চারিদিকে ভারত মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত ছোট একটি দেশ শ্রীলংকা। বিশ্বের কাছে ভারত মহাসাগরের অশ্রু নামে পরিচিত দ্বীপ দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে দেশটি ‘সিলন’ থেকে নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীলঙ্কা’ হয়। প্রতি বছর প্রচুর বিদেশি পর্যটক দেশটিতে ভ্রমন করেন এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির জনগণ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে চলেছেন।
শ্রীলঙ্কার এই গৃহযুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে হলে, ফিরে তাকাতে হবে পেছনে। ব্রিটিশরা ১৮১৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সিলন তথা শ্রীলঙ্কা শাসন করে। ব্রিটিশ শাসনাধীন শ্রীলঙ্কায় শুরু থেকেই সামাজিকভাবে সিংহলি জনগোষ্ঠীর আধিপত্য ছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয় সিংহলি ভাষাভাষীরা খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ শতকের দিকে ভারত থেকে শ্রীলঙ্কায় আসেন এবং সেই থেকে দেশটিতে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অপরদিকে, তামিল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী সেদেশে আরও অনেক পরে তথা খ্রিষ্টাব্দ সাত থেকে এগারো শতকে আসে বলে জানা যায়।
১৮১৫ সালের হিসেব মতে, তৎকালীন সিলনে মোট জনসংখ্যার ত্রিশ লক্ষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সিংহলী জনগণ এবং মাত্র তিন লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী তামিল জনগোষ্ঠী ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা আসার পর যখন শ্রীলঙ্কায় ব্যাপকহারে বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ শুরু হয় তখন চাষাবাদের কাজে নিয়োগ করার জন্য ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ভারত থেকে প্রায় দশ লক্ষ তামিল ভাষাভাষী লোক নিয়ে আসে।
ধীরে ধীরে দেশের উত্তর প্রান্তে তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ গড়ে উঠে। ইংরেজদের সহায়তায় তামিল ভাষায় কথা বলা মানুষদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং তামিলদের মধ্যে একটা শিক্ষিত শ্রেণী তৈরী হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক পদে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাত্রাতিরিক্তভাবে তামিলদের নিয়োগ দিতে থাকে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। শুরু হয় ব্রিটিশ শাসকদের বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন করার পুরোনো খেলা।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সিলন তথা শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই শ্রীলঙ্কা সরকার সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করে বৈষম্যমুলক আইন পাশ করতে থাকে। বিশেষ করে ব্রিটিশদের আনা ভারতীয় তামিলদের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়।
১৯৫৬ সালে সরকার সিংহলি ভাষাকে দেশটির একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার ফলে তামিলদের জন্য সরকারি চাকরি করা দুরুহ হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ‘সিলন সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৪৮’ প্রায় সাত লক্ষ ভারতীয় তামিল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন করে দেয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে দ্বীপটিতে কৃষিকাজের জন্য ভারত থেকে এসেছিল। হঠাৎ নাগরিকত্ব হারানো এই বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে দেশটির সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এবং এভাবেই একটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের বীজ তামিল জনগণের মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকে।
১৯৫৮ সালে সেখানে একটি ব্যপক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। যাতে সিংহলি ও তামিল ভাষাভাষী জনগণ একে অপরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে বাধ্য হয়ে হাজার হাজার তামিলভাষী লোকজন দেশটির তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরাঞ্চলে পাড়ি জমায়।
