তেমন কিছুই করার ছিল না। রাডার স্টেশনের সাহায্য না পাওয়ায় এবং এন্টি এয়ারক্রাফট গান ইউনিটের সাথে সমন্বয় না থাকায় তারা ৪০ বার আক্রমণ করে একটি বিমানও ভূপাতিত করতে পারেনি।
ক্ষয়ক্ষতি
জাপানি বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলায় ৪২টি ক্ষতিগ্রস্থ এবং ১২টি বিমান ভূপাতিত হয়। এদের মধ্যে ৫টি সাগরে ক্রাশ করে এবং তাদের ক্রুরা আগে থেকেই অপেক্ষা করা মার্কিন সাবমেরিন দ্বারা উদ্ধার হয়। বাকি বিমানগুলোর মোট ৯৬ জন ক্রু মারা যান। টোকিওর ৬২৫ জন ফায়ারম্যান মারা যান। আগুন এত ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে তা নেভাতে এসে ৯৬টি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক ধ্বংস হয়। শুধুমাত্র পাথরের তৈরি বিল্ডিংয়ের কঙ্কাল ছাড়া বিস্তীর্ণ এলাকার কোনো ঘরবাড়ি আস্ত ছিল না।
নিহত এক লাখ বেসামরিক লোকজনের মধ্যে বেশিরভাগই বিমান হামলা থেকে বাঁচতে বাড়ির আশেপাশের ফক্সহোলে (বিশেষ ধরনের গর্ত) আশ্রয় নিয়ে মারা যায়। ধারণার চেয়েও দ্রুত আগুন ছড়ানোর ফলে এদের অনেকেই আবার নিজেদের বাড়িঘর আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়। সরাসরি বোমা হামলায় যত না মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি মারা গেছে পালানোর সময়। এর মধ্যে একটি মর্মান্তিক ঘটনার কথা আলাদাভাবে বলতেই হচ্ছে।
আগুন থেকে বাঁচতে সবাই পানির উৎসের দিকে দৌড়াচ্ছিল। সুমিদা নদীর উপর কোতোটোই নামের একটি ব্রিজের ওপর থাকা কয়েকশ মানুষের উপর একটি বি-২৯ তার সবগুলো বোমা একবারে ফেলে দেয়! ব্রিজের উপর বোমা ফেলা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এতগুলো মানুষকে পুড়িয়ে মারতে মার্কিন ক্রুরা যে ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া বেশ কিছু মন্দির ও ভূমিকম্প শেল্টার হাউজগুলোর উপরেও বোমা ফেলা হয়। সব মিলিয়ে ৪১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। টোকিও পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হিসাব অনুসারে, ২,৬৭,১৭১টি ভবন ধ্বংস হয় এবং বেঁচে যাওয়া ১০,০৮,০০৫ জন তাদের বাসস্থান হারান। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ৭৯,৪৬৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করে গণকবর দেয়া হয়। এদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিল না। নদীতে/ভবনের নিচে চাপা পড়া লাশগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। (Roar বাংলার নীতিমালা অনুযায়ী মৃতদেহের বীভৎস ছবি প্রকাশ করা হলো না) ।
নিহতের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। টোকিও ফায়ার ডিপার্টমেন্টের মতে ৯৭,০০০ নিহত এবং ১,২৫,০০০ আহত হয়েছিল। মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক বোম্বিং সার্ভে ও জাপানের অন্যান্য সুত্র অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৯০,০০০-১,০০,০০০ বলে প্রচার করা হয় যাদের বেশিরভাগই নারী-শিশু এবং বৃদ্ধ। এডওয়ার্ড পি. হয়োট, মার্ক সেলডানের মতো কয়েকজন ঐতিহাসিক নিহতের সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি বলেছেন। তবে টোকিও মেমোরিয়াল হলে এই রেইডে নিহত ১,০৫,৪০০ জনের কথা বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে অপারেশন মিটিংহাউজ হলো আজ অবধি হওয়া সবচেয়ে বিধ্বংসী বিমান হামলা। এমনকি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমাও এই রেইডের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যাকে অতিক্রম করতে পারেনি। নিচের কয়েকটি ছবিতে দেখে নিন ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা:
প্রতিক্রিয়া
জাপান তাদের বেসামরিক জনগণের উপর হওয়া এই হামলাকে সরাসরি গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে তাদের আহাজারিতে কান দেয়ার মতো সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, সেক্রেটারি অফ ওয়্যার হেনরি স্টিমসন, বেশিরভাগ মার্কিন পার্লামেন্ট সদস্য এবং জনগণও এই হামলাকে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার একমাত্র মাধ্যম বলে বিবেচনা করে। জেনারেল কার্টিস তার পূর্বসূরি জেনারেল আর্নল্ড ও অন্যান্য সামরিক বিভাগ থেকে অভিনন্দন বার্তা পান।
এই সাফল্যের কারণে পরদিন অর্থাৎ ১১/১২ মার্চ রাতে ওসাকা, ১৪ মার্চ সকালে কোবে এবং ১৭/১৮ মার্চ রাতে নাগোয়া শহরে আবারও ফায়ারবোম্বিং রেইড চালানো হয়। প্রতিটি মিশনে প্রায় ১০ হাজারের আশেপাশে নিহত হয়। সব মিলিয়ে ৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। জাপানি সরকার যথারীতি ক্ষয়ক্ষতি কম দেখানোর প্রোপাগান্ডা চালায়। আমেরিকান সংবাদপত্রও নিহতের সংখ্যা কম দেখিয়ে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির কথা বেশি প্রচার করে। যুদ্ধ শেষের আগপর্যন্ত প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র বিশ্ববাসী জানতে পারেনি। কিন্তু এত কিছুর পরও জাপানি জেনারেলরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিল। তাদের শান্তিবাদী কিছু রাজনীতিবিদের যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা কয়েক দফা চেষ্টার পরও ভেস্তে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ ও ৯ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাগিতে যথাক্রমে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’ নামক দুটো পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়। ফলে ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয় এবং ২ সেপ্টেম্বর দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে।
পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে আরো জানতে পড়ুন:
১) যে জাপানি শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা পরমাণু বোমা ফেলার সিধান্তকে ত্বরান্বিত করেছিল
২) লিটল বয় বোমা ডেলিভারি দেয়া যুদ্ধজাহাজটি ডুবে গিয়ে নৌযুদ্ধের ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রাণহানির গল্প
৩) বিকিনি আইল্যান্ড: যেখানে বিস্ফোরিত হয়েছিল ২৩টি পারমাণবিক বোমা!