আঠারো শতকের শুরুর দিকে মেরিওয়েদার লুইস ও উইলিয়াম ক্লার্ক সম্মিলিতভাবে একটি অভিযান পরিচালনা করেন, যেটি ‘কর্পস অফ ডিসকভারি’ নামে পরিচিত। অভিযানটির মাধ্যমে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী অঞ্চল সেন্ট লুইস থেকে যাত্রা শুরু করে মহাদেশীয় ভাগ পার হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে পৌঁছান।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এরকম কোনো অভিযান এর আগে হয়নি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসনের নির্দেশে ১৮০৪ সালে এই অভিযানটির যাত্রা শুরু হয়। নেতৃত্বে ছিলেন লুইস ও ক্লার্ক। অভিযানের মূল উদ্দেশ্যে ছিল ১৮০৩ সালের লুইজিয়ানা পার্চেজের মাধ্যমে আমেরিকা ভূখণ্ডে নতুন যোগ হওয়া এই বিশাল অঞ্চলটির মানচিত্র তৈরি করা এবং আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ভ্রমণ উপযোগী একটি কার্যকর পথ খুঁজে বের করা। দুর্গম এই অঞ্চলে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়দের পূর্বেই মার্কিনীদের উপস্থিতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করাও ছিল এই অভিযানের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। তাছাড়া অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিলো এই অঞ্চলের প্রাণী, উদ্ভিদ, ও ভৌগলিক বৈচিত্র্যের ওপর তথ্য সংগ্রহ এবং আদিবাসীদের বিভিন্ন গোত্রের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা, যার মধ্যে চামড়া বাণিজ্য সম্প্রসারণের গুরুত্ব ছিল বেশি। মাত্র ৪৫ জন অভিযাত্রী নিয়ে লুইস ও ক্লার্ক এই অভিযানটি সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন।
লুইস ও ক্লার্কের এই অভিযানটির অন্যতম অভিযাত্রী ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি, যার নাম ছিল ইয়র্ক। তিনি উইলিয়াম ক্লার্কের দাস হিসেবে সফরসঙ্গী হন এবং অভিযানটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে পাড়ি দেয়া প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান ছিলেন ইয়র্ক। বাকিরা নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় যোগদান করলেও ইয়র্ক তার মনিবের আদেশ অনুসারে অনেকটা বাধ্য হয়েই যাত্রা করেন।
১৭৭০ সালে ভার্জিনিয়ার এক ক্রীতদাস পরিবারে ইয়র্কের জন্ম। তার জন্মের আগে থেকেই তার বাবা-মা উইলিয়াম ক্লার্কের বাবার পরিবারে ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করতেন। ক্লার্ক ও ইয়র্ক কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তারা একইসাথে বেড়ে ওঠেন। তখনকার সমাজে ককেশীয় শ্রেণীর লোকদের ব্যক্তিগত একজন দাস থাকাটা খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। যেমন- তখন থমাস জেফারসনেরও জুপিটার নামে একজন ব্যক্তিগত ক্রীতদাস ছিল। সেই অনুসার ১৭৮৪ সালে ১৪ বছর বয়সী ইয়র্ককে উইলিয়াম ক্লার্কের ব্যক্তিগত ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং তখন থেকেই তিনি ক্লার্কের অধীনে বসবাস করতে থাকেন। ধারণা করা হয়, ইয়র্ক বাকি ক্রীতদাসদের থেকে কিছুটা উঁচু পর্যায়ের জীবন নির্বাহ করতেন। তিনি হয়তো উইলিয়াম ক্লার্কের বাড়িতেই বসবাস করতেন, ক্লার্ক ভাইদের ব্যবহৃত পোশাক পরতেন এবং আচার-আচরণের দিক দিয়ে বেশ পরিশীলিত ছিলেন।
লুইস ও ক্লার্কের অভিযানে মোট ৪৫ জন অভিযাত্রীর মধ্যে ইয়র্কই ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ। তার উপরে ক্লার্কের অধীনস্থ একজন চাকরের ভূমিকায় তাকে অভিযানে অংশগ্রহণ করতে হয়। অভিযানের বিভিন্ন বিষয়ে অনবদ্য ভূমিকা তাকে একটি সমঅধিকার পূর্ণ স্থান প্রদান করে বলে ধারণা করা হয়। অভিযানে অসুস্থদের সেবা-শুশ্রূষা করতেন তিনি। অভিযানে মৃত্যুবরণ করা একমাত্র ব্যক্তি চার্লস ফ্লয়েডের চিকিৎসা ইয়র্কই করেছিলেন। এতে কিছুটা ধারণা করা হয় যে, তার ভেষজ ঔষধ সম্পর্কে ধারণা ছিল।
ইয়র্ককে একটি বন্দুক প্রদান করা হয় যা সাধারণ দাসত্বের রীতিনীতির একদম ব্যতিক্রম ছিল। শুধু তা-ই নয়, শিকার করা ও দিক নির্দেশনার কাজও তিনি পারদর্শিতার সাথে সম্পন্ন করেছিলেন। প্রাপ্ত বন্দুক দিয়ে মহিষ, হরিণ ও হাঁস শিকার করে ইয়র্ক অভিযাত্রীদেরকে খাবার পরিবেশন করতেন। এমনকি একটি বিষয়ে ভোট দেয়ার সুযোগও ইয়র্ক পেয়েছিলেন, যা তৎকালীন ক্রীতদাসদের জন্য একটি অকল্পনীয় বিষয় ছিল। ১৮০৫ সালের শীতকালীন মৌসুমে অভিযাত্রীরা কোথায় থাকবে সেই সম্পর্কিত বিষয়ে ভোটটি হয়েছিল। তাছাড়া আদিবাসীদের জন্য ইয়র্ক ছিলেন কৌতূহলের বিষয়। আদিবাসীরা এর আগে বহু ককেশীয় মানুষ দেখেছে। কিন্তু কখনো কৃষ্ণাঙ্গ কাউকে দেখেনি। যুদ্ধে যাওয়ার আগে আদিবাসীরা শরীরে কালো রঙ মেখে যাওয়ার রীতি অনুসরণ করতো। তাই ইয়র্কের শরীরের জন্মগত কৃষ্ণ বর্ণ দেখে তাদের কৌতূহল ও আতঙ্কের অন্ত ছিল না। এমনকি তারা অনেকেই ইয়র্কের শরীর স্পর্শ করে যাচাই করারও চেষ্টা করেছিল।
তবে এ সবকিছুর মধ্যেও অভিযানে ইয়র্কের সঠিক স্থান অস্পষ্ট থেকে যায়। প্রথমদিকে তাকে অভিযানের অন্যান্য অভিযাত্রীদের মতো মনে করা হতো না। দেখা হতো শুধুমাত্র ক্লার্কের ক্রীতদাস হিসেবে। ক্লার্ক তার বড় ভাইয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে ইয়র্ককে একজন চাকর হিসেবে সম্বোধন করতেন, ক্রীতদাস হিসেবে নয়। কিন্তু একজন চাকর যেসব সুবিধা ভোগ করে, যেমন- বেতন পাওয়া, নিজ ইচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি লাভ, অথবা অভিযান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার শর্তে সম্পদ লাভ ইত্যাদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন ইয়র্ক।
অভিযান থেকে সফলভাবে ফিরে আসার পর লুইস ও ক্লার্ক অভিযাত্রীদেরকে নিয়ে আয়েশী জীবন কাটাতে থাকলেন। এক ফাঁকে লুইস কংগ্রেসকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল অভিযাত্রীদেরকে ভালো করে পুরস্কৃত করা। চিঠিতে প্রত্যেক অভিযাত্রীর নাম উল্লেখ করা হয়। কেবলমাত্র একজনের নাম বাদ দেওয়া হয়, এবং তিনি ছিলেন ইয়র্ক। এতে ইয়র্ক বাদে বাকি সবাই বিপুল সম্পদ লাভ করেছিল, অথচ ইয়র্ক কিছুই পাননি।