১৯৭২ সালে মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের। যিনি পরবর্তিতে শ্রীলঙ্কান তামিলদের একচ্ছত্র নেতা হয়ে উঠেন। এবং দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে তামিলদের পক্ষে তিনিই একমাত্র সেনাপতিতে পরিণত হন।
প্রভাকরণ ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠিত করে ‘নতুন তামিল আন্দোলন’ নামে একটি ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তামিল ছাত্রদের গ্রেডিং সিস্টেমে সমঅধিকার এবং উচ্চ শিক্ষায় আরো বেশি সংখ্যক তামিল ছাত্র-ছাত্রীকে সুযোগ দেওয়ার দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে জাফনার মেয়র এদের হাতে হত্যার শিকার হন, ফলে চলমান সহিংসতা আরও উস্কে উঠে।
প্রভাকরণ ১৯৭৬ সালে দি লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলম (এলটিটিই) গঠন করেন। কারণ এর আগে প্রভাকরণের গড়ে তোলা তামিল নিউ মুভমেন্ট অন্য আরেকটি তামিল আন্দোলনের দলে যুক্ত হয়ে যায়।
১৯৭৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ছোট ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ‘দি তামিল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট’ নামক রাজনৈতিক জোট বেশিরভাগ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি। কারণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা তামিলদের জন্য শ্রীলঙ্কা থেকে স্বাধীন হয়ে আলাদা দেশ গঠনের পক্ষাবলম্বী।
তামিলরা আরেক দফা দাঙ্গার শিকার হয় যখন তাদের বিরুদ্ধে এক সিংহলি পুলিশ কন্সটেবলকে পেটানোর অভিযোগ উঠে। এবারও তীব্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮৩ সালে দেশব্যাপী চলতে থাকা জাতিগত সহিংসতা আর বিশৃংখলা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে, শুরু হয় প্রথম ইলম যুদ্ধ। সে বছর এলটিটিই’র এক হামলায় ১৩ জন সিংহলি সেনা সদস্য নিহত হলে রাজধানী কলম্বো সহ সারা দেশে তামিল বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশব্যাপী তামিলরা সহিংসতার শিকার হয় এবং হাজার হাজার তামিল নিহত হয়। সিংহলি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো থেকে তামিল জনগণকে বাধ্য হয়ে অন্যত্র সরে যেতে হয়।
শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কা সরকার এবং তামিল টাইগারদের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। ১৯৮৭ সালে শ্রীলংকান সেনাবাহিনী তামিল টাইগারদের উত্তরাঞ্চলের জাফনা শহরের দিকে ঠেলে দেয়।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সিদ্ধান্ত নেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। এবং সেবছরই শ্রীলঙ্কা আর ভারত সরকার এক শান্তিচুক্তিতে উপনিত হয়। চুক্তির আওতায় ভারত সরকারের মধ্যস্থতায় শ্রীলঙ্কা সরকার তামিল বিদ্রোহীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া তামিল ভাষা দেশটির অন্যতম দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদালাভ করে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশের উত্তর ও পুর্বাংশে শান্তি স্থাপনের কাজে নিয়োজিত হয়।
১৯৮৮ সালে দু’পক্ষের তরফেই সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গেলে এবং আন্তর্যাতিক এবং আভ্যন্তরীণ নানা চাপে ভারতীয় সেনাবাহিনী শ্রীলঙ্কায় তাদের মিশন গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষা মিশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ভারতীয় বাহিনী চলে যাওয়ার পর সহিংসতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। তামিল টাইগাররা এবার এই লড়াইয়ের নাম দেয় দ্বিতীয় ইলম যুদ্ধ। ১৯৯০ সালের ১১ জুন তামিল টাইগাররা প্রায় ছয় থেকে সাত শত শ্রীলঙ্কান পুলিশ সদস্যকে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে। এর এক সপ্তাহ পরে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বময় যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
