দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক ভারতীয় নাগরিকের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের একটি জেলা পুদুচেরি। ঔপনিবেশিক সময়ে এই জেলা ছিল ফরাসি উপনিবেশের অন্তর্গত। ১৯৫৪ সালে ফরাসিরা জেলাটি ভারতের তৎকালীন সরকারের কাছে অর্পণ করে সমস্ত কিছু গুটিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে। যোগাযোগের জন্য আধুনিক যানবাহন উদ্ভব ও সড়কপথের উন্নয়ন হওয়ার আগে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পন্ন হতো সমুদ্রপথের মাধ্যমে। এজন্য উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর আলাদা গুরুত্ব ছিল। পুদুচেরি মালাবার উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় ফরাসিরা প্রায় সাড়ে তিনশ বছর এই জেলার কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে রেখেছিল। এই অঞ্চলের মানুষের সাথে ফ্রান্সের আলাদা সম্পর্ক ছিল। যেমন বলা যায়, ব্রিটিশ ভারতে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত পরিবারের সন্তানদের বিলেত তথা ইংল্যান্ডে পাঠানো হতো। কিন্তু পুদুচেরি জেলার অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে পাঠাতেন।

জডজতপতপগ
মাধাভান যেখানে জন্মগ্রহণ করেন, সেটি ফরাসিদের উপনিবেশ ছিল; image source: architecturaldigest.com

পুদুচেরিরই এক সন্তান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার-বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। হিটলারের ফ্যাসিবাদ গোড়াসমেত উপড়ে ফেলতে তিনি ফরাসিদের পক্ষে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান। অসম যুদ্ধে হিটলার-বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে হয়তো পেরে ওঠেননি, কিন্তু মৃত্যুভয় তাকে কখনও নিজের আদর্শ থেকে একচুল নড়াতে পারেনি। ফ্রান্স তার জন্মভূমি নয়, ফরাসিরা তাকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেয়নি। তারপরও ইউরোপের এই দেশের পক্ষে তিনি জীবন বাজি রেখে লড়েছেন, দিনশেষে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তাকে নিয়ে তার নিজ দেশেই খুব বেশি আলোচনা হয় না। কিন্তু তিনি আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন, সেটি নিশ্চিতভাবে একজন ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করবে। কীভাবে তিনি হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে ফরাসিদের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করলেন এবং শেষপর্যন্ত মারা গেলেন– আমরা সে গল্পই আজ জানব।

মিশোলেট মাধাভানের জন্ম পুদুচেরি জেলার মাহে শহরে। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেন, সেই বছর ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। ছোটবেলায় তিনি পন্ডিচেরিতে পড়াশোনা করেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি মাহে শহরের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। জানা যায়, তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করার সময়ই তিনি অস্পৃশ্যদের সংগঠন হরিজন সেবক সংঘে যোগদান করেন। মাধাভানের নিজ শহরের অসংখ্য মানুষ ছিল গরীব। এই মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা অবলোকন করে তিনি খুব ছোট থেকেই তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করতেন। এই চেষ্টা থেকেই আসলে তার হরিজন সেবক সংঘে যোগ দেয়া। তখনকার ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যদের সমাজের মূল স্রোত থেকে আলাদা করে দেয়া হয়েছিল। যেমন- হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলে আলাদা বেঞ্চে বসতে হতো। মিশোলেট মাধাভান ভারতের এই বর্ণবাদী আচরণে ব্যথিত হন। এজন্য হরিজন সেবক সংঘের মাধ্যমে তিনি অস্পৃশ্য শিশুদের শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।

কতেগেগপগ
ফ্রান্সের বিখ্যাত সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন মাধাভান; image source: sonbonne-universita.fr

