আমাদের এই পৃথিবী বড়ই বিচিত্রময়। তার চেয়েও বিচিত্রময় এর মানুষেরা। এ বৈচিত্র্যতার জন্য সর্বদাই এ বিশ্বে নতুন নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি হয়ে চলেছে। তাই বিশ্ব রেকর্ডের পরিমাণ এ বিশ্বে নেহায়েত কম নয়। সবগুলো রেকর্ডই নিজের নিজের জায়গায় অনন্য। কিন্তু তার মাঝেও কিছু কিছু রেকর্ড থেকেই যায় যা আমাদের ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত করে তোলে। আজ এমনই কয়েকটি বিশ্ব রেকর্ডের গল্প নিয়ে এসেছি আপনাদের সামনে। তো চলুন শুরু করা যাক।
হাতবিহীন তীরন্দাজের তীর ছোঁড়ায় বিশ্ব রেকর্ড
ম্যাট স্টাটজম্যান একজন আমেরিকান তীরন্দাজ। জন্ম থেকেই তার দুটি হাত ছিলো না। হাত নেই কিন্তু তীরন্দাজ হবেন সেটা কি কল্পনা করা যায়? কিন্তু স্টাটজম্যান নিজের এই অক্ষমতাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি শুধু তার কাঁধ আর পা ব্যবহার করেই এক বিশেষ পদ্ধতিতে তীর ছোঁড়েন। নিয়মিত চেষ্টার ফলে ২০১২ সালের প্যারা অলিম্পিকে সিলভার মেডেলও জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি করতে চেয়েছিলেন বিশ্ব রেকর্ড।
২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রায় ২৮৪ মিটার দূর থেকে তীর ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করলেন ম্যাট। তৈরি হলো বিশ্বরেকর্ড। যাদের হাত আছে এমন তীরন্দাজরাও এখনও এই রেকর্ড করতে পারেন নি। এর পর থেকে ম্যাট স্টাটজম্যান গোটা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়ে যান। জীবনে যত বাঁধাই আসুক না কেন, চেষ্টা করলে সব বাঁধাকে উপেক্ষা করে সফল হওয়া যায় তা পৃথিবীর মাটিতেই আবারও প্রমাণ করে দেখালেন তিনি। এখন ম্যাট স্টাটজম্যান অনেক প্রতিবন্ধী মানুষদেরই প্রেরণার উৎস।
পাঁচ বছর বয়সী আইটি বিশেষজ্ঞ
আয়ান কোরেশি। জন্ম ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানের লাহোরে। আয়ান কোরেশি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট মাইক্রোসফট কর্তৃক স্বীকৃত আইটি পেশাদার। সে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে বার্মিংহাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষায় সফলভাবে কৃতকার্য হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর ৭ মাস। সে মেহরুজ আফরোজ নামের সারে ছয় বছর বয়সী পাকিস্তানী আরেক মাইক্রোসফট স্বীকৃত বিশেষজ্ঞের রেকর্ড ভেঙ্গে এ নতুন রেকর্ড তৈরি করে। ২০১৫ সালে কোরেশি ব্রিটিশ মুসলিম অ্যাওয়ার্ডে “ইয়াং অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ডে”র জন্য মনোনীত হয়। কোরেশির মা তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
মজার বিষয় কোরেশি এই পরীক্ষাটি প্রায় মিস করে ফেলেছিলো। এ পরীক্ষাটি সাধারণত চাকরীর জন্য খুবই প্রয়োজন। তাই পরীক্ষাটি সাধারণত তরুণরা দিয়ে থাকেন। কোরেশি পরীক্ষায় বসলে পরিদর্শক বেশ অবাক হয়ে যান। পরিদর্শক ভেবে বসলেন কোরেশির বয়স পরীক্ষাটি দেয়ার জন্য খুবই কম। তখন বার্মিংহাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোসফটের আমেরিকার প্রধান কার্যালয়ে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হওয়া হয়েছিলো যে এত ছোট বয়সের কেউ পরীক্ষায় বসতে পারবে কিনা। মাইক্রসফট থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই বিশ্ব রেকর্ড করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন আয়ান কোরেশি।
লিফট ছিঁড়েও বেঁচে যাওয়ার রেকর্ড
বেট্টি লু অলিভার। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর একজন লিফটের কর্মচারী। লিফট নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। তিনি তার জীবনে ২ টি খুবই বড় ধরণের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাও আবার একই দিনে! কি অস্বাভাবিক লাগছে? চলুন পুরোটা জানা যাক।
