সার্গন দ্য গ্রেট: প্রাচীন আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। প্রাচীন ইরাকে তখন দজলা-ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে ওঠা সুসংগঠিত সুমেরীয় সভ্যতা চলমান। তপ্ত বালির উপর নির্মিত ধবধবে প্রাসাদে বসে তখন রাজ্য শাসন করছেন কিশির রাজা উর-জাবাবা। সেসময় বুকভরা সাহস আর অদম্য স্পৃহা নিয়ে মসনদে আসীন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন সুমেরের এক ফলচাষী। নিজ প্রচেষ্টায় তিনি ফলচাষী থেকে উর-জাবাবার ভৃত্য তালিকায় জায়গা করে নেন। একসময় তার অধরা এই স্বপ্ন বাস্তবতা হিসেবে প্রতিফলিত হয়। উর-জাবাবাকে হটিয়ে তিনি হয়ে উঠেন সুমেরের অধিকর্তা। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীন আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। ইতিহাসে এই ফলচাষী আক্কাদের সার্গন বা সার্গন দ্য গ্রেট নামেই সুপরিচিত।

সার্গন দ্য গ্রেট; Image Source: Pazasaurus.

কিংবদন্তি

আক্কাদের প্রারম্ভিক জীবন কেমন ছিল, তা ‘সার্গনের কিংবদন্তি‘ নামে প্রাচীন এক কিউনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে জানা যায়। এই ট্যাবলেটের সন্ধান মিলেছে সম্রাট আশুরবানিপালের গ্রন্থাগারে। ট্যাবলেট অনুসারে, সার্গনের মা ছিলেন সুমেরীয় দেবী ইশতারের একজন পুরোহিত, যিনি সার্গনকে গোপনে জন্ম দিয়ে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেই নবজাতক এসে ঠেকে মেসোপটেমিয়ার কিশ শহরের উপকণ্ঠে। সার্গনকে কুড়িয়ে পায় ওই শহরের একজন মালী। মালী পরিবারেই শৌর্য-বীর্য নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন সার্গন। বাল্যকাল থেকেই তার মনে দানা বেধেছিল তার আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছা। ফলচাষি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করলেও, সদা-সচেতন সার্গন কিশের সম্রাট উর-জাবাবার পেয়ালা-বাহক হিসেবে চাকরি পেয়ে যান। নিজ বুদ্ধি ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে একসময় তিনি বিশ্বস্ত ভৃত্য থেকে রাজার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টায় উন্নীত হন।

সার্গন ছিলেন সম্রাট উর-জাবাবার পেয়ালা-বাহক; Image Source: Pazasaurus.

এই সময়ে, মেসোপটেমিয়ায় পরিপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল সুমেরীয় সভ্যতা। তৎকালে এই সভ্যতা ছিল বহু নগররাষ্ট্রে বিভক্ত। সম্রাট উর-জাবাবা ওই সময় আরেক সুমেরীয় নগররাষ্ট্র উম্মার রাজা লুগাল-জাগে-সি’র সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তখন যুদ্ধবিগ্রহের ঝামেলা সামাল দেওয়া কিংবা, রাজ্যপরিচালনার জন্য অনেক শলা-পরামর্শই উর-জাবাবা সার্গনের কাছ থেকে গ্রহণ করতেন। এভাবেই সার্গন পরিণত হয়েছিলেন পটু এবং চৌকস একজন রাজনীতিবিদে, এবং শিরে রাজমুকুট পরিধানের অভিলাষকে তিনি বাস্তবে রূপ দেওয়ার দিকে ধাপে ধাপে এগোতে থাকেন।

সার্গনের জন্মকাহিনি সম্বলিত কিংবদন্তি; Image Source: Louvre Museum.

সার্গনের স্বপ্ন

একরাতে সার্গন স্বপ্নে দেখেন, দেবী ইশতার উর-জাবাবার শাসনকার্যে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে খুন করছেন। গণকদের কাছে গেলে তারা স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা দেন যে, উর-জাবাবাকে খুন করলেই সার্গন দেবী ইশতারের আশীর্বাদপুষ্ট হবেন। স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা শুনে ঘুম হারাম হয়ে গেলো সম্রাটের। মামুলি এক পেয়ালা-বাহক কিনা তার মৃত্যুর কারণ হবে? প্রচণ্ড ভয় ঘিরে ধরল তাকে। সেজন্য সার্গনকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সম্রাটের লোকেরা হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

স্বপ্নে সার্গনের কাছে এসেছেন দেবী ইশতার; Image Source: Edwin J. Prittie.

