তিনি ছিলেন একজন দাস। কিন্তু আর দশজন দাসের তুলনায় তার জীবন ছিল ভিন্ন। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, ছিলেন কুরআনে হাফেজ, এবং ছিলেন অল্প কিছু সৌভাগ্যবান দাসদের মধ্যে একজন, যারা নিজেদের গুণ এবং জ্ঞান দ্বারা মালিকদেরকে মুগ্ধ করে নিজেদের স্বাধীনতা ক্রয় করে দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। একইসাথে তিনি হলেন এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া প্রথম দাস, সে সময়ই যার জীবন্ত ছবি আঁকা হয়েছিল এবং যার বন্দী হওয়ার ও মুক্তিলাভের গল্প প্রকাশিত হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল পাঠকদের কাছে। তিনি হলেন সেনেগালের হাফেজ আইয়ুবা সুলাইমান দিয়ালো।
আইয়ুবা সুলাইমান দিয়ালোর জন্ম ১৭০১ সালে বর্তমান সেনেগালের বুন্দু গ্রামের ফুতা তোরো রাজ্যের এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে। তার দাদা ছিলেন বুন্দু গ্রামটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বেড়ে উঠেন ফুতা তোরো রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্যদের সাথে। দিয়ালোর পরিবার ছিল অত্যন্ত ধার্মিক। ফলে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করে ফেলেন এবং মালিকি মাযহাব অনুযায়ী ধর্মীয় বিধি-নিষেধ অনুশীলন করতে শুরু করেন।
দিয়ালোর পরিবারের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা ছিল। তার বাবা গবাদি পশু, কৃষি সামগ্রী এবং দাস কেনাবেচার ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, ১৭৩০ সালে দিয়ালো নিজেই প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রদের হাতে বন্দী হয়ে যান এবং দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যান। সে সময় দিয়ালো নিজেই বাবার ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সে বছর তিনি এবং তার অনুবাদক যখন কাগজ এবং দাস কেনাবেচার জন্য গাম্বিয়া নদী দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তারা ম্যান্ডিনকা জাতির হাতে বন্দী হন।
সে সময় যুদ্ধবন্দীদেরকে বৈধভাবেই দাস হিসেবে কেনাবেচা করা যেত। ফলে ম্যান্ডিনকারা দিয়ালো ও তার সঙ্গীর চুল ও দাড়ি কামিয়ে দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে উপস্থাপন করে এবং ঐ অঞ্চলের প্রধান পশ্চিমা দাস ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানীর কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে এক নাবিকের হাত হয়ে দিয়ালো এসে পৌঁছেন আমেরিকার ম্যারিল্যান্ডে।
একাধিকবার হাত বদলের পর দিয়ালোর স্থান হয় মিস্টার টলসি নামে ম্যারিল্যান্ডের এক তামাক ক্ষেতের মালিকের বাড়িতে। টলসি প্রথমে তাকে তামাক ক্ষেতে কঠোর পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করেন। কিন্তু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে বড় হওয়া দিয়ালোর শরীর বেশি পরিশ্রম করার উপযোগী ছিল না। ফলে কিছুদিন পরেই তার মালিক তাকে ক্ষেত থেকে সরিয়ে গবাদি পশু দেখাশোনার কাজে ন্যস্ত করেন।
সে সময় দাসদের নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতা ছিল না। ফলে তাদেরকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে ধর্ম পালন করতে হতো। দিয়ালো তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে গোপনে নামায আদায় করতেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করতেন। প্রায় এক বছর পর্যন্ত দিয়ালো তার ধর্ম গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর একদিন গোপনে নামায পড়ার সময় তিনি ধরা পড়ে যান।
নিজের ধর্ম পালনের জন্য দিয়ালোকে প্রচুর অপমান এবং নির্যাতন সহ্য করতে হয়। নামায পড়া অবস্থাতেই মালিকের ছেলেরা তার শরীরে কাদা নিক্ষেপ করতে থাকে। পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে ১৭৩১ সালে দিয়ালো তার মালিকের খামার থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি ধরা পড়েন। তাকে ফিরিয়ে এনে ম্যারিল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টির আদালতে তার বিচার করা হয় এবং বিচার শেষে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কারাগারে বন্দী অবস্থাতেই থমাস ব্লুয়েট নামের এক আইনজীবির সাথে তার পরিচয় হয়। তার আরবি ভাষায় পারদর্শিতা, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও স্মৃতিশক্তি এবং ধর্মের প্রতি গভীর বিশ্বাস দেখে ব্লুয়েট অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি তাকে তার পূর্বের মালিক মিস্টার টলসির কাছে ফিরিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু দিয়ালোর বংশমর্যাদা সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন এবং দিয়ালোকে তার বাবার কাছে একটি চিঠি পাঠানোর সুযোগ করে দেন।
আরবি ভাষায় লেখা সেই চিঠিতে হতাশাগ্রস্ত দিয়ালো বর্ণনা করেন, “খ্রিস্টানদের দেশে মুসলমানদের জন্য কোনো প্রভু নেই।” চিঠিতে বুন্দু গ্রামের সকল মুসলমানকে উদ্দেশ্য করে তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি বেঁচে আছেন। একইসাথে তিনি গ্রামের মাতব্বরদেরকে এবং তার পরিবারের সদস্যদেরকে অনুরোধ করেন তারা যেন তার দুই স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে নিষেধ করে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, শীঘ্রই তিনি দেশে ফিরে যেতে পারবেন।