২৮ জুলাই, ১৯৪৫। প্রতিদিনকার মত বেট্টি লু অলিভার তার নিজের কাজ করছিলেন। তিনি ছিলেন বিল্ডিংটির ৮১ তলায়। সেদিন বাইরে বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন ছিলো। এমনই এক দিনে বি-২৫ মিশেল বোম্বার নামের একটি বোম্বার প্লেন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর ৮০ তম তলার উত্তর দিকে আঘাত হানে। এর ফলে অলিভার ছিটকে পড়লো এবং ঘাড় এবং পিঠে মারাত্মক আঘাত পেলো। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হলো এবং তাকে লিফটে করে নিচে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হলো। কিন্তু লিফটের তারগুলো কিছুক্ষণ আগের প্লেন ক্র্যাশের ফলে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো যা তারা বুঝতে পারেন নি। ফলে লিফট অলিভারকে নিয়ে নামার সময় ৭৬ তলায় থাকা অবস্থায় ছিঁড়ে নিচে পড়ে গেলো। একদম নিচে। এ দূরত্ব ছিল প্রায় ৩০০ মিটার। এই ঘটনাটি তখন থেকেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের লিফট ছিঁড়ে পড়ার পর সবচেয়ে দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে বেঁচে যাওয়ার একটি বিশ্ব রেকর্ড হয়েই আছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব কক্ষ
পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব কক্ষের নতুন রেকর্ডটি মাইক্রোসফটের অধীনে। কক্ষটি মাইক্রোসফটের ওয়াশিংটনের অফিসে তৈরি করা হয়েছে। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত এবং নীরব জায়গা। এ কক্ষে গেলে আপনি নিজেই নিজের রক্ত প্রবাহের শব্দ শুনতে পাবেন। এতটাই নীরব এ কক্ষ। মূলত গবেষণা কাজের জন্য এ কক্ষটি তৈরি করা হয়েছে।
খাদ্য এবং পানি ছাড়া সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড
অ্যান্দ্রেয়াস মিয়াভেকজ হলেন একজন অস্ট্রিয়ান। তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি যার দখলে আছে খাবার এবং পানি ছাড়া সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকার গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডটি।
১ এপ্রিল,১৯৭৯। অ্যান্দ্রেয়াসের বয়স তখন ১৮ বছর। একজন পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার অভিযোগে তিনজন পুলিশ অ্যান্দ্রেয়াসকে সাময়িকভাবে একটি কারাকক্ষে রাখেন। কিন্তু এরপর তারা ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভুলে যান। প্রত্যেকেই ধরে নেন অন্য ২ জন তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে নিয়েছে। অ্যান্দ্রেয়াসের কক্ষ ছিল একদম নিচের তলায়। ফলে কেউই তার চিৎকার শুনতে পেতো না। তার আশে পাশেও কেউ ছিলো না। ১৮ দিন সে এভাবে বন্দী থাকে। এ কদিনে অ্যান্দেয়াসের ওজন ২৪ কেজি কমে যায়। ১৮ দিন পর, ১৯ এপ্রিল এক পুলিশ অফিসার কোন কারণ ছাড়াই নিচের কক্ষগুলোর দিকে যাওয়ার সময় তাকে লক্ষ্য করেন এবং অ্যান্দ্রেয়াস ১৮ দিন পর এ নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।
এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ ওঠে। তবে তাদের মধ্যে কে দায়ী তা বের করা যায়নি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করেছিল সেটিও প্রমাণিত হয়নি। তাদের প্রায় ২,০০০ ইউরোর মতো জরিমানা করা হয়। আরো ২ বছর পর অ্যান্দ্রেয়াসকে আদালত ২ লক্ষ ৫০ হাজার অস্ট্রিয়ান সিলিং ক্ষতিপূরণ দেয়।
মেটালিকা ব্যান্ডের বিশ্ব রেকর্ড
মেটালিকা একটি রক ব্যান্ড। মেটালিকাই পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র ব্যান্ড দল যারা পৃথিবীর ৭ টা মহাদেশেই তাদের কনসার্ট করেছে বা, তাদের মিউজিক বাজিয়েছে। তারা এক বছরেই এ ৭ টি মহাদেশেই ঘুরেছেন। তারা এই বিশ্বরেকর্ডটি শেষ করেন আন্টার্কটিকায় ১২০ জন বিজ্ঞানী এবং একটি প্রতিযোগীতায় জয়ীদের নিয়ে হওয়া একটি অনুষ্ঠানে মিউজিক বাজিয়ে। ঘটনাটি তারা ঘটান ২০১৩ সালে। আন্টার্কটিকা বরফে ঘেরা এক মহাদেশ। আন্টার্কটিকায় বাজানো ব্যান্ডগুলোর মাঝে মেটালিকাই ছিলেন দ্বিতীয় ব্যান্ড। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড তাদের ২০১৫ সালের বইয়ে মেটালিকার নাম অন্তর্ভুক্ত করে তাদের এ কীর্তির স্বীকৃতি প্রদান করে।