হিটলার ক্ষমতার থাকাকালে বার্লিনের প্রাণকেন্দ্রে ‘দ্য তেভার্ন’ নামে একটি ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ছিল, যার মালিক ছিলেন বন্ধুসুলভ এক জার্মান ও তার বেলজিয়ান স্ত্রী। এই রেস্টুরেন্টটি শুধুমাত্র খাবারের দোকান ছিল না। পাশাপাশি হিটলারের থার্ড রাইখের সময়ে বিদেশী সাংবাদিকদের বিপদের মুহূর্তে নিরাপদ আশ্রয়স্থলও ছিল। দ্য তেভার্ন রেস্টুরেন্টে রাতের পর রাত জার্মানিতে কর্মরত বিদেশী সাংবাদিকরা একে অপরের সাথে মিলিত হতেন। সেখানে তারা বিভিন্ন খবর ও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতেন।
ক্ষমতার গ্রহণের আগে হিটলার অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। অনেক সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষাও করতেন। প্রথম আমেরিকান সাংবাদিক হিসেবে ১৯২২ সালে হিটলারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হার্স্টের প্রতিনিধি কার্ল ভন উইগ্যান্ড। হিটলারের বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। ফলে উইগ্যান্ডও প্রথম দেখায় তার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
তবে শুধুমাত্র উইগ্যান্ডের মতো সাংবাদিকরা নন। বিদেশী অনেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা অথবা সামরিক কর্মকর্তাও হিটলারে কথায় মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কিন আর্মির জুনিয়র মিলিটারি অ্যাটাচি ট্রুম্যান স্মিথ। ১৯২০ সালে দিকে হিটলারের সাথে দেখা করার পর তিনি তাকে একজন বিস্ময়কর বাগ্মী নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
হিটলার তার অসাধারণ সব বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতার মসনদে বসেন। চ্যান্সেলরের আসনে হিটলার বসার পর থেকেই জার্মানিতে বিদেশী সাংবাদিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। শুরুতেই তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়- কোনো ধরনের সমালোচনামূলক সংবাদ সহ্য করা হবে না।
হিটলারের প্রচারণা (প্রোপাগাণ্ডা) বিষয়ক প্রধান জোসেফ গোয়েবলস শুরু থেকেই ক্রমাগত বিদেশী সাংবাদিকদের উপর নিজের প্রভাব ও চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। তার ভয়ে বিদেশী সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যেও তথ্যের আদান-প্রদান করে স্বস্তিবোধ করতে না। প্রায় সবাই হিটলারের অন্ধকার জগতের কোনো তথ্য দেওয়ার পরপরই অন্যদের অনুরোধ করতেন কেউ যেন তথ্যের উৎস প্রকাশ না করেন।
হিটলারের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন হারমান গোয়েরিং। ১৯৩৩ সালের শুরুর দিকে বার্লিনে থাকা বিদেশী সংবাদপত্রের হয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের তার সাথে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ভারনন বার্টলেট। তার ভাষ্যমতে, সেদিন প্রকাশ্যে বিদেশী সাংবাদিকদের একপ্রকার হুমকি দেন তিনি। বার্টলেট তার জীবনে এমন ঘটনা সেদিনই প্রথম দেখেছিলেন। সেই বৈঠকে গোয়েরিং সাংবাদিকদের শাসিয়ে বলেন,
আপনারা টেলিগ্রাম ও টেলিফোনে যেসব তথ্য পাঠাচ্ছেন শুধু সেগুলোই নয়, এর পাশাপাশি আপনারা ব্যক্তিগত চিঠিতেও কী লিখছেন তার সবই আমি জানি।
সরাসরি হিটলারের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের উপর চাপ আসায় তাদের জার্মানিতে কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছিল দিন দিন। সেই সাথে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদের পাঠানো খবর অবিকৃত অবস্থায় প্রকাশ করার জন্যও সম্পাদকদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তবে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সেই সময় নাৎসিদের ঘৃণ্য কৃতকর্মকে সারা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন সাংবাদিকরা।
