“দ্য এম্পায়ার অন হুইচ দ্য সান নেভার সেটস” -কথাটা একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বোঝাতে ব্যবহৃত হত, আজো হয়। যদিও গ্রেট ব্রিটেনের সে জৌলুস আজ আর নেই। তবুও যতদিন ইতিহাস পড়া হবে, যতকাল ঔপনিবেশিক শাসনতেন্ত্রর চর্চা চলবে; ততদিনই পরম বিস্ময়ের সাথে উচ্চারিত হবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নাম, পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে বড় সাম্রাজ্যের নাম!
কিন্তু যে সুসভ্য, সদম্ভ আর দিগ্বিজয়ী ব্রিটেনের চর্চায় আমরা মশগুল থাকি, তার অতীত ইতিহাস হয়তো অনেকেরই অজানা। আমরা হয়তো জানি না, ব্রিটিশরা এককালে রোমানদের থেকে নিয়েছিল সভ্যতার পাঠ, রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে পার করেছিল প্রায় ৩৬৭ বছর।
খ্রিস্টীয় যুগের পত্তন হতে তখনো প্রায় বছর পঞ্চাশেক বাকি। প্রতাপশালী রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন গলদের বিরুদ্ধে। ব্যাপক অঞ্চল নিয়ে তখন প্রাচীন গলদেশের বিস্তৃতি। সমগ্র ফ্রান্স তো বটেই, তা ছাড়াও লাক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডের সিংহভাগ, উত্তর ইতালির খানিকটা, নেদারল্যান্ডসের কিছু অংশ সহ রাইন নদীর পশ্চিম তীরের জার্মানিতে তখন কেল্টিক উপজাতির গলদের সুবিস্তৃত ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিদ্যমান। তাই সিজারের পক্ষে যে সে যুদ্ধে জয়লাভ করা মোটেই সুসাধ্য ছিল না, তা আর আলাদা ভাবে বলে দিতে হয় না।
ইংল্যান্ডের ব্রিটনরা ছিল এই গলদেরই মহাদেশীয় কুটুম্ব, তাই মাঝে মধ্যে তারা এই যুদ্ধে অনধিকার অংশগ্রহণ করে বসতো। এর ফলেই জুলিয়াস সিজারের রোষাগ্নি ব্রিটনদের ওপর পড়লো।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ অব্দে সিজার প্রথমবারের মতো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। সে যাত্রায় তার সাথে ছিল মাত্র ২ লিজিয়ন, অর্থাৎ ৮০০০-১২০০০ সেনা। কেন্ট প্রদেশের উপকূলে সফল অবতরণ ব্যতীত সে অভিযানের আর কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। তবে প্রথমবারের ব্যর্থতা যে তার দ্বিতীয় অভিযানের সাফল্যের নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল, সেটা অনস্বীকার্য।
কারণ পরের বছর সিজার ৬২৮ টি জাহাজ, ৫ লিজিয়ন সাধারণ সৈন্য এবং ২০০০ অশ্বারোহী সহযোগে অত্যন্ত সফল এক বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন, সেন্ট আলবানসের কাছে ব্রিটনদের দূর্গ ভূমিস্যাৎ করেন এবং সর্দার ক্যাসিভেলানাসকে বাধ্য করেন আপোষ করতে। তবে ব্রিটেনের ভূখণ্ডে রোমান ধ্বজা তিনি ওড়াননি- একটি নির্দিষ্ট হারে বাৎসরিক কর ধার্য করে প্রত্যাবর্তন করেন নিজের দেশে।
সিজারের আক্রমণ ছিল শাস্তিমূলক আক্রমণ। সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাভিলাষ তার ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুকাল বাদে ব্রিটেনের সমুদ্রতটে গড়ে ওঠে রোমান সেনাঘাঁটি, সম্রাট ক্লডিয়াসের হাত ধরে। ৪৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটন নেতারা রোম অধিকৃত গলদেশের কোনো এক উপকূলে সশস্ত্র আক্রমণ করে বসে। আর তারই জের ধরে ক্লডিয়াসের আদেশে অ্যালাস প্লাটিয়াস ব্রিটেনে সসৈন্য সমরাভিযান চালান। ক্যাম্যুলোডুনাম দূর্গ গুড়িয়ে দিয়ে তিনি সেনাধ্যক্ষ ক্যারাট্যাকাসকে পরাজিত করেন।
পরবর্তী গভর্নর অস্টোরিয়াস স্কাপুলা ওয়েলসের যুদ্ধপ্রিয় উপজাতিদের দমন করে রোমান ব্রিটেনের সীমানা পশ্চিম দিকে প্রসারিত করেন এবং সৈন্যঘাঁটি সমৃদ্ধ শহর নির্মাণের মাধ্যমে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। স্যুটনিয়াস পলিনাস পশ্চিম দিকের গোটা এলাকা সাম্রাজ্যভুক্ত করার উদ্দেশ্যে মোনা অব অ্যাঙলেসি অধিকার করেন। সেটি ছিল ড্রুইডদের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু তিনি সে বিজয় সুসম্পন্ন করতে পারেননি। কেননা, তার অনুপস্থিতিতে পূর্বাঞ্চলে এক ভয়াবহ বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে বিদ্রোহের হোঁতা ছিলেন আইসিনাই গোত্রের রানী বীরাঙ্গনা বউডিক্কা, যার দুই মেয়ে রোমান সেনাদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় বলে জানা যায়।
বউডিক্কার নেতৃত্ব সশস্ত্র বিদ্রোহীরা ক্যাম্যুলোডুনাম ও লন্ডনে আগুন লাগিয়ে দেয় ও বহুসংখ্যক রোমানদের হত্যা করে। কিন্তু এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পলিনাস অতি সত্ত্বর ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিদ্রোহ দমন করেন।
জুলিয়াস এগ্রিকোলাই প্রথম গভর্নর যিনি ব্রিটেন অভিযান সুসম্পন্ন করেন। ৭৮ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় এসে প্রথমেই তিনি গোটা ওয়েসে সফলভাবে রোমান শাসন প্রবর্তন করেন। উত্তর সীমান্ত ফোর্থ এবং ক্লাইড পর্যন্ত বিস্তৃত করে ইয়র্ককে উত্তরের জেলাগুলির রাজধানীতে পরিবর্তিত করেন। নর্দান ব্রিটনদের পরাজিত করে দেশের সর্বত্র শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। ক্লাইড থেকে ফোর্থ পর্যন্ত এক অভেদ্য দূর্গবেষ্টনী নিমার্ণের মাধ্যমে পিক্ট এবং স্কটদের মতো বর্বর জাতির আক্রমণের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ।
শুধু সামরিক সফলতা আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, জুলিয়াস এগ্রিকোলা সদয় ব্যবহার আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের জন্যও সমানভাবে চর্চিত। তিনি বুঝেছিলেন, ভূখণ্ড দখল করে সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানাই কেবল বাড়ানো যায়- বিজিতের হৃদয় জয় করতে পারাই আসল বিজয়।
রোমান শাসকেরা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পুরো ব্রিটেনকে পাঁচটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক অঞ্চলের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে রোমান গভর্নর। আর এই পাঁচজন গভর্নর একজন পার্ফেক্টের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতেন, যার হাতে দেওয়া হতো দেশটির সর্বময় ক্ষমতা।
মোটের ওপর বলা যায়, রোমানরা একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী সরকার ব্যবস্থা গঠন করেন। যেখানে সকলের সাথে ন্যায় করা হতো এবং যার হাত ধরে দেশের সর্বত্র শৃঙ্খলা বিরাজ করতো। কলহপ্রিয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভেতরকার নিরন্তর সংঘাতেরও ইতি ঘটে রোমান শাসকদের সুদক্ষ কর্মকুশলতার সুবাদে।
দেয়াল ঘেরা শহর নির্মাণ করে তাদেরকে অভিনব সড়ক ব্যবস্থায় গ্রথিত করা হয়। আর সেই সড়কপথের কল্যাণে রাষ্ট্রময় ঘটে এক অভূতপূর্ব বাণিজ্য বিপ্লব। জঙ্গল সাফ করে, জলা সংস্কার করে কৃষিব্যবস্থায় আনা হয় আমূল পরিবর্তন। প্রাচীন ড্রুইডতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রবর্তন করা হয় খ্রিষ্টধর্ম। আর তাছাড়া স্থাপত্যে, খনিজ পদার্থে, সর্বক্ষেত্রেই ব্রিটেন হয়ে ওঠে সুসভ্য আর সমৃদ্ধ।
রোমান শাসনের শেষের বছরগুলোতে স্যাক্সন দস্যুদের উৎপাত এতটাই বেড়ে যায় যে, গোটা দেশকে তিনজন বিশেষ অফিসারের জিম্মায় ছাড়তে হয়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। রোমের মূল ভূখণ্ডে গথ প্রভৃতি অসভ্য জাতির আক্রমণে নাকাল হয়ে সম্রাট হনোরিয়াস ৪০১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
রোমান আমলে ব্রিটেনে ব্যাপক বস্তুনিষ্ঠ উন্নয়ন সাধিত হলেও স্খলন হয়েছিল ব্যক্তিনিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের। রোমান সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক সজাগ রক্ষণাবেক্ষেণের ফলে স্থানীয় ব্রিটনরা হয়ে উঠেছিল অলস এবং উদাসীন। তাদের ভেতর পূর্বেকার আদিম উগ্রতার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিল না, ছিল না স্বাধীনতাপ্রীতিও। ফলস্বরূপ, রোমান প্রতিরক্ষা ব্যূহ অপসৃত হলেই অতি সহজে এবং শীঘ্রই তারা আবারও পরাধীন হয়ে পড়ে।
ব্রিটেনে রোমান শাসন মূলত ছিল সামরিক। তাই যত উন্নয়নই তারা করুক, সেসবের পেছনে সবসময়ই কোনো না কোনো সামরিক অভিসন্ধি কাজ করতো, থাকতো শাসনতান্ত্রিক উদ্দেশ্য। স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর কখনোই তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেনি। যার ফলে অভিজাত শ্রেণির মুষ্টিমেয় কিছু ব্রিটন বাদে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোমান সংস্কৃতির প্রায় কোনো চিহ্নই তারা রেখে যেতে পারেনি।
তবে রোমান স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ও অবশিষ্ট কিছু নিদর্শন, কেল্টিক ভাষায় কতগুলো রোমান শব্দ আর রোমান ভাষা থেকে আসা ‘চেস্টার’ শব্দটি দিয়ে শেষ হওয়া জায়গার নামগুলো আমাদের আজো রোমান ব্রিটেনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
যেহেতু রোম পরিত্যক্ত ব্রিটেনে রোমান সংস্কৃতির কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন মেলে না, তাই স্থিতিকাল বিচারে রোমান ব্রিটেনের আয়ু সুদীর্ঘ হলেও বাস্তবতার নিরীখে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব একটা নেই। ব্রিটেনের আসল ইতিহাসের সূচনা ঘটে ঐ ভূখণ্ডে স্যাক্সনদের আগমনের মধ্যে দিয়ে, যারা ব্রিটেনের ভাষা, সংস্কৃতি আর জীবনাচরণে এনেছিল অবিস্মরণীয় আর অপরিহার্য বিবর্তন।