মিখিয়েল ডি রুইটার (পর্ব-১৯): স্পেনের সাহায্যে ডি রুইটার

[১৮ তম পর্ব পড়ুন]

২৪ জুলাই, ১৬৭৫। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এস্টেট জেনারেলদের থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন ডি রুইটার। এস্টেট জেনারেলরা নির্দেশ দিলেন যাত্রাপথে সুইডিশ জাহাজ দেখলেই আক্রমণ করার। লুইয়ের মিত্র হিসেবে সুইডিশরা তাদের শত্রু বলেই গণ্য।

ডি রুইটার এস্টেট জেনারেলদের আদেশ পালনে হেল্ভেটস্লুইসের বন্দরে অপেক্ষমান বহরের সাথে যোগ দিলেন। উঠে পড়লেন এন্ড্রাট (Eendraght) জাহাজে। সাথে দেয়া বহর ফরাসিদের বিপুল শক্তির তুলনায় নস্যি জেনেও তার ভাবান্তর নেই।

বন্দর ত্যাগ করছে ডাচ নৌবহর; Image Source: Wikimedia Commons

কিন্তু প্রতিকূল বাতাস তাদের যাত্রা শুরুর বাধা হয়ে দাঁড়াল। অবশেষে ১১ আগস্ট শেষবারের মতো নেদারল্যান্ডসের সীমানায় শ্বাস নিলেন ডি রুইটার। তার নেতৃত্বে বহর বেরিয়ে এলো খোলা সাগরে। তার উপর নির্দেশ ছিল প্রথমে জার্মানির ব্ল্যাঙ্কেনবার্গ অথবা ফ্রান্সের নিকটবর্তী ডানকার্কে নোঙর করে কিছুদিন অপেক্ষা করা।

স্পেনের বন্দরে

যাত্রাপথে ইংল্যান্ডের উপকূলে কয়েকটি ফরাসি প্রাইভেটিয়ার জাহাজকে তাড়া দেন ডি রুইটার। তার জাহাজগুলোর নিম্নমান এ সময় ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।আর্ডেনবার্গ রণতরীর অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে কোনো উপায় না দেখে ডি রুইটার তাকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন। ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরতি পথে যাওয়া আর্ডেনবার্গ’কে কেউ যাতে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য অক্ষত পাঁচটি জাহাজও প্রহরী হিসেবে দিয়ে দেন।

সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখ কাদিজে এসে পৌঁছলে ডাচ বহর। আলজিয়ার্সের উপকূলে এ সময় কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিলে কাদিজ থেকে ক্যাপ্টেন বার্কুটের (Berkhout) সাথে চারটি রণতরী পরিস্থিতি শান্ত করতে চলে গেল।

এমন সময় রাজদরবার থেকে পত্রযোগে ডি রুইটারকে অনুরোধ করা হলো স্প্যানিশ নৌবাহিনীর সাথে ইবিজার দিকে রওনা দিতে। সেখানে প্রতিক্ষা করা স্প্যানিশ রাজা চতুর্থ ফিলিপের অবৈধ সন্তান জেনারেল ডন জনকে (John Joseph of Austria) ইতালিতে নিয়ে যাবে স্প্যানিশ জাহাজ, ডি রুইটার যাতে তাদের সাথে যান।

জেনারেল ডন জন অফ অস্ট্রিয়া; Image Source: Wikimedia Commons

কিন্তু ডি রুইটারের তখন নড়াচড়া করার অবস্থা নেই। তার নিজের জাহাজের মাস্তুলেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। অন্যান্য রণতরীর অবস্থাও তথৈবচ। ফলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করে উত্তর দেন। এই সময় কাদিজের নিকটবর্তী মেডিনার ডিউক জুয়ান কার্লোস (Juan Claros Pérez de Guzmán y Fernández de Córdoba) তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

৭ অক্টোবর কাদিজ ছাড়লেন ডি রুইটার, গন্তব্য ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী ভ্যালেন্সিয়া অঞ্চলের অ্যালিকান্ট (Alicante)। এখানে আবার রাজদরবার তাকে পত্র দিল, এবার অনুরোধ ছিল কাদিজে পাঁচটি জাহাজ পাঠাতে, যাতে স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল ইতালিতে যেতে পারবেন।

