প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে একটি সরকারি ছুটির দিন রয়েছে, যার নাম ‘থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’। ১৯৭১ সালের থ্যাঙ্কসগিভিং ডে ছিলো ২৫ নভেম্বর। এর ঠিক আগের দিন দুপুরের কথা। কালো অ্যাটাশ কেস হাতে সুস্থির ভঙ্গিতে পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢুকলেন মধ্যবয়স্ক এক লোক। প্রায় ছ’ফুট লম্বা লোকটির পরনে ছিলো রেইনকোট, গাঢ় রঙা একটি স্যুট, সাদা কলারের শার্ট, লোফার, কালো টাই এবং মুক্তোর টাই পিন। ঢুকেই লোকটি সোজা চলে গেলেন নর্থওয়েস্ট অরিয়েন্ট এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে, নিজের পরিচয় দিলেন ‘ড্যান কুপার’ নামে। সেখান থেকে সিয়াটল যাবার জন্য ৩০৫ নং ফ্লাইটের একটি টিকেট কাটলেন তিনি।
কুপার যে প্লেনের টিকিট কেটেছিলেন সেটা ছিলো বোয়িং ৭২৭-১০০ মডেলের। প্যাসেঞ্জার কেবিনের পেছনের দিকে ছিলো তার সিট। তবে সিট নাম্বার কত ছিলো তা নিয়ে দ্বিমত আছে প্রত্যক্ষদর্শীদের। ১৮সি, ১৮ই কিংবা ১৫ডি- এই তিন ধরনের মতামত পাওয়া গিয়েছে। সে যা-ই হোক, নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে সাথে থাকা জিনিসপত্র রেখে আরামসে বসে পড়লেন কুপার। তারপর টুকটাক খাওয়াদাওয়া শুরু করে দিলেন তিনি।
বেলা ২টা ৫০ মিনিটে এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী নিয়ে সিয়াটলের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলো এরোপ্লেনটি। এর কিছুক্ষণ পরের কথা। কুপারের কাছাকাছি একটি জাম্প সিটে বসেছিলেন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ফ্লোরেন্স শ্যাফনার। কুপার গিয়ে মহিলার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে আসলেন। শ্যাফনার ভাবলেন লোকটি বোধহয় কোনো নিঃসঙ্গ ব্যবসায়ী। কিছুটা সময়ের জন্য তাকে কাছে পেতেই হয়তো নিজের ফোন নাম্বার কাগজে লিখে তাকে দিয়েছেন। সেজন্য পাত্তা না দিয়ে কাগজটা নিজের ব্যাগে রেখে দিলেন শ্যাফনার। এটা দেখে আবারো এগিয়ে গেলেন কুপার, শ্যাফনারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“মিস, আপনি নোটটি একবার খুলে দেখলে ভালো হয়। আমার কাছে বোমা আছে।”
সাথে সাথেই ভয়ের শীতল স্রোত যেন বয়ে গেলো শ্যাফনারের মেরুদণ্ড দিয়ে। ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি করে নোটটা বের করলেন তিনি, দেখতে পেলেন বড় হাতের অক্ষরে সেখানে রয়েছে ছাপানো কিছু বাক্য- “আমার ব্রিফকেসে একটা বোমা আছে। দরকার হলে আমি সেটা ব্যবহার করবো। আমি চাই তুমি আমার পাশে এসে বসো। তোমাদের হাইজ্যাক করা হয়েছে।”
শ্যাফনার বুঝতে পারলেন কত বড় বিপদে পড়ে গেছেন তিনি, তার প্লেনের যাত্রীরা। তাই উপায়ান্তর না দেখে কুপারের কথামতোই তার পাশে গিয়ে বসলেন তিনি, দেখতে চাইলেন বোমাগুলো। কুপারও আস্তে করে তার ব্রিফকেসটি খুললেন। সেখানে শোভা পাচ্ছিলো আটটি লালরঙা সিলিন্ডার, দুই সারিতে রাখা, প্রতি সারিতে চারটি করে সাজানো। বোমাগুলো থেকে বেরিয়ে আসা তারগুলোও ছিলো লাল রঙের টেপ দিয়ে প্যাঁচানো। লোকটি যে মোটেই মজা করে কিছু বলে নি তা এবার নিশ্চিত হওয়া গেলো।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কুপারের দিকে তাকালেন তিনি। কুপারও জানিয়ে দিলেন তার দাবির কথা– ২,০০,০০০$ (বর্তমান হিসেবে যা প্রায় ১১,৬০,০০০$), চারটি প্যারাস্যুট এবং সিয়াটলে প্লেন নামার পরেই সেটায় পুনরায় জ্বালানী ভরার জন্য একটি ফুয়েল ট্রাক থাকতে হবে। শ্যাফনার চলে গেলেন ককপিটে, সেখানে অবস্থানরত পাইলটদের জানালেন বিস্তারিত। ফিরে এসে দেখলেন চোখে কালো রঙের একটি সানগ্লাস জড়িয়ে মনের সুখে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে সেই লোকটি।