তথ্য সংগ্রহের যুদ্ধ
হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের আগে জার্মানিতে বিদেশী সাংবাদিকদের জীবন ছিল অন্য দশজন সাংবাদিকদের মতোই। তারা নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। আর এজন্য কর্তৃপক্ষ তাদের প্রচুর অর্থ দিয়েছে। এছাড়া সংবাদ সংগ্রহ কিংবা প্রকাশে তেমন কোনো চাপ ছিল না। কিন্তু হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার পরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের উপর তিনি একপ্রকার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এরপর ইহুদীদের ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জার্মানদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়ে সাংবাদিকদের কাজকে আরো কঠোর করে দেন। জার্মানিতে তখন ইহুদীরা নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে। তাদেরকে গণহারে আটক করা হচ্ছে। কিন্তু তার তথ্য বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে স্বাভাবিক পথে আসতে পারছিল না। বরং তাদের অনেকে কৌশলে সেসব খবর সংগ্রহ করতেন।
শিকাগো ডেইলি নিউজের প্রতিনিধি হিসেবে জার্মানিতে কাজ করতেন সাংবাদিক এডগার মৌরার। তিনি এক জার্মান চিকিৎসকের কাছে থেকে ইহুদী নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করতেন। সেই চিকিৎসক নিজেও ইহুদী ছিলেন। এডগার প্রায়ই তার কাছে রোগী সেজে দেখা করতেন। সেই চিকিৎসক প্রথম তার সহকারীকে কৌশলে বের করে দিয়ে এডগারের শার্টের পকেটে একটি কাগজ গুঁজে দিতেন।
সেই কাগজে কোন কোন ইহুদীকে আটক করা হয়েছে, কেন আটক করা হয়েছে- সব তথ্যই তিনি লিখে দিতেন। কিন্তু একসময় ইহুদীদের উপর নজরদারি এত বাড়ানো হয় যে সেই কাজটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তখন এডগার ও সেই ইহুদী চিকিৎসক প্রতি সপ্তাহে একবার করে কোনো পাবলিক টয়লেটে দেখা করতেন। পাশাপাশি দুটি ইউরিনালের পাশে প্রথমে দাঁড়াতেন। এরপর যাওয়ার সময় সবার অলক্ষ্যে চিকিৎসক একটি কাগজ ফেলে দিতেন। এরপর এডগার সেটি তুলে নিয়ে দুজন দুদিক দিয়ে বের হয়ে যেতেন।
এমন ঝুঁকি শুধু এডগার মৌরার একাই নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। তিনি ছাড়াও আরো অনেক সাংবাদিক ও কূটনীতিক জার্মানির সেই সময়ের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু এরপরও কাজ করার জন্য জার্মানি ছিল সাংবাদিকদের পছন্দের শীর্ষ একটি স্থান। জার্মানিতে বিদেশী সাংবাদিকরা নিজেদের বন্দী মনে করতেন। কিন্তু এরপরও তারা নিজের পেশাদারিত্বকে বিপন্ন হতে দেননি।
দর্শনগত যুদ্ধ
জার্মানিতে থাকা বিদেশী সাংবাদিকদের কাজকে কঠিন করে দেওয়ার জন্য নাৎসিদের পাশাপাশি তাদের সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মালিকপক্ষেরও ভূমিকা ছিল। অনেক ব্রিটিশ সংবাদপত্রের সম্পাদক অথবা মালিক হিটলারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাদের অনেকেই নাৎসিবাদকে সমর্থন করতেন।
এমনই একজন ছিলেন ডেইলি মেইলের মালিক লর্ড ভিসকাউন্ট রথারমেয়ার। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্রিটেনের জন্য নাৎসিদের চেয়ে কমিউনিস্টরা বড় শত্রু। এবং হিটলারের অধীনে জার্মানি শক্তিশালী হলে বলশেভিজমের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত এক প্রাচীর তৈরি করতে পারবেন।
