১
১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে রাজপুত শক্তিকে সমূলে উৎপাটন করার পর হিন্দুস্তানের নতুন উদীয়মান শক্তি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছেন এখন। বিগত বেশ কয়েক মাস চরম উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছিলো তাকে। পানিপথের যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করার পর তিনি ইব্রাহীম লোদির ভূখন্ডগুলো থেকে শুধুমাত্র দিল্লি, আগ্রা আর এর আশেপাশের কিছু এলাকা নিজের অধিকারে নিতে পেরেছিলেন। হিন্দুস্তানের বিস্তীর্ণ এক ভূখন্ড তখনো জয় করা বাকী ছিলো। এদিকে পরাজিত আফগানরা হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলকে নিজেদের ঘাটি করে ধীরে ধীরে বাবরের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলো।
আরেকদিকে গোটা হিন্দুস্তান শাসনের স্বপ্নে বিভোর রাজপুতরা মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে এই আফগান শক্তিকে ব্যবহার করা জন্য আফগানদের সাথে সামরিক সহযোগীতামূলক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। রাজপুতরা দিল্লির সাবেক সুলতান ইব্রাহীম লোদির ছোটভাই মাহমুদ লোদিকে ‘সুলতান’ উপাধী দিয়ে লোদি সাম্রাজ্যের বৈধ দাবিদারের স্বীকৃতি দেয়। রাজপুত রাজা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে অন্যান্য রাজপুতরাও তাকে সমর্থন দেন। মাহমুদ লোদিকে রাজপুতদের এই সমর্থন দানের ব্যাপারটি অবশ্য উদ্দেশ্যমূলক ছিলো। তারা চাইছিলো আফগানদের সাথে নিয়ে বাবরকে পরাজিত করে হিন্দুস্তান থেকে বিতাড়িত করে হিন্দুস্তানে রাজপুত শাসন কায়েম করতে। পরবর্তীতে আফগানরা যদি এতে বাঁধা দেয়, তাহলে তাদেরও দমন করা হবে। এদিকে হিন্দুস্তানের আফগান নেতৃবৃন্দসহ বেশ কিছু স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থন লাভ করে খুব দ্রুতই নিজেকে আফগানদের প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হন লোদি বংশের নতুন সুলতান মাহমুদ লোদি।
সম্রাট বাবর সদ্যই দিল্লি আর আগ্রা বিজয় করলেও তাকে হিন্দুস্তানে বিদেশি শক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বাবর বিদেশিদের মতো হিন্দুস্তানে কোন লুটপাট না চালিয়ে হিন্দুস্তানকে আপন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিদেশি শক্তি মুঘলদের হটিয়ে হিন্দুস্তান শাসন করতে রাজপুত রাজা সংগ্রাম সিংহ সুলতান মাহমুদ লোদিকে নিয়ে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রযাত্রা করেন। আরও বেশ কয়েকজন রাজপুত রাজাসহ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বিশাল এক বাহিনী নিয়ে রাজপুত সেনাবাহিনী খানুয়ার প্রান্তরে সমবেত হয়। সম্রাট বাবর যখন যুদ্ধের জন্য খানুয়ার প্রন্তরে উপস্থিত হন, তখন তার সাথে মাত্র ২৫,০০০ যোদ্ধার তুলনামূলক একটি ক্ষুদ্র বাহিনী! কিন্তু ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে রাজপুতদের এই বিশাল বাহিনীটিই ছোট্ট মুঘল সেনাবাহিনীর সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো।
খানুয়ার প্রান্তরে অবশ্য বাবরের পক্ষে রাজপুতদের পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয়নি। তবে মুঘল সেনাবাহিনী আজীবনের জন্য তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। সহসাই রাজপুতরা আর মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারবে না, এ ব্যপারে সম্রাট বাবর একেবারে নিশ্চিত ছিলেন।
