ছবি কী শুধুই ছবি? না! কিছু ছবিতে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, ঘটনা ও গল্প। চলুন এই ছবিগুলো দেখে জানা যাক অনেক অজানাকে।
দ্য জায়ান্ট মান্তা রে, ১৯৩৮
প্রায় ৫৪৪ কেজির এই মান্তা রেটি (বিশাল পাখনাবিশিষ্ট বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ) ফরেস্ট ওয়াকার নামের একজন মাছ ধরার গাইড ধরেন। এই ছবিতে ওনার বন্ধু জন হ্যাচমাইস্টার ও আর্ল বাউমকে দেখা যাচ্ছে। তারা ওয়াকারকে প্রশংসা করছেন এই বিশালাকার মাছটি ধরার জন্য।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি বক্স থেকে বের করা
নকশাকার ফ্রেডেরিক অগাস্টি বার্থোল্ডি এবং নির্মাণ করেছেন গুস্তাভ আইফেল। এই ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ ১৮৮৫ সালে শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে জাহাজে করে পাঠানো হয়। সম্পূর্ণ এই ভাস্কর্যটিতে ৩৫০টি আলাদা আলাদা অংশে বিভক্ত ছিলো এবং যুক্তরাষ্ট্রে জাহাজে করে পাঠানোর সময় ২১৪টি বক্সে করে পাঠানো হয়েছিলো। ১৮৮৪ সালের ৪ জুলাই ফ্রান্সের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এই ভাস্কর্যটি উপহার দেয়া হয়। তামা দিয়ে তৈরি এই ভাস্কর্যটি হলো লিবার্টাস্, অর্থাৎ রোমের একজন দেবী! এই ভাস্কর্যটির হাতে রয়েছে একটি মশাল ও ট্যাবুলা আনতা যাতে রোমান সংখ্যায় লেখা আছে, “JULY IV MDCCLXXV” (৪ জুলাই, ১৭৭৬)। সে সময়েই যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় বলেই এই তারিখটি সেখানে লেখা। এই ভাস্কর্যটির পায়ের কাছে একটি ভাঙা শিকল রয়েছে। পরবর্তীতে এই ভাস্কর্যটি যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বপ্রথম সেলফি, ১৮৩৯
যদিও স্লফি বিষয়টি মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসার পর থেকে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তবুও এই বিষয়টি ফটোগ্রাফিক ক্যামেরার দিনগুলো থেকেই কিন্তু এর চর্চা রয়েছে। রবার্ট কর্নেলিয়াসের (যুক্তরাষ্ট্রের ফটোগ্রাফি বিষয়ের অগ্রদূত) ছবিটি হলো প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি বা বর্তমান সময়ের সেলফি, যা ১৮৩৯ সালে তোলা হয়েছিলো। এই সেলফি শব্দটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন জিম ক্রাউস নামের একজন ফটোগ্রাফার। এই শব্দটি ধীরে ধীরে এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, ২০১৩ সালে অক্সফোর্ডের ইংরেজি অভিধানে জায়গা করে নেয়।
মন্টপার্নাশ লাইনচ্যুত হওয়া, ১৮৯৫
গার মন্টপার্নাস (মন্টপার্নাস স্টেশন, প্যারিসের ৬টি বড় রেল স্টেশনের মধ্যে একটি) বিখ্যাত হয়েছে ১৮৯৫ সালের ২২শে অক্টোবর গ্রানভিল প্যারিস এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে। ইঞ্জিনটি প্রায় ৩০ মিটার বেগে স্টেশন মঞ্চে আটকে পড়ে, এটি একটি ৬০ সেন্টিমিটার পুরু দেয়ালের মধ্য দিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে একটি ছাদ ভেদ করে স্টেশন থেকে ছিটকে পড়ে। দ্রুতগতিতে স্টেশনের দিকে যাওয়ার কারণে ট্রেন চালককে ৫০ (প্রায় ৭৭৮ টাকা) ফ্র্যাঙ্ক জরিমানা করা হয়। আর পাহারাদারদের মধ্যে একজনকে কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে হ্যান্ডব্রেক প্রয়োগে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ২৫ ফ্রাঙ্ক (৩৮৯ টাকা) জরিমানা করা হয়। দ্য লেভি এন্ড সন্সের তোলা এই ঘটনার ছবিটি পরিবহন ইতিহাসের সেরা ছবিগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রাইট বৈমানিকের প্রথম উড্ডয়ন, ১৯০৮
নকশাকারের নামানুসারে দেয়া নামানুজায়ী ‘দ্য রাইট ফ্লায়ার’ ছিলো আকাশে ওড়া প্রথম বিমান। যদিও এই বিমানটি প্রথমে আকাশে ওড়ার সময়সীমা ছিলো ১২ সেকেন্ড, তবুও এটি বিমানের অগ্রগামী যুগের প্রারম্ভিক ঘটনা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর এই বিমানটি ৪ বার আকাশে উড়েছে। ফটোগ্রাফার জন ড্যানিয়েলের তোলা এই ছবিটি ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়।
আরএমএস টাইটানিকের সর্বশেষ ছবি, ১৯১২
