ইতিহাসে দুটি বিশ্বযুদ্ধের কথা লেখা আছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষ্যমতে সেভেন ইয়ার্স ওয়ার’ই (সাত বছরের যুদ্ধ) সত্যিকার অর্থে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তার কথার পেছনে যুক্তি আছে। সেভেন ইয়ার্স ওয়ার সম্ভবত অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া আর সব মহাদেশকেই স্পর্শ করেছিল। মোটামুটিভাবে তখনকার সব পরাশক্তিই কোনো না কোনোভাবে এই যুদ্ধে জড়িত ছিল। সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল আমেরিকাতে, যা ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ, পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল, ভূমধ্যসাগর, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ভারত এবং ফিলিপাইনসেও। প্রুশিয়ার তৎকালীন সম্রাট ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের হিসেবে এই লড়াই কেড়ে নিয়েছিল প্রায় দুই লাখ প্রুশিয়ান সেনার প্রাণ, বিপরীতে শত্রুরা হারিয়েছিল প্রায় সাত লাখ সেনা।
এই সংঘাত প্রুশিয়াকে নিয়ে গিয়েছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রায় অর্ধ মিলিয়ন প্রুশিয়ান নাগরিক হতাহত হয়েছিল। যুদ্ধশেষে রাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামো ছিল ভগ্নপ্রায়। তবে ফ্রেডেরিকের সম্মান ও প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। ফ্রেডেরিকের অদম্য মানসিকতা, তার সেনাদের লড়াকু মনোভাব প্রশংসা কুড়োলেও আদতে তাকে ধংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল ভাগ্য।
এক অর্থে সেভেন ইয়ার্স ওয়ার পূর্বের অস্ট্রিয়ান সাকসেশন যুদ্ধেরই চলমান রূপ। ইক-লা-শ্যাপেল চুক্তি রনক্লান্ত ইউরোপিয়ান রাজতন্ত্রগুলোকে দম ফেলার ফুরসত করে দিয়েছিল মাত্র, কারণ সত্যিকারভাবে কেউই এই চুক্তি নিয়ে খুশি ছিল না। মারিয়া থেরেসা সিলিসিয়ার ক্ষতি হজম করতে পারছিলেন না। ওদিকে ফরাসিরা হাবসবুর্গদের ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিকল্পনা সফল করতে পারেনি, ইংল্যান্ডের সাথে ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইও অমীমাংসিত। আবার সিলিসিয়া করায়ত্ত্ব করেও ফ্রেডেরিকের খাঁই মেটেনি, তার দরকার আরো জমি। রাশিয়া ভাবছিল, “হুঁহ! আমি তো খেলাই শুরু করিনি।” কাজেই আরেকটি যুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী।
সময়
সেভেন ইয়ার্স ওয়ার চলেছিল ১৭৫৬-৬৩ সাল অবধি। তবে এটি আনুষ্ঠানিক সময়সীমা। ১৭৫৬ সাল প্রথাগতভাবে যুদ্ধ ঘোষণার পর সমাপ্তি টানা হয় ১৭৬৩ সালে, প্রধানত প্যারিস শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। তবে সত্যিকারভাবে ১৭৫৪ সালে থেকেই আমেরিকান উপনিবেশে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে সংঘাত বেঁধে যায়। সে হিসেবে যুদ্ধ চলেছিল আসলে নয় বছর (১৭৫৪-১৭৬৩) ।
মূল কুশীলব
- পঞ্চদশ লুই, ফ্রান্সের সম্রাট
- ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জর্জ
- প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট
- রাশান সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ
- অস্ট্রিয়ান সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা
- স্পেন, পোল্যান্ড, বোহেমিয়া, নেদারল্যান্ডস, স্যাক্সোনি, সুইডেনও বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
পেছনের কথা
সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের আগে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ইউরোপে জোটের মেরুকরণের একটি প্রথাগত পদ্ধতি চালু হয়ে গিয়েছিল। অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্স ছিল মুখোমুখি। ফ্রান্সের বিপক্ষে অস্ট্রিয়ার বন্ধু ইংল্যান্ড, ওদিকে প্রুশিয়া নিজেদের ভাগ্য জুড়ে নিয়েছিল ফরাসি সমর্থনের সাথে। রাশিয়াও ফ্রান্সকে শত্রু হিসেবেই দেখত। কিন্তু সমকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৫৬ সালের ভেতরে এই ছক সম্পূর্ণ উল্টে যায়, যাকে বলা হয় ডিপ্লোম্যাটিক রেভ্যুলিউশন (Diplomatic Revolution)। ব্রিটিশরা জোট বাধে প্রুশিয়ার সাথে। অন্যদিকে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া মিলে যায় একবিন্দুতে।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জর্জ তার জন্মস্থান হ্যানোভারের ইলেক্টর। তার কাছে জন্মভূমির নিরাপত্তা মুখ্য। তিনি শঙ্কিত ছিলেন প্রুশিয়া আর ফ্রান্সকে নিয়ে। ১৭৪৭ সালের ২৯ মে সম্পাদিত এক চুক্তি মোতাবেক ফ্রান্স আর প্রুশিয়া তখন মিত্র। তারা যে কেউ যেকোনো সময় সহজেই হ্যানোভার আক্রমণ করে বসতে পারে। ইংল্যান্ড থেকে সহায়তা পাঠানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফ্রান্সের সাথে উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে তখন দ্বন্দ্ব তুঙ্গে, বিশেষ করে আমেরিকা আর ভারতে। জর্জের ভয় ছিল হ্যানোভার দখল করে ফ্রান্স এই ব্যাপারে তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
জর্জের আশঙ্কা পুরোটা অমূলক ছিল না। ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের লক্ষ্য ছিল হ্যানোভার ছাড়াও পোল্যান্ড পর্যন্ত ফরাসি সীমানা প্রসারিত করা এবং সুইডেন ও তুরস্ককে ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের ভেতর নিয়ে আসা। এই লক্ষ্যে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অগোচরেই লুই ল্যু সিক্রেট দ্যু র্যুঁ (le Secret du roi) নামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বাধীন একটি গুপ্ত সংগঠনের প্রবর্তন করেন। এর লোকদের কাজই ছিল লুইয়ের উদ্দেশ্য পূরণে গোপন কূটনৈতিক মিশন পরিচালনা করা। পোল্যান্ডের প্রতি রাশিয়ারও প্রবল আগ্রহ যাদের স্বার্থ কিনা ফ্রান্সের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যে কারণে লুই বেছে বেছে রাশিয়া বিরোধী লোকদেরকেই বেশি করে দলে নিতেন।
এদিকে ইক-লা-শ্যাপেল চুক্তির আগে ১৭৪৬ সালের জুনে অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া এক সমঝোতায় উপনীত হয়। সমঝোতার মূল কথা ছিল নিজ নিজ সার্বভৌমত্ব এবং পোল্যান্ডের ভূখণ্ড রক্ষায় তারা একে অপরকে সহযোগিতা করবে। প্রুশিয়ার ফ্রেডেরিককে তৎকালীন রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। তিনি জানতেন প্রুশিয়া সুযোগ পেলেই পোল্যান্ডে নাক গলাবে। কাজেই সমঝোতার গোপন একটি ধারা ছিল এই যে- প্রুশিয়ার সাথে কোনো পক্ষের সংঘাত সূচীত হলে তারা একত্রে ফ্রেডেরিকের মোকাবেলা করবে। উদ্দেশ্য হবে প্রুশিয়ার ক্ষমতা ধ্বংস করে নিজেদের মধ্যে তাকে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া। কথা ছিল, পূর্ব প্রুশিয়া তুলে দেয়া হবে পোল্যান্ডের হাতে, তারা কুরল্যান্ড (Courland) অঞ্চল বিনিময়ে রাশিয়াকে দিয়ে দেবে।