অভিযান থেকে ফেরত আসার পর ইয়র্ক পূর্বের মতোই দাসত্বের জীবনে ফিরে গেলেন। কর্পস অফ ডিসকভারিতে তার বিভিন্ন অবদানের পরেও তিনি এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাননি। সাধারণত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তৎকালীন সময়ে মনিবরা তাদের ক্রীতদাসদেরকে মুক্ত করে দিতেন। এমনকি উইলিয়াম ক্লার্ক নিজেও ১৮০২ সালে একজন দাসকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইয়র্কের বেলায় সেটি ঘটেনি।
১৮০৯ সালের দিকে ইয়র্ক ও তার মনিব ক্লার্কের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইয়র্ক বিভিন্ন সময়ে তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য ক্লার্কের নিকট আবেদন করতেন। তার ইচ্ছা ছিল কেনটাকির লুইসভিলে তার স্ত্রীর কাছে ফেরত যাওয়ার। কিন্তু ক্লার্ক তাকে লুইসভিলে কৃষিজমির একজন মালিকের অধীনে কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দেন। জমির মালিক ছিলেন অত্যন্ত রূঢ় প্রকৃতির এবং অধীনস্থ শ্রমিকদের উপর শারীরিকভাবে নির্যাতন করার নজিরও ছিল। এরপর থেকে ক্লার্ক তার পরবর্তী কোনো চিঠি কিংবা নথিপত্রে ইয়র্কের বিষয়ে কিছু লিখতেন না।
এর প্রায় ২০ বছর পর, ১৮৩২ সালে একটি সাক্ষাৎকারে উইলিয়াম ক্লার্ক ইয়র্কের কথা তুলে বলেন যে অন্যান্য দাসদের মতো ইয়র্ককেও তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তার ভাষ্যমতে, ইয়র্ক দাসত্ব থেকে মুক্তির পর ঘোড়ার গাড়ি চালানোর ব্যবসা শুরু করে, কিন্তু অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ক্লার্ক বলেছিলেন, ইয়র্ক দাসত্বের জীবন থেকে মুক্ত হওয়ায় অনেক আফসোস বোধ করতেন এবং মনিবের কাছে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। এরই চেষ্টায় ইয়র্ক ক্লার্কের কাছে ফিরে আসার পথে টেনেসিতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ইয়র্ক সম্পর্কে উইলিয়াম ক্লার্কের দেয়া তথ্য অনুসারে হয়তো এতটুকুই জানা সম্ভব। কিন্তু ইয়র্কের গল্প এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। জেনাস লেওনার্ড নামের একজন ব্যক্তির ভাষ্যমতে, আদিবাসীদের একটি গ্রামে একজন আফ্রিকান-আমেরিকানকে লুইস ও ক্লার্কের সাথে যোগদান করা অভিযানের গল্প শোনাতে দেখা যায়। এই তথ্য থেকে বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়- ইয়র্ক জীবিত ছিলেন এবং আদিবাসীদের অঞ্চলে ভালোভাবেই বসবাস করতেন। ১৮১১ সাল থেকে ১৮১৫ সালের মাঝামাঝি কোনো সময়ে হয়তো তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
তার স্মৃতিতে দুটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সম্ভবত ইয়র্ক তার সুখের সন্ধানে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। হয়তো ইয়র্ককে তার মৃত্যুর পর কোনো চিহ্নহীন কবরে শায়িত করা হয়েছিল। তবে তিনি স্বাধীন ছিলেন, একজন দাস নয়। কর্পস অফ ডিসকভারির যাত্রা সফল করার জন্য তিনি যে অবদানটি রেখে গেছেন তা কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়।