ডি রুইটার খর্বশক্তির বহর আরো খর্ব করতে রাজি হলেন না। এবারও ভদ্রভাবে কারণ দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করা হলো। তিনি এরপর অ্যালিকান্ট থেকে ভিনেরোসের দিকে চলে যান। নভেম্বরের ৮ তারিখ এখানে নোঙর করবার পর ক্যাপ্টেন বার্কুটও এসে যোগ দেন।

ডি রুইটারের হাতে ডন জনের চিঠি এসে পৌঁছল। নেদারল্যান্ডসের সাহায্যের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং মাদ্রিদে তার অনুপস্থিতির কারণও ব্যাখ্যা করেন। স্পেনে ততদিনে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে, সিংহাসনে বসেছেন স্পেনের ইতিহাসের সর্বশেষ হাবসবুর্গ সম্রাট, দ্বিতীয় চার্লস।

ডি রুইটার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ইবিজা চলে যাবেন, তার জাহাজে পানি আর জ্বালানী কাঠের খুব দরকার। ইবিজাই হতে পারে তার রসদের প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু তুফান উঠলে ডাচদের জাহাজগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিম্নমানের পাল আর মাস্তুলের কারণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেকগুলো রণতরী। ১৪ নভেম্বর বার্সেলোনায় প্রায় সব জাহাজ আবার মিলিত হলো। ভাইস অ্যাডমিরাল ডি হানের জাহাজ মেরামতের জন্য নেপলসে চলে যায়।

এখান থেকে ডি রুইটার চার্লসকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠালেন। শহরের নামিদামি ব্যক্তিদের সাথেও তার সাক্ষাৎ হলো। ১৭ তারিখে চার্লস ফিরতি চিঠিতে ডি রুইটারকে অনুরোধ করলেন নতুন করে পাল না তুলতে। ডন জন পথে আছেন, এবং তিনি এসে পড়লে সবাই একসাথে রওনা হতে পারবেন।

ডি রুইটার চাচ্ছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফরাসিদের মুখোমুখি হতে, কিন্তু চার্লসের কাছ থেকে সরাসরি পত্র পাওয়ায় তিনি বাধ্য হন অপেক্ষা করতে। তবে ডন জনকে পাওয়া গেল না। তিনি ২৮ তারিখে জানিয়ে দিলেন- অসুস্থতার কারণে এই মুহূর্তে বহরের সাথে যোগ দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

স্পেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস © Juan Carreño de Miranda

অগত্যা জনকে ছাড়াই ডি রুইটার পাল তুললেন, তার পরবর্তী বন্দর ছিল সার্ডিনিয়ার কাগ্লিয়ারি। এই এলাকা তখন সুবিশাল স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। যথাযোগ্য মর্যাদায় মিত্র ডাচদের সমাদর করলেন সার্ডিনিয়ার স্প্যানিশ শাসক।

সিসিলির পথে

কাগ্লিয়ারিতে অবস্থান করাকালীন চার্লসের দ্বিতীয় পত্র এসে পৌঁছল। এখানে উল্লেখ ছিল যে নেদারল্যান্ডসের সাথে নতুন চুক্তি মোতাবেক ডাচ বহর পূর্ববর্তী মেয়াদের থেকে ছয় মাস বেশি স্প্যানিশদের অধীনে কাজ করবে। ডি রুইটারের উপর আদেশ হলো সিসিলিতে যাবার, সেখানে সিসিলির স্প্যানিশ ভাইসরয় মার্কুইস ডি ভিলাফ্রাঙ্কা (Fernando de Valenzuela, 1st Marquis of Villasierra) আর দক্ষিণ ইতালির ক্যাম্পানিয়ার রাজ্য মন্টে সার্চিও’র(Monte Sarchio) যুবরাজ বসে আছেন।

মার্কুইস অফ ভিলাফ্রাঙ্কা; Image Source: Wikimedia Commons

শেই আর নুওরোট নামে দুই ডাচ ক্যাপ্টেনকে নেপলসে পাঠালেন। ডি হানকে বার্তা দেয়া হলো যথাশীঘ্র সম্ভব সিসিলি চলে আসতে। ১৩ ডিসেম্বর ডি রুইটার সিসিলির উদ্দেশ্যে বের হন, ২০ তারিখে এসে নামলেন এখানকার অন্যতম প্রধান অঞ্চল মেসিনার অন্তর্ভুক্ত মিলাজ্জোর বন্দরে। মেসিয়াতে তখন ফরাসি ইন্ধনে চলছে স্প্যানিশবিরোধী বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে বেশ সফলতাও পাচ্ছে।

পরদিন ভিলাফ্রাঙ্কা আর যুবরাজের সাথে সেখানেই তার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডি রুইটার অবিলম্বে ফরাসিদের উপর আক্রমণের পক্ষপাতী হলেও স্প্যানিশ কম্যান্ডার ভিলাফ্রাঙ্কা প্রস্তুতির কথা বলে সময়ক্ষেপণ করেন। ইত্যবসরে মন্টে সার্চিও’র যুবরাজ পালের্মো চলে গেলেন।

হাঙ্গেরিয়ান যাজকদের ঘটনা

নেদারল্যান্ডসের বাইরে আরেকটি দেশে ডি রুইটার লোককথার নায়ক হয়ে আছেন, সেই দেশের নাম হাঙ্গেরি। এর পেছনে ১৬৭৫ সালে স্পেনে তার আগমনের যোগসূত্র থাকায় আলাদাভাবে সেই ঘটনার অবতারণা করাই যায়। এই ঘটনার সূত্রপাত ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যকার চলমান বিবাদ থেকে।

ষোড়শ শতাব্দী ছিল ইউরোপে খৃষ্টধর্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শতক। বিগত বছরগুলো ধরে চলে আসা বিরোধের জেরে ভাঙন ধরে খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্র, রোমান ক্যাথলিক চার্চে। গতি পেল সংস্কারপন্থী আন্দোলন, যা ইতিহাসে পরিচিত রিফর্মেশন নামে।

হাঙ্গেরি তখন হাবসবুর্গ শাসিত হলি রোমান এম্পায়ারের অংশ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যাথলিক রাজা, কর্মকর্তা আর ধর্মগুরুদের হাতেই পুঞ্জীভূত শাসনক্ষমতা। তবে সংস্কারের বাতাস হাঙ্গেরিতে পৌঁছে যায় যাজক ম্যাথিয়াস ডেভাইয়ের (Matthias Devai) হাত ধরে। জার্মান ধর্মপ্রচারক মার্টিন লুথারের লেখা অনুবাদ করে তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের লুথেরান ধারার বিস্তৃতি ঘটাতে শুরু করেন। এজন্য তাকে ক্যাথলিক চার্চের রোষানলে পড়তে হয়।

মার্টিন লুথারের শিক্ষাই হাঙ্গেরিতে প্রচার করেছিলেন ম্যাথিয়াস ডেভাই; Image Source: biography.com

ভিয়েনা থেকে আসা ইনকুইজিটর (inquisitor: ক্যাথলিক মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে এমন বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যাদের দ্বারা সংঘটিত তদন্তের নাম ইনকুইজিশন) বিশপ জন ফেবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মুক্তি পান। তারপর আরো অনেকেই হাঙ্গেরিতে প্রোটেস্ট্যান্টদের ঝান্ডা বয়ে নিতে থাকেন।

সপ্তদশ শতকে হাঙ্গেরির অধিকাংশ নাগরিকই ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট, যাদের অনেকেই লুথেরান মতাদর্শের অনুসারী। এমনকি ভিয়েনার সংসদেও প্রোটেস্ট্যান্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সম্রাট শাসিত হলি রোমান এম্পায়ারে তৎকালীন সংসদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। মূল ক্ষমতা পুঞ্জীভূত ছিল সম্রাট, তার ক্যাথলিক মন্ত্রী এবং যাজক গোষ্ঠীর হাতে। তাদের সাথে ক্যাথলিক ভাইবেরাদর, বিশেষ করে হাবসবুর্গ শাসিত স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। 

ক্যাথলিক যাজকেরা তাদের প্রোটেস্ট্যান্ট জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণে অগ্রগামী ছিলেন। ক্যাথলিক চার্চ ভেঙে যাওয়ার পেছনে প্রোটেস্ট্যান্টদেরই দায়ী করতেন তারা। তাদের বিস্তার ঠেকাতে রোমান ক্যাথলিক চার্চ কাউন্টার রিফর্মেশন পরিকল্পনা হাতে নেয়। তাদের প্ররোচনায় গড়ে ওঠে সোসাইটি অফ জেসাস, যার সদস্যরা নিজেদের বলতেন জেসুইট।

সোসাইটি অফ জেসাস প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠে রিফর্মেশনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে; Image Source: Wikimedia Commons

১৫৭০ সালে জেসুইটরা হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যভুক্ত হাঙ্গেরির অঞ্চলগুলোতে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ঘোষণা দিল। বলাই বাহুল্য, এর উদ্দেশ্য ছিল প্রোটেস্ট্যান্টরাই। ১৫৮০ সালে বর্তমান রোমানিয়ার ট্র্যান্সিলভানিয়াতেও তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যায় বেশি হলেও সামরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অভাবে তাদের হাতে নাজেহাল হতে থাকে প্রোটেস্ট্যান্টরা।

এর পাশাপাশি ক্যাথলিক চার্চ পুনরুজ্জীবিত করে এক নীতি, কিউয়াস রেজিয়াস রিলিজিও (cuius regioeius religio), যার মূলমন্ত্র ছিল জমির মালিক তার অধীনস্থদের ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এর প্রয়োগে তারা অনেক প্রোটেস্ট্যান্ট হাঙ্গেরিয়ান অভিজাতকেই জোরপূর্বক ক্যাথলিক চার্চে ফিরিয়ে আনেন। হাঙ্গেরির উপর আরোপ করা হয় বিপুল কর। চারিদিক থেকে যাঁতাকলে পড়ে হাঙ্গেরিয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তাদের কেউ কেউ মিত্রের সন্ধানে পূর্বদিকে তাকালেন, সেদিকে তখন সুবিশাল উসমানী সাম্রাজ্য।

হাবসবুর্গরা চিরশত্রু অটোমানদের বিরুদ্ধে হাঙ্গেরিকে তাদের পূর্বদিকের প্রতিরক্ষা বিবেচনা করত। প্রায় দেড়শ বছর ধরে হলি রোমান এম্পায়ারের বাইরে হাঙ্গেরির বড় একটা অংশ তখন নিয়ন্ত্রণ করছিল উসমানী সুলতানেরা। তারা প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, কারণ ক্যাথলিকদের মনে করা হতো খ্রিস্টান রাজার প্রতি অধিক অনুগত।

ফলে তিনজন বিশিষ্ট লুথেরান উসমানীদের সাথে যোগাযোগ করেন, আইনজ্ঞ ইভডন উইটনিডি (Istvdn Wittnyedy), ব্যারন ইসিডুন পেট্রিজি (Isuidn Petrdczy), এবং কাউন্ট ইভডন থকোলি (Istvdn Thokoly)। কাউন্ট মিক্লস বেথেলেন (Miklos Bethlen) নামে আরেক তরুণ অভিজাতও তাদের সঙ্গী হন।

হাঙ্গেরিয়ানদের অনেকে যোগাযোগ করে উসমানীয়দের সঙ্গে; Image Source: brill.com

সুস্পষ্টভাবে তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল তা নিয়ে সন্দেহ আছে, তবে হাবসবুর্গ নিষ্পেষণ থেকে হাঙ্গেরির প্রোটেস্ট্যান্টদের মুক্ত করার পরিকল্পনায় যে তারা উসমানীদের সাহায্য চেয়েছিলেন তা মনে করা হয়। তাদের কার্যকলাপ ফাঁস হয়ে গেলে ক্যাথলিক চার্চ প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে একদম গরম গরম রসদ পেয়ে গেল। রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবার অভিযোগ আনল বহু হাঙ্গেরিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টের উপর।