১৯৩৩ সালের মার্চে হিটলার নির্বাচনে জয়ের পর রথারমেয়ার ডেইলি মেইলে এক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন,
প্রভু (হের) হিটলার স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে জয় লাভ করেছেন। তিনি যদি এই জয়কে বুদ্ধিমত্তার সাথে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করেন, তাহলে জার্মানিতে গণতন্ত্র না থাকলেও মায়াকান্না করার মতো কেউ থাকবে না।
রথারমেয়ার যখন হিটলারকে অভিনন্দন জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করলেন, তখন বেশ হতাশ হয়ে পড়েন ডেইলি মেইলের বার্লিন ব্যুরো প্রধান রথেয় রেনল্ডস। মালিকের বিরুদ্ধে গিয়ে তার কাজ করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন হিটলারের এক জয় কীভাবে জার্মানির রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে নেতিবাচকভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। রেনল্ডস পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জার্মানরা সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশ করার স্বাধীনতা হারায়।
১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে ‘হুররে ফর দ্য ব্লাকশার্টস’ এর মতো বিতর্কিত এক মন্তব্যের মাধ্যমে ইউরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে স্বাগত জানান লর্ড রথারমেয়ার। এখানে ব্লাকশার্ট বলতে মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির সদস্যদের বোঝানো হয়েছে। মূলত হিটলারের উত্থান তাদের জন্য আনন্দের বিষয় সেটি বোঝাতে চেয়েছিলেন রথমেয়ার।
কিন্তু ঠিক তখন রেনল্ডস তার বিপরীত ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল নাৎসিবাদের উত্থানের অর্থ হলো জার্মানির ইহুদী ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর একদল অস্ত্রধারী সৈন্যের হিংস্র আক্রমণের সূচনা। কিন্তু রথারমেয়ারের মতো হিটলার সমর্থকরা সেসব লক্ষ্য করেননি। তারা হিটলারে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো জার্মান অর্থনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু জার্মানির সেই অর্থনীতি বালির বাঁধ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
কিছুদিনের মধ্যেই রথারমেয়ার ও রেনল্ডসের মধ্যে দর্শনগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে নাৎসি সরকার ইহুদী পণ্য ও সেবা বয়কট করার নির্দেশ দিলে এ বিষয়ে রেনল্ডস একটি সংবাদ পাঠান। সংবাদের শেষে নাৎসি প্রচারমাধ্যম ‘দ্য অ্যাংরিফ’কে উদ্ধৃত করে লেখেন, এই বয়কট জার্মানদের জন্য চমৎকার ফলাফল বয়ে আনবে।
কিন্তু ডেইলি মেইলে যখন সংবাদ প্রকাশ হয়। তখন ‘দ্য অ্যাংরিফ’ শব্দ মুছে দেওয়া হয়। তার পরিবর্তে রেনল্ডসের ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। যেটি হিটলারের অনুসারীরা লুফে নিতে দেরি করেননি। ডেইলি মেইলের সাংবাদিক বয়কট সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন এমন প্রচার চালানো শুরু করেন।
বিষয়টি রেনল্ডসের মোটেই ভালো লাগেনি। হিটলার সম্পর্কে তার মনোভাব বোঝার পর রথারমেয়ার পরবর্তীতে রেনল্ডসকে পুরো দশক জুড়েই গুরুত্বহীন করে রাখেন। তার পরিবর্তে হিটলার ও নাৎসি সম্পর্কিত সংবাদগুলো জি ওয়ার্ড প্রাইস লিখতে থাকেন, যিনি রথারমেয়ারের চেয়েও অধিক পরিমাণে হিটলারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটেনেও ফ্যাসিবাদ ছড়িয়ে পড়ে, যার নেতৃত্বে ছিলেন অসওয়াল্ড মোসলে। ব্রিটেনে মোসলের ব্ল্যাক শার্ট মুভমেন্টকে রথারমেয়ারসহ অন্যান্য অধিকাংশ পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক সমর্থন করেছেন, পরবর্তীতে যে আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে। এরপরও ব্রিটেনের অধিকাংশ সংবাদপত্রের মালিকপক্ষ সরকারের হিটলারকে তুষ্ট করার নীতিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। যদিও নাৎসিরা ক্রমান্বয়ে তাদের বৈদেশিক নীতিতে আক্রমণাত্মক হওয়া শুরু করে।
