তৃতীয় মোঘল সম্রাট আকবর ইতিহাসে আজো এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে বিদ্যমান। এই রত্নের সভায় তিনি ছাড়াও ছিলেন আরো নয়জন রত্ন যাদের একসাথে বলা হয় আকবরের সভার ‘নবরত্ন’। এই নবরত্নের নবকাহিনী নিয়ে আমরা আজ হাজির হয়েছি। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়, তাদের তুলনা শুধু তারা নিজেরাই হতে পারতেন আর এজন্যই সম্রাট আকবরের সভা তাদের আলোয় দীর্ঘকাল আলোকিত হয়ে ছিলো।
প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল
লেখনীতে আকবর-জমানার ধারাভাষ্য দিয়েছেন আবুল ফজল। আকবরের সময়কার রীতিনীতি ও খোদ আকবরের জীবনকে আমরা দেখতে পাই আবুল ফজলের রচনায়। এ থেকে তাকে একজন ঐতিহাসিকের উপাধি দিলেও ভুল হবে না, কারণ একজন ঐতিহাসিক একটি সময়কে ধরে রাখেন তার লিপিতে, আবুল ফজলও তেমনটাই করেছেন।
সম্রাট আকবরের জীবনী ‘আকবরনামা’ ও তৎকালীন নিয়ম-কানুন নিয়ে ‘আইনি-আকবর-ই’ গ্রন্থ দু’টি ইতিহাসে তার অন্যতম অবদান। সম্রাট আকবর কেমন ছিলেন, এমনকি ব্যক্তি আকবর কেমন ছিলেন তার একটি নমুনা পাওয়া যায় তার ‘আকবরনামা’তে। আকবরনামা তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে রয়েছে তিমুর বংশের ইতিহাস, বাবর ও হুমায়ুনের রাজত্বকাল এবং দিল্লির শূর বংশের সুলতানদের বিবরণ; দ্বিতীয় খন্ডে আকবরের রাজত্বের ছেচল্লিশতম বছর পর্যন্ত ঘটনাবলির বিস্তৃত বিবরণ; এবং তৃতীয় খন্ডে আকবরের সাম্রাজ্যে প্রচলিত বিধিবিধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি বর্ণিত আছে। এ শেষ খন্ডের নামই ‘আইন-ই-আকবর-ই’।
আবুল ফজল সম্রাটের ভালো একজন বন্ধুও ছিলেন এবং এজন্য তার লেখায় যে আকবরের প্রতি কিছুটা পক্ষপাত আসেনি তা বললে ভুল হবে। তিনি মূলত তার দরবারের ইতিহাস লেখক বলেই গণ্য হন। আবুল ফজল সশরীরে কখনো বাংলায় আসেননি। তাই তার লেখায় বাংলার বিভিন্ন ভৌগোলিক বর্ণনা নিখুঁত বলা যায় না, তিনি ইতিহাস লেখনের জন্য কিছু তথ্য উৎসের ওপর নির্ভর করতেন, যা হয়তো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য বা সত্য ছিলো না।
এসব কিছুর পরও আকবরের সময়কার ইতিহাসের জন্য আমাদের কাছে বিশাল তথ্যের আকর হলো আবুল ফজলের লেখনী। শুধু আকবরই নন, আবুল ফজলের লেখায় ফুটে উঠেছে বাংলার বার ভূঁইয়ার প্রাথমিক জীবনও। তিনি সবকিছুই একজন ভালো পর্যবেক্ষকের মতো যৌক্তিক চোখে দেখতেন ও তারপরই সেসব তথ্য তার গ্রন্থে যুক্ত করতেন। ১৬০২ সাল পর্যন্তই তিনি ইতিহাস রক্ষার এই কাজটুকু করতে পেরেছিলেন। কারণ ১৬০২ সালে দাক্ষিণাত্য থেকে ফেরার পথে যুবরাজ সেলিমের প্ররোচনায় বীর সিং বুন্দেলা তাকে হত্যা করে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী আব্দুল রহিম খান
‘দোহাগান’ এর কথা বললে এই ব্যক্তির কথা বলতেই হয়। যারা দোহাগানের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত, রহিমের হিন্দু/ হিন্দি দোহা তাদের কাছে অচেনা কিছু নয়। তাকে মির্জা খানও বলা হতো। বৈরাম খানের কথা কে-ইবা না জানে! বৈরাম খান আকবরের জীবনে একজন অভিভাবকস্বরূপ ছিলেন, এবং এই আব্দুল রহিম খান সেই বৈরাম খানেরই পুত্র, যিনি আকবরের রাজসভা উজ্জ্বল করায় স্বক্ষেত্রে অবদান রেখেছিলেন। তবে তার স্বক্ষেত্র শুধু একটি ছিলো না। তিনি একাধারে কবি, গায়ক, গীতিকার এবং জ্যোতিষশাস্ত্রী ছিলেন। তার কবিত্বে এবং মধুর গায়কীতে রাজসভা প্রায়ই মেতে উঠতো এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে তার পারদর্শিতা তাকে রাজা-মন্ত্রী-উজির নির্বিশেষে সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছিলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বীরবল
আকবর ও বীরবল নিয়ে চালু আছে হাজারো গল্প। এসব গল্পে বীরবলের ধারালো বুদ্ধির ঝলকের দেখা মেলে। এমনকি প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাথে বীরবল নামটি ভারতীয় উপমহাদেশে একটি সমার্থক শব্দের মতোই! তবে অনেক জায়গায় বীরবলকে ভাঁড় কিংবা বিদূষকরূপে দেখানো হতে পারে, যদিও এর সাথে বীরবলের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্রজবুলি ভাষায় গান ও কবিতায় পারদর্শিতা থাকার কারণে আকবরের রাজসভায় তিনি এসেছিলেন কবি ও গায়ক হয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার বুদ্ধিদীপ্ততার কারণেই তিনি হয়ে উঠলেন নবরত্নের একজন। এমনকি আকবরের রাজসভা বীরবলের উপস্থিতি ছাড়া যেন কল্পনাই করা যেতো না।
তার প্রকৃত নাম ছিল মহেশ দাস। যেকোনো সমস্যায় আকবর বীরবলকেই খুঁজতেন এবং বীরবলও তাকে কখনো নিরাশ করতেন না, তাদের মধ্যকার সখ্যতা ইতিহাসের অত্যন্ত অপূর্ব একটি সম্পর্ক। উপদেষ্টার কাজ করার সাথে সাথে একসময় তিনি শাসনব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর কাজেও যুক্ত হন। তিনি উত্তর পশ্চিম ভারতের স্বাত ঘাটিতে (বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত) আফগান উপজাতিদের সাথে এক যুদ্ধের সময় মারা যান।
শিক্ষামন্ত্রী ফইজি
কবিতা রচনা করলেও, একজন সফল অনুবাদক কিংবা শিক্ষক- এভাবেই ফইজিকে বর্ণনা করা যায়। ফার্সি ভাষায় অনুবাদের কাজে তিনি দক্ষ ছিলেন। পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ ও মহাভারত– গ্রন্থগুলো ফইজি দ্বারাই ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়েছিলো। তিনি ছিলেন আবুল ফজলের বড় ভাই। সম্রাট তার একজন গুণগ্রাহী ছিলেন এবং এই গুণগ্রাহিতার কারণেই ও তার মেধায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট ফইজিকে তার পুত্রদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেক্ষেত্রেও ফইজি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি আর এসব কারণেই আকবরের সভার নবরত্নের একজন- ফইজি।
ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ফকির আজিওদ্দিন
বীরবল ছাড়াও সম্রাট আকবরের পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন এই ফকির আজিওদ্দিন। আকবরসভার একজন মুখ্য উপদেষ্টারূপেই গণ্য হতেন তিনি। ব্যক্তিজীবনেও তিনি আকবরের খুব কাছের মানুষ ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি মূলত একজন সুফীসাধক ছিলেন এবং ধর্মীয় বিষয়ে আকবরকে নানা উপদেশ দান করতেন। আকবরও তার যেকোনো উপদেশ বা যুক্তিই অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং অন্য সবার সাথে এই ব্যক্তিটিও তাই স্থান করে নিয়েছিলেন আকবরের সভার ‘নবরত্নে’।
সেনাপতি মানসিংহ
মানসিংহ ছিলেন অম্বরের (বর্তমান জয়পুর) এর রাজা। তার পুরো নাম রাজা মানসিংহ তোমর। তাকে ‘মীর্জা রাজা’ও বলা হতো। সম্রাট আকবরের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু তিনি। বহু যুদ্ধে আকবর তার কাছ থেকে অনেক সাহায্যও পেয়েছেন। বিহার, উড়িষ্যা ও দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ- এমনই কয়েকটি যুদ্ধ যাতে মানসিংহ সম্রাটকে অনেক সাহায্য যুগিয়েছেন। শোনা যায় আকবরের সৎ-ভাই হাকিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তিনি আকবরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
১৫৯৬ সালে বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর সাথে মোঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধটি ইতিহাসের পাতায় অনেক বিখ্যাত একটি যুদ্ধ। তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের আফগান ও পরবর্তী সময়ে বাংলা প্রান্তের মোগল প্রতিনিধি ছিলেন। সেসময়কার প্রজাদের নানা প্রকার বিদ্রোহ দমনে মানসিংহের জোরদার ভূমিকা ছিলো। আকবরের অতি বিশ্বস্ত সেনাপতি হয়ে মানসিংহ খ্যাত। আকবরের ব্যক্তিগত জীবনেও যে মানসিংহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তার বহু উদাহরণ মেলে। আকবর তাকে ‘ফরজন্দ’ বা ‘পুত্র’ উপাধিতেও ভূষিত করেন।
গৃহমন্ত্রী মোল্লা দো-পিঁয়াজা
খুব অদ্ভুত নাম, তাই না? অদ্ভুতের সাথে সাথে বেশ সুস্বাদুও নামটি! কিন্তু কেন? কারণ এই ব্যক্তিটিই নাকি অতি পরিচিত সুস্বাদু মোঘল খাবার দো-পিঁয়াজার উদ্ভাবক। আর এ থেকেই তার নামও হয়ে গিয়েছিলো ‘মোল্লা দো-পিঁয়াজা’। তবে নবরত্নে তিনি এর জন্য স্থান পাননি, পেয়েছিলেন তার অন্য প্রতিভার জন্য। তাকে নাকি বীরবলের প্রতিপক্ষ ধরা হতো! তবেই বুঝে নিন, খুব সহজ নন এই দো-পিঁয়াজা! বিচক্ষণতা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছিলো তারও অস্ত্র। সেই সাথে তিনি ছিলেন লোকগাথা ও লোক সংগীতে দক্ষ। সভা মাতানোর সাথে সাথে তিনি সম্রাটের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করতেন। বহুমাত্রিক এই ব্যক্তিকে তাই নবরত্নে স্থান পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি!