১৬৭১ সালে লুথেরান বিশপ কালিঙ্কা (Joachim Kalinka) আর ৮৩ বছর বয়স্ক যাজক দ্রিবিক (Miklds Drdbik) তৎকালীন হাঙ্গেরির রাজধানী পজোনি’তে (Pozsony) বিচারের মুখোমুখি হলেন। রাষ্ট্রবিরোধী লেখা ছড়ানোর দায়ে দ্রিবিককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, কালিঙ্কার ভাগ্যে জুটল নির্বাসন।

পরের বছর ১৫ জন লুথেরান ধর্ম প্রচারক একই কারণে বিচারকের সামনে দাঁড়ালেন। তাদের দেয়া হলো তিনটি বিকল্প: ক্যাথলিক মতবাদ পুনরায় গ্রহণ করা, অথবা পদত্যাগ, নতুবা নির্বাসন। তারা সকলেই জার্মানিতে নির্বাসনে চলে যান, যেখানে তাদের সাদরে গ্রহণ করে কাজ চালিয়ে যাবার জন্য সমস্ত সহায়তা দেয়া হয়। ১৬৭৩ সালে ৩২ জন লুথেরানও একই শাস্তি মেনে নেন। 

১৬৭৪ সালের বসন্ত দেখল সবচেয়ে বড় বিচারকাজ। হাঙ্গেরির ২৭টি প্রদেশের সমস্ত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারক ও যাজকদেরে ডেকে পাঠানো হলো পজোনিতে। কিন্তু ২৭টি প্রদেশের অনেকগুলো তখন উসমানী নিয়ন্ত্রণাধীন। উসমানী শাসক তার এলাকার কাউকে পজোনিতে যেতে মানা করে দেন। ফলে শেষাবধি ৩৩৬ জন বিবাদি সমবেত হলো পজোনিতে।

দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাসনে যেতে রাজি হয়। ৯০ জন অসম্মত হলে তাদের পাঠানো হলো কারাগারে। এক বছর দৈহিক নির্যাতনের পর তাদের অনেকেই ক্যাথলিক ধর্মে ফিরে এলো। বাদবাকি ছিল ৪২ জন, তাদের স্প্যানিশদের কাছে দাস হিসেবে পাঠানো হয়। স্প্যানিশ নৌবাহিনী তাদের ব্যবহার করল যুদ্ধজাহাজের দাঁড় টানার কষ্টকর কাজে। বেশিরভাগের ঠাঁই হলো নেপলসের বন্দরে, জাহাজের মানবেতর পরিবেশে। তখন দাঁড় টানার কাজ করানো হতো বন্দি, অপরাধী এমন লোক দিয়েই, কারণে-অকারণে পড়ত চাবুক।

হাঙ্গেরিয়ান যাজকদের লাগিয়ে দেয়া হয় স্প্যানিশ জাহাজে কষ্টকর কাজে; Image Source: Wikimedia Commons

হাঙ্গেরিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টদের বিচার ছিল প্রধানত রাজনৈতিক। প্রোটেস্ট্যান্টদের দমন করার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবেই ক্যাথলিক চার্চ একে কাজে লাগিয়েছিল। ফলে নিরীহ মানুষজন তাদের বলি হয়। এই পরিস্থিতিতে প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান দেশগুলো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ডাচ রাষ্ট্রদূত হামেল (Hamel Bruyninx) আর সুইডিশ দূত অক্সেন্সটিমা (Oxenstiema) ভিয়েনার দরবারে তাদের হয়ে নমনীয়তা প্রদর্শনের আবেদন জানান। নেপলসের ভাইসরয়ের কাছেও তারা ধর্না দিলেন।

ডি রুইটার যখন মিলাজ্জোতে, তখন নেপলসে অবস্থান করছিল একটি ডাচ রণতরী। তৎকালীন প্রত্যেক জাহাজেই একজন যাজকের স্থান হতো। নেপলসের ডাচ রণতরীর যাজক থিওডোর (Dominé Theodoor Westhovius) জানতে পেরেছিলেন হাঙ্গেরির প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকেরা সেখানকার জাহাজগুলোতে সাধারণ কয়েদিদের মতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ভিয়েনা থেকে পাঠানো ৪২ জনের মধ্যে যাত্রাপথেই মারা গিয়েছিল ছয়জন, নেপলসে মারা গেছে আরো দুজন। তিনজন সক্ষম হয় পালিয়ে যেতে।

