খ্রিষ্টপূর্ব ৫১ সালে, জুলিয়াস সিজারের হাত ধরে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে রোমান সাম্রাজ্য। সিনেট তখনো শাসনভার সামলাচ্ছিল, কিন্তু দিনকে দিন কমেই যাচ্ছিল তার ক্ষমতা। ৪৪ খ্রিষ্টপূর্বে অতর্কিতে হত্যা করা হয় সিজারকে, তার স্থান নেন তারই পালিত পুত্র- গাইয়াস জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানাস (অক্টেভিয়ান)। মার্ক অ্যান্টনির পাশাপাশি তিনিও হাতে তুলে নেন শাসনক্ষমতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ সনে মিশর দখল করে নেয় রোম, মারা যান মার্ক অ্যান্টনি এবং রোমের একচ্ছত্র শাসক বনে যান অক্টেভিয়ান।
‘অগাস্টাস’ উপাধি ধারণ করেন প্রখ্যাত এই শাসক, সেই সঙ্গে হন রোমান ইতিহাসের সর্বপ্রথম সম্রাট। অনেকে সিজারকে এই সম্মান দিতে চাইলেও, প্রকৃতপক্ষে সিজার ছিলেন একজন ‘ডিক্টেটর’। এই পদবীর অধিকারী এমন এক ব্যক্তি যাকে রোমান সিনেট জরুরি অবস্থায় শাসন-ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে আহ্বান করত। সিজার কখনো সম্রাট হিসেবে সিনেট কর্তৃক ঘোষিত হননি। তাই অক্টেভিয়ানকেই প্রথম রোমান সম্রাট বলা চলে।
রোমান এই সাম্রাজ্যের সূত্রপাত হয় ৩১ খ্রিষ্টপূর্বে, শেষ হয় রোমের পতনের সঙ্গে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময়ের মাঝে ক্রমেই বেড়ে যায় রোমের প্রভাব, প্রতিপত্তি। ১১৭ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ উন্নতির চুড়োয় পৌঁছে যায় এই সাম্রাজ্য। এশিয়া মাইনর, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের প্রায় পুরোটাই চলে আসে তার অধীনে।
অতঃপর ২৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় রোমান সাম্রাজ্য- পূর্ব এবং পশ্চিম। উভয় খণ্ডেই আলাদা-আলাদা সম্রাট ছিলেন। পশ্চিম সাম্রাজ্য গথদের হাতে বলতে গেলে প্রায় নিশ্চিহ্নই হয়ে যায় ৪৭৬ সনে।
এদিকে পূর্ব সাম্রাজ্য, যাকে মানুষজন বাইযানটাইন সাম্রাজ্য হিসেবেই সহজে চেনে, এটি পনেরো শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকে। ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিরা দখল করে নেয় এই সাম্রাজ্যের রাজধানী- কনস্টান্টিনোপল (বর্তমানে যা ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত)।
রোমান সম্রাট হিসেবে ইতিহাসে সত্তর জনেরও বেশি মানুষের নাম লেখা আছে। তন্মধ্যে অগাস্টাস থেকে শুরু করে ডিয়োক্লেশিয়ান পর্যন্ত সম্রাটের রাজত্বকালকে বলা হয় ‘হাই এম্পায়ার’। এরপর থেকে রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত সময়কাল ‘লো এম্পায়ার’ নামেই অধিক পরিচিত।
হাই এম্পায়ার (২৭ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৩০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
৩১ খ্রিষ্টপূর্বে, অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে জয়ী গাইয়াস অক্টেভিয়ান থুরিনাস রোমের প্রথম সম্রাট হন। তিনি একাধারে ছিলেন জুলিয়াস সিজারের ভাতুষ্পুত্র এবং তার উত্তরাধিকারী। সিংহাসনে আসীন হয়ে তিনি ধারণ করেন ‘অগাস্টাস সিজার’ নাম।
