গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে বলা যেতে পারে ‘প্রেমের স্বর্গভূমি’। শৈশব থেকেই আমরা লায়লী-মজনু, সেলিম-আনারকলি, হীর-রাঞ্ঝার মতো বাস্তব জগতের দুঃসাহসী প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণ, শিব-সতীর মতো পৌরাণিক চরিত্রের অনবদ্য ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে বড় হতে থাকি। বলিউডেও এসব প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হচ্ছে একের পর এক অনিন্দ্য সুন্দর চলচ্চিত্র। কিন্তু হাতেগোনা কয়েক জোড়া কপোত-কপোতীর নামই যেন সেখানে ঘুরে ফিরে আসে, তথাকথিত শোরগোলের ভিড়ে হারিয়ে যায় স্বল্প পরিচিত প্রেমকাহিনীগুলো। এমনই এক অচেনা কালজয়ী প্রেমের গল্পের জন্মদাতা মির্জা-সাহিবান জুটিকে নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আয়োজন।
প্রেমকাহিনীও যে হয়ে উঠতে পারে পূজনীয়, তা হয়তো আজকের দিনে ভাবতেও অবাক লাগবে অনেকের। এখন ভালোবাসা, বন্ধুত্ব সবকিছু ছুটে চলেছে আঙুলের ছোঁয়ায়। তারপরও অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ইতিহাসের কিছু অংশ শুনে যেন ভালোবাসতে ইচ্ছে করে নতুন করে, নতুনভাবে। মির্জা-সাহিবান কাহিনীর শুরু আধুনিক এই ডিজিটাল দুনিয়ার সূত্রপাত হওয়ার প্রায় কয়েক শ’ বছর আগে। পাঞ্জাবের পূর্বদিকে খিওয়া নগরীতে পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে মৃত্যুবরণ করেন এক নারী। সন্তানকে এক ফোঁটা স্তন্যদান করার সুযোগও পেলেন না হতভাগ্য এই মা। অন্যদিকে প্রায় কাছাকাছি সময়ে, ঠিক একই শহরে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন আরেক নারী। মা-হারা এই ছেলেটিকে দেখে মমতায় ছেয়ে যায় তার হৃদয়। নিজের মেয়ের সাথে সাথে এই ছেলেটিকেও নিজের সন্তানের মতো করেই পালতে থাকেন তিনি।
সে আমলে ‘দুধ ভাইবোন’ নামে একটি সম্পর্ক খুব প্রচলিত ছিল। একই মায়ের স্তন পান করায় তারাও দু’জন হয়ে ওঠেন দুধ ভাইবোন। মেয়েটির নাম রাখা হয় ফতেহ বিবি আর ছেলেটির নাম খিওয়া খান। একটু বড় হয়ে উঠলে ফতেহ বিবির বিয়ে দেয়া হয় ওয়াঞ্জল নামের এক লোকের সাথে। ওয়াঞ্জল ছিলেন খারাল জাতের সর্দার। বর্তমান ফয়সালাবাদের কাছে দানাবাবাদ গ্রামে বিয়ে হয় ফতেহ বিবির। তাদের দুজনের ভালোবাসার ফসল হিসেবে জন্ম নেয় সুপুরুষ মির্জা। অপরদিকে ফতেহ বিবির দুধ ভাই খিওয়া খান হয়ে ওঠেন সিয়াল জাতের সর্দার। তার ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসে সাহিবান, কারো কারো মতে সাহিবা। এখান থেকেই শুরু ইতিহাসে জায়গা করে নেয়া মির্জা-সাহিবান প্রেমকাহিনীর।
বাচ্চাদের যখন বিদ্যালয়ে পাঠানোর সময় এলো, মির্জার বাবা-মা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন মির্জাকে পাঠিয়ে দেবেন তার ‘দুধ মামা’র বাড়িতে। ওখানকার শিক্ষার পরিবেশ ঢের ভালো বিধায় আপত্তি জানালো না কেউ। সাহিবানের বাবাও সাদরে বুকে টেনে নিলেন মির্জাকে। মামাতো-ফুফাতো ভাইবোন হিসেবে একইসাথে শুরু হলো তাদের শিক্ষাপর্ব। সমবয়সী মির্জা-সাহিবান কোরআন শিখতে গেল একসাথে।
ছোট্ট মির্জা টেরই পায়নি তার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা সাহিবান একদিন এতোটাই রূপবতী হবে যে, তার কাছে হার মানবে চন্দ্রের সৌন্দর্যও। পড়ালেখা আর খেলাধুলায় মগ্ন দুই শিশু ছিল একে অপরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তবে তারা কৈশোরে পা রাখতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। ভালোবাসা কী তা বুঝে উঠতে না উঠতেই মির্জা বুঝতে পারে ভালোবাসা মানে সাহিবান, আর সাহিবান উপলব্ধি করে প্রেমের অপর নাম মির্জা।