১৬৭৫ সালের জুলাইয়ে আরো তিনজন যাজকের মৃত্যু হয়। ৫ সেপ্টেম্বর থিওডোর যখন তাদের কথা জানতে পারলেন, তখন মাত্র ২৭ জন বেঁচে, তাদের তিনজনকে আবার সিসিলিতে স্থানান্তর করা হয়। ডি রুইটার জানতেন প্রোটেস্ট্যান্ট নেদারল্যান্ডসের এস্টেট জেনারেলরা এসব যাজকের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হবেন। তিনি পুরো রিপোর্ট পাঠালেন স্বদেশে।   

তিনি ভিলাফ্রাঙ্কার কাছেও হস্তক্ষেপের আবেদন করেন। তার জোরাজুরিতে ভিলাফ্রাঙ্কা নেপলসের স্প্যানিশ ভাইসরয়কে যাজকদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করলেন। এদিকে ডি রুইটার সিসিলিতে পাঠানো যাজকদের খোঁজ বের করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

এদিকে সিসিলির পথে থাকা ডি হান ২২ ডিসেম্বর পালের্মোতে নোঙর করেন। মন্টে সার্চিও’র যুবরাজের সাথে তার দেখা হয়। যুবরাজের ভাবভঙ্গী দেখে বোঝা গেল- ফরাসি জাহাজে গিজগিজ করা ভূমধ্যসাগর পাড়ি জমাতে তার প্রবল অনীহা। ফলে ডি হান তাকে ছাড়াই সিসিলিতে চলে আসেন, সাথে করে যাজকের ব্যাপারে এস্টেট জেনারেলদের পক্ষ থেকে ডি রুইটারের প্রতি সর্বাত্মক চেষ্টা করার নির্দেশ নিয়ে এলেন।

এদিকে ত্রয়োদশ লুইয়ের তরফ থেকে হুমকি দেখে অস্ট্রিয়ার হলি রোমান এম্পেরর প্রথম লিওপোল্ড ডাচদের সাথে জোট করার কথা ভাবছিলেন। এর বিনিময়ে তিনি হাঙ্গেরিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টদের ছাড়তে রাজি হলেন। ফলে নেপলসের স্প্যানিশ ভাইসরয়ও তাদের মুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে দেন।

প্রথম লিওপোল্ড; Image Source: Wikimedia Commons

১৬৭৬ সালের ১১ (মতান্তরে ১২) ফেব্রুয়ারি নেপলসে এসে ডি রুইটার নিজ হাতে অবশিষ্ট ২৬ জন যাজককে মুক্ত করেন। কাকতালীয়ভাবে এরা সবাই ছিল হাঙ্গেরির ডেব্রেকেন (Debrecen) শহরের। ডি রুইটার তাদের যাত্রার ব্যবস্থা করে দেন। সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস আর জার্মানি হয়ে তারা শেষ অবধি জন্মভূমিতে ফিরে গেলেন। তবে লম্বা যাত্রার ধকল সইতে না পেরে বেশ কয়েকজন মারা যান পথেই।

ডি রুইটারকে এই কারণে হাঙ্গেরিতে অনেকটা জাতীয় বীরের সম্মান দেয়া হয়। রাজধানী বুদাপেস্টে তার নামে একটি স্মৃতিসৌধ আছে, যেখানে প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ডাচ রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে হাঙ্গেরিয়ানরা সেসব বন্দি প্রোটেস্ট্যান্টদের স্মরণে পালন করে থাকে।

This is a Bengali language article about the intrepid Dutch Admiral, Michiel De Ruyter. The article describes the De Ruyter’s lie and achievements. Necessary references are mentioned below.

References

  1. Douglas, P. Michiel De Ruyter, Held van Nederland. New Netherland Institute.
  2. Grinnell-Milne, G.(1896). Life of Lieut.-Admiral de Ruyter. London: K. Paul, Trench, Trübner & Company.
  3. Curtler, W. T. (1967). Iron vs. gold : a study of the three Anglo-Dutch wars, 1652-1674. Master's Theses. Paper 262.
  4. Michiel Adriaanszoon De Ruyter. Encyclopedia Britannica

Feature Image: imdb.com

Related Articles

Exit mobile version