পাইলট উইলিয়াম স্কটের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সাথে সাথেই তিনি যোগাযোগ করলেন সিয়াটল-টাকোমা এয়ারপোর্ট এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ তখন শরণাপন্ন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ৩০ মিনিটের পথে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে যাত্রীদের জানানো হলো যান্ত্রিক ত্রুটির কথা। এরপর পাক্কা দুই ঘণ্টা আকাশেই ঘুরে বেড়াতে লাগলো প্লেনটি। ওদিকে মাটির পৃথিবীতে স্থানীয় পুলিশ ও এফবিআই সদস্যরা কাজে নেমে পড়েছিলেন প্যারাস্যুট, মুক্তিপণের অর্থ ও আনুষাঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণে। পুরো সময়টা জুড়ে একেবারেই নিরুদ্বেগ ছিলেন কুপার। আপনমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি, জানালা দিয়ে বিভিন্ন জায়গা দেখে সেগুলোর কোনটা কোন জায়গা হতে পারে সেটা বলাবলি করছিলেন। ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয় নি!
ওদিকে কুপারকে ধরতে এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিলো এফবিআই। তারা ১০,০০০টি ২০ ডলারের নোট যোগাড় করলো, যেগুলোর অধিকাংশেরই সিরিয়াল নাম্বার ‘L’ অক্ষর দিয়ে শুরু। নোটগুলোর বেশিরভাগই ছিলো ‘1963A’ বা ‘1969’ সিরিজের। প্রতিটি নোটেরই মাইক্রোফিল্ম ফটোগ্রাফ নেয়া হলো।
বিকাল ৫টা ২৪ মিনিট, প্লেনটি তখনও আকাশে চক্কর খাচ্ছে। এমন সময় কুপারকে জানানো হলো যে তার সকল দাবি মেটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপর বিকাল ৫টা ৩৯ মিনিটে ভূমিতে অবতরণ করে প্লেনটি। কুপারের নির্দেশে স্কট প্লেনটিকে কিছুটা নির্জন, কিন্তু উজ্জ্বল আলোকিত জায়গায় নিয়ে দাঁড় করান। পাশাপাশি কেবিনের লাইটও বন্ধ করে দিতে বলেন কুপার, যেন বাইরে থেকে স্নাইপাররা তার কিছু করতে না পারে। নর্থওয়েস্ট অরিয়েন্ট এয়ারলাইন্স কোম্পানির সিয়াটল শাখার অপারেশন্স ম্যানেজার আল লী ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট টিনা মাকলৌয়ের হাতে ডলারের ঝোলা ও প্যারাসুট দিয়ে আসেন। এগুলো হাতে পাওয়ার পর কুপার প্লেন থেকে সকল যাত্রী ও ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টদের (মাকলৌ বাদে) নেমে যাবার অনুমতি দেন।
এবার শুরু হলো কুপারের পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ, কিংবা বলা চলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ- পালিয়ে যাওয়া।
যখন প্লেনটিতে কুপারের কথামতো জ্বালানী ভরা হচ্ছিলো, তখন তিনি প্লেনের ক্রুদের কাছে তার পরবর্তী প্ল্যানগুলো তুলে ধরেন। যতটা কম বেগে পারা যায়, ততটা কম বেগে এবং কখনোই প্লেনটিকে না থামিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মেক্সিকো সিটি বরাবর প্লেনটিকে উড়িয়ে নিতে নির্দেশ দেন তিনি। এছাড়া প্লেনের ল্যান্ডিং গিয়ার টেক-অফ পজিশনে রাখতে, উইং ফ্ল্যাপগুলো ১৫ ডিগ্রি কোণে নামিয়ে আনতে এবং কেবিনকে চাপশূন্য রাখতেও বলেন কুপার।
