ইতিহাসের অনেক নারীই নানা গুণে গুণবতী ছিলেন। চর্চার অভাবে তাদের অনেকেই অচেনা হয়ে গেছেন আজকের প্রজন্মের মাঝে। এরকম কয়েকজন মহীয়সী নারী সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো এখানে।
লেডি গোদাইভা
কিংবদন্তী অনুসারে লেডি গোদাইভা সেন্ট্রাল ইংল্যান্ডের শহর কভেন্ট্রির প্রতি সমব্যথিত হয়েছিলেন। কারণ তারা লেডি গোদাইভার স্বামী কর্তৃক আরোপিত কর ব্যবস্থার জন্য নিপীড়িত হচ্ছিল। তার স্বামী করের পরিমাণ কম না করা পর্যন্ত তিনি অনুরোধ করতে থাকেন এবং অবশেষে তার স্বামী একটি শর্তের বদলে তার দাবী মেনে নেবেন বলে জানায়। শর্তটি ছিল এরকম, তাকে নগ্ন হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে।
তিনি স্বামীর কথা মেনে নিলেন। ঘোষণা করা হলো, শহরের কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না এবং অবশ্যই ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হবে। সবাই ঘোষণা অনুযায়ী নির্দেশ পালন করলো এবং লেডি গোদাইভা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে, শুধুমাত্র নিজের চুল গায়ে জড়িয়ে পুরো শহরে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ান। ১১ শতকের কিংবদন্তী লেডি গোদাইভা ১১ শতকের এবং সে সময়ের ঠিক পরবর্তী দুই শতক পর্যন্ত তাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে আশ্চর্য এবং দুঃখজনক বিষয় হলো, বর্তমান সময়ের ইতিহাসবিদরা তাকে নিয়ে তেমন চর্চা করেন না বললেই চলে।
ইয়াং গোইফেই
প্রাচীন চীনের ৪ জন সুন্দরীর মধ্যে তিনি একজন। ১৪ বছর বয়সে তিনি চীনের সম্রাটের ছেলে উ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উ মৃত্যুবরণ করার পর সম্রাট বেশ দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে যান। কারণ উ ছিল তার সবচেয়ে পছন্দের। পরবর্তীতে রাজকুমারী ইয়াংকে সম্রাটের ভালো লেগে যায় এবং তিনি ইয়ংকে তার রক্ষিতা হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তার ছেলে লি মাওকে আরেকটি বিয়ে করিয়ে দিয়ে লেডি গোদাইভাকে নিজের রক্ষিতা করে ফেলেন।
সম্রাট তাকে এতটাই সুযোগ সুবিধা দেন যে, তার পোশাক তৈরি করার জন্য ৭০০ জন শ্রমিক বাধ্যতামূলকভাবে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকতেন। এছাড়াও সম্রাটের বিভিন্ন কর্মকর্তা তাকে সবসময় গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতেন। সম্রাট তাঁর পরিবারের সবাইকে উচ্চ পদ ও ক্ষমতা দিয়েছিলেন, যার কারণে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। ইয়াং সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। আর সে সময়ে এই বিষয়টির বেশ চাহিদা ছিলো। তাকে প্রায়ই সম্রাজ্ঞী যাহো এর সাথে তুলনা করা হতো। কারণ একদিকে ইয়াং পরিচিত ছিলো সুঠাম দেহ এবং অপরদিকে সম্রাজ্ঞী যাহো পরিচিত ছিলো তার রুগ্ন শরীরের জন্য।
ফ্রাইনি
ফ্রাইনি ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের নারী। বলা হয়ে থাকে, ভাস্কর প্রাক্সিতিলিস (যিনি ফ্রাইনির প্রেমিকও ছিলেন) আফ্রোদিতি অব নাইদোস ভাস্কর্যটি তার প্রতিকৃতি হিসেবে তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল প্রাচীন গ্রিসের প্রথম নগ্ন নারী ভাস্কর্য। কিংবদন্তি অনুসারে, তাকে একবার ধর্মদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। যখন ধারণা করা হয় যে, অভিযোগের রায় ফ্রাইনির বিপক্ষে যাচ্ছে ঠিক তখনই তার সমর্থক বিচারকদের সামনে ফ্রাইনির বক্ষের কাপড় খুলে দেয়।
তা দেখে বিচারকমণ্ডলীর মনে করুণা জাগে। তার সৌন্দর্য বিচারকদের মাঝে আধ্যাত্মিক ভয়ের সঞ্চার ঘটায়। তারা গ্রিকদের প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির সাথে তুলনীয় এই নারীর মৃত্যুদণ্ড দেয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। ফ্রাইনিকে সমবেদনার বশে বেকসুর খালাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ওনো নো কোমাচি
