সমুদ্রপথে ইউরোপিয়ানদের অভিযান শুরু হয় চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে। অনিরাপদ জেনেও নতুন ভূখণ্ডের সন্ধানে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করতেন তখনকার নাবিকরা। তাদের মধ্যে সবাই অবশ্য সফল হয়নি। যারা সফল হয়েছেন তাদের সাফল্যমণ্ডিত গল্পগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর ইতিহাস একজনের পক্ষে একটু বেশিই সাক্ষ্য দেয়। কারণ তার মতো সাহসী ও দৃঢ়প্রত্যয়ী নাবিক ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়জন জন্মায়নি। বলছিলাম বিখ্যাত নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কথা। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে যিনি নতুন বিশ্বের সন্ধানে বেরিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকায় পৌঁছাতে সক্ষম হন।
কলম্বাসের অভিযানগুলোর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীন অভিমুখী অভিযানটি বিখ্যাত। তৎকালীন স্প্যানিশ রানী ইসাবেলার পূর্ণ সমর্থন ও আর্থিক সহায়তায় কলম্বাস এই অভিযানের উদ্যোগ নেন। ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট দক্ষিণ স্পেনের প্যালস বন্দর থেকে ৩টি জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন কলম্বাস। জাহাজগুলোর মধ্যে লা সান্তা ক্লারা (নিনা) এবং লা পিন্টা ছিলো অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির। আধুনিক যুগের জাহাজ অপেক্ষা ছোট এই জাহাজ দুটোর আকার ছিলো ৫০ থেকে ৭০ ফুট পর্যন্ত। যদিও দ্রুতগতির কারণে জাহাজ দুটি কলম্বাসের অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতো।
কলম্বাসের ভারত অভিমুখী অভিযানের তৃতীয় বড় জাহাজটির নাম সান্তা মারিয়া। মালামাল পরিবহন এবং অভিযান থেকে পাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে ফেরার জন্য এই কার্গো জাহাজটি ব্যবহার করতেন তিনি। ৮৬ জন স্প্যানিশ নাবিককে সঙ্গে নিয়ে তার পশ্চিম অভিমুখী যাত্রা চলেছিল একটানা ৩৫ দিন। উপকূলের সন্ধান পাওয়ার পর কলম্বাস এবং তার সঙ্গীরা যে আনন্দ-উৎসব করেছিলেন তা অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ প্রকৃতপক্ষে তারা চীন কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছাতে পারেননি।
কিন্তু দীর্ঘ এই সমুদ্রযাত্রায় ছোট আকৃতির জাহাজ দুটো নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়াটা ছিলো সত্যিই বিস্ময়কর। সান্তা ক্লারা এবং পিন্টা ছোট এবং দ্রুতগতি সম্পন্ন হওয়ায় এগুলোকে বলা হতো ক্যারাভেল। ভারত অভিমুখী অভিযানের পূর্বে কলম্বাসকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে গিয়ে রানী ইসাবেলা প্রজাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি জাহাজগুলোর প্রশংসা করেন।
কলম্বাসের রোমাঞ্চকর জীবনের উত্থান, অভিযান এবং সফলতা সম্পর্কে অনেক সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত গল্প রয়েছে। তেমনিভাবে এই জাহাজগুলো তার সফলতা এবং ব্যর্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চলুন জেনে নেয়া যাক কলম্বাসের জাহাজগুলো সম্পর্কে।
১৫ শতাব্দীর দ্রুতগামী জাহাজগুলোর ধরন
দ্রুতগামী, ছোট জাহাজসমূহ ক্যারাভেল নামে বিখ্যাত। সমুদ্র অভিযানে সর্বপ্রথম এই ধরনের জাহাজের প্রচলন ঘটায় পর্তুগিজরা। চৌদ্দ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আফ্রিকা উপকূলে অভিযানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো বাতাস। প্রচন্ড সামুদ্রিক বাতাসের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলা কিংবা বিপরীতে চলার সুবিধার্থে ছোট, সরু আকৃতির এসব ক্যারাভেল তৈরি করেন পর্তুগিজ নাবিকরা। তাদের তৈরি জাহাজগুলোর স্থানীয় নাম ‘ক্যারাভেলা লাতিনা’।
উপ-সাহারা আফ্রিকান উপকূলে উত্তর থেকে দক্ষিণ অভিমুখে প্রবল বেগে বাতাস বয়। পর্তুগিজদের জাহাজগুলো এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে করে তীব্র বেগেও এগুলো বাতাসের বিপরীতে চলতে পারে। বহুমুখী গুণে গুণান্বিত এই ধরনের জাহাজের পালের ধরন ছিলো অনেকটা ডানার মতো। মূলত বাতাসের দিক অনুযায়ী জাহাজ চালনার সুবিধার্থে এগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হতো। টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটির নটিক্যাল প্রত্নতত্ত্ববিদ লুইস ফিলিপে ভিয়েরা ডি কাস্ত্রো এই প্রসঙ্গে বলেন,
পর্তুগিজদের তৈরি ক্যারাভেলের পালগুলো দেখতে ডানার মতো। নাবিকরা চাইলে বাতাসের অভিমুখে ২০ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্বে জাহাজের পাল স্থাপন করতে পারতেন। এমন অবস্থাতেও জাহাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বাইরের প্রান্তে পর্যাপ্ত সুবিধা পাওয়া যেত। স্বাভাবিক অবস্থায় জাহাজের পালসমূহ ডেকের সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণে স্থাপন করা হয়েছিল।
কলম্বাস নিজের অভিযানের জন্য ক্যারাভেল তৈরির ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনেন। ক্যারাভেলের স্প্যানিশ সংস্করণটি ‘ক্যারাভেলা রেদোন্দা’ নামে বিখ্যাত। কলম্বাস জাহাজে তিনটি লম্বা পোল ব্যবহারের প্রচলন ঘটান। প্রথম দুটি পোলে বর্গাকার পাল যুক্ত করা হয়েছিল যাতে করে উন্মুক্ত সমুদ্রে জাহাজ চালনা করা যায়। তৃতীয় পোলে পর্তুগিজদের লাতিন ক্যারাভেলের মতো পাল যুক্ত করা হয়েছিল যাতে উপকূলবর্তী ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে জাহাজ ঠিকমতো চলতে পারে। নতুন এই পদ্ধতির কারণে সান্তা ক্লারা এবং পিন্টা সেই সময়ের সেরা জাহাজ হিসেবে সুখ্যাতি পায়।
পনেরো শতাব্দীর শেষে কলম্বাস ও তার স্থপতিরা আরও কয়েকবার জাহাজে নতুনত্ব আনেন। সে সময়ের সফলতম সংস্করণ ছিলো জাহাজের পাল নতুন স্থানে সংযোজন করা। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নাবিকরা চৌদ্দ শতাব্দীতে জাহাজের দুই পাশে পাল সংযোগ করতেন। আর এই নিয়মটি বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো। ভিয়েরা ডি কাস্ত্রোর মতে, জাহাজে পালের এমন ব্যবহার নরওয়ের ভাইকিংসদের সময় থেকে চলছিল। জাহাজের কেন্দ্রস্থল থেকে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে ভেবে কলম্বাস জাহাজের পাল এবং নিয়ন্ত্রণ মাঝের অংশে স্থাপন করেন।
ছোট জাহাজগুলো যেমন সুবিধাজনক তেমনই বিপজ্জনক
কলম্বাসের ছোট জাহাজগুলোর মধ্যে সান্তা ক্লারা এবং পিন্টার ধারণক্ষমতা ছিলো ৪০ থেকে ৫০ টন। এই পরিমাণ মালামালসহ সর্বোচ্চ ৩০ জন নাবিককে বহন করতে পারতো জাহাজ দুটি। গভীর সমুদ্রে ভালোভাবে চলাচলের সুবিধার্থে এগুলোকে কম ওজন ও আয়তনে তৈরি করা হয়েছিল। কারণ, কলম্বাসের বেশিরভাগ অভিযানই ছিলো দূরদূরান্তে। যার ফলে এই জাহাজগুলো তার অভিযানে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো।
কিন্তু অগভীর সমুদ্রে কলম্বাস ছোট জাহাজ দুটি নিয়ে বিপাকে পড়েন। ক্যারিবিয়ান উপকূলে অভিযানের সময় কিউবার নিকটবর্তী অগভীর সমুদ্রে জাহাজগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গতিতে চলছিল। এছাড়াও সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৫০ টন তখন জাহাজগুলোর জন্য বেশি মনে হচ্ছিল। নাবিকরা অগভীর সমুদ্রে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিপদে পড়েন। যদিও পরবর্তীতে এই সমস্যার সমাধান করে কিউবা উপকূল থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন কলম্বাস।