তবে সম্পাদকদের বিরূপ আচরণের শিকার শুধু রেনল্ডসই হননি। সেই সময়ের আরো অনেক বিদেশী সাংবাদিক জার্মানিতে কাজ করতে গিয়ে একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এদের মধ্যে দ্য টাইমসের সাংবাদিক নর্মান এবাটও ছিলেন, যিনি জার্মানিতে কাজ করা বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিতদের একজন ছিলেন।
কিন্তু একসময় এবাট বুঝতে পারেন তার সম্পাদক জিওফ্রে ডাওসন নাৎসি জার্মানির প্রতি সহানুভূতিশীল। এবং তাদের তুষ্ট করার নীতির সমর্থক। তখন থেকে এবাটের বিভিন্ন স্থানের সংবাদ সংগ্রহের তথ্যগুলো একটি দিনলিপিতে লিখে রাখতেন তার মার্কিন বন্ধু উইলিয়াম শিয়ার। তার কাছে এবাট বলেছিলেন, তিনি যেসব খবর পাঠাচ্ছেন তার সব প্রকাশ করা হচ্ছে না। এবং ডাওসন নাৎসিদের অন্ধকার দিকগুলো প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। যদিও ইতোমধ্যে লন্ডনে নাৎসি মতবাদ ছড়িয়ে গেছে।
জার্মানি থেকে বিতাড়িত হওয়া
নর্মান এবাটের প্রতিবেদন অনেক কাটছাট করে প্রকাশ করা হলেও নাৎসিদের ঘৃণ্য কাজকর্ম প্রকাশের জন্য তা যথেষ্ট ছিল। ফলে তার প্রতিবেদনগুলো নাৎসি সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তিকর ছিল, যার ফলশ্রুতিতে তাকে ১৯৩৭ সালে জার্মানি থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু জার্মানি থেকে বিতাড়িত হওয়া ছিল সেখানকার সাংবাদিকদের জন্য গর্বের বিষয়, কারণ তারা সত্য প্রকাশে আপোষ করেননি বলেই এমন শাস্তি পেয়েছেন, যে শাস্তি পুরস্কারের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
তবে এবাটই প্রথম বহিস্কৃত হওয়া সাংবাদিক নন। সর্বপ্রথম জার্মানি থেকে বিতাড়িত করা হয় শিকাগো ডেইলি নিউজের বার্লিন ব্যুরো প্রধান এডগার মৌরারকে। হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার আগেই তিনি নাৎসিদের চোখের বালি হয়ে যান। এর জন্য তার লেখা ‘জার্মানি পুটস দ্য ক্লক ব্যাক‘ বইটি দায়ী ছিল।
হিটলার ক্ষমতায় বসার পরও সমালোচনা অব্যাহত রাখেন, যা নাৎসি সরকারের বিরক্তির কারণ ছিল। এরপর যখন তিনি জার্মানির ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাচিত হন, তখন বিষয়টি হিটলার ঘনিষ্ঠদের বেশ ক্রুদ্ধ করে। ফলে নাৎসি সরকার তাকে জার্মানি ছাড়তে বাধ্য করে। তিনি যদি স্বেচ্ছায় জার্মানি না ছাড়েন, তাহলে তার উপর হামলা হলেও কোনো পদক্ষেপ সরকার নেবে না বলে হুশিয়ারি দেওয়া হয়। তখন জীবন রক্ষার তাগিদেই মৌরার জার্মানি ছাড়েন। পরে সেই বছর তাকে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
জার্মানি থেকে বিতাড়িত হওয়া প্রথম ব্রিটিশ সাংবাদিক ছিলেন নোয়েল প্যান্টার। তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফের হয়ে কাজ করতেন। মিউনিখের অস্ত্রশস্ত্র সহ মিছিলের খবর প্রকাশ করাই ছিল তার অপরাধ। এই মিছিলের বিষয়ে বাইরের পৃথিবীর কেউ জানুক সেটা নাৎসিরা চায়নি। ফলে প্যান্টারকে প্রথমে গ্রেফতার করে এক সপ্তাহের বেশি সময় জেলে রাখা হয়। এরপর ১৯৩৩ সালের নভেম্বরে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
