১৯৭৭ সালের ২৮ই সেপ্টেম্বর জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৪৭২ এর ডিসি ৮ বিমানটি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিল। ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ভারতের মুম্বাই হয়ে জাপানের টোকিওগামী ঐ বিমানে ১৪২ জন যাত্রী এবং ১৪ জন ক্রু ছিলেন। ভারতের মুম্বাইয়ে ঘটনার সূত্রপাত হলেও ঢাকার পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরে জিম্মি দশা সমাপ্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়েছিল। ভারতের মুম্বাইয়ে যাত্রাবিরতি শেষে উড়াল দেওয়ার পরপরই জাপানিজ রেড আর্মি নামে জাপানের একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের ৫ জন সদস্য সাধারণ যাত্রীদের পিস্তল দেখিয়ে বিমানের ককপিটে প্রবেশ করে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে জাপানে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটানো ও পৃথিবীজুড়ে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত হওয়া জাপানিজ রেড আর্মি বিমানের যাত্রীদের মুক্তিপণ হিসেবে জাপানের কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী রেড আর্মির সদস্যসহ ৯ জন ব্যক্তির মুক্তি একইসাথে ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করেছিল।
এ সময় বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বিমানবন্দরে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করে ফেলে। প্রায় ৪ দিন ধরে ছিনতাই করা বিমানটি ঢাকায় অবস্থান করেছিল। বিমানটিতে বিভিন্ন দেশের যাত্রী অবস্থান করায় জিম্মি হওয়াদের উদ্ধারের জন্য জাপান এবং বাংলাদেশ সরকারের উপর আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে চাপ আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ১লা অক্টোবর জাপানের তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই এর নেতৃত্বে জাপানের একটি প্রতিনিধি দল পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে এসেছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ছিনতাইকারীদের সাথে সমঝোতার জন্য বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল গফুর মাহমুদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল গফুর মাহমুদ ১৯৭৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বিনা রক্তপাতে শান্তিপূর্ণভাবে জিম্মি দশা শেষ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি জাপান থেকে প্যারা-কমান্ডো পাঠিয়ে সামরিক অভিযানের প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও সমঝোতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
জিম্মিকারীদের সাথে তিনি আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন, এই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সামরিক কর্মকর্তাই মূলত জাপান সরকার এবং জিম্মিকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করেছিলেন। জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাকিও ফুকুদা ১লা অক্টোবর ছিনতাইকারীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং জাপানিজ রেড আর্মির ৬ জন বন্দী সদস্যকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। জিম্মিকারীদের দাবিকৃত অর্থ এবং জাপানিজ রেড আর্মির মুক্তিপ্রাপ্ত সদস্যদের বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করার পর বিমানের জিম্মি যাত্রীদের ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
প্রথমে কয়েক দফায় ৬৬ জন যাত্রী এবং ৫ জন ক্রুকে ছেড়ে দেয়। ২রা অক্টোবর হঠাৎ করে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। ঢাকার পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরে কয়েকজন বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার ছিনতাইকৃত বিমানটিকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা ত্যাগ করতে নির্দেশনা জারি করে।
বিমানটি ঢাকা ত্যাগের পূর্বে এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল গফুর মাহমুদ এবং জাপানের তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই এর যৌথ প্রচেষ্টায় ছিনতাইকারীরা আরো ৪২ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রুকে ছেড়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২৯ জন যাত্রী আর চারজন ক্রু নিয়ে ছিনতাইকারীরা ঢাকার পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দর ছেড়ে চলে যায়। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য বাংলাদেশ ও জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাকি জিম্মিদের দ্রুতই মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
এরপর ছিনতাইকৃত ফ্লাইট ৪৭২ এর ডিসি ৮ বিমানটি ৩রা অক্টোবর কুয়েতে পৌঁছে তেল নেওয়ার পর সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে পৌঁছে আরো ১০ জন জিম্মিকে ছেড়ে দেয়। সবশেষে বিমানটি দামেস্ক থেকে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের উপকণ্ঠে আল বাইদা শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে বাকি জিম্মি যাত্রীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছিল একটি শ্বাসরুদ্ধকর ও চরম নাটকীয় জিম্মি ঘটনার।
এই ঘটনার বিবরণ দিয়ে জাপানের তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই জাপানি ভাষায় একটি বই লিখেছিলেন। বইটিতে জিম্মি উদ্ধারের ঘটনায় তৎকালীন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল গফুর মাহমুদের বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৯ই মে জাপান সরকার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল গফুর মাহমুদকে রাজকীয় পুরস্কার ‘দ্য অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড অ্যান্ড সিলভার স্টার’ প্রদান করেছিল। এই সাহসী সামরিক কর্মকর্তার অবদানের ফলে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আরো ত্বরান্বিত হয়েছিল।
যেকোনো বিমান ছিনতাই এবং জিম্মির ঘটনায় জিম্মি হওয়া যাত্রীদের নিরাপদে উদ্ধারকে সবসময়ই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে তৎকালীন বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল গফুর মাহমুদ জাপান সরকারের অনুরোধে সামরিক অভিযানের পথে না গিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল গফুর মাহমুদ ১৯৭৬-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন এবং ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও, এই চৌকস সামরিক কর্মকর্তা ‘My Destiny’ নামে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন।