গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশো বছর যারা পড়েছেন তারা কলা কোম্পানির গণহত্যার কথা নিশ্চয় মনে রেখেছেন। মাকান্দোর নিভৃত নিরিবিলি পরিবেশে কোত্থেকে এক ভুইফোড় মার্কিন কলা কোম্পানি প্রবেশ করে কী নিদারুণ ঘাপলাটাই না পাকিয়েছিল। সরকারও সে সময় কলা কোম্পানির পক্ষ নিয়ে খুব একচোট মার দিয়েছিল মজুরীর দাবিতে আন্দোলনরত জনগণকে। প্রত্যেক উপন্যাসের একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে। কাজেই কলা কোম্পানির এই কাহিনীর পেছনেও একটা বাস্তব ভিত্তি থাকা স্বাভাবিক। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাহলে কোত্থেকে পেলেন এহেনতর নৃশংস এক কোম্পানির কথা?
এখানেই সাহিত্য রূপ নিয়েছে বাস্তবে। মার্কেজের কলা কোম্পানি কল্পিত হতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি যা করেছিল তা নিছক রুঢ় বাস্তবতা। আসুন, জেনে নিই মধ্য আমেরিকার উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস।
ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি
১৮৭০ এর দিকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মিনর কেইথ আর লরেঞ্জো বেকার, দুই সুযোগসন্ধানী মার্কিন ব্যবসায়ী। কেইথ সদ্য গাদাখানেক টাকা খুইয়ে ফতুর হয়েছেন। আর লরেঞ্জো বেকার ওদিকে মধ্য আমেরিকা থেকে গোটা কয়েক কলা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসে বিক্রী করে টাকার গন্ধ পেয়েছেন। তার সাগরেদ ছিল জনৈক অ্যান্ড্রু প্রেস্টন। কেইথ-কে তারা নিজেদের বোস্টন ফ্রুট কোম্পানির সাথে জুড়ে নিলেন। প্রতিষ্ঠিত হল ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি। বিংশ শতাব্দী তখন সদ্য শুরু হচ্ছে। ১৯০১ সালের মধ্যে গুয়াতেমালায় তারা এত ক্ষমতাশীল হয়ে উঠলো যে সরকার তাদেরকে গুয়াতেমালার ডাক বিভাগের দেখভাল করবার দায়িত্ব তুলে দেয়। একইসাথে এই ফল কোম্পানি নিজেদের রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে। মধ্য আমেরিকার দেশগুলো তখন দুর্বল সরকার ব্যবস্থা আর অর্থনৈতিক জটিলতায় খাবি খাচ্ছে। দেশগুলোর তালিকায় ছিল জ্যামাইকা, কিউবা, কোস্টারিকা, পানামা, গুয়াতেমালা, হণ্ডুরাস, এল সালভাদর এবং কলম্বিয়ার উপকূলবর্তী প্রদেশগুলোর সরকার।
মার্কিন ফল ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা নিলো। মধ্য আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কলাসহ অন্যান্য উষ্ণমণ্ডলীয় ফলমূল রপ্তানি করা দারুণ লাভজনক ব্যবসা। ডলারের দাপটে লক্ষ লক্ষ একর জমি কিনে নিলো ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি। সস্তা মজুরিতে গরীব লোকদেরকে খাটিয়ে নিয়ে তারা প্রচুর ফলমূল ফলাতে করা শুরু করলো। ফুলে ফেঁপে উঠলো ব্যবসা। একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফল ব্যবসার ৯০ ভাগই এই কোম্পানির হাতে চলে যায়। মধ্য আমেরিকায় তাদের ছিল অপ্রতিহত ক্ষমতা। তিরিশের দশকে প্রায় ৩৫ লক্ষ একর জমির মালিকানা ছিল তাদের হাতে। গোটা অঞ্চলের রেল যোগাযোগও বলতে গেলে তারাই তৈরি করেছিল। একইসাথে এই কোম্পানি চেষ্টা করতো যাতে দেশের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকে। এমনটি হলে তাদের পরিবহন ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখবার সুবিধা হত।
ফল ব্যবসায়ীদের উৎপাত
ফল ব্যবসায়ীরা বিশেষ সাধু ছিলেন না। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, জলের দরে হাজার হাজার একর জমি কিনে নিয়ে তারা তাদের ব্যবসা গড়ে তুলেছিল। এখানকার শ্রমিকরা বেতন পেতই না বলতে গেলে। পরিবেশগত দিক দিয়েও এরা ছিল বেশ ক্ষতিকর। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ধ্বংস করে দিয়ে ফল গাছ লাগাতো। প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে দ্রুততম সময়ে যথাসম্ভব বেশি ফলন আদায় করবার চেষ্টা করতো। অতিরিক্ত সার প্রয়োগের ফলে এই সব জমির উর্বরতাও কয়েক বছরের মধ্যে একদম নষ্ট হয়ে যেত। নষ্ট হয়ে যাওয়া জমি ফেলে জমিখেকো এই কোম্পানি তখন আসন গাড়তো দূরের কোনো বনাঞ্চলে।
ফল কোম্পানিটির হাত কতদূর লম্বা ছিল তা একটি ঘটনার উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। গুয়াতেমালায় ১৯৫৪ সালে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে এরবানেজ গুজমান-এর সরকার। এরবানেজকে পশ্চিমা বিশ্ব খুব একটা সুনজরে দেখতো না। তার কর্মসূচীও কিছুটা বাম ঘরানার ছিল। কাজেই আরবানেজ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালাস সিআইএ আর অন্যান্য মার্কিন সংস্থাকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে খুব চাপ দিলেন আরবানেজকে দূরে হটানোর জন্য।
আরবানেজ আসলেই সোভিয়েত ঘেঁষা ছিলেন কিনা তা এখনো জানা যায় না। তবে এটা জানা যায় যে হণ্ডুরাস থেকে কাস্তিল্লো আর্মাস নামক জনৈক সেনা কর্মকর্তা গুয়াতেমালায় হানা দিয়ে আরবানেজকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। আরবানেজের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকার পরেও কেন সিআইএ এই অপারেশনে ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার ঢাললো? কারণ আরবানেজ কোম্পানিটির ক্ষমতা খর্ব করছিলেন। অভ্যুত্থানের মূল ইন্ধনদাতা জন ফস্টারের সাথে এই কোম্পানির বিশেষ দহরম মহরম থাকায় আরবানেজকে ক্ষমতা থেকে সরানো দরকার হয়ে পড়েছিল
এর থেকেও ভয়ানক কাণ্ড অবশ্য আছে। ১৯২৮ সালে কলম্বিয়ার সান্তা মার্তার কাছে কলার খামারের শ্রমিকেরা বেতন ভাতার দাবিতে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। জেনারেল ভার্গাসের সেনারা বেশুমার গুলি চালিয়ে তিন হাজার মানুষকে হত্যা করে। খুব সম্ভবত ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির নির্দেশেই সেনাবাহিনী এই কাজ করেছিল। যদিও পরে জেনারেল ভার্গাস বলেছিল, তাকে বলা হয়েছিল মার্কিন সেনারা কলম্বিয়া দখল করতে আসছে এবং এ জন্যই তিনি গুলি চালিয়েছেন। তবে হতদরিদ্র শ্রমিকদেরকে কোন যুক্তিতে হানাদার বাহিনী মনে হল সে বিষয়ে তিনি নীরব থাকেন। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির উত্তরাধিকার চিকুইতা ব্র্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল কলম্বিয়াতে কট্টর ডানপন্থী একটি গেরিলা গোষ্ঠীকে তিন হাজার একে-৪৭ রাইফেল আর ১৭ লক্ষ মার্কিন ডলার দিয়েছিলো প্রতিবাদী মজুরদেরকে শায়েস্তা করবার জন্য।
ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির বর্তমান
মধ্য আমেরিকায় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির উত্থান ও পতনের সময়কালকে মোটামুটি ১৮৭০ থেকে ১৯৭০ সাল, এই ১০০ বছর ধরা যায়। ১৯৭০ সালে এলি ব্ল্যাক নামক এক ধনকুবের কোম্পানিটি কিনে নিয়ে নতুন নামকরণ করেন ইউনাইটেড ব্র্যান্ডস কোম্পানি। ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের কারণে সৃষ্ট বিশ্বমন্দা এবং হণ্ডুরাসের প্রেসিডেন্টকে মোটা অংকের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ইউনাইটেড ব্র্যান্ডস কোম্পানির অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে। তাদের ক্ষমতা ও টাকা দুই-ই দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিল। এলি ব্ল্যাক ১৯৭৫ সালে আত্মহত্যা করেন। আরেক ধনকুবের কোম্পানিটি কিনে নিয়ে নতুন নামকরণ করেন চিকুইতা ব্র্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটি আজও এই নামেই ব্যবসা করছে। আজতক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফল ব্যবসা এদের হাতে কুক্ষিগত আছে। তবে অন্যান্য দেশে আগের মতো দৌরাত্ম্য চালানোর সুযোগ এখন আর তাদের হয় না।
ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির অবদান
মধ্য আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি আর সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি এক গুরুতর ভূমিকা পালন করে। বিখ্যাত মার্কিন লেখক ও হেনরী একবার হণ্ডুরাসে যান। সেখানে ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির দৌরাত্ম দেখে তিনি ব্যানানা রিপাবলিক তথা কলা প্রজাতন্ত্র নামটি দেন। অর্থনীতিকে কলা প্রজাতন্ত্র বলতে বোঝায় এমন কোনো দেশকে যার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই টালমাটাল এবং অর্থনীতির সমস্তটাই কোনো প্রধান ফসলের ওপর নির্ভরশীল। কলা প্রজাতন্ত্রের ভূত কোনো দেশের ওপরে চেপে বসলে তার জনগণের মধ্যে বিরাট ধনীদের একটা ছোট্ট অংশ সৃষ্টি হয়। এরাই তখন সরকার আর সেনাবাহিনীর সাহায্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রদেরকে পিষতে থাকে।
স্প্যানিশ আমেরিকার লোকেরা এই ফল ব্যবসায়ীদের অত্যাচার বিনা প্রতিরোধে মেনে নিয়েছিল ভাবলে ভুল হবে। কলম্বিয়ার জনপ্রিয় নেতা গাইতান ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তাকে খুন করা হয়। পরবর্তী দাঙ্গা হাঙ্গামা চলে ঝাড়া ১০ বছর ধরে। লা ভায়োলেন্সিয়া নামের এই হাঙ্গামায় প্রাণ হারায় ২ লক্ষ মানুষ। মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন, বামপন্থী রাজনীতি আর গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়ার পেছনে মূল অবদান এই ফ্রুট কোম্পানির।
মার্কেজের কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। গাইতানের হত্যাকাণ্ড আর লা ভায়োলেন্সিয়ার রক্তাক্ত প্রেক্ষাপট তাকে লেখক হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এছাড়াও ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন পাবলো নেরুদা কিংবা অগুস্তো মন্তেরেসোর মতো লেখকেরা। কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বারবার এই কোম্পানির বাড়াবাড়ির ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। ১৯৫৪ সালে যখন আরবানেজের সরকারকে তাড়ানো হচ্ছে, তখন প্রতিবাদী জনতার সাথে কাধ মিলিয়ে লড়েছিলেন সুদর্শন এক আর্জেন্টাইন, তার নাম আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে নিজেদের কর্মী ও কর্মীদের ছেলেমেয়ের জন্য ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি সস্তায় আবাসন, চিকিৎসা সেবা কিংবা পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এর বিপরীতে মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক খাতগুলোতে রীতিমত পচন ধরিয়ে দিয়েছিল এই কোম্পানি। মার্কেজের চরিত্রটি ঠিক কথাই বলেছিল, “কোন দুঃখে যে একটা গ্রিঙ্গোকে কয়েকটা কলা খেতে দিয়েছিলাম! এখন দেখ কি দুর্দশা আমরা ডেকে এনেছি।” লাতিন দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে গ্রিঙ্গো বলে ডাকা হয় অনেক সময়। এটি একটি অপমানসূচক শব্দ।
ফিচার ইমেজ: wikimedia commons