সংস্কৃতিমন্ত্রী তানসেন
সুর আর রাগ নিয়ে তিনি রচেছেন অপূর্ব সব সঙ্গীত। আকবরের রাজত্বকালে হয়তো এমন কেউ নেই যে তানসেনের সঙ্গীতে বিমোহিত হয়নি, তা সে সভার ভেতরেই হোক আর বাইরেই হোক। তানসেনকে মনে করা হয় ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মহান শাস্ত্রীয় গায়ক, গীতিকার ও বাদক। এই কালজয়ী সংগীতজ্ঞ জন্ম দিয়েছিলেন বহু রাগ-রাগিণীর। এর মধ্যে অন্যতম হল মিঞা কী মলহার, মিঞা কী তোডী ও দরবারী কান্ডারা ইত্যাদি।
তানসেনের গুরু ছিলেন হরিদাস গোস্বামী এবং এই গুরু-শিষ্যেরও বহু গল্প প্রচলিত রয়েছে। হরিদাস গোস্বামী বৃন্দাবনের অধিবাসী ছিলেন। তানসেনের পূর্বনাম কোথাও বলা হয়েছে রামতনু মিশ্র আবার কোথাও বা রাম পাণ্ডে। কখনো কখনো তাকে নাকি ডাকা হতো ‘তন্না মিশ্র’ বলেও! তার পিতার নাম নিয়েও রয়েছে এমনই মতভেদ। তবে তিনি সর্বকালের জন্য ‘তানসেন’ নাম নিয়েই আছেন উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতজুড়ে। আর তার এই ‘তানসেন’ নামটি দিয়েছিলেন নবরত্নেরই একজন- রাজা মানসিংহ। তানসেন প্রথম জীবনে হিন্দু থাকলেও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু এই ধর্মই পালন করে যান। সম্রাট আকবরের সভায় সুর ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব ছিলো তানসেনের।
অর্থমন্ত্রী টোডরমল
তৎকালীন ভারত নয় শুধু, তৎকালীন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ মানা হয় টোডরমলকে! আকবরের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে তিনি ছিলেন সম্রাট শের শাহের অর্থমন্ত্রী। শের শাহ মারা যাবার পর, সম্রাট আকবর টোডরমলের প্রতিভা, নিষ্ঠা, পরিকল্পনা ও জ্ঞান দেখে অভিভূত হয়ে যান এবং তাকে নিজের অর্থমন্ত্রী করে রাখেন।
আকবরের অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন টোডরমলের বহু অবদান আজও ভারতের কিছু প্রদেশে মেনে চলা হয়। যেমন তিনি বহুদিনের নিরীক্ষণ ও গবেষণার পর মানুষের আয় ও তার জমির পরিমাণের সাথে তার প্রদেয় করের পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছিলেন। কর এবং আয় নিয়ে তার অনেক ধারণা ও গণনা ভারতের বহু প্রদেশে আজও প্রচলিত আছে। এছাড়া অনুবাদেও তার দক্ষতা ছিলো। তিনি ফার্সি ভাষায় ভাগবত পুরাণ অনুবাদ করেন। এছাড়া আরেকটি কাজের জন্যও টোডরমল স্মরণীয়- তিনি কাশির বিশ্বনাথ মন্দিরকে ১৫৮৫ সালে মেরামত করে পুনরায় তৈরি করেছিলেন।
তথ্য ও ছবি উৎস
১। riyabutu.com/quiz/navratna-sava-in-bengali.php
২। bn.banglapedia.org/index.php?title=আকবরনামা
৩। clubpimble.com/history/some-facts-about-9-jewels-of-akbar-that-every-history-lover-must-know
৪। revolvy.com/topic/Navaratnas&uid=1575
৫। pinterest.com