এরপর উর-জাবাবা এক কূটনৈতিক বৈঠকের অজুহাতে রাজা লুগাল-জেগে-সি’র কাছে সার্গনকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। উর-জাবাবা সার্গনের কাছে মাটির একটি ট্যাবলেট দিয়ে দেন, যাতে নির্দেশনা দেওয়া ছিল লুগাল-জেগে-সি যাতে তার পেয়ালা-বাহককে হত্যা করে। শত্রুর এই সুযোগের ফায়দা নিলেন লুগাল-জেগে-সি। তিনি উর-জাবাবার ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন সার্গনের কাছে। ফলে লুগাল-জেগে-সি এবং সার্গন উর-জাবাবার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হন। লুগাল-জেগে-সির সামরিক শক্তি আর প্রাক্তন রাজ-উপদেষ্টা হিসাবে সার্গনের রাজনৈতিক জ্ঞান, এই দুইয়ের কাছে পরাজিত হলেন উর-জাবাবা।

সুমেরীয় এবং সেমাইটীয়দের চলমান যুদ্ধ, যার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সম্রাট সার্গন; Image Source: Alamy.

আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

উর-জাবাবার কাছ থেকে সিংহাসন ছিনিয়ে নেওয়ার পরেই সার্গন তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিটি নগর-রাষ্ট্রের শাসনকার্য ঘনিষ্ঠ লোকজনদের হাতে সঁপে দেন। গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পদে তিনি শুধু নিজের পরিবারের লোকজনকেই বসাতেন। যেমন, তিনি তার কন্যা এনহেদুয়ানাকে দেবী ইশতারের মহাযাজিকা হিসেবে নিযুক্ত করেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে, সার্গনকন্যা এনহেদুয়ানা হলেন পৃথিবী প্রথম মহিলা কবি, যার ৪২টি স্ত্রোতগীতির সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রশাসনিক, ধর্মীয় এবং রাজ্যের কাঠামোগত বহু উন্নতি এবং সংস্কার সাধন করেছিলেন সার্গন, যা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে।

সার্গনকন্যা এনহেদুয়ানা; Image Source: DiChap

কোনো এক অজানা কারণে, লুগাল-জেগে-সি এবং সার্গনের সম্পর্কে ফাটল ধরে যায়। তারপর দুজনই একে অপরের বিপরীতে পূর্ণ শক্তি নিয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এই দ্বন্দ্বে জয়ের স্বাদ আস্বাদন করেছিলেন সার্গন দ্য গ্রেট। ফলে, তিনি প্রতিপক্ষ সম্রাটকে বন্দী করার পাশাপাশি, লুগাল-জেগে-সির রাজ্য উরুকের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যেহেতু সুমেরের বেশিরভাগ অংশই ছিল লুগাল-জাগে-সির অধীনে, তাই সারগন বিশাল বড় অঞ্চল শাসনের সুযোগ পান। পরবর্তীতে তিনি বড় বড় সামরিক অভিযান চালিয়ে তার রাজ্যকে ক্রমশই সম্প্রসারণ করে গেছেন। সময়ের সাথে সাথে সিরিয়া, লেবানন এবং আনাতোলিয়ার অংশগুলোও তার রাজ্যসীমায় যুক্ত হয়ে যায়। রাজ্য সম্প্রসারণের একপর্যায়ে ক্লান্ত হবার পর তিনি নতুন একটি শহর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, যা হবে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী। টাইগ্রিস নদীর পূর্বে অবস্থিত হওয়ায় মেসোপটেমীয় গ্রন্থে এই শহরকে ‘আগাদে’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। কালক্রমে শহরটি ‘আক্কাদ‘ নামে পরিচিতি পায়।

সার্গনের ছবি সম্বলিত সিলিন্ডার পাওয়া গেছে কিশির ধ্বংসাবশেষে; Image Source: The Field Museum.