কিন্তু, খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজয়ের পর সম্রাট বাবরের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ ছিলো ইব্রাহীম লোদির ছোট ভাই সুলতান মাহমুদ লোদি। কারণ তিনি জানতেন খানুয়ার প্রান্তরে ভরাডুবি হলেও মাহমুদ লোদির নেতৃত্বে আফগানরা যেকোনো সময় সমবেত হয়ে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করবে। আর এ জন্য তিনি আফগানদের গতিবিধির উপর সবসময়ই তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন।
২
এদিকে বিহারে তখন নবপ্রতিষ্ঠিত পাঠান রাজবংশের শাসন চলছিলো। এই রাজবংশের শাসক সুলতান শাহ লোহানি মৃত্যুবরণ করলে শাহ লোহানির পুত্র জালালউদ্দিন লোহানি বিহারের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি বয়সে বেশ তরুণ ছিলেন। ফলে শীঘ্রই বিহারে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। সুলতান জালালউদ্দিন লোহানির বিভিন্ন আত্মীয়রা নিজেদের সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারি ভাবতে থাকেন, যা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরো উস্কে দেয়। জালালউদ্দিন লোহানি নিজেকে ভয়ানক বিপদের মাঝে দেখতে পেয়ে বঙ্গদেশের সুলতান নুসরত শাহের নিকট নিরাপত্তা প্রত্যাশী হন। এরকম অবস্থায় বিহারের জনগণ নিজেদের অরক্ষিত ভাবতে থাকে। তারা হিন্দুস্তানে চলমান রাজনৈতিক পালাবদল সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। তারা বুঝতে পারছিলেন শীঘ্রই বিহারের পতন ঘনিয়ে আসছে। আর তাই তারা সুলতান ইব্রাহীম লোদির ভাই মাহমুদ লোদিকে বিহার আর জৈনপুরের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সুলতান মাহমুদ লোদি অত্যন্ত আনন্দের সাথেই এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে কোনো প্রকার বাঁধা কিংবা প্রতিরোধ ছাড়াই বিহারের সিংহাসনে বসতে সক্ষম হন।
বিগত বছরের যুদ্ধগুলো থেকে সম্রাট বাবর বুঝতে পেরেছিলেন, হিন্দুস্তানের কোনো স্থানীয় সেনাবাহিনীই প্রবল শক্তিশালী মুঘল সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়াতে সক্ষম না। মুঘল সেনাবাহিনীর সামনে তারা খড়কুটার মতো উড়ে যাবে। কিন্তু আফগানরা সংগটিত হওয়ার মতো যথেষ্ট সুযোগ পেলে তারা বাবরের বিরুদ্ধে বেশ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। আফগানরা স্বভাবগতভাবেই বেশ ভালো যোদ্ধা আর কিছুটা বিদ্রোহপ্রবণও। তাই আফগানদের পুরোপুরি ধ্বংস না করা পর্যন্ত সম্রাট বাবর যেন কোনোকিছুতেই ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।
৩
বাবর সুলতান মাহমুদ লোদির বিহারের সিংহাসনে আরোহণ সংবাদ শুনেই মাহমুদ লোদিকে বাঁধা দিতে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যেই পাঠান আর আফগানরা দলে দলে মাহমুদ লোদির অধীনে সমবেত হচ্ছে। আর তাদের উদ্দেশ্য একটাই। সম্রাট বাবরের নিকট থেকে দিল্লি আর আগ্রা পুনরুদ্ধার করা।
১৫২৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাবর তার সেনাবাহিনী নিয়ে বিহার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি দোয়াব নদী পাড়ি দেন এবং গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে তিনি তার পুত্র হুমায়ুন মির্জার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শীঘ্রই হুমায়ুন মির্জা, আশকারি মির্জাসহ মুঘল সেনাবাহিনীর বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাবরের সাথে মিলিত হন। বাবর নিজে তার সেনাবাহিনীসহ গঙ্গার দক্ষিণ তীর বরাবর এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে হুমায়ুন মির্জা আর কামরান মির্জার নেতৃত্বে তাদের বাহিনী বাবরের বাহিনীর সাথেই নদীর বিপরীত তীর বরাবর সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