কিন্তু দিয়ালোর চিঠি তার বাবার কাছে যাওয়ার আগে গিয়ে পড়ে রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানীর পরিচালক জেমস ওগলেথোর্পের হাতে। জেমস চিঠিটি অক্সফোর্ড থেকে অনুবাদ করিয়ে নেন এবং আইনজীবি থমাস ব্লুয়েটের মতোই দিয়ালোর ধর্ম পালনের সংগ্রামের গল্প জেনে অভিভূত হন। তিনি ৪৫ পাউন্ডের বিনিময়ে দিয়ালোকে তার মালিকের কাছ থেকে কিনে নেন এবং ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
১৭৩৩ সালে ব্লুয়েটের সাথে দিয়ালো ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি শ্বেতাঙ্গদের সমমর্যাদা লাভ করেন। ইংল্যান্ডে যাওয়ার পথে তিনি ব্লুয়েটের সহায়তায় ইংরেজি ভাষা শিখে ফেলেন। সেই জ্ঞান দিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে খ্রিস্টান পাদ্রীদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা এবং বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি কিছুদিন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আরবি পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও সজ্জিতকরণের কাজেও নিযুক্ত ছিলেন। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সদস্যদের সাথেও তিনি সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন।
১৭৩৪ সালে স্বাধীন মানুষ হিসেবে দিয়ালো গাম্বিয়া হয়ে সেনেগালে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। ততোদিনে তার বাবা মারা যান, তার এক স্ত্রী তাকে মৃত মনে করে বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায় এবং তাদের গ্রাম যুদ্ধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তবে নিজের পূর্বের ব্যবসার অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয়দের উপর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দিয়ালো শীঘ্রই নিজেকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
১৭৩৬ সালে দিয়ালো আবারও বন্দী হন। ব্রিটিশদের সাথে তার সুসম্পর্কের অভিযোগে এবার তাকে গ্রেপ্তার করে ফরাসিরা। প্রায় এক বছর ফরাসিদের হাতে বন্দী থাকার পর গ্রামের প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তি পাওয়ার পর দিয়ালো সেই রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির সাথেই আবার যোগাযোগ করেন এবং ১৭৭৩ সালে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেই দাস ব্যবসায়ী কোম্পানির অনুবাদক হিসেবে কাজ করে যান।
আইয়ুবা সুলাইমান দিয়ালো ছিলেন অত্যন্ত ভাগ্যবান এবং ব্যতিক্রমী একজন দাস। অধিকাংশ দাসদের সাথেই সে সময় অমানবিক আচরণ করা হতো। কঠোর পরিশ্রমে জর্জরিত হয়ে অথবা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েই তারা মৃত্যুবরণ করত। এবং তাদের কাহিনী বিশ্ববাসীর কাছে অজানাই রয়ে যেত। কিন্তু দিয়ালোর কাহিনী ব্যতিক্রমী হওয়ায় আইনজীবি থমাস ব্লুয়েট তার জীবনী প্রকাশ করেন। এই জীবনীর মাধ্যমেই তার গল্প দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ইল্যান্ডে থাকা অবস্থায় ১৭৩৩ সালে দিয়ালোর দুটি তেল রংয়ের পোর্ট্রেটও আঁকা হয়। এই ছবিগুলো হচ্ছে এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া প্রথম ছবি, যেখানে আফ্রিকান কোনো দাসকে প্রধান সাবজেক্ট হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দিয়ালোর ছবিগুলো এঁকেছিলেন উইলিয়াম হোর নামে একজন ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী, যিনি প্রধানমন্ত্রী এবং রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন।
উইলিয়াম যখন দিয়ালোকে তার ছবি আঁকার প্রস্তাব দেন, তখন দিয়ালো রাজি হন এই শর্তে যে, তাকে তার দেশের সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্বকারী ঐতিহ্যবাহী পোশাকে উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু সে সময় দিয়ালোর সাথে সেরকম কোনো পোশাক ছিল না। ফলে তিনি উইলিয়ামকে মুখে বর্ণনা করে পোশাকটি সম্পর্কে ধারণা দেন এবং সেই বর্ণনা শুনেই উইলিয়াম সেটিকে তার রংতুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। ছবিতে দিয়ালোর গলায় যে লাল বইটি ঝুলানো দেখা যায়, সেটিও সাধারণ কোনো বই না। এটি ছিল সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে দিয়ালোর লেখা কুরআন শরিফের একটি কপি।
হাফেজ আইয়ুবা সুলাইমান দিয়ালো তার এই ঐতিহাসিক ছবির মাধ্যমে আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন, বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হয়ে ইংল্যান্ডের সুশীল সমাজে স্থান পাওয়ার কিংবা বিখ্যাত এক চিত্রশিল্পীর দ্বারা নিজের পোর্ট্রেট করানোর প্রস্তাব পাওয়ার পরেও তিনি তার নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি। ছবিতে নিজেকে ব্রিটিশদের চোখে সুন্দর করে তোলার চেয়ে নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলার ওপরেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।