রাশিয়ান গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর (পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমতুল্য) আলেক্সেই পেত্রোভিচ (Aleksey Petrovich) প্রুশিয়ার উপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর পক্ষপাতি ছিলেন। তবে অস্ট্রিয়ার পক্ষে আলোচনা পরিচালনাকারী কর্মকর্তা প্রিন্স কুনিৎজ (Wenzel Anton von Kaunitz) হঠকারী ছিলেন না। তিনি পেত্রোভিচকে বোঝালেন- ফরাসিরা যতদিন প্রুশিয়াকে সমর্থন দিতে থাকবে ততদিন ফ্রেডেরিককে না ঘাঁটানোই ভাল। অস্ট্রিয়ার তৎকালীন মিত্র ইংল্যান্ড ১৭৫০ সালে এই চুক্তিতে সায় দেয়, তবে প্রুশিয়ার বিপক্ষে গোপন ধারা তারা অনুমোদন করেনি। ফলে কুনিৎজ প্রুশিয়াকে কায়দা করতে ফরাসি-অস্ট্রিয়ান একটি জোটের রূপরেখা চিন্তা করতে থাকেন।
১৭৫০ সালে মারিয়া থেরেসা তাকে পাঠালেন ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত করে। সেখানে তিন বছর থাকাকালে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে সক্ষম হন, যারা পরবর্তীতে ফরাসি আর অস্ট্রিয়ার মিত্রতায় সাহায্য করে। তবে তিনি ফ্রান্স-রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং ফ্রান্সকে প্রুশিয়ার বিপক্ষে উস্কে দিতে ব্যর্থ হন। ফ্রান্সের দায়িত্ব পালন শেষে মারিয়া থেরেসা কুনিৎজকে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
ইংল্যান্ড হ্যানোভারের ব্যাপারে কুনিৎজের সাথে আলোচনা করল। হ্যানোভার বিষয়ে অস্ট্রিয়ার সমর্থন যোগাতে তারা মারিয়া থেরেসার ছেলে জোসেফকে পরবর্তী হলি রোমান এম্পেরর নির্বাচনে সমর্থনের আশ্বাস দেয়। কিন্তু ফ্রেডেরিক এর বিরোধিতা করেন। জার্মান রাজ্যগুলো ফ্রেডেরিকের কথার উপর কথা বলার সাহস রাখত না, ফলে সেই মুহূর্তে জোসেফের প্রার্থিতা ঝুলে গেল। তবে মারিয়া থেরেসার ধ্যানজ্ঞান ছিল সিলিসিয়া। ফ্রেডেরিক, ব্রিটেন আর ফ্রান্সের ঝগড়ায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে কুনিৎজ ব্রিটিশদের পরামর্শ দেন জার্মান আর রাশিয়ান সেনাদের ব্যবহার করে তারা হ্যানোভার এবং দক্ষিণ নেদারল্যান্ডস রক্ষা করুক।
দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের গুরুত্ব ছিল এই কারণে যে সেখান থেকে আগে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ডাচদের সামরিক শক্তি হ্রাস পাওয়ায় সেই এলাকা রক্ষার্থে তাদের কাছ থেকে কুনিৎজ খুব বেশি কিছু আশা করছিলেন না। তিনি এমনকি ফরাসিদের সাথে শান্তির বিনিময়ে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস লুইয়ের কাছে তুলে দেবার কথাও ভেবেছিলেন। ব্রিটিশরা তার ভাবভঙ্গিতে ভরসা পাচ্ছিল না।
এদিকে ১৭৫৪ সালে থেকেই আমেরিকাতে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের বিবাদ সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয়। তৎকালীন ইউরোপীয় শক্তিগুলোর তুলনায় ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনী ছিল বেশ ছোট। তাই তারা ইউরোপে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে বাইরে ফ্রান্সের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অস্ট্রিয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে ১৭৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে অনুযায়ী লিভোনিয়া-লিথুয়ানিয়া সীমান্তে ৫৫,০০০ রাশিয়ান সৈন্য সমাবেশ করা হয়, যাদের দায়িত্ব ছিল হ্যানোভার আক্রান্ত হলে সহায়তায় এগিয়ে যাওয়া। এজন্য বার্ষিক এক লাখ পাউন্ড করে ইংল্যান্ড রাশিয়াকে চুক্তির সময়কালে দিয়ে যাবে, আর হ্যানোভারের দিকে অভিযান প্রয়োজন হলে অতিরিক্ত আরো চার লাখ পাউন্ড দেয়া হবে। সৈন্য ছাড়াও রাশিয়া ৪০টি জাহাজ ইংল্যান্ডকে ধার দেয়। তবে হ্যানোভার রক্ষা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি দূরত্ব ছিল। ইংল্যান্ডের কাছে রক্ষা মানে ছিল ফ্রান্স এবং রাশিয়ান দুই শত্রুর হাত থেকেই রক্ষা, অন্যদিকে রাশিয়া ধরে নিয়েছিল শুধুমাত্র প্রুশিয়ার দ্বারা আক্রান্ত হলেই তাদের সাহায্য চাওয়া হবে।
প্রুশিয়ায় বসে ফ্রেডেরিক বেখবর ছিলেন না, তার গুপ্তচরেরা সব খবরই এনে দিচ্ছিল। ইংল্যান্ড-রাশিয়ার চুক্তি হচ্ছে শুনে তিনি ব্রিটিশদের কাছে বার্তা দিলেন যে হ্যানোভার নিয়ে তার কোনো আগ্রহই নেই। ফ্রেডেরিক আসলে চাচ্ছিলেন স্যাক্সোনি, যা ছিল পোলিশ রাজা ফ্রেডেরিক অগাস্টাসের এলাকা। পোল্যান্ড থেকে স্যাক্সোনি ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, প্রুশিয়া এবং বোহেমিয়ার মধ্যে। কিন্তু তিনি জানতেন আগ বেড়ে বোহেমিয়া বা স্যাক্সোনিতে অভিযান চালালে মিত্র ফ্রান্স তা ভালভাবে নেবে না। সেদিকে এক চোখ রেখে ফ্রেডেরিক ইংল্যান্ডের সাথে বোঝাপড়া করলেন যে জার্মান ভূখণ্ডে তারা যেকোনো বহিঃশত্রুকে প্রতিরোধ করবেন, এর ফলে দ্বিতীয় জর্জ নিশ্চিত হন যে ফরাসিরা হ্যানোভার আক্রমণ করতে এলে ফ্রেডেরিক রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। ১৭৫৬ সালের ১৫ জানুয়ারি কনভেনশন অফ ওয়েস্টমিনস্টার (Convention of Westminster) একে আনুষ্ঠানিক রূপ দিল।
ফ্রেডেরিক আশা করেছিলেন এর ফলে ইংল্যান্ড রাশিয়াকে তার বিরুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবে।কিন্তু ঘটনা হল উল্টো। সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ এবং রাশিয়ান গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর কনভেনশন অফ ওয়েস্টমিনস্টারকে তাদের সাথে ইংল্যান্ডের করা চুক্তির বরখেলাপ বলে দাবি করলেন। তারা ব্যাখ্যা চাইলেন তাহলে কেন প্রুশিয়াকে রুখতে রাশিয়ার সহায়তা চাওয়া হলো। ইংল্যান্ড থেকে উত্তর এলো চুক্তি প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে করা হয়নি, ফরাসিদের জন্য করা হয়েছে। এই চুক্তি সম্রাজ্ঞী আর অনুমোদন দিলেন না।
ফ্রান্সও প্রুশিয়াকে বিশ্বাসঘাতক অভিহিত করে গোপনে ল্যু সিক্রেট দ্যু র্যুঁ থেকে অ্যালেক্সান্ডার ম্যাকেঞ্জি নামে এক জ্যাকোবাইটকে সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রেরণ করে। ফলে তলে তলে ফরাসি-রাশিয়ান পুনর্মিলনী শুরু হলো। রাশিয়া অস্ট্রিয়ার দিকেও বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করল। ১৭৫৬ সালের এপ্রিলে ৮০,০০০ রাশান সৈন্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো প্রুশিয়ার উপর হামলা করতে। মারিয়া থেরেসার মতো সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথও চাইছিলেন ফ্রেডেরিকের ধ্বংস, সাথে উপরি হিসেবে পোল্যান্ডের জমি এবং ফ্রান্সের নীরবতা। সুইডেন এবং তুরস্ক যাতে বাগড়া না দেয় সেদিকেও তার নজর ছিল।