দ্বিতীয় ব্রিটিশ সাংবাদিক হিসেবে দেশে ফিরতে বাধ্য হন ফিলিপ স্টিফেন্স। ডেইলি এক্সপ্রেসের সেসময়ে এই তরুণ সাংবাদিক ইহুদী নির্যাতনের খবরগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতেন। ১৯৩৪ সালের মে মাসে তিনি এক খবরে লেখেন,
জার্মান ইহুদীরা তাদের সবচেয়ে দুর্দিন পার করছেন। তারা বর্তমানে বন্ধুহীন, নিগৃহীত, এবং সরকার থেকে তাদের বলা হচ্ছে, সবচেয়ে ভালো হয় তোমরা মরে যাও।
এই খবর প্রকাশের পর গেস্টাপো তাকে আটক করে। এরপর কোনো অভিযোগ ছাড়াই জেলে বন্দী করে রাখা হয়৷ জেলের যে কক্ষে তিনি থাকতেন, সে ঘরে অনেক মানুষের শিরশ্ছেদ করা ছবি লাগানো ছিল। তাকে ভয় দেখানোর জন্য এমন কাজ করা হয়। পরে অবশ্য তাকে বরখাস্ত করে দেশে ফেরত পাঠানো। তবে এখানে উল্লেখ্য, ডেইলি মেইলের কোনো সাংবাদিককে নাৎসি সরকারের আমলে বিতাড়িত করা হয়নি।
হার না মানা সংকল্প
জার্মানির নাৎসি সরকারের পাহাড় সমান চাপ থাকা সত্ত্বেও সেখানে কাজ করা বিদেশী সাংবাদিকরা দমে যাননি। বরং তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সত্য প্রকাশের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। ডেইলি মেইল ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের মতো কিছু সংবাদমাধ্যম যখন জার্মানিতে ইহুদী নিধনের বিষয়টি অস্বীকার করেছে, ঠিক তখন ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকা সেসব ঘটনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে।
ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানের ফ্রেডরিক ভয়েট নাৎসিদের ইহুদী নির্যাতন নিয়ে খুঁটিনাটি সব বিষয় তুলে ধরে প্রতিবেদন লিখেছেন, যা সেই সময় করা ছিল দুঃসাহসী এক কাজ। আর এজন্য তাকে ১৯৩৩ সালে জার্মানি ছেড়ে আসতে হয়। কারণ তার কাছে খবর ছিল তাকে হিটলারের গোয়েন্দারা হত্যা করতে পারেন।
১৯৩৬ সালে ভয়েট তার আলোচিত লেখাটি প্রকাশ করেন। জার্মানির বন্দীশিবিরগুলোতে কীভাবে সরকারবিরোধী ও ইহুদীদের নির্যাতন করা হতো তা তুলে ধরেন। তার ভাষ্যমতে, সেখানে কাউকে ১৮টি চাবুক মারার পরই অনেকে গোঙানো শুরু করতেন। কিন্তু এরপরও নাৎসি সেনারা থামতেন না। একদম অচেতন হওয়ার আগপর্যন্ত তারা চাবুক মারতেই থাকতেন।
যারা গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়তেন তাদের জন্য কোনো আইনি সুযোগ সুবিধা ছিল না। বরং তাদের কাউকে মরার আগপর্যন্ত পেটানো হতো। আবার অনেকে সামান্য আঘাতের পরপরই মৃত্যুবরণ করতেন।
জন সার্গ নামে নিউজ ক্রনিকলের এক সাংবাদিককে নাৎসিরা দুবার বিতাড়িত করে। ‘৩০ এর দশকের শেষদিকে তাকে প্রথমবার বরখাস্ত করা হলে তিনি অস্ট্রিয়া চলে যান। কিন্তু ১৯৩৮ সালে হিটলারের বাহিনী অস্ট্রিয়া আক্রমণ করার পর সেখানেও ইহুদী নিধন শুরু হয়। একদিন সার্গকে ইহুদী ভেবে এক নাৎসি সেনা আরেক ইহুদীর সাথে তার গাড়ি পরিষ্কার করতে বলেন। তিনি তখন আদেশ মেনে এক বৃদ্ধ নারীর সাথে গাড়ি পরিষ্কার করেন।
এরপর সেই সেনা কর্মকর্তার কাছে ফিরে এসে বলেন,
আপনাদের এই পশুত্বের গল্পগুলো আগে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আজ নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিলাম। আজ তা দেখলাম।
এরপর সার্গকে দ্বিতীয়বারের মতো নাৎসি সেনারা বিতাড়িত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সেনাদের হাতে তিনি আটক হন। এরপর এক বন্দীশিবিরে মৃত্যু হয়। তবে তার মতো সাংবাদিকদের আত্মত্যাগের কারণে আজকের বিশ্ব হিটলারের বর্বরতার সম্পর্কে জানতে পারছেন। তারা যদি অন্যদের মতো চুপ হয়ে যেতেন তাহলে নাৎসিদের দমন করা হয়তো আরো কঠিন হয়ে যেত।
‘হিটলারের ডায়েরী (১৯১৭ – ১৯৪৫)’ বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-