একদিন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মির্জা পাঠশালা থেকে বাড়ি ফেরার জন্য বেছে নেয় ভিন্ন একটি পথ। রাস্তার পাশেই ছিল একটি বাজার। মির্জা দেখতে পায় সাহিবান রান্নার জন্য কিছু সবজি কিনছে। চেয়ে চেয়ে দেখল মির্জা, সবজি বিক্রেতা সাহিবানের রূপে মুগ্ধ হয়ে ওজনের চেয়ে বেশি সবজি দিয়ে দিচ্ছে। একই অবস্থা যেন মির্জারও, সারাটা পথ মন উথাল-পাথাল করা এক স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরে চলল সে। মির্জা আর সাহিবান এখন আলাদা দুই বাড়িতে থাকে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘোড়সওয়ারি আর ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে মির্জা। জমিনে দৃপ্ত পায়ে টগবগিয়ে ছুটে চলা বাক্কি নামের তেজী ঘোড়াটি তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তীরন্দাজ হিসেবে তার নিশানা এতোই ভালো ছিল যে, চলন্ত ঘোড়ার পিঠে বসেও দিব্যি লক্ষ্যভেদ করতে পারত সে। অন্যদিকে, সময়ের সাথে সাথে আরও রূপসী হয়ে উঠছিল সাহিবান। তরুণ মির্জার প্রতি অন্যরকম এক ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছিল সে। খুব শীঘ্রই অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, মির্জা আর সাহিবান কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারছে না। নিজেদের দুনিয়ায় বিভোর হয়ে রইল তারা। একদিন কোরআন শরীফের একটি আয়াতে উচ্চারণ ভুল করায় বেত দিয়ে সাহিবানের হাতে আঘাত করেন মৌলভী। সে আঘাত যেন সরাসরি মির্জার গায়ে লাগে। সাহিবানকে রক্ষা করতে মৌলভীর কাছ থেকে তার হয়ে নিজের জন্য সাজা চেয়ে নেয় মির্জা।
এভাবে তাদের ভালোবাসার ফুল যখন পাঁপড়ি মেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই তা নজরে পড়ে সাহিবানের বাবা-মার। মির্জাকে তারা তার বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাহির খান নামক ঐ শহরের এক অধিবাসীর সাথে সাহিবানের বিয়ে ঠিক করেন তারা। মির্জা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় নির্বিঘ্নে সাহিবানের বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন দুজন মিলে।
সাহিবান তার এক ব্রাহ্মণ বন্ধু কার্মুর হাতে একটি চিঠি পাঠায় মির্জার উদ্দেশ্যে। এই বিয়েতে যে তার একেবারেই মত নেই, সে কথা বারবার করে চিঠিতে উল্লেখ করে সাহিবান। চিঠি পাওয়া মাত্রই প্রেয়সীর কাছে ছুটে যাওয়ার সংকল্প নেয় মির্জা। ছেলেকে আর কোনোভাবে আটকানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে মির্জার বাবা তাকে জানান, এ বাড়িতে ফের ঢুকতে হলে অবশ্যই সাহিবানকে সাথে নিয়ে ফিরতে হবে। অন্যথায় এ বাড়ির দরজা তার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। পুত্রের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন ওয়াঞ্জল। ‘চল বাক্কি’, বলে পিঠে তীর-ধনুক সাজিয়ে বীরদর্পে বাক্কির পিঠে চড়ে খিওয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন মির্জা।