আক্কাদীয় সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের প্রথম সভ্যতাগুলোর একটি, যারা নিজ সাম্রাজ্যে আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রয়োগ করেছিল। সার্গনের পূর্বে মেসোপটেমিয়ার সমাজগুলো ছিল রাজতন্ত্র শাসিত। সম্রাটদের পাশাপাশি পুরোহিতেরাও অনেকসময় শাসনভার গ্রহণ করতেন। রাজ্যশাসনে তাদের ক্ষমতা ছিল অসীম। সার্গন তার নতুন ব্যবস্থার অধীনে ধর্মীয় পুরোহিতদের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দিলেও অনেক বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ সীমিত করে দেন।

প্রস্তরফলকে সার্গনের প্রতিকৃতি; Image Source: Wikimedia Commons.

আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে সুমেরে সবচেয়ে প্রভাব বজায় রেখেছিল প্রাচীন সুমেরীয় ধর্ম। সার্গনের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে সুমেরীয় দেব-দেবীদের মন্দির মেসোপটেমিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। সার্গন নিজে ছিলেন দেবী ইশতারের খাঁটি ভক্ত, সেজন্য তিনি প্রাচীন সুমেরীয় ধর্মে ইশতারকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। শাসক হিসেবে উত্থানের প্রথম দিকে তিনি সমগ্র রাজ্য জুড়ে এই দেবীর উপাসনার রীতি প্রচার করেছিলেন। মেসোপটেমীয় সভ্যতায় দেবী ইশতারের তুমুল জনপ্রিয়তা, উপাসনা, এবং প্রভাব বিস্তারের পেছনে প্রায়শই সার্গনের প্রভাবকে দায়ী করা হয়।

আক্কাদীয় সভ্যতায় দেবী ইশতারের প্রতিমূর্তি; Image Source: Wikimedia Commons.

মেসোপটেমিয়ায় সরকারব্যবস্থা এবং ধর্মীয় রীতিনীতি সংস্কারের পাশাপাশি, তিনি রাজ্যের স্থাপত্য ও কাঠামোগত দিকের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। তার অধীনে থাকা সকল অঞ্চলের মধ্যে তিনি পরস্পর সংযুক্ত একটি সুগঠিত বাণিজ্যিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। আক্কাদীয় সাম্রাজ্য কৃষিতে সমৃদ্ধ থাকলেও, অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ, যেমন- ধাতু এবং কাঠের অভাব ছিল সেখানে। সেজন্য তিনি লেবানন থেকে ধাতু এবং কাঠ এনে এসবের চাহিদা মিটিয়েছিলেন। এভাবে বিস্তৃত বাণিজ্যিক অন্তর্জালের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন জিনিস বিনিময়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থাকে আরও সহজ করার লক্ষ্যে তিনি কৃষি ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সেচ-খাল নির্মাণে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। এছাড়াও মানব ইতিহাসে প্রথম ডাক-ব্যবস্থা এবং স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠনের মূল কারিগর ধরা হয় তাকেই।

সার্গন দ্য গ্রেট; Image Source: Pazasaurus.

খ্রিষ্টপূর্ব ২২৭৯ অব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সার্গন মেসোপোটেমীয় সভ্যতায় নিজের এক স্থায়ী এবং শাশ্বত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হওয়ায় তাকে প্রাচীন মেসোপোটেমীয় গ্রন্থগুলোতে ‘মহাবিশ্বের অধিপতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সার্গনের কিংবদন্তি ট্যাবলেটে বর্ণিত ছিল,

“যদি রাজারা মহান হতে চান, তবে তাদেরকে সার্গনের পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে।”

সার্গন-পরবর্তী আক্কাদীয় সাম্রাজ্যে সার্গন এতটাই সম্মানিত ছিলেন যে, পরবর্তী রাজারা তাদের নামের সাথে সার্গন যোগ করতেন। আক্কাদীয় সাম্রাজ্য তার জৌলুশের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে সার্গনের দৌহিত্র নারাম-সিনের আমলে। খ্রিষ্টপূর্ব ২১৫৪ অব্দের দিকে গুতিয়ান নামে এক বর্বর জাতির আক্রমণে স্তিমিত হয়ে যায় দেড়শো বছর ধরে জ্বলতে থাকা আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের সূর্য।

This is a Bengali article about Sargon the Great, founder of the ancient Akkadian Empire. References have been hyperlinked inside.
Feature Image: Lord Good

Related Articles

Exit mobile version