এসব কথা শুনে কো-পাইলট উইলিয়াম রাটাচয্যাক জানান, কুপার যেসব শর্ত দিয়েছেন, সেগুলো মেনে প্লেনটি বড়জোর ১,৬০০ কিলোমিটার উড়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ মেক্সিকো যাবার আগে তাদের কমপক্ষে আরেকবার হলেও জ্বালানী দরকার হবে। অবশেষে বিমানের ক্রুদের সাথে কথা বলে নেভাদার রেনোতে আরেকবার অবতরণের সিদ্ধান্ত জানান কুপার।
সন্ধ্যা ৭টা বেজে ৪০ মিনিট। জ্বালানী নিয়ে আকাশে আবারো ডানা মেলেছে বোয়িং ৭২৭-১০০। প্লেনে তখন আছেন কেবল কুপার, পাইলট স্কট, কো-পাইলট রাটাচয্যাক, ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট মাকলৌ এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এইচ. ই. অ্যান্ডারসন। ওদিকে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলো না যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীও। কাছেই ছিলো ম্যাককর্ড বিমানঘাঁটি। সেখান থেকে উড়ে যায় দুটো এফ-১০৬ ফাইটার প্লেন। একটি বোয়িংয়ের নিচে, আরেকটি উপরে এমনভাবে উড়তে থাকে যেন সেগুলো কোনোভাবেই কুপারের নজরে না আসে। একটি লকহিড টি-৩৩ ট্রেনারও গিয়েছিলো। কিন্তু জ্বালানী স্বল্পতায় সেটি ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
কিছুক্ষণ পর মাকলৌকে ককপিটে যেতে বলেন কুপার। যাবার আগে মাকলৌ দেখতে পান কুপার তার কোমরে কী যেন বেঁধে নিচ্ছেন। রাত আটটার দিককার কথা। হঠাৎ করে ককপিটে বিপদসংকেত বেজে উঠলো। সবাই চেক করে দেখতে পেলো পেছনের দিককার সিড়িটি চালু করা হয়েছে। অল্প সময় পর দেখা গেলো পেছনের দরজাটিও খোলা। রাত আনুমানিক সোয়া দশটার দিকে রেনো বিমানবন্দরে অবতরণ করে প্লেনটি। প্লেনটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সবার মনে অজানা আশঙ্কা, এই বুঝি বিকট শব্দে বিষ্ফোরিত হয়ে গেলো পুরো বিমানটি। সতর্কতার সাথে সশস্ত্র বাহিনী বিমানের ভেতর ঢুকলো। ঢুকে তারা যা দেখলো তাতে তাদের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। কারণ প্লেনের ভেতর ড্যান কুপারের কোনো নামগন্ধই যে নেই!
এরপর শুরু হয় জোর তদন্ত। এক সাংবাদিকের ভুলে ‘ড্যারেন কুপার’ হয়ে যান ‘ডি. বি. কুপার’। এই ভুল সংবাদটি সবদিকে ছড়িয়ে পড়ায় লোকে তাকে ডি. বি. কুপার নামেই চিনতে শুরু করে। বছরের পর বছর ধরে প্লেন হাইজ্যাকের এ দুর্ধর্ষ ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত চালিয়ে গিয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের হতাশ হতে হয়েছে।
অবশেষে গত বছরের ৮ জুলাই হাল ছেড়ে দেয় এফবিআই-ও। তারা জানায় যে, কুপারের চেয়েও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অর্থ ও জনশক্তি বিনিয়োগ করতে হবে তাদের। তাই এসব নিয়ে আর পড়ে থাকা যাবে না। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘটে যায় অসমাপ্ত এক রহস্যের, অমীমাংসিত একটি কেসের। ৪৫ বছর ধরে তৈরি হওয়া ৬০ ভলিউমের কেস ফাইল এখন ইতিহাসের অংশ হিসেবে রাখা আছে ওয়াশিংটন ডিসিতে এফবিআই-এর হেডকোয়ার্টারে।
লোকটির নাম কি আসলেই ড্যারেন কুপার ছিলো? তিনি কি ঠিকমতো পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, নাকি কোনোভাবে মারা পড়েছিলেন প্যারাস্যুট ঠিকমতো কাজ না করায়? এতগুলো ডলার দিয়ে কী করলেন তিনি? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- কে তিনি? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। সকল প্রশ্নের উত্তর কেবল একটিই- তিনি ডি. বি. কুপার; মধ্যবয়স্ক, কালো চশমা পরা, ছ’ফুট লম্বা একজন সুদর্শন পুরুষ!
ফিচার ইমেজ- kxro.com