কলম্বাসের সবচেয়ে বড় জাহাজ হিসেবে পরিচিত সান্তা মারিয়ার ধারণক্ষমতা ছিলো ১১০ টন। অন্য জাহাজের তুলনায় এটি আকারে যেমন বড় ছিলো তেমনই এতে নাবিকদের থাকার ব্যবস্থাও ছিলো। ছোট ছোট কেবিনে নাবিকরা সময়মতো বিশ্রাম নিতে পারতেন। এছাড়াও প্রতি ৮ ঘন্টা পর পালাক্রমে ঘুমাতেও পারতেন তারা। যদিও ১৪৯২ সালের ক্রিসমাসে হাইতি উপকূলে সান্তা মারিয়া জাহাজটি ডুবে যায়। অন্যদিকে, সান্তা ক্লারা এবং পিন্টাতে নাবিকদের জন্য কোনো কেবিনের ব্যবস্থা ছিলো না। কেউ বিশ্রাম নিতে চাইলে ডেকের উপর শুয়ে পড়তে হতো। জাহাজগুলোতে একটি করে ছোট কেবিন ছিলো যাতে শুধুমাত্র জাহাজের ক্যাপ্টেন থাকতেন।
১৫ শতাব্দীর জাহাজে কাজ করা ছিলো খুবই বিপজ্জনক। শুধুমাত্র কলম্বাসের জাহাজ নয়, স্পেন কিংবা ইউরোপিয়ান অভিযাত্রীদের তৈরি প্রায় সকল জাহাজেই নাবিকদের থাকার ব্যবস্থা ছিলো না। কখনও কখনও জাহাজের ক্যাপ্টেনের জন্যও কোনো কেবিন রাখা হতো না। সান্তা ক্লারা এবং পিন্টায় ২০ জন নাবিক ও ২৬ জন ক্রু সার্বক্ষণিক কাজে ব্যস্ত থাকতো। ঢেউয়ের প্রকৃতি ও বাতাসের বেগ হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিনিয়ত পাল তোলা, শক্ত দড়ি বাঁধা, পালের দিক পরিবর্তন করার মতো কাজগুলো করতেন এসব নাবিক। ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত মেরিনার মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ মার্ক নুকাপ বলেন,
সেকালে ক্যারাভেলে অবস্থান করা লোকেরা যেখানে কাজ করতো সেখানেই ঘুমাতো। কেউ চাইলেই অন্য নাবিকদের থেকে দূরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারতো না। তখন ক্যাথিড্রাল, দুর্গ এবং জাহাজ ছিলো মানুষের তৈরি সবচেয়ে জটিল স্থাপনা। আর এগুলোতে সার্বক্ষণিক কিছু না কিছু কাজ করতেই হতো।
অভিযানে জাহাজের খাবারদাবার
প্রতিটি অভিযান শুরু করার পূর্বে কলম্বাস মোটামুটি ১ বছরের খাবারদাবার জাহাজে মজুদ রাখতেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, কলম্বাস স্পেনে ফিরে আসা অবধি যে পরিমাণ খাবার প্রয়োজন হতে পারে ঠিক ঐ পরিমাণ খাবারই সঙ্গে নিতেন। কারণ তিনি বরাবরই গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। যদিও এই বিষয়টি তিনি কাউকেই বুঝতে দেননি। জাহাজে খাবারগুলো বেশিদিন সংরক্ষণ করতে সেগুলো শুকনো হওয়া আবশ্যক ছিলো।
কলম্বাসের অভিযানে শুকনো এবং নুনযুক্ত ছোট মাছ, কড, আঁচার, নুনযুক্ত গরুর মাংস, শুয়োরের মাংস, শুকনো দানা, ছোলা, মসুর ডাল, মটরশুঁটির মতো খাবারগুলো ছিলো উল্লেখযোগ্য। তবে সে সময় নাবিকদের নিকট সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার ছিলো হার্ডটেক বিস্কুট। এই বিস্কুট শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ bis coctus থেকে যার অর্থ দুবার সেঁকা। প্রথমে ময়দা গুলে খন্ড খন্ড করে তাতে পানি দিয়ে বিস্কুটের আকার প্রদান করার পর সেগুলোকে তাপে সেঁকা হতো।
অতঃপর তৈরিকৃত বিস্কুটগুলোক পুনরায় ভেঙে গুড়া করা হতো এবং ঐ বিস্কুটের গুড়ায় পানি মিশিয়ে নতুন আকৃতি প্রদান করে দ্বিতীয়বার সেঁকা হতো। এই প্রক্রিয়ায় বিস্কুটগুলো কাঠের মতো শক্ত হতো যা পানিতে চুবিয়ে খাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো উপায় ছিলো না। কলম্বাসের নাবিকদের মাঝে এই হার্ডটেক বিস্কুট বড় কাঠের পাত্রে পরিবেশন করা হতো। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ১৪ বছর বয়সী পুত্র ফার্দিনান্দ কলম্বাস আমেরিকা অভিমুখী চতুর্থ অভিযান সম্পর্কে বলেন,
জাহাজের খাবারগুলোয় পোকার উপদ্রব হয়েছিল। দাঁতভাঙার মতো শক্ত হওয়ার পরেও অন্যসব খাবার অপেক্ষা সবাই হার্ডটেক বিস্কুটের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলো। এমনকি পুরোনো বিস্কুটে পোকা থাকলেও নাবিকরা সেগুলো খেতে দুবার ভাবেনি। তখন নাবিকরা মনে করতো বিস্কুট পরিস্কার করতে গেলে কিছুটা বিস্কুট নষ্ট হতে পারে।