সব গ্র্যান্ডমাস্টারদের ইতিহাস মনে রাখে না, আবার কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার না হয়েও ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হন।
গ্র্যান্ডমাস্টার না হয়েও দাবার ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম স্মরণীয় এক খেলোয়াড়ের নাম রশিদ গিবাতোভিচ নাজমুদ্দিনোভ। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার চির আক্রমণাত্মক সব ম্যাচের জন্য। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাটাকিং প্লেয়ার হিসেবেও তাকে মানেন অনেকে। তার গ্র্যান্ডমাস্টার হতে না পারার কারণ হিসেবে দুর্ভাগ্যকে দায়ী করা হয়। সমকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল তালের সাথে তার ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। রশিদ ছিলেন তালের একাধারে বন্ধু, খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী, সাথে মেন্টরও! এমনকি তালের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে তিনি ৩-১ ব্যবধানে এগিয়েও ছিলেন। তার সম্পর্কে তালের এই অমর বাণী স্মরণীয়,
Players die, tournaments are forgotten, but the works of great artists are left behind them to live on forever.
রোর বাংলার পাঠকদের জন্য এই সিরিজে আমরা এই মহারথী সম্পর্কে আলোচনা করবো। এই পর্বে থাকবে তার দারিদ্রপীড়িত শৈশব, দুর্ভিক্ষের করুণ কাহিনী, দাবায় হাতেখড়ি এবং উত্থান সম্পর্কে। দ্বিতীয় পর্বে থাকবে তাঁর সৈনিক জীবন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রোমহর্ষক কাহিনী, কোনোমতে জীবন হাতে নিয়ে পালিয়ে আসা, আবার পরবর্তীতে দাবায় প্রত্যাবর্তনের কাহিনী। এবং এই সিরিজের সর্বশেষ পর্বে আমরা তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় নিয়ে আলোচনা করবো। তার শেষজীবন, মৃত্যু এবং লেগ্যাসি নিয়েও কিছু কথা থাকবে। সাথে থাকবে তার সমসাময়িক অন্যান্য গ্র্যান্ডমাস্টারগণ কর্তৃক তার মূল্যায়নে করা অমর বাণীগুলোও। তাহলে আর দেরি কীসের? চলুন, প্রিয় পাঠক, শুরু করা যাক!
শৈশব
রশিদ ১৯১২ সালে তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের আকতিউবিৎস্ক (বর্তমানে কাজাখস্তানের একটি ছোট শহর) এ জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই বাবা-মাকে হারান তিনি। ঐতিহাসিক ভলগা নদীর তীরে বাস করা এক চাচার কাছে তাকে পাঠানো হয়। ১৯১৮-২৩ সাল পর্যন্ত চলা রাশিয়ান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানকার অবস্থাও ছিল তথৈবচ! তদুপরি বলশেভিক কর্তৃক কৃষকদের ফসল চুরি করে বৈপ্লবিক সৈন্যদের রসদ জোগান দেওয়া তাদের জন্য ছিল মরার উপর খাঁড়ার ঘা। ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের অন্যতম প্রাণক্ষয়ী দুর্ভিক্ষ নেমে আসে, শুধু শিশুই মারা যায় ২০ লাখেরও বেশি। তার ভাই তাতার কবি কাভি নাদজমির কল্যাণে রশিদ বেঁচে যান। কাভি রশিদকে কাজানের একটি এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে দেন, যেখানে রশিদ জীবনে প্রথম পেটভরে খেতে পারেন।
তাতারদের প্রাচীন রাজধানী ছিল এই কাজান। অনাথাশ্রমটিতেই রশিদ ইসলামের কিছু প্রাথমিক শিক্ষা পান এবং তাতার ভাষাও শিখে নেন। সাহিত্য, ইতিহাস ও গণিতের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ও পাণ্ডিত্য ছিল।
দাবায় হাতেখড়ি
তিন বছর পর কাভি তাকে নিজ বাসায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এসময় রশিদ কাজান প্যালেস অফ পাইওনিয়ার্সে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ শুরু করেন। এটি ছিল কিছুটা বয় স্কাউটের মতো। সাথে থাকত কমিউনিস্ট ইনডক্ট্রিনেশন। পাইওনিয়ার্স প্যালেস একটি সোশ্যাল হাবের কাজ করত, যেখানে বয়স্করা তাদের সাথে দেখা করতে আসত। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা সেশনও চলত।
একদিন ক্লাবে রশিদ একটি ম্যাগাজিনের ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে পায় যাতে দাবার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে লেখা ছিল। কৌতূহলী রশিদ কাগজের টুকরোটা পকেটে পুরে নিয়ে আসে। বেশ কয়েকদিন পর সে ক্লাবে বড়দের খেলা দেখে অভিভূত হয়, কেননা তারা ঐ কাগজে বর্ণিত পদ্ধতিতেই প্রতিটি ঘুঁটি চালছিল। একদিন সে প্রথম খেলার সুযোগ পায়, এবং সবক’টা ম্যাচই জিতে যায়। সেখানে স্যামসনোভ নামক এক ব্যক্তি তার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে কাজান চেস ক্লাবে ভর্তি করতে চিঠি লিখে পাঠান। রশিদ চেস ক্লাবে ভর্তি হয়, কিন্তু সেখানকার আসল দক্ষ প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে খেলায় সে তেমন সুবিধা করতে পারেনি ১৯২৭ সালের আগপর্যন্ত। তারা ব্লিটজ ম্যাচ বেশি খেলত, কিন্তু রশিদের উন্নতি খুব মন্থর গতিতে হচ্ছিল।
রশিদের উত্থান
১৯২৭ সালে ১৫ বছরের রশিদ সিটি পাইওনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন ১০০% স্কোর নিয়ে। এর ঠিক তিন বছর পর তিনি ফার্স্ট ক্লাস ক্যাটাগরির প্লেয়ার হয়ে যান কাজান সিটি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার মাধ্যমে। ১৯২৯ সালে এক ম্যাচে সেই কালো ঘুঁটিতে তার মেন্টর স্যামসনোভকে হারিয়ে দেন এক অসাধারণ স্মাদার্ড মেটের মাধ্যমে।
১৯৩০ সালে রশিদ উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর তিনি কাজান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন, কিন্তু অর্থাভাবে তাকে ড্রপ-আউট হতে হয়। তার ভাই কাভি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, এবং সেই সামান্য আয় দিয়ে রশিদকে পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। রশিদ বা তার ভাই কখনোই বলশেভিকদের সেই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করেননি, যদিও তারা প্রায় মারাই পড়েছিলেন তাতে। উপরন্তু তার ভাই কাভি, বলশেভিকদের গুণকীর্তন করে ছোট-গল্প লেখেন, যার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারও পান। রশিদ পরে ওডেসায় চলে আসেন।
তিনি মিলে কঠোর পরিশ্রম করতেন, সাথে দাবা খেলাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। টানা তিন বছর তিনি ওডেসার শীর্ষ দাবাড়ুদের সাথে সমানে সমানে লড়তে লাগলেন। ১৯৩৩ সালে ওডেসার দাবা এবং চেকার্স উভয় ক্ষেত্রেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে কাজানে ফিরে আসেন।
সেখানে তিনি কাজান পেডাগজিক্যাল ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করে শিক্ষকতাও শুরু করেন। তিনি চেকার্সে মাস্টার টাইটেলও অর্জন করেন, যদিও সেটা তার দাবার ক্যারিয়ারে কাজে আসেনি। ১৯৩৪-৩৫ এ চেকার্সে মন দিলেও দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন, দাবায় তার বেশি মনোযোগ দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে তিনি এতটাই একাগ্র ছিলেন যে, অসুস্থাবস্থায় হাসপাতালে থাকার দিনগুলোতেও প্র্যাকটিস মিস করেননি। তার কঠোর পরিশ্রম ফল দেয়, ১৯৩৯ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীর একটি টুর্নামেন্ট ১০ এ ৯ পয়েন্ট নিয়ে শেষ করেন, যা তাকে ক্যান্ডিডেট মাস্টার খেতাব এনে দেয়। ১৯৪০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হবার পর সেনাবাহিনীতে ডাক পান।
পরবর্তী পর্বে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রশিদ নাজমুদ্দিনোভের জীবনের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জানব।