পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো একক যুদ্ধে যদি সবচেয়ে বেশি গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনার রেকর্ড থেকে থাকে, তাহলে সেটি অবশ্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দখলে থাকবে। যেকোনো যুদ্ধেই আসলে শত্রুর গতিবিধির উপর নজর রাখা, আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানোর পূর্বে শত্রুর অবস্থান সঠিকভাবে জানা কিংবা শত্রুপক্ষের কোনো গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে সেই সম্পর্কে জেনে ফেলতে গোয়েন্দাগিরির বিকল্প নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেহেতু ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, তাই এই যুদ্ধে দু’পক্ষই প্রচুর গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনা করেছিল। এটি আর দশটি যুদ্ধের মতো ছিল না; জল-স্থলে-অন্তরীক্ষে এই যুদ্ধের বিকাশ তো ঘটেছিলই, এর পাশাপাশি পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মহাদেশেই এই যুদ্ধের রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। যে প্রধান মিত্রপক্ষীয় দেশগুলোকে (আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন) এই যুদ্ধে জয়লাভের কৃতিত্ব দেয়া হয়, তাদের বিজয়ের পেছনে সেসব দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিশাল ভূমিকা ছিল।
ভারতবর্ষ তখনও ছিল ব্রিটিশদের অধীনে। বলে রাখা ভালো, ভারতবর্ষের সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রায় পঁচিশ লাখ ভারতীয় সৈন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেছিলেন, ত্রিশ হাজারের মতো সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিলেন বিভিন্ন রণক্ষেত্রে। অসংখ্য ভারতবর্ষীয় পুরুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনেকে স্বদেশেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পৃথিবীর কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, ভারতবর্ষও ছিল না। তাই জনগণের চাহিদা মেটাতে বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ভারতের সাথে পৃথিবীর অনেক দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। মূলত, ভারতীয় মহাসাগরের বিশাল সমুদ্রপথ ব্যবহার করে বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মালামাল নিয়ে বিদেশি জাহাজগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে নোঙর করত। ১৯৪৩ সালের দিকে তিনটি মালবাহী জার্মান জাহাজ ভারতীয় উপকূলে নোঙর করে করে, উদ্দেশ্য ছিল ভারত থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি করা।
ভারতীয় মহাসাগরে কিন্তু নিয়মিত অক্ষশক্তির সাথে মিত্রশক্তির বাহিনীর সামরিক সংঘর্ষ হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির কুখ্যাত ইউ-বোট নামক সাবমেরিনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। ভারতীয় মহাসাগরেও মিত্রপক্ষের অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ জার্মান ইউ-বোটগুলোর কবলে পড়ে সাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। বিষয়টি ব্রিটিশ নীতিনির্ধারণকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। ইউ-বোটগুলো কীভাবে মিত্রপক্ষীয় জাহাজগুলোর অবস্থান সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারছিল, সেটি ছিল একটি বিরাট রহস্য। তারা এই রহস্য উন্মোচন করার জন্য জোরদার প্রচেষ্টা চালায়, এবং একপর্যায়ে আবিষ্কার করে যে ভারতীয় উপকূলীয় অঞ্চল মর্মুগাঁওয়ে নোঙর করা একটি মালবাহী জাহাজ, যার নাম ‘এরেনফেলস’ (Ehrenfels), সেখান থেকে গোপন বার্তা প্রেরণ করা হয় জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। এবার ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকেরা সেই জাহাজ ধ্বংসের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
‘কলকাতা লাইট হর্স’ (Kolkata Light Horse)’ ও কলকাতা স্কটিশ ‘(Kolkata Scottish) নামে দুটি স্পেশাল অপারেশন ইউনিট আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল। মূলত এই ইউনিটের সদস্যরা ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বাছাই করা কর্মকর্তা, যাদের দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশদের জাহাজগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমে কেউ বাধা দিলে সেই জাহাজের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করা। কিন্তু ভারতীয় মহাসাগরের বিশাল সমুদ্রপথে একচ্ছত্র আধিপত্যশালী ব্রিটিশদের সাথে সহজে কেউ বৈরিতা তৈরি করত না। তাই এই ইউনিটের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে দূরে ছিলেন। এমনও হয়েছিল, এই বিশেষ সামরিক ইউনিটের অনেক ব্যক্তি সর্বশেষ পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছিলেন দুই কিংবা তিন দশক আগে। ব্রিটিশ সরকার এবার তাদের কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এই ইউনিটের সেনাসদস্যরা দীর্ঘদিন পেশাগত দায়িত্ব পালন থেকে দূরে থাকার পর হঠাৎ এরকম একটা অভিযানে সফল হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে প্রাথমিকভাবে দ্বিধায় ভুগছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে তাদেরকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পরিকল্পনানুযায়ী, কলকাতা লাইট হর্সের সদস্যরা ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনার জন্য জার্মান মালবাহী জাহাজগুলোর ব্যবসায়ীদের সাথে দেখা করতে যান। ব্রিটিশদের পরিকল্পনা ছিল, জার্মান ব্যবসায়ীদের মালবাহী জাহাজ যেখানে নোঙর করা আছে, তা থেকে একটু দূরে মদের আসর বসিয়ে জাহাজের প্রধান কর্মকর্তাদের জাহাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসবেন। এতে করে যখন এরেনফেলস জাহাজে হামলা চালানো হবে, তখন সঙ্গীর অভাবে জাহাজের জার্মান নিরাপত্তারক্ষীরা খুব বেশি প্রতিরোধ করতে পারবেন না। স্থানীয় একটি পতিতালয়ের সাথে কলকাতা লাইট হর্সের একজন সদস্য আগেই মদের আসর ও জার্মান কর্মকর্তাদের পতিতা সরবরাহের কথাবার্তা পাকা করে আসেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন জার্মান ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন তারা প্রথমে রাজি হ নি। এরপর বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে জার্মানদের রাজি করানো হয়।
পরিকল্পনানুযায়ী, এরেনফেলসের বেশিরভাগ কর্মকর্তা ব্রিটিশদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে মদের আসরে যোগ দেন। এতে তাৎক্ষণিক কোনো সামরিক আক্রমণ ঠেকানোর জন্য যে পরিমাণ জনবল দরকার ছিল, এরেনফেলসে তার ঘাটতি দেখা দেয়। এই সুযোগই কাজে লাগায় ব্রিটিশরা। তাদের কয়েকজন জার্মানদের মদের আসরে ও পতিতাদের মাধ্যমে ব্যস্ত রাখে। অপরদিকে কলকাতা লাইট হর্সের বাকি সদস্যরা পর্যাপ্ত পরিমাণ বোমা নিয়ে এরেনফেলসের আশেপাশে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে তারা জার্মান নিরাপত্তারক্ষীদের অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখেই এরেনফেলসের উদ্দেশ্যে বোমা নিক্ষেপ শুরু করেন। নিরাপত্তীরা সংখ্যায় ছিল অনেক কম, কলকাতা লাইট হর্সের সদস্যদের সামনে তাদের প্রতিরোধ স্থায়ী হয়েছিল অল্প কয়েক মিনিট। কিছু সময় পরেই তীব্র বোমা হামলায় এরেনফেলস ধ্বংস হয়ে পানিতে ডুবে যায়, জাহাজের ক্যাপ্টেন ও অন্যদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মারা যান। এরেনফেলসের জার্মান কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা মদের আসরে ও পতিতালয়ে ছিল, তারা খবর পাওয়ার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়।
ব্রিটিশরা চেয়েছিল এরেনফেলস থেকে যদি কোনো ডকুমেন্ট পাওয়া যায়, তাহলে যেন সেগুলো অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। কলকাতা লাইট হর্সের সদস্যরা তেমন কিছুই সংগ্রহ করতে পারেননি, তার আগেই জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। জার্মান ব্যবসায়ীরা ভেবেছিল- হয়তো মিত্রপক্ষ তাদের উপর পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ শুরু করেছে। তারা এরপর আতঙ্কের মাথায় দ্রুততার সাথে তাদের বাকি দুটো মালবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। তাদের ধারণা ছিল, নিজেরা ধ্বংস না করলে ব্রিটিশরা আবার আক্রমণ করে জাহাজগুলো দখল করে নিতে পারে, এতে করে অনেক গোপন তথ্য তাদের হাতের নাগালে চলে আসবে। জার্মানিতে যখন এই বোমা হামলার খবর পৌঁছায়, তখন জার্মানরা প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে যে ব্রিটিশরা নিরীহ জার্মান ব্যবসায়ীদেরও ছাড়ছে না।
এরেনফেলস ধ্বংসের মাধ্যমে ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ঠিকই অর্জিত হয়েছিল। এরেনফেলসে হামলার আগে দুই বছরে দুই ডজনেরও বেশি মিত্রপক্ষীয় জাহাজ ডুবিয়ে দেয় জার্মান ইউ-বোটগুলো। কিন্তু এরেনফেলস ধ্বংসের পর পরবর্তী দুই বছরে মাত্র দুটি জাহাজ ধ্বংসে সমর্থ হয় তারা। কলকাতা লাইট হর্স নামের সেই বিশেষ সামরিক ইউনিট ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের প্রস্থানের পর ভেঙে দেয়া হয়। এই ইউনিটের সদস্যরা স্বদেশে ফিরে যান। যেহেতু এই সামরিক অভিযান একেবারে গোপনে পরিচালনা করা হয়েছিল, ১৯৭৮ সালের আগে এই অভিযান সম্পর্কে তাই কেউই জানত না!