যাত্রাপথেই বাবরের কাছে প্রতিনিয়ত গোয়েন্দা তথ্য এসে পৌঁছাচ্ছিল। মাহমুদ লোদি নিজের অধীনে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যক সৈন্যের একটি বাহিনী সমবেত করতে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্য এতে বাবর খুব একটা অবাক হননি। তিনি এমনটাই ধারণা করছিলেন। বাবরের সাথে তখন মাত্র ৩০ হাজারের কিছু বেশি সংখ্যক সৈন্য ছিলো। মাত্র ৩০ হাজার সৈন্যর এই মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যদি বিশাল আফগান বাহিনী শক্তভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, তাহলে তা মুঘল সাম্রাজ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারবে। এটা নিয়েই বাবর কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন।
৪
মুঘল সেনাবাহিনীর এগিয়ে আসার সংবাদ পেয়ে মাহমুদ লোদি শেখ বায়েজিদ আর বাবনের নেতৃত্বে একটি বাহিনী সিরওয়ার দখল করতে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে বিহারের শের খান বেনারস দখল করে নেন। ১৫২৮ সালে বিহারের লোহানি বংশের সুলতান মুহাম্মদ শাহ-এর ইন্তেকালের পর তরুণ সুলতান জালালউদ্দিন লোহানি সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তরুণ হওয়ায় রাজকার্যে অদক্ষতার দরুণ নতুন সুলতানের মা দুদু বিবি সুলতান জালালউদ্দিনের রাজপ্রতিভূ হিসেবে বিহার শাসন করতে থাকেন। এসময় শের খান মুহাম্মদ শাহের দরবারেই অবস্থান করছিলেন। দুদু বিবি শের শাহের কাছে বিহারের প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে দেন। আক্ষরিক অর্থে এসময় তিনিই বিহার শাসন করতেন। কিন্তু জালালউদ্দিন লোহানির নিকট থেকে বিহারের ক্ষমতা মাহমুদ লোদির নিকট স্থানান্তরিত হলে তিনি মাহমুদ লোদির অধীনে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে, জালালউদ্দিন লোহানির মন্ত্রী ফতেহ খান শিরওয়ানি দ্রুত চুনার অভিমুখে এগিয়ে যান। এসমস্ত তথ্যই বাবর গোয়েন্দা মারফত পাচ্ছিলেন। তবে তিনি তার গতিপথ পরিবর্তন না করে পূর্বপরিকল্পিত যাত্রাপথ ধরে অগ্রযাত্রা বজায় রাখেন।
বাবর যখন কারার কাছাকাছি পৌছে যান, তখন তার সাথে যোগ দেন শর্কি রাজবংশের সুলতান জালালউদ্দিন শর্কি। জালালউদ্দিন শর্কিকে নিজ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে বাবর তার বাহিনী নিয়ে বেনারসের দিকে এগিয়ে যান। বাবরের বেনারস অভিমুখে যাত্রার কথা শুনে সুলতান মাহমুদ লোদি বেনারস থেকে দ্রুত পিছু হটেন। মুঘল সেনাবাহিনী গঙ্গা আর যমুনার মিলনস্থল এলাহাবাদে এসে পৌছায়। মাহমুদ লোদিকে ধাওয়া করতে মুঘল সেনাবাহিনী দ্রুত যমুনা অতিক্রম করে প্রয়াগ পর্যন্ত পৌঁছে যান। মাহমুদ লোদি এসময় সন নদীর তীরে সেনাছাউনি ফেলে অবস্থান করছিলেন।
প্রয়াগ থেকে মুঘল সেনাবাহিনী দ্রুত চুনার, বেনারস আর গাজীপুর (এই ‘গাজীপুর’ ঢাকার পাশ্ববর্তী ‘গাজীপুর’ জেলা নয়। আলোচ্য ‘গাজীপুর’ বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা) অতিক্রম করে। এসময় গাজীপুরের আফগান আমির শাহ মুহাম্মদ মারুফ বাবরের প্রতি নিজের আনুগত্য স্বীকার করেন। প্রায় একই সাথে আরো বেশ কিছু আফগান আমির বাবরের আনুগত্য স্বীকার করলে মাহমুদ লোদির জয় সম্পর্কে তার অনেক আমিরই সন্দিহান হয়ে পরেন। এসময় বিহারের বৈধ উত্তরাধিকারী জালালউদ্দিন লোহানিসহ শের শাহ বাবরের আনুগত্য স্বীকার করেন। ধীরে ধীরে অন্যান্য আফগান আমিররাও সুলতান মাহমুদ লোদির বাহিনী ত্যাগ করতে থাকে। বাবর যখন সুলতান মাহমুদ লোদিকে ধাওয়া করে কর্ণ নদী অতিক্রম করে চৌসার পৌঁছান, তখন তার সামনে মাহমুদ লোদির বাহিনীর দৈন্যদশা ফুটে উঠে। রাতারাতি প্রায় ১ লাখের বেশি আফগান আর পাঠান যোদ্ধাই তাদের সুলতানকে ত্যাগ করে পালিয়েছে। এদের অনেকেই বাবরের প্রতি তাদের আনুগত্য স্বীকার করেছে, আবার অনেকেই পালিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে।