তিনি ছিলেন জাপানের ওয়াকা (জাপানের সাহিত্যে শাস্ত্রীয় ধরনের কবিতা) কবি। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন তার অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য। কোমাচি বর্তমানে জাপানের নারী সৌন্দর্যের আরেক নাম। এছাড়াও তিনি তার নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতার জন্য পরিচিত ছিলেন। একজন ব্যক্তি তাকে এক রাজপুরুষের কথা জানান যিনি তার প্রেমে পড়েছিলেন। কোমাচি কথা দিয়েছিলেন, সেই রাজপুরুষ যদি টানা একশত দিন তার সাথে দেখা করতে আসে, তবে তিনি তার প্রেমিকা হবেন। কোমাচির কথা মতো তিনি বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করেও প্রতিদিন দেখা করতে এসেছিলেন। তবে ৯৯ তম রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। এই ঘটনায় ব্যথিত হয়ে তিনি একটি কবিতা লিখেন। এটি ছিল তার লেখা অন্যতম বিষাদগ্রস্ত কবিতা।
এলেনর অব অ্যাকুইসিন
১৫ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তার স্বামী ফ্রান্সের রাজা হন এবং তাদের দুটো কন্যা সন্তানও ছিল। তাদের দুজনের তালাক হওয়ার পর তার স্বামী কন্যা সন্তানদের নিয়ে যান এবং এলেন নিয়ে যান জমিজমা। পরে এলেনর বিয়ে করেন ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজা দ্বিতীয় হেনরিকে। তাই ফ্রান্সের অর্ধেকটাই ইংল্যান্ডের দখলে চলে যায় এবং এটাই সম্ভবত শতবর্ষী যুদ্ধের প্রথম কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল। পরবর্তী ১৩ বছরে হেনরি ও তার ঘরে ৩টি কন্যা ও ৫টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে দুজন ছিল রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট ও জন ল্যাকল্যান্ড।
যখন ছেলেরা বড় হয়ে গেল তখন এলেন তার আগের স্বামী। তিনি হেনরির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আর এজন্য তাকে পরবর্তী ১৬ বছরের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়। হেনরির মৃত্যুর পর এলেনরের বড় ছেলে রিচার্ড তার মাকে মুক্তি দেয়ার আদেশ দেন। তখন তার প্রায় ৬০ বছরের মাঝামাঝি বয়স ছিলো, যা দ্বাদশ শতাব্দীতে বয়স্ক বা প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তার যে বয়স ছিলো তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি সরাকারি কাজের সাথে গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে যান। বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীল শক্তি ও উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ জীবনে তিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মধ্যযুগে যখন নারীদের অস্থাবর সম্পত্তির চাইতে বেশি কিছুই মনে করা হতো না, সেই তুলনায় তখনকার দিনে তার অর্জন ছিল হৃদয়স্পর্শী।
প্রাসকোভিয়া যেমচোগোভা
বাস্তবে সিন্ড্রেলাকে রাজকুমারের বিয়ের কাহিনী একটি হলেও আছে! প্রাসকোভিয়া যেমচোগোভা ও তার পরিবার শেরেমেটেভস্ বংশের উত্তরাধিকারী ছিলেন, যা সে সময়ে রাশিয়ার ধনী ও উত্তম পরিবারগুলোর মধ্যে একটি ছিলো। তার কণ্ঠ ছিলো খুব মধুর। আর তাই তাকে গীতিনাট্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা গানের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং সেখানে তার সাথে আরও ছিলেন কাউন্ট পিউটর (রাশিয়ার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের পরামর্শদাতা) ও তার ছেলে নিকোলাই শেরেমেটেভ। প্রাসকোভিয়া কাউন্ট নিকোলাই শেরেমেটেভের উপপত্নী হয়ে যান এবং তাকে পালিয়ে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে সম্রাটের কাছ থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পান যা ভদ্র সমাজে বিশাল এক কলঙ্কের সৃষ্টি করে।
সাইমনেটা ভেসপুচি
তার ডাকনাম ছিলো লা বেলা সাইমনেটা। তার সময়ে উত্তর ইতালিতে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য। এছাড়াও তিনি বতিচেলির (ইতালির চিত্রশিল্পী) বিভিন্ন চিত্রাঙ্কনের মডেল হিসেবেও কাজ করেছন। যদি আপনি কখনো ‘দ্য বার্থ অব ভেনাস’ চিত্রটি দেখে থাকেন, তবে আপনি অবশ্যই সাইমেনতাকে দেখেছেন। গুজব আছে যে, তিনি দেখতে খুবই নমনীয় ছিলেন এবং তার আচার ব্যবহারও ছিলো শালীন ও নির্মল। মাত্র ২২ বছর বয়সে সম্ভবত যক্ষার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার মৃতদেহ উন্মুক্ত এক কফিনে করে শহরের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যেন সবাই তার রূপের প্রশংসা করতে পারে।
Feature Image: Heritage Images/Getty Images