তখন থেকে শুরু করে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন তিনি। তার মুখ থেকেই শোনা যাক রোমের উন্নতির বিবরণ- “আমি রোমকে পেয়েছিলাম কাদামাটির এক শহর রূপে। আর রেখে যাচ্ছি মার্বেলের নগরী হিসেবে।” তিনি আইন-কানুনের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন, সেই সঙ্গে রোমের সীমান্তের সুরক্ষার দিকে নজর দেন। বিশ্বস্ত সেনাপতি অ্যাগ্রিপ্পার কাঁধে ভর দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বিশাল সব দালান, যাদের মাঝে প্রথম প্যান্থেননও আছে।
বলা যায়, ইতিহাসের পাতায় রোমকে সবচেয়ে বড়, মহান সাম্রাজ্য এবং তার রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে মানুষের মনে অম্লান রাখার কৃতিত্ব তারই। প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই সম্রাট এতটাই শ্রদ্ধেয় ছিলেন যে রোমের নাগরিকরা তাকে দেবতা-জ্ঞান করত।
১৪ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সাম্রাজ্য চালানোর দায়িত্ব পালন করেন তার উত্তরাধিকাররা- টাইবেরিয়াস, ক্যালিগুলা, ক্লডিয়াস এবং নিরো। টাইবেরিয়াস শাসনভার নেন অগাস্টাসের মৃত্যুর পর। পূর্ববর্তী সম্রাটের কাজ আরও এগিয়ে নেন তিনি। কিন্তু মহান অগাস্টাসের মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা বা দূরদর্শিতা- কোনটাই তার ছিল না। এই ব্যাপারটি পরবর্তী তিন সম্রাটের মাঝেও দেখা যায়, আগেরজনের চাইতে দুর্বল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন পরের জন।
ইতিহাসের প্রথম এই পাঁচ সম্রাটকে এক কথা বলা হয় জুলিয়ো-ক্লডিয়ান বংশ (জুলিয়াস এবং ক্লডিয়াস- এই দুই পরিবারের নামানুসারে, যাদের এরা বংশধর)। ক্যালিগুলা তার পাগলামির কারণে ইতিহাসে কুখ্যাত হলেও, তার প্রাথমিক শাসন পদ্ধতিকে আজও ইতিহাসবেত্তারা সপ্রশংস দৃষ্টিতেই দেখেন।
তার পরবর্তী সম্রাট ক্লডিয়াস, রোমের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে ব্রিটেন পর্যন্ত নিয়ে যান। তবে নিরো তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি সাম্রাজ্যের এলাকা কিংবা প্রভাব বিস্তারে। ক্যালিগুলা নিহত হয় তার প্রিয়েটোরিয়ান প্রহরীর হাতে, ক্লডিয়াসকে হত্যা করেন তারই স্ত্রী। নিরোর আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত ঘটে জুলিয়ো-ক্লডিয়ান বংশের। যদিও পরবর্তী এমন অনেক সম্রাট এসেছেন যারা জুলিয়াস কিংবা ক্লডিয়াস পরিবারের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও, এই বংশের পারিবারিক নাম ধারণ করেছিলেন।
এখানে ছোট্ট একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কালের বিবর্তনে একসময় ‘সিজার’ শব্দটি খোদ ‘সম্রাট’ অর্থ বোঝাতে শুরু করে। জার্মানি, হাঙ্গেরি বা অস্ট্রিয়ার সম্রাটদের এই কদিন আগেও ডাকা হতো ‘কেইসার’ বলে যা সিজার-এর পরিবর্তিত রূপ। রুশ ‘জার’ শব্দটাও এই শব্দেরই অপভ্রংশ।
এরপর শুরু হয় সামাজিক অস্থিরতার সময়, যাকে ডাকা হয় ‘চার সম্রাটের বছর’ বলে। এই চার সম্রাট হচ্ছেন- গ্যালবা, অথো, ভিটেলিয়াস এবং ভেসপাসিয়ান। ৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নিরো মারা যাবার পর ক্ষমতা নিজের করে নেন গ্যালবা। কিন্তু অচিরেই বোঝা যায়- দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম। প্রিয়েটোরিয়ান প্রহরীর হাতে তিনি খুন হলে, সেদিনই সম্রাটের স্থলাভিষিক্ত হন অথো। নবনিযুক্ত সম্রাটের পূর্ব ইতিহাসের কারণে তার কাছ থেকে ভালো কিছুই আশা করছিল রোমান সাম্রাজ্য। কিন্তু সেনাপতি ভিটেলিয়াস নিজেই সম্রাট হবার ইচ্ছা থেকে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেন। অথো আত্মহত্যা করলে, সিংহাসনে আদিষ্ট হন তিনি।
গ্যালবা যেমন ব্যর্থ ছিলেন, তেমনি ব্যর্থ প্রমাণিত হলেন ভিটেলিয়াসও। অচিরেই তিনি দায়িত্ব ভুলে গা ডুবিয়ে দিলেন বিলাসে। বিরক্ত হয়ে সৈন্যরা সেনাপতি ভেসপাসিয়ানকে সম্রাট ঘোষণা করে রোম আক্রমণ করে বসল। ভিটেলিয়াস খুন হলেন ভেসপাসিয়ানের সমর্থকদের হাতে। গ্যালবার ক্ষমতা গ্রহণের ঠিক এক বছর পর, সম্রাট হিসেবে অভিষেক হলো ভেসপাসিয়ানের।
দশ বছর রাজত্ব করেন ভেসপাসিয়ান (৬৯ থেকে ৭৯ সাল পর্যন্ত), এই সময়ের মাঝে শুরু করেন বিখ্যাত ফ্ল্যাভিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাজ। পরবর্তীতে তার সন্তান, টাইটাস (৭৯ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত সম্রাট ছিলেন) সে কাজ সমাপ্ত করেন। টাইটাসের আমলেই ভিসুভিয়াস থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়, যার ফলে ছাই ও লাভার নিচে সলীল সমাধি ঘটে পম্পেই ও হেরকুলানিয়াম নগরীদ্বয়ের। তবে ইতিহাস সম্রাট টাইটাসের শাসন ক্ষমতার প্রশংসাই করে।
৮১ খ্রিষ্টাব্দে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি, তারপর সম্রাট হন তারই ভাই, ডমিশিয়ান। ৯৬ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন তিনি। ভাই যে নির্মাণ-কাজগুলো হাতে নিয়েছিলেন, সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি, অর্থনৈতিকভাবেও রোমকে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। কিন্তু তারপরও স্বৈরাচারী পদ্ধতি এবং আইন-প্রণয়নে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে রোমান সিনেটের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন তিনি। ৯৬ সনে তাকে হত্যা করা হয়।
এর পর সম্রাট হন তারই সচিব, নারভা। তার হাত ধরে চালু হয় নারভান-আন্টোনিন রাজবংশ। ৯৬ সাল থেকে ১৯২ সাল পর্যন্ত রোম শাসন করে এই পরিবার। এই সময়ের মাঝে পাঁচজন অত্যন্ত দক্ষ সম্রাটের হাত ধরে আরও বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে রোমান সাম্রাজ্য। এই পাঁচজন হলেন:
১. নারভা (৯৬-৯৮ সাল)
২. ট্রাজান (৯৮-১১৭ সাল)
৩. হেড্রিয়ান (১১৭-১৩৮ সাল)
৪. অ্যান্টোনিয়াস পাইয়াস (১৩৮-১৬১ সাল)
৫. মার্কাস অরেলিয়াস (১৬১-১৮০ সাল)
এই বংশের শেষ দুই সম্রাট হলেন লুসিয়াস ভেরাস এবং কমোডাস। লুসিয়াস আবার মার্কাস অরেলিয়াসের সঙ্গে সহযোগী-সম্রাট হিসেবে ছিলেন। ইতিহাসে তার তেমন কর্ম-তৎপরতার নজির দেখা যায় না। অরেলিয়াসের পুত্র কমোডাস রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটদের মাঝে সবচাইতে জঘন্য হিসেবে পরিচিত। নিজের মনের ইচ্ছে পূরণের জন্য তিনি সাম্রাজ্যের অর্থ খরচ করতে দ্বিতীয়বার ভাবতেন না। গোসল করার সময়, ১৯২ সনে, কুস্তি খেলার পার্টনার তাকে গলা টিপে মারে। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে নারভান-অ্যান্টনিন রাজবংশের। মাথা তুলে দাঁড়ান নতুন এক সম্রাট- প্রিফেক্ট পারটিনাক্স।
পারটিনাক্সই সম্ভবত আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়িয়ে হত্যা করিয়েছিলেন কমোডাসকে। কিন্তু তিনিও মাস তিনেকের বেশি সিংহাসনে টিকতে পারলেন না। তার গুপ্তহত্যার পর, একই বছরে আরো চারজন সম্রাটের দেখা পায় রোমান সাম্রাজ্য। শেষপর্যন্ত শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সেপটিমাস সেভেরাস।
১৯৩ থেকে ২১১ সাল পর্যন্ত রোম শাসন করেন তিনি। তার হাত ধরেই সূত্রপাত হয় সেভেরান রাজবংশের, তিনি পারথিয়ানদেরকে পরাজিত করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। কিন্তু আফ্রিকা এবং ব্রিটেনে তিনি যে অভিযান চালান, তা এতই ব্যয়বহুল ছিল যে তা সাম্রাজ্যের উপর অর্থনৈতিক দিক থেকে মারাত্মক চাপ ফেলে। তার পর একে-একে সম্রাট হন কারাকাল্লা, গেটা, ম্যাক্রিনাস, এলাগাবালুস এবং আলেক্সান্ডার সেভেরাস।
২৩৫ সনে আলেক্সান্ডারের গুপ্তহত্যার পর, সাম্রাজ্য পতিত হয় এক অকুল পাথারে। ‘তৃতীয় শতাব্দীর দুর্যোগ’ নামে পরিচিত এই সময়কালের স্থায়িত্ব ২৩৫ সন থেকে ২৮৪ সন পর্যন্ত।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল রোমের ক্ষমতা। ২৩৫ থেকে শুরু করে ৩০০ সাল পর্যন্ত তাদের নজর ছিল মূলত সীমান্ত রক্ষার দিকে। পারস্যের সাসানিয়ান এবং অসভ্যদের মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখে অস্তিত্ব রক্ষায় তার মাথা ব্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সমস্ত কারণেই ২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয় সেনাবাহিনী। বছর পঞ্চাশেক ধরে চলতে থাকে এই অরাজকতা, এ সময়ের সম্রাটদের একমাত্র চিন্তা ছিল কীভাবে সাম্রাজ্যকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
এদিকে এসব যুদ্ধের কারণে ধীরে ধীরে পর্বত-প্রতিম হয়ে উঠে সেনাবাহিনীর ব্যয়। দেনার দায়ে প্রায় ডুবতে বসে সাম্রাজ্য। শুরু হয় অবক্ষয়। এদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকা নতুন ধর্ম, খ্রিস্টবাদের কাছে জৌলুস হারাতে থাকে রোমান পৌত্তলিকতা।
২৮৪ সালে সেনাবাহিনীর হাত ধরেই ক্ষমতায় আসেন ডিয়োক্লেশিয়ান। তিনি শুরুতেই ক্ষমতাকে কয়েক ভাগে ভাগ করে দেন। যেহেতু অরাজকতার প্রধান কারণ হচ্ছে একজন সম্রাটের পর কে সম্রাট হবে তার কোনো পরিষ্কার নীতিমালা না থাকা- তাই ডিয়োক্লেশিয়ান ঘোষণা করেন, রাজত্বের শুরুতেই সম্রাটকে উত্তরাধিকারী বেছে নিতে হবে।
এমন দুজন উত্তরাধিকারী ছিলেন সেনাপতি ম্যাক্সেনটিয়াস এবং সেনাপতি কনস্ট্যান্টইন। প্রথম জনকে ডিয়োক্লেশিয়ান দেন পশ্চিম সাম্রাজ্যের ভার, পরের জনকে দেন হয় পূর্ব সাম্রাজ্যের ভার। পরে এর সাথে আরো কিছু যোগ করেন। দুইজন ‘সিজার’কে নিয়োগ দেন তিনি। ৩০৫ সনে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়েন ডিয়োক্লেশিয়ান, সঙ্গে সঙ্গে ধ্বসে পড়ে তার প্রবর্তিত এই ট্রেট্রার্কিক পদ্ধতি। বোঝা যায়, যোগ্য নেতা ছাড়া এমন পদ্ধতি একেবারেই অকার্যকর।
লো এম্পায়ার (৩০৫ থেকে ৪৭৬ সাল)
৩০৫ সনে ডিয়োক্লেশিয়ান ক্ষমতা ছাড়ার পর শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ৩১২ সালে কনস্ট্যানটাইন পশ্চিমের সম্রাট হন। তার এই জয় সরাসরি যীশু খ্রিষ্টের দয়ায় হয়েছে বলে ধরে নিয়ে, কনস্ট্যানটাইন বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেন। সাম্রাজ্যে সব ধর্মের প্রতি একটা সহনশীল পরিবেশ কায়েম হয়। এতে বিশেষ সুবিধা পায় খ্রিষ্ট ধর্ম। কনস্ট্যান্টাইনই অখণ্ড রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট, তার হাত ধরেই সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ধর্মের সম্মান লাভ করে খ্রিষ্ট ধর্ম।
এ সময়েই রোম থেকে সরিয়ে সাম্রাজ্যের রাজধানী নিয়ে যাওয়া হয় বাইযানটানিয়াম নামক প্রাচীন শহরে। ৩২৪ সনের ৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শহরটির নামকরণ করা হয় ‘কনস্টান্টিনোপল’ হিসেবে।
সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের তিন পুত্র- দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টাইন, দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস এবং কনস্ট্যানস, নিজেদের মাঝে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেন। অচিরেই তারা নিজেদের মাঝে লড়াই জড়িয়ে পড়েন। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টাইন এবং কনস্ট্যানস মারা পড়েন এই গৃহযুদ্ধে। এদিকে দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস তার আত্মীয়, জুলিয়ানকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন।
মাত্র দুই বছর রাজত্ব করেন সম্রাট জুলিয়ান, এরই মাঝে তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ হাতে নেন; বিশেষ করে সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের নিয়ম করেন। খ্রিষ্ট-ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং, কনস্ট্যান্টাইনের উক্ত ধর্মের প্রতি প্রদর্শিত অনুরাগকেই দায়ী করেন সাম্রাজ্যের পতনের জন্য। যদিও তখন পর্যন্ত সাম্রাজ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা বজায় ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে জুলিয়ান সরকারি সব গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে খ্রিস্টানদের সরিয়ে দিতে থাকেন। পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালীন সময়ে মৃত্যু হয় তার, সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে কনস্ট্যান্টাইন রাজবংশেরও।
এরপর জোভিয়ান ক্ষমতায় এসেই ধর্ম-সংক্রান্ত জুলিয়ানের সব নীতি পাল্টে, খ্রিষ্টান ধর্মকে আবার উপরে তুলে আনেন। তার অল্প সময়ের রাজত্বের পর সাম্রাজ্যের ভার এসে চাপে প্রথম থিয়োডসিয়াসের কাঁধে। কনস্ট্যান্টাইন এবং জোভিয়ানের কাজ সমাপ্ত করেন তিনি- পৌত্তলিকতাকে নিষিদ্ধ করেন এবং মন্দিরগুলোকে উচ্ছেদ করে স্থাপন করেন চার্চ।
রোমান সাম্রাজ্যের পতন
৩৭৬ সাল থেকে শুরু করে, পরবর্তী ছয় বছরে রোমকে সামলাতে হয় গথদের আক্রমণ। ৩৭৮ সালের ৯ আগস্ট, অ্যাড্রিয়ানোপলের যুদ্ধে পরাজিত হন রোমান সম্রাট ভ্যালেনস, এই যুদ্ধটাকেই ইতিহাসবিদেরা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বলে নির্দিষ্ট করেন। তবে এর অন্য মতও আছে। কেউ-কেউ এর জন্য দায়ী করেন খ্রিষ্ট ধর্মকে।
কারণ যাই হোক, ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর পতন ঘটে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের। জার্মানিক রাজা অডোয়াসের, রোমান সম্রাট রোমুলাস অগাস্টাসকে পরাজিত করেন এই দিনে।
তবে তখনো টিকে ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, বাইযানটান সাম্রাজ্য নামে অধিক পরিচিত এই সাম্রাজ্য আসলে টিকে ছিল সেই ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত। একাদশ কনস্ট্যান্টাইনের মৃত্যু এবং অটোমান তুর্কিদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতনের মাধ্যমে শেষ হয় তা।