নিজ সেনাবাহিনীর এই দুরাবস্থায় বাবরের আগমনে নিজের বিপদ বুঝতে পেরে মাহমুদ লোদি আবারো পিছু হটতে থাকেন। এসময় তার বাহিনীর সাথে মুঘল সেনাবাহিনীর ছোটখাট কিছু সংঘর্ষ হয়। কোনো উপায় না দেখে সুলতান মাহমুদ লোদি বঙ্গের সুলতানের কাছে আশ্রয় নেন। এসময় তার সাথে মাত্র ২ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যক সৈন্য ছিলো!
৫
১৫২১ সালে বঙ্গের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রায় ২৪ বছর বঙ্গ শাসন করেছিলেন। কিছু কিছু সূত্রে তার শাসনকাল ২৯ বছর ৫ মাস উল্লেখ করা হয়েছে। যা-ই হোক, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তার ১৮ পুত্রের মধ্যে জৈষ্ঠ্য পুত্র নসরত শাহ বঙ্গের সিংহাসনে বসেন। শাসক হিসেবে তিনি বেশ বিজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ আর প্রজাদরদি ছিলেন। সম্রাট বাবর যখন হিন্দুস্তান আক্রমণ করে দিল্লি আর আগ্রা বিজয় করে নেন, তখন বহুসংখ্যক আফগান আমির নসরত শাহের দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। নসরত শাহ তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। এমনকি তাদের পদ আর মর্যাদা অনুযায়ী তারা জায়গীরও বরাদ্দ পান। এই আশ্রয় প্রার্থীদের দলে সুলতান নিহত সুলতান ইব্রাহীম লোদির একজন কন্যাও ছিলেন। বঙ্গের সুলতান নসরত শাহ তাকে সসম্মানে বঙ্গের দরবারে আশ্রয় দেন এবং পরে তাকে বিয়ে করেন।
৬
বাবরের নিকট পরাজিত হয়ে সুলতান মাহমুদ লোদি বঙ্গের সুলতান নসরত শাহের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করলে দয়াবান শাসক নসরত শাহ তাকেও বঙ্গে আশ্রয় দেন। এদিকে সুলতান মাহমুদ লোদির এই রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের ঘটনায় বাবর বুঝতে পারেন মাহমুদ লোদি বঙ্গে অবস্থান করে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করবে। এক্ষেত্রে হয়তো বঙ্গের সুলতান নসরত শাহই তাকে সামরিক সহায়তা দিয়ে সাহায্য করবেন। বিচক্ষণ সম্রাট বাবর একজন শক্তিশালী শত্রুকে পেছনে ফেলে রাজধানী ফিরে যেতে মোটেই ইচ্ছুক ছিলেন না।
এদিকে বঙ্গের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় নুসরত শাহ বাবরকে বঙ্গের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করেন। তিনি বঙ্গের সীমানা থেকে মুঘল সেনাদের পিছু হটানোর জন্য একটি বড় সেনাবাহিনীসহ কুতুব খানকে বাহরাইচ অভিমুখে প্রেরণ করেন। মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে তার বাহিনীর বেশ কিছু সংঘর্ষ হয়। ইতোমধ্যেই বাবরের জেনারেল এবং জামাতা জামান খান মির্জা জৈনপুর দখল করে নেন। জৈনপুর দখলের পর বাবর জৈনপুর এসে অবস্থান নেন। বঙ্গের সেনাবাহিনীর পাল্টা অভিযানের সংবাদ শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন এখান থেকে বঙ্গ অভিমুখে অভিযান চালানোর জন্য এগিয়ে যাবেন তিনি।
বাবরের সাথে বঙ্গ সৈন্যদের দেখা হয় গঙ্গা আর ঘাঘরা নদীন মিলনস্থলে। স্থানটি বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশের সারান জেলার অন্তর্গত। এখানে তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গের সেনাবাহিনীর ব্যপক যুদ্ধপ্রস্তুতি দেখতে পান। নদী অতিক্রম করে এগিয়ে আসার জন্য বঙ্গের সেনাবাহিনী বেশ কিছু নৌযানও নদীতে মোতায়েন করে রেখেছিলো। বঙ্গের সেনাবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধপ্রস্তুতি দেখে বাবর বঙ্গের সাথে লড়াই এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। কারণ বঙ্গের সেনাবাহিনী মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য মূল হুমকি না। তাই বাবর এই যুদ্ধাবস্থায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চাচ্ছিলেন। তিনি বঙ্গের সুলতান নসরত শাহের নিকট আফগান বিদ্রোহীদের প্রত্যাবর্তন করার অনুরোধ জানিয়ে একজন দূত প্রেরণ করলেন। কিন্তু বঙ্গের রাজদরবার থেকে তার পত্রের কোনো সন্তোষজনক উত্তর দেয়া হয় নি।
যুদ্ধ এড়ানোর কোনো উপায় না দেখে বাবর এবার ঘাঘরা নদী পেড়িয়ে বঙ্গের সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মুঘল সেনাবাহিনীকে ৬টি অংশে ভাগ করেন। বাবর নিজের ব্যক্তিগত কমান্ডে ২টি বাহিনী রেখে অবশিষ্ট ৪টি বাহিনী আশকারী মির্জার অধীনে দেন। জুনায়েদ মির্জাকে নির্দেশ পাওয়া মাত্র ঘাঘরা নদী অতিক্রমের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। বাবর তার আর্টিলারি বাহিনীর কমান্ডার ওস্তাদ আলী কুলিকে ঘাঘরা নদীর তীরে বঙ্গদেশের সৈন্যদের অবস্থান বরাবর বিপরীত পাশে মুঘল সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিটের কামানগুলো বসানোর নির্দেশ দেন।
মোস্তফা রুমির অধীনে মাস্কেটিয়ারদের গঙ্গা ও ঘাঘরা নদীর মিলনস্থল থেকে বঙ্গ সৈন্যদের পেছন থেকে আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়। এই বাহিনীতেও বাবর কিছু কামান মোতায়েন করেন। পরিকল্পনা মতো সৈন্য মোতায়েন করে বাবর আশকারী মির্জার অধীনস্ত ডিভিশনগুলোকে ঘাঘরা নদী অতিক্রমের নির্দেশ দেন। আশকারী মির্জা হলদিঘাট দিয়ে ঘাঘরা নদী অতিক্রমের সিদ্ধান্ত নিয়ে হলদিঘাটের দিকে অগ্রসর হন। এদিকে ওস্তাদ আলী কুলি আর মোস্তফা রুমির কামানগুলো বঙ্গের সৈন্যদের উপর তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করে। অন্যদিকে এমন ঘোলাটে পরিস্থিতির মাঝেই আফগান আমির শাহ মুহাম্মদ মারুফ দলত্যাগ করে বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে বাবরের সাথে যোগ দেন।
৭
১৫২৯ সালের ৬ মে ভোরের দিকে বঙ্গের সৈন্যরা বাবরকে আক্রমণের জন্য নদী তীরে এগিয়ে আসতে থাকে। বঙ্গের সৈন্যদের সাথে প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি রণতরী ছিলো। বাবর দ্রুত নিজের আর জামান মির্জার বাহিনীকে নদী পাড়ি দেয়ার নির্দেশ দেন। মুঘল সেনাবাহিনীর নিকট উল্লেখযোগ্য কোনো নৌশক্তি না থাকায় নির্দেশের সাথে সাথেই যে যেভাবে পেড়েছে সেভাবেই নদী পাড়ি দিয়েছেন। কেউ ছোট নৌকায়, কেউ কোনো অবলম্বন ধরে কিংবা সাঁতরে নদী পাড়ি দিতে থাকেন। নদীর অপর তীরে মুঘল সেনাবাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালানো হয়। ইতোমধ্যে নদীর মাঝেই যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। তবে বেশ কিছু প্রাণহানী সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত মুঘল সৈন্যরা নদী পাড়ি দিয়ে নদীর অপর তীরে সমবেত হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মুঘল সেনাবাহিনী নদী অতিক্রম করার সাথে সাথেই বঙ্গের সৈন্যরা তিনদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত যুদ্ধের প্রচন্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে বঙ্গের সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। পরে তারা যত্রতত্রভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ত্যাগ করে।
যুদ্ধে পরাজয়ের পর বঙ্গের সুলতান নসরত শাহ এবার নিজের বিপদ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন। তিনি বাবরের উদ্দেশ্যে মূল্যবান উপহারসহ দূত প্রেরণ করে বাবরের আনুগত্য স্বীকার করেন। বাবর নিজেও হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বঙ্গ আক্রমণে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। তাই তিনিও বঙ্গের সুলতান নসরত শাহের সাথে শান্তিচুক্তি করে রাজধানী ফিরে যান। অন্যদিকে, ঘাঘরার যুদ্ধের পর সুলতান মাহমুদ লোদি উড়িষ্যার দিকে পালিয়ে যান। ৯৪৯ হিজরি মোতাবেক ১৫৪২ অথবা ১৫৪৩ সালে তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
৮
ঘাঘরার যুদ্ধ খুব বড় আকারের কোনো যুদ্ধ না হলেও এই যুদ্ধটি বাবর এবং তার প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি লড়াই ছিলো। পানিপথের প্রান্তরে লোদি সাম্রাজ্যের শক্তি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও তারা হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলে অবস্থান নিয়ে শক্তিবৃদ্ধি করছিলো। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো বাবরকে হিন্দুস্তান ছাড়া করে দিল্লি সিংহাসন পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাদের সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এই যুদ্ধের পর আফগানরা হাল ছেড়ে দেয়। আফগান আমিররা দলে দলে বাবরের আনুগত্য স্বীকার করতে থাকেন। প্রচুর সংখ্যক আফগান আর পাঠান সৈন্যরা বাবুরের আনুগত্য স্বীকার করলে তাদের প্রত্যেককেই মুঘল সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। এদিকে বিহারের জালালউদ্দিন খান লোহানি বাবরের আনুগত্য স্বীকার করলে বিহারও বাবরের দখলে চলে যায়। অন্যদিকে বঙ্গের সুলতান বাবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শান্তিচুক্তি করলে বাবর বঙ্গের দিক থেকেও নিরাপদ হয়ে যান।
ঘাঘরার যুদ্ধের পর বাবরের সামনে দাঁড়ানোর মতো আর শক্তিশালী কোনো সেনাবাহিনীর অস্তিত্বই আর হিন্দুস্তানের মাটিতে ছিলো না। সবদিক থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাবর যেন এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কিছুটা সুযোগ পান।
তথ্যসূত্র
১। বাবরনামা- জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবুর (অনুবাদ: মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)
২। হুমায়ুননামা- মূল গুলবদন বেগম (অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ)
৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান
৪। রিয়াজ-উস-সালাতীন- মূল গ্রন্থ (ফারসী) : গোলাম হোসায়ন সলীম (বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ: বাংলার ইতিহাস, অনুবাদ: আকবরউদ্দীন)
এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ
১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা
২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ
৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল
৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক
৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল
৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল
৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন
৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য
৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস
১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র
১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান
১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো
১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে
১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি
১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই
১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত
ফিচার ইমেজ: Pinterest