প্রথম যাত্রাতেই আরএমএস টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার ঘটনার সর্বশেষ ছবি। ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল হিমশৈলের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এই টাইটানিকের। ধারণা করা হয় যে, এই ছবিটি ১৯১২ সালের ১২ এপ্রিল ফ্রান্সিস ব্রাউন নামে আয়ারল্যান্ডের একজন ক্যাথলিক যাজক এই ছবিটি তোলেন।
জার্মান হেলমেট থেকে তৈরি পিরামিড, ১৯১৮
এই ছবিটি ১৯১৮ সালে তোলা। তবে কারও কারও মতে, এই ছবিটি ১৯১৯ সালে তোলা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেল রোডের কর্মীরা গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালের সামনে জার্মান হেলমেট দিয়ে বানানো একটি পিরামিড দেখিয়ে বিজয় উদযাপন করছে। সেই পিরামিডের ‘পিকেলাউবস্’ (উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে জার্মান সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাঁটাযুক্ত এক ধরনের হেলমেট ব্যবহার করতো) এর নিচে সেদিন ১২,০০০ জার্মান জনগণ ছিলেন। জার্মানির গুদাম থেকে যুদ্ধের শেষে এটি সেখানে পাঠানো হয়। আজকের দিনে সবাই এই হেলমেটটি দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারে। কারণ সেই প্রতিটি হেলমেটই মৃত বা বন্দী সৈনিকের প্রতিনিধিত্ব করে। ওই সময়ের ভয়ংকর সেই যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে এটি দেখলে আমাদের আবেগ হয়তো বা কাজ করতে পারে। তবে সে সময়ে যা ঘটেছিলো তা অনুমান করাটাও খুব কঠিন।
বুলেট প্রতিরোধক পোশাক পরীক্ষা, ১৯২৩
১৯২৩ সালে নিউ ইয়র্কের প্রটেক্টিভ গার্মেন্ট কর্পোরেশন পুলিশ বাহিনীর জন্য হালকা গড়নের বুলেট প্রতিরোধক একটি ভেস্ট (হাতা কাটা পোশাকের মতো) তৈরি করে। এর কার্যকারিতা প্রমাণ করার জন্য তারা সরাসরি একটি পরীক্ষামূলক আয়োজন করেন। এই পরীক্ষাটি চালানো হয় ওয়াশিংটন সিটি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এবং যাদের ওপর চালানো হয় তাদের নাম হলো ডব্লিউ এইচ মার্ফি ও তার সহযোগী। ১০ ফুট দূরত্ব থেকে মার্ফির বুকের ওপর দুটি গুলি ছোড়া হয়। সেখানে উপস্থিত একজন সাক্ষীর বক্তব্য মতে, তার চোখ বাঁধা ছিলো না। পরীক্ষামূলকভাবে গুলি ছোড়ার পর মার্ফি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে স্মারক হিসেবে সেই বুলেটগুলো দিয়ে দেন।
এমজিএম এর সিংহের গর্জন রেকর্ড, ১৯২৮
জ্যাকি ছিলো এমজিএম (মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার; এক সময়ের সবচাইতে বড়, আকর্ষণীয় এবং সম্মানিত স্টুডিও) এর লোগোর দ্বিতীয় সিংহ। এমজিএম এর লোগো হিসেবে জ্যাকিই প্রথম গর্জন করে যা ছিলো গ্রামোফোন দিয়ে রেকর্ড করা এমজিএম এর প্রথম সাউন্ড প্রোডাকশন। পর্দার ডান দিকে তাকানোর আগে জ্যাকি ৩ বার গর্জন করে। জ্যাকি নামের এই সিংহকে ১৯২৮ থেকে ১৯৫৬ সালে এমজিএম এর বানানো সকল সাদাকালো সিনেমাতে দেখা যেতো। এছাড়াও জ্যাকি বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার জন্যও পরিচিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ২টি ট্রেনের ধ্বংস, ভূমিকম্প এবং স্টুডিওর বিস্ফোরণ। তবে সবচাইতে আলোচিত দুর্ঘটনাটি ছিলো যখন একজন বৈমানিক বিমান দুর্ঘটনার আশংকার কারণে অ্যারিজোনার বনে যখন বিমান অবতরণ করেছিলেন। তখন চারদিনের জন্য জ্যাকি সামান্য পানি আর কয়েকটি স্যান্ডউইচ খেয়ে বেঁচে ছিলো। এসব কারণে তাকে নাম দেয়া হয়, “লিও দ্য লাকি”।
হিন্ডেনবার্গ দুর্যোগ, ১৯৩৭
৬ই মে ১৯৩৭ সালে একটি বিশাল যাত্রীবাহী বিমান লেকহার্স্টের (নিউ জার্সি, যুক্তরাষ্ট্র) কাছে অবতরণের সময় আগুন ধরে যায়। এই দুর্ঘটনায় মারা ৩৫ জন মানুষ মারা যায়। ৯৭ জন যাত্রী ও বিমান সদস্যদের মধ্যে ৬২ জন দুর্ঘটনা থেকে কোনো রকমে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়। অনেক সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার এই দুর্ঘটনাটির ছবি তুলে বিভিন্ন রেডিও স্টেশন, খবরের কাগজে প্রচার করেন। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই বিমানটি বিস্ফোরণ এবং দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের পরিস্থিতি দেখতে পায়। এই দুর্যোগটির কারণে মানুষের মনে বিমানযাত্রা নিয়ে যে বিশ্বাসের ঘাটতি হয়েছিলো তা পূরণ হতে পুরো এক যুগ সময় লেগেছিলো।
Feature Image Source: YouTube