অস্ট্রিয়া ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের কাণ্ডকারখানায় বিরক্ত হয়ে প্রকাশ্যে ফ্রান্সের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। বলা হয়, মারিয়া থেরেসা এজন্য পঞ্চদশ লুইয়ের প্রিয় মিস্ট্রেস মাদাম পম্পাদুরকে কাজে লাগিয়েছিলেন, যার বেশ প্রভাব ছিল লুইয়ের উপরে। ১৭৫৬ সালের পয়লা মে প্রথম ভার্সাই চুক্তির (First Treaty of Versailles) মাধ্যমে ব্রিটেন-ফ্রান্সের লড়াইয়ে অস্ট্রিয়ান নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়। আক্রান্ত হলে পরস্পরকে ২৪,০০০ সেনা সহায়তা দেবারও অঙ্গিকার করা হলো। সংঘর্ষ আরম্ভ হলে পরের বছর দ্বিতীয় ভার্সাই চুক্তিতে অস্ট্রিয়া সিলিসিয়াতে সেনা সাহায্যের বিপরীতে নেদারল্যান্ডসের হাবসবুর্গ শাসিত ভূখণ্ডের অনেক এলাকাই ফ্রান্সের হাতে তুলে দেয়।
এদিকে ১৭৫৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে রাশিয়াও আনুষ্ঠানিকভাবে ভার্সাই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু চুক্তির একটি ধারা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। পোল্যান্ডের ব্যাপারে ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সাংঘর্ষিক নীতি তাদের একজোট হবার প্রধান অন্তরায় ছিল। রাশিয়াকে শান্ত করতে ফরাসি সরকারের প্রতিনিধি ম্যাকেঞ্জি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেন রাশিয়া এবং তুরস্কের লড়াইয়ে ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের পক্ষাবলম্বন করবে। এদিকে ফ্রান্স আর অটোমানদের বোঝাপড়া ছিল ভাল, সেদিক চিন্তা করে ফরাসি সরকার এই ধারা অনুমোদন দিলনা। চুক্তি ভেঙে যাবার উপক্রম হলে পঞ্চদশ লুই নিজ হাতে পত্র লিখে এলিজাবেথকে পাঠালে সব কূল রক্ষা পেল। তবে তুরস্কের ব্যাপারে ধারা বাতিল করা হয়।
রাশিয়া আর ফ্রান্সের গলার কাঁটা পোল্যান্ড। দুই পক্ষই পোলিশ রাজ্যে নিজের প্রভাব বাড়াতে চায়। বহু বাকবিতণ্ডার পর রাশিয়াকে পক্ষে রেখে অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স আর পোল্যান্ডের প্রতিনিধিত্বকারী স্যাক্সোনির মধ্যে সমঝোতা হয়, যা অনুমোদিত হয় যুদ্ধ শুরু হবার পর। সেই মোতাবেক রাশিয়া পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক না গলানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে ফরাসিরা ইংল্যান্ডের তরফ থেকে রাশিয়ার যে পরিমাণ অর্থ পাবার কথা সেই পরিমাণ টাকা তাদের দেবার অঙ্গিকার করে। সুইডেনকেও জোরপূর্বক রাশিয়া নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসে। সুতরাং বহু বছরের মিত্রতা ভেঙে গিয়ে ব্রিটেন-প্রুশিয়ার বিপক্ষে গঠিত হলো ফরাসি-অস্ট্রো-রাশান জোট। দাবার সব গুটি এখন জায়গামত বসে গেছে। শুধু দরকার বারুদে স্ফুলিঙ্গ।
সূচনা
ভূমধ্যসাগরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের জের ধরে ১৭৫৬ সালের এপ্রিলে ফরাসিরা মিনোর্কা (Minorca) দ্বীপে ব্রিটিশ ঘাঁটিতে হামলা করলে ইংল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেয়। মিত্রতার কারণে প্রুশিয়া তাদের সাথে জড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সের সাথে জোটের দুই সদস্য অস্ট্রিয়া আর রাশিয়া দ্রুত প্রুশিয়ার কাছে সৈন্য সমাবেশ করল। পশ্চিমে ফ্রান্স, উত্তরে রাশিয়া আর সুইডেন, এবং দক্ষিণে সিলিসিয়ার সীমান্তে দেড় লাখ অস্ট্রিয়ান সেনা তিনদিক থেকে ফ্রেডেরিককে ঘিরে ফেলে। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না এই ভাব ধরে ফ্রেডেরিক তাদের কাছে এত সেনা প্রুশিয়ার নিকটে নিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু তলে তলে নিজের মতো পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেললেন। আগস্টের ২৯ তারিখ ঢুকে পড়লেন স্যাক্সোনিতে। পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ হলো মহাযুদ্ধ।