বঙ্গভঙ্গ: বাতিল ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা বঙ্গভঙ্গের পটভূমি, বিভিন্ন কারণ, বঙ্গভঙ্গের পর দুই বাংলার প্রতিক্রিয়া নিয়ে বলা হয়েছে আগের দুই পর্বে (পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ: পেছনের গল্প; বঙ্গভঙ্গ: প্রতিক্রিয়া)। এবার বঙ্গভঙ্গের শেষ পর্বে থাকছে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের পেছনের বিভিন্ন কারণ আর এর ফলে বাংলায় যেসব প্রভাব পড়েছিল সেসব নিয়ে।

বঙ্গভঙ্গ রদ

আগের পর্বে বলা হয়েছিল ১৯১০ সালের শেষের দিকে ভারতের প্রশাসনের দুটি বড় পরিবর্তনের কথা। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর ভারতে আসার ঘোষণা দেন। এ সময় যাতে ভারতীয়রা, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃত্ব যেন কোনো ঝামেলা না করে সে কারণে তিনি তাদের সাথে এক প্রকার আপোসে যান। কংগ্রেসের সাথে বঙ্গভঙ্গ রদের ব্যাপারে আপোসে গেলেও অন্যদিকে লর্ড হার্ডিঞ্জের মাথায় ছিল ভিন্ন এক পরিকল্পনা। বঙ্গভঙ্গ রদ করলে মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হবে এটি জানা ছিল তার। একইসাথে বাংলাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জোরদার হচ্ছিল। দুই পক্ষকে শান্ত রাখার জন্য গোপনে আরেক চাল চালেন তিনি।

পঞ্চম জর্জ; Source: Wikimedia Commons

১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ভারত সচিবের কাছে সুপারিশ করেন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। প্রথমত, বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দমন করা যাবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ভারতে মুসলিম শাসনের কেন্দ্র দিল্লিকে রাজধানী করে মুসলিমদের খুশি রাখা যাবে। একই সাথে বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে পৃথক করে দুই বাংলাকে এক করার পরিকল্পনা তো ছিলই। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির মসনদে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা করেন। ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় বঙ্গভঙ্গ রদ। একইসাথে কলকাতা হারায় রাজধানীর মর্যাদা। দুই বাংলা এক হলেও রাজধানীর মর্যাদা আর থাকে না বাংলা প্রদেশের।

দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ ও তার রানী; Source: Wikimedia Commons

বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ

বঙ্গভঙ্গ রদের মূল কারণ ছিল হিন্দুদের বিরোধীতা, স্পষ্ট করে বলতে গেলে পশ্চিম বাংলার উঁচু শ্রেণীর হিন্দুদের বিরোধীতা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার কথা ভেবে হিন্দু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ শিক্ষিত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে। অথচ পূর্বের হিন্দুরা ঠিকই বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই ছিল। তবে পরবর্তীতে পশ্চিমের উগ্রবাদী আন্দোলনের প্রভাব পূর্বেও পড়ে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয় যখন বাংলাকে ভাগ করাকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্ম হয় ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসারের চেষ্টায় মুসলমানদের সমর্থন হারায় কংগ্রেসসহ হিন্দু নেতারা।

স্বদেশী আন্দোলনের শুরুতে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটও ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক অচলতার সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ কারখানাগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও বঙ্গভঙ্গ বাতিলের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে। একইসাথে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে চাপে পড়লেও বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায় ব্রিটিশরা। পশ্চিম বাংলাকে শান্ত করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করে, কিন্তু একইসাথে রাজধানীও বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর, দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ; Source: Wikimedia Commons

বঙ্গভঙ্গ রদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মুসলিম লীগের দুর্বলতা। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও সাংগঠনিক দিক দিয়ে কংগ্রেসের চেয়ে দুর্বল ছিল। ফলে কংগ্রেস কলকাতা ও পশ্চিম বাংলায় হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গের জন্য যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মুসলিম লীগ সেরকম কিছুই করতে পারেনি বঙ্গভঙ্গকে সমর্থনের ব্যাপারে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম সীমিত ছিল বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানানো। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গভঙ্গকে চালু রাখা কিংবা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো কিছু করতে পারেনি মুসলিম লীগ। ফলে কংগ্রেসের কাছে একপর্যায়ে নতি স্বীকার করতেই হয় ব্রিটিশ সরকারকে। মুসলিম লীগ নিজেদের স্বার্থে সেরকম কোনো চাপও সৃষ্টি করতে পারেনি সরকারের উপর। ফলে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয় স্বাভাবিকভাবেই মাত্র ছয় বছরের মাথায়।

হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দুদের যে প্রতিক্রিয়া ছিল বঙ্গভঙ্গ রদের পর তাদের প্রতিক্রিয়া হয় ঠিক উল্টো। কংগ্রেস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। উগ্রপন্থী হিন্দুরা একে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিজয় হিসেবে প্রচার করে। কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার ব্রিটিশ সরকারকে অভিনন্দন জানান বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাময় লিখেছেন, “১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দিয়েছে”।

মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া

স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হতাশ হয়। তারা সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা ছাড়াও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় যে উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়েছিল সেটি নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার জনগণ। মুসলিম লীগের নেতারা সরকারের সমালোচনা শুরু করেন। বঙ্গভঙ্গ রদে সবচেয়ে ব্যথিত হন নবাব সলিমুল্লাহ। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে বলেন, “বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলাম তা আমাদের বিরাট দুঃখের কারণ। কিন্তু আমাদের দুঃখ আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে যখন দেখি সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে বা কোনো পূর্বাভাষ না দিয়েই এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করলেন”।

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক; Source: Greatest Bangalis

বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার পর ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উভয় বাংলার নেতৃত্বস্থানীয়দের নিয়ে এক সভা করেন। সেই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মুসলিম নেতারাও উপস্থিত ছিলেন এবং মুসলমানদের সাথে কোনো প্রকার পরামর্শ না করে হঠাৎ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করায় সরকারের সমালোচনা করেন। মুসলিম লীগ মুসলমানদের অধিকার আদায়ের মুখপাত্রে পরীনত হয়। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের আসে পরিবর্তন। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, এ. কে. ফজলুল হকের মতো নেতারা হাল ধরেন মুসলিম লীগের। ফজলুল হক ব্রিটিশ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন মুসলমানদের দাবির প্রতি উপেক্ষা করা হলে বিপদের সম্ভাবনা আছে।

ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গ রদ করে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের শান্ত করতে পারলেও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের অসন্তোষ ব্রিটিশদের আরেক সমস্যায় ফেলে। বাংলা থেকে রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া বাংলার মুসলমানদের কোনো প্রভাবই ফেলেনি। লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফর করেন এবং মুসলিম নেতার সাথে বৈঠক করেন। তিনি তাদের আশ্বাস দেন নতুন প্রশাসনে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে। একইসাথে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। ড. রাসবিহারী ঘোষসহ বেশ কজন হিন্দু নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

কার্জন হল, বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন; Source: Wikimedia Commons

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তবে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আসা নেতারা হিন্দুদের বিরোধীতার বদলে ঐক্যের চেষ্টা চালান। ফলে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দও তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ১৯১৩ সালে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ভারতের জন্য স্বরাজ দাবি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ডাক দেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম লীগের নেতা হবার পরেও কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯১৪ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন কংগ্রেসের শ্রীমতি নাইডু। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একসাথে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ‘লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের হারানো ঐক্য আবারো ফিরে আসতে থাকে এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ভারতে। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রমাণ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক রূপ ছিল উগ্রবাদী একটি শ্রেণীর নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।

লক্ষ্ণৌ প্যাক্টের উপস্থিত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের একাংশ; Source: Pinterest

শুরুতে বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ ব্রিটিশরা নিয়েছিল প্রশাসনিক সুবিধার কথা ভেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাকে ভাগ করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও যুক্ত হয়। পশ্চিম বাংলার ব্যাপক বিরোধীতা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের আন্দোলন। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া হিন্দু-মুসলিম উভয়ই উপকৃত হয় এর ফলে। কিন্তু একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারকে হার মানতে হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কাছে। অবশ্য হার মানলেও দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করে পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষেই কাজে লাগায় তারা। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে যে দাগ পড়েছিল সেটি আর কখনোই মুছে যায়নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় কিছুদিন ঐক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐক্য টেকেনি বেশিদিন। ফলে ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় আর দুই বাংলাকে এক রাখা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলাকে ভাগ করা নিয়েই ঘটে গেছে কত কিছু!

তথ্যসূত্র

১. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া, মুনতাসির মামুন

২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯০৫-১৯৭১), ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন

৩. Bengal Electoral Politics and Freedom Struggle 1832-1947, Gautum Chattopadhyay

৪. The New Province of Eastern Bengal and Assam, M. K. U. Molla

৫. The History of Bengal, Volume II, Sir Jadunath Sarkar

৬. From Plassey to Partition – A History of Modern India (2004), Sekhar Bandyopadhyay

ফিচার ইমেজ- armaeniaeditorial.com

Related Articles

Exit mobile version