এদিকে ১৯৯১ সালে ভারতীয় জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নিতে তামিলনাড়ুতে যাওয়া রাজিব গান্ধী এলটিটিই’র সদস্যদের আত্নঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। এলটিটিইর প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ধারণা ছিল রাজিব গান্ধী নির্বাচনে জয়লাভ করলে তিনি পুনঃরায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে শ্রীলঙ্কায় পাঠাবেন। ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রানাসিংহে প্রেমাদাসাও একইভাবে এলটিটিই’র সদস্যদের হাতে হত্যাকান্ডের শিকার হন।
১৯৯৪ সালে নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা নতুন করে তামিল টাইগারদের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। সংলাপ ব্যর্থ হয়, সরকার কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমনের পথে হাঁটে। সরকার এবারের যুদ্ধকে ‘শান্তির জন্য যুদ্ধ’ নামকরণ করে আর টাইগারদের কাছে এটা ছিল তৃতীয় ইলম যুদ্ধ।
১৯৯৫-৯৬ সালে শ্রীলংকান সেনাবাহিনী পূর্ণ শক্তিতে বিদ্রোহ দমনে উত্তরাঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে। জাফনা শহর থেকে বিদ্রোহীদের হঠাতে ব্যাপক মাত্রায় অভিযান চালানোর ফলে প্রায় ৬ লক্ষ তামিল জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়।
২০০০ সালে নরওয়ের মধ্যস্থতায় আবার শান্তি আলোচনা শুরু হয়। ইতিমধ্যে ২০০১ সালে রণিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি তামিলদের সাথে শান্তিপুর্ণ উপায়ে আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতি ছিলেন। আলোচনা শুরু হলে কয়েক দশক পর প্রথমবারের মত শ্রীলঙ্কায় কিছুটা শান্তির বাতাবরণ বইতে থাকে।
নরওয়েতে ২০০২ সালে উভয় পক্ষ একটি ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তিতে উপনীত হয়। এর আওতায় দেশের উত্তর এবং পশ্চিম অঞ্চলে তামিল স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়। দু’পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধ বিরতি চুক্তিও সই হয়।
কিন্তু ২০০৩ সালে পুনঃরায় শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়। সরকার এবং তামিল টাইগারদের বিরোধ চরমে পৌঁছে।
২০০২ সালের সই হওয়া যুদ্ধবিরতির পর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে ২০০৫ সালের আগষ্ট মাসে। সেনাবাহিনী ও তামিল টাইগারদের মধ্যে লড়াইয়ে শত শত মানুষ নিহত হয় আর হাজার হাজার মানুষ হয় বাস্তুচ্যুত।
২০০৬ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আলোচনা শুরু হয়ে তা আবারও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সরকারের সিদ্ধান্তে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী এবার জোরালো আক্রমণ শুরু করে তামিল টাইগারদের দখলকৃত পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলে। তামিল টাইগারদের নিশ্চিহ্ন করাই এবারের হামলার মুল উদ্দেশ্য। ২০০৭-০৯ সাল পর্যন্ত চলা এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রচুর মানুষ নিহত হয়। সেনা আর টাইগারদের সংঘর্ষের মুখে পড়ে প্রচুর সাধারণ মানুষের প্রাণহানী হয়। গ্রামের পর গ্রাম মাটির সাথে মিশয়ে দেওয়া হয়। অনেক টাইগার সেনাবাহিনীর হাতে যাতে ধরা পড়তে না হয় তার জন্য আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার গ্রেফতারকৃত অনেক তামিল টাইগার সদস্যদের সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যার শিকার হন বলে অভিযোগ আছে। প্রায় এক লক্ষ লোকের প্রানহানী ঘটে এই সংঘর্ষে যা দু’পক্ষের তরফেই হয়েছে। জাতিসংঘ এই লড়াইকে ‘একটি রক্তস্নান’ বলে অভিহিত করে। বিশ্বজুড়ে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করার দাবি উঠে।
অবশেষে ২০০৯ সালের ১৬ মে শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে। পরেরদিন তামিল টাইগারদের পরিচালিত একটি ওয়েবসাইটে বলা হয় ‘আমরা এই যুদ্ধের তিক্ত সমাপ্তিতে পৌঁছে গেছি ’। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে চলা সহিংসতার অবসান ঘটে। বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা শ্রীলঙ্কানরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সমাপ্তি ঘটে কয়েক দশক ধরে চলমান এশিয়ার দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধের।