একটা সময় মূলত তীর-ধনুক এবং তরবারিই ছিলো যুদ্ধক্ষেত্রের প্রধান অস্ত্র। যোদ্ধারা সামনাসামনি যুদ্ধ করতে তরবারি ব্যবহার করতেন এবং দূর থেকে তীর ছুঁড়তেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধে তীর-ধনুক এবং তরবারির ব্যবহার নিতান্তই অমূলক মনে হবে। কারণ আধুনিক যুগের উন্নত সব মারণাস্ত্র, বন্দুক, ট্যাংক, বোমারু বিমান, গ্রেনেড ইত্যাদির কাছে এই মধ্যযুগীয় অস্ত্রগুলো মনে হবে নিতান্তই ছেলেখেলা। কিন্তু ঘটনা অদ্ভুত হলেও সত্য যে, এক ব্যক্তি সত্যি সত্যিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধে সর্বদা তীর-ধনুক এবং তরবারি ব্যবহার করেছেন। তিনি হলেন জর্জ ম্যালকম থর্প ফ্লেমিং চার্চিল। নিজের অদ্ভুত এই স্বভাবের জন্য যিনি পরিচিত হয়েছিলেন ‘ম্যাড জ্যাক’ নামেও।
জন্মেছিলেন পুরনো অক্সফোর্ডশায়ারের একটি পরিবারে। ১৯২৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন স্যান্ডহার্স্টের রয়াল মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সকলের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার পূর্বে তিনি কাজ করতেন নাইরোবি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে। তিনি একাধারে ছিলেন একজন মডেল এবং সিনেমার পার্শ্ব অভিনেতাও। তীর-ধনুকে পারদর্শী হওয়ায় তিনি ‘দ্য থিফ অব বাগদাদেও‘ অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই একই পারদর্শিতার জন্য তিনি ১৯৩৯ সালে নরওয়ের ওসলোতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রিটেনের পক্ষে তীরন্দাজ হিসেবে অংশগ্রহণও করেছিলেন।
এ সময়ে অবশ্যই পুরো ইউরোপ দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। প্রায় ১০ বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর নিজের সহজ-সরল নাগরিক জীবনে ফিরে আসা ম্যাড জ্যাক পুনরায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন হাসিমুখেই। কারণ তার ভাষায় “দেশটি তার অনুপস্থিতিতে একটি যানজটে আটকে গিয়েছে”!
১৯৪০ সালের মে মাসের দিকে ম্যাড জ্যাক পদাতিক সেনাবাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হন। তিনি সবসময় যুদ্ধক্ষেত্রে তার তীর-ধনুক নিয়ে অগ্রসর হতেন। সাথে থাকতো তার অতি বিশ্বস্ত তরবারিও। যদিও তার অস্ত্রগুলো ছিলো অনেকটাই সেকেলে, তবুও কেউ যদি তার ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো এবং তার এই অদ্ভুত স্বভাবের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তুলতো, তবে তিনি নিজেকে সংযত করতেন এটা বলে, “আমার মতে, তরবারি ছাড়া যেকোনো অফিসারের যুদ্ধের পোষাকই অসম্পূর্ণ!”
তিনি মধ্যযুগীয় অস্ত্রগুলো শুধু যে প্রসাধনীরূপে ব্যবহার করতেন তা কিন্তু নয়। তিনি সেগুলোর সঠিক ব্যবহারও করেছেন। যেমন, ১৯৪০ সালে ‘ব্যাটল অব ডানকার্ক’ এ প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্য সমুদ্রসৈকতে আটকা পড়েছিলো। খুব দ্রুত তাদের সেই স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। ঠিক সেই সময় চার্চিল এক জার্মান সৈন্যকে ধরাশায়ী করেছিলেন শুধুমাত্র তার তীর-ধনুকের নিপুণ দক্ষতায়। একটু পরেই দেখা যায়, তিনি একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ফিরে আসছেন। পাশে ছিলো তার প্রিয় তীর-ধনুক। সেই সাথে একজন জার্মান অফিসারের ক্যাপও লাগানো ছিলো মোটরসাইকেলটির হেডলাইটের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়!
১৯৪১ সালে জার্মানির নরওয়েতে ‘অপারেশন আর্চারি’ নামের একটি আক্রমণে তিনি দুটি সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে এই আক্রমণে তিনি নিজস্ব তীর-ধনুক ব্যবহার করেছিলেন কিনা সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি তরবারিটি ব্যবহার করেছিলেন এটা সত্য।
সেই অপারেশনে তিনি এবং তার সৈন্যদলের উপর দায়িত্ব ছিলো ম্যালোয় দ্বীপে অবস্থানরত জার্মান সৈন্যদের আক্রমণ করার। দ্বীপে পৌঁছানোর মুহূর্তে চার্চিলকে দেখা গিয়েছে, জলযানের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগপাইপ বাজাতে! ব্যাগপাইপে ‘দ্য মার্চ অব দ্য ক্যামেরন ম্যান’ এর সুরটি বাজাচ্ছিলেন। সৈকতে পৌঁছানোর পর বাকি সময়টুকু নিজের সৈন্যদের সাথে নিয়ে উন্মুক্ত তরবারি নিয়েই আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন।
পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালেও তার ব্যবহৃত তরবারিটি অনেক উপকারে এসেছে। সেই সময়ে ম্যাড জ্যাক ছিলেন সালেরনোর কমান্ডিং অফিসার। সেখানে তার সৈন্যদেরকে বাধ্য করা হয়েছিলো সম্মুখযুদ্ধ করতে, যে ধরনের যুদ্ধে তার সৈন্যদল মোটেও প্রশিক্ষিত এবং প্রস্তুত ছিলো না। অবস্থা বেগতিক দেখে চার্চিল তার তরবারি হাতে সৈন্যদলের একদম সামনে চলে গেলেন। হুট করেই অন্ধকার থেকে বের হয়ে জার্মান প্রহরীদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করলেন। তীর-ধনুক সাথে, ব্যাগপাইপ কাঁধে ঝুলানো এবং উন্মুক্ত তরবারি হাতে ভোজবাজির মতো উদয় হওয়া এমন এক অদ্ভুত ‘মানব’কে দেখে জার্মান সৈন্যরা এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো যে, তারা আত্মসমর্পণ করেছিলো!
সেই রাতে চার্চিল শুধুমাত্র তার এক সৈন্য এবং তার নিজস্ব বিশ্বস্ত তরবারির সাহায্যে মোট ৪২ জন জার্মান সৈন্যকে আটক করেছিলেন। জার্মান সৈন্যদের প্রতি তার নিজস্ব একটি দর্শন আগে থেকেই ছিলো যা তার মনোভাবকে আরো প্রভাবিত করে ৪২ জন সৈন্যকে আটক করার পরে। তার মতে,
“আমি বিশ্বাস করি, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তাদের সিনিয়র রবে এবং উচ্চস্বরে ও পরিষ্কারভাবে জার্মানদের যেকোনো কিছু করার আদেশ দেবে , ততক্ষণ তারা বলবে ‘ইয়াভোল’ (ইয়েস স্যার)! এবং দ্রুত তোমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।”
তারপর চার্চিলকে যুগোস্লাভিয়াতে পাঠানো হয়। সেখানকার ভিস দ্বীপমালায় তিনি জার্মানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। ১৯৪৪ সালের মে মাসে দ্বীপগুলোর ৩টি পাহাড়ে ৩টি বড় বড় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ম্যাড জ্যাকের উপর দায়িত্ব পড়ে একটি দলের নেতৃত্ব প্রদানের। কিন্তু তার অভিযানের লক্ষ্যে অর্থাৎ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায় মাত্র ৬ জন। সেখানে পৌঁছে ম্যাড জ্যাক দেখলেন, তারা এমন একটি ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, যার চারপাশে শুধুই শত্রু।
অর্থাৎ শত্রুদের সহজ নিশানায় পরিণত হয়েছেন তিনি ও তার মুষ্টিমেয় সৈন্যরা। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে তিনি ‘উইল ইউ নো কাম ব্যাক এগেইন’ এর সুর তুলে তার ব্যাগপাইপ বাজাতে শুরু করলেন! তার একটু পরই জার্মান সৈন্যদের ছোঁড়া গ্রেনেডে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং তাকে আটক করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে জাকজেনহাউজেন বন্দীশিবিরে রাখা হয়। জার্মানদের বিশ্বাস, তিনি ছিলেন উইন্সটন চার্চিলের খুব ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়! যেহেতু তার নামের শেষটাও ছিলো চার্চিল। এছাড়াও তাকে সেনাবাহিনীর উচ্চশ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে কয়েদখানায় বন্দী করা হয়। তবে ম্যাড জ্যাক মোটেই জেলে পড়ে থাকার মতো মানুষ ছিলেন না। সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি কাঁটাতারের বেড়ার নিচের পুরনো নর্দমার নালা দিয়ে চুপিচুপি পালিয়ে যান। তবে তার বেশ কিছুদিন পরেই তিনি ও তার একজন সহযোগী পুনরায় গ্রেফতার হন এবং তাকে অস্ট্রিয়ার একটি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে অস্ট্রিয়ার সেই ক্যাম্পের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। চার্চিল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি অন্ধকারে মিশে যান এবং সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর হাঁটতে থাকেন। প্রায় ৮ দিন পর এবং সেখান থেকে ১৫০ মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অস্ত্রধারী গাড়ির সামনে পড়ে যান তিনি। তার অদ্ভুত বেশভূষার জন্য সমস্যায় পড়লেও তিনি তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি একজন ব্রিটিশ অফিসার। ফলে তিনি নিরাপদে ফিরতে সক্ষম হন।
তবে চার্চিল নিজের নিরাপত্তার দিকটা নিয়ে বেশি ভাবতেন না! তিনি বেশ হতাশ হলেন, যখন জানতে পারলেন যুদ্ধের দামামা তখন প্রায় অস্তমিত হয়ে পড়েছে এবং তিনি প্রায় এক বছর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে ছিলেন। তাই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছায় বাড়িতে ফেরত আসার পরিবর্তে তিনি বার্মায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেন, যেখানে তখনো পুরোদমে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিল।
তবে ইতোমধ্যেই জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা হয়েছিল, অর্থাৎ যুদ্ধ এককথায় শেষের দিকে বলা চলে। এতে চার্চিল অনেকটাই বিরক্ত হয়ে বলেন, “ঐ ইয়াংকদের জন্য আজ এমন অবস্থা, তা না হলে আরো দশ বছর আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতাম!”
তবে যুদ্ধের শেষ মানেই যে চার্চিলের অভিযানেরও শেষ তা কিন্তু নয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিমান থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে লাফিয়ে নামার প্রশিক্ষণ নিবেন। এখানেও তিনি সফল হন দ্রুত এবং তাকে ফিলিস্তিনে প্রথম ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়ায় যুদ্ধ প্রশিক্ষক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন এবং সেখানে তিনি সার্ফিং শিখেন। ১৯৫৯ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন যুদ্ধপাগল ম্যাড জ্যাক।
ফিচার ইমেজ: dailystarmovies.com