সাহিবানের বিয়ের রাতে সেখানে পৌঁছান মির্জা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে যাবে, এমন সময় সোজা কনে সাহিবানের ঘরে ঢুকে পড়েন তিনি। ঘরে সেই মুহূর্তে কেউ ছিল না, কেউ দেখেনি তাকে। সাহিবানের দিকে তাকিয়ে তার রূপের প্রশংসা না করে পারলেন না তিনি। টকটকে লাল রঙের শাড়ি পরেছে সাহিবান, অনিন্দ্য সুন্দর হাত দুটি মেহেদীর কারুকাজমণ্ডিত। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সে হাত ধরে সাহিবানকে বাড়ি থেকে বের করে আনেন মির্জা। নিচে অপেক্ষারত বাক্কির পিঠে উঠে চলতে থাকেন দুজন, যতক্ষণ না মনে হলো নিরাপদ জায়গায় এসে পড়েছেন ততক্ষণ ছুটে চললেন তারা। অবশেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে নেমে পড়লেন তারা। গাছের ছায়ায় শুয়ে, প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন মির্জা। সাহিবান জেগে থেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো চারপাশ।
এর মধ্যে বিয়েবাড়িতে সাড়া পড়ে গেছে কনে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে। সাহিবানের ভাইরা তাকে ডাকতে গিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই। ঘটনা বুঝতে আর কারো বাকি থাকে না। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তারা রওনা দেয় সাহিবান আর তার প্রেমিককে খুঁজে বের করতে। এদিকে ঘুমন্ত মির্জাকে পাহারা দিতে দিতে ভয়ে কাঁপতে থাকে সাহিবান। তার ভাইয়েরা যে এতো সহজে তাকে ছেড়ে দেবে না, এ কথা সে খুব ভালো করে জানত। আবার মির্জার ধনুর্বিদ্যা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা ছিল তার। সে কথা মাথায় রেখেই বুঝতে পারে সাহিবান, মির্জার তীর-ধনুকের সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই তার ভাইদের। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না সে।
ভাইরা আর যা-ই হোক, তাদের প্রাণে মারবে না, সেই বিশ্বাস থেকে দুঃসাহসী এক কাজ করে বসে সাহিবান। ঘুমন্ত মির্জার কাঁধ থেকে তীক্ষ্ণধার তীরগুলো বের করে, পাথর দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে সেগুলোর মাথা বাঁকিয়ে ফেলে সে। মতান্তরে জানা যায়, মির্জার কাঁধ থেকে তীর-ধনুকের থলেই গায়েব করে দেয় সে। এভাবে অন্তত রক্তপাত বন্ধ করা যাবে বলে মনে করেছিল সাহিবান।
কিন্তু বিধি বাম, সে এই কাজ করতে না করতেই ঐ পথে হাজির হয় তার ভাইয়েরা। গাছের ছায়ায় বিশ্রামরত প্রেমিক যুগলকে দেখা মাত্রই গর্জে ওঠে তারা। সে গর্জনে ঘুম ভেঙে যায় মির্জার। আত্মরক্ষার জন্য ঘাড়ে হাত দিয়েই টের পায় তীর-ধনুক কিচ্ছু নেই সেখানে। সাহিবানের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই একটি তীর এসে বিঁধে যায় ঠিক তার গলা বরাবর। পরক্ষণেই আরেকটি তীর আঘাত হানে তার বুকে। প্রেমিককে বাঁচাতে সাহিবান নিজেকে সমর্পণ করে দেয় মির্জার বুকে। পরবর্তী তীরগুলো এসে লাগে সাহিবানের শরীরে। এভাবে দুজন একসাথে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। শেষ হয় দুই মানব-মানবীর মিলন প্রহরের প্রতিক্ষার। অমর হয়ে ওঠে তাদের প্রেমকাহিনী, ইতিহাসে তারা জায়গা করে নেয় কালজয়ী হিসেবে।
পাঞ্জাবের বিখ্যাত প্রেমকাহিনীগুলোর মধ্যে হীর-রাঞ্ঝা আর সোনি-মাহিওয়ালের গল্পই সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে পাঞ্জাবের ইতিহাসে মির্জা-সাহিবানের মতো ট্র্যাজিক প্রেমগাঁথা আর একটিও নেই। সপ্তদশ শতাব্দীতে কবি পেলুর লেখনীতে প্রথম কাগজে-কলমে আটকা পড়ে অসাধারণ এই কাহিনী। পরবর্তীতে লোকের মুখে তা ছড়িয়ে পড়ে আর আজকের দিনের কপোত-কপোতীদের কাছে মির্জা-সাহিবান জুটি হয়ে ওঠে আদর্শ। সিনেমা, থিয়েটার, নাটক কিংবা সাহিত্যে অসংখ্যবার উঠে এসেছে তাদের এই প্রেমকাহিনী। ২০১৬ সালে রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার নির্দেশনায় অনীল কাপুর তনয় হর্ষবর্ধন কাপুর এবং সাইয়ামি খের অভিনয় করে ‘মির্জা’ চলচ্চিত্রটিতে।