তখনকার সময়ে পুদুচেরিতে উচ্চশিক্ষার জন্য খুব ভালো প্রতিষ্ঠান ছিল না। পুদুচেরিতে যেহেতু ফরাসি উপনিবেশ ছিল, তাই ফ্রান্সে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মানুষেরা আলাদা সুবিধা পেত। পরিবারের পরামর্শে মাধাভান উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পুদুচেরির স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর ভেবেছিলেন পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। বলে রাখা ভালো, মাধাভানের পরিবার মোটামুটি সচ্ছল ছিল। অবশেষে, ১৯৩৭ সালে তিনি ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পরবর্তীতে প্যারিসের বিখ্যাত সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পান। প্যারিসে বেশিরভাগ রাত তিনি আরেক ভারতীয় বামপন্থী সংগঠক ভারাদারাজুলু সুব্বিয়াহর সাথে হেঁটে হেঁটে পার করতেন। ভারাদারাজুলু সুব্বিয়াহ্ পরবর্তীতে ভারতের ফরাসি উপনিবেশের যে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল, তার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ভারত সরকার তার স্মরণে ২০১১ সালে ডাকটিকেট প্রকাশিত করে এবং পুদুচেরিতে বর্তমানে তার সম্মানার্থে একটি ভাস্কর্যও স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো আবারও জার্মানি ফ্রান্সকে আক্রমণ করে বসে। মিশোলেট মাধাভান যুদ্ধ শুরু হলেও পালিয়ে জন্মভূমিতে চলে আসেননি। যেহেতু তিনি ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন, তাই তিনি ফ্রান্স থেকে ফ্যাসিবাদের প্রতিনিধি হিটলারের সেনাবাহিনীকে বিতাড়নের জন্য ফরাসিদের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী খুব বেশি সমৃদ্ধ ছিল না, এজন্য ফরাসিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সক্রিয় যুদ্ধের পরিবর্তে বিভিন্ন গোপন বাহিনীর মাধ্যমে হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার কৌশল হাতে নেয়। যেমন- গেরিলা কৌশলের মাধ্যমে হঠাৎ করে কোনো নাৎসি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আবার হারিয়ে যেত ফরাসিরা। এর মাধ্যমে যেমন হাতে থাকা স্বল্প অস্ত্রশস্ত্রের সঠিক ব্যবহার করা যেত, তেমনি নাৎসি বাহিনীরও ক্ষতিসাধন করা যেত।

িরওটওতওত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা ফ্রান্স দখল করে নিয়েছিল; image source: english-heritage.org.uk

শক্তিশালী জার্মান সেনাবাহিনীর সামনে তুলনামূলক দুর্বল শক্তির ফরাসি সেনাবাহিনী পেরে উঠবে না– এটা অনুমিতই ছিল। ফ্রান্স যখন নাৎসি বাহিনীর করায়ত্তে চলে আসে, তারপর অসংখ্য জার্মান গুপ্তচর ফ্রান্সে ঘুরে বেড়াত। কারণ গোপন ফরাসি বাহিনীগুলো তখনও ফ্রান্সে সক্রিয় ছিল এবং নাৎসি বাহিনীর উপর নিয়মিত ক্ষুদ্র আক্রমণ চালাত। গোপন ফরাসি বাহিনীর সদস্যদের ধরার জন্যই মূলত হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনী প্যারিসে চলাফেরা করতো। অসংখ্য ফরাসিকে গোপন পুলিশী রিপোর্টের ভিত্তিতে গ্রেফতারের পর প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

ফ্রান্সের দখল নেয়ার পর জার্মান সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়েছিল, যেসব ফরাসি প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে, তারা ধরা পড়লে অন্তত দেশটির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে না। এরই মধ্যে ফরাসি বামপন্থী কিছু যুবক ১৯৪২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্যারিসের রেক্স সিনেমাহলে বোমা নিক্ষেপ করে। এই হামলায় দুই নাৎসি সৈন্য মারা যায় ও সতেরজন আহত হয়। হিটলারের সেনাবাহিনী এই বোমা হামলার ফলে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যে, এর পেছনের কুশীলবদের ধরার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে তারা। হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপো বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেফতারের জন্য। শেষমেশ, এই বোমা হামলার সাথে জড়িত সকলকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় হিটলারের বাহিনী। যেহেতু বোমা হামলার সাথে মিশোলেট মাধাভানও জড়িত ছিলেন, তাই তাকেও গ্রেফতার করা হয়।

জতকতকতকত
রেক্স থিয়েটারে বোমা হামলার জন্য মাধাভানসহ অনেক বামপন্থীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়; image source: dirkdeklein.net

মিশোলেট মাধাভানের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে দুজন পুলিশ তাকে একটি খুঁটির দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এরপর তাকে খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধা হয়। চোখ খোলা অবস্থাতেই তাকে গুলি করা হয়। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের জন্য গুলির আদেশ দিয়েছিলেন কার্ল ওবেগ নামক এক পুলিশ অফিসার। শুধু তাকেই নয়, আরও সত্তরজন বামপন্থী কর্মীকে সেদিন খুঁটির সাথে বেঁধে চোখ খোলা রাখা অবস্থায় গুলি করে মারা হয়েছিল। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। মাধাভানের একজন সহযোদ্ধা, যিনি পরবর্তীতে নাৎসি বাহিনীর মৃত্যুদন্ডের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তার কাছ থেকে আশ্চর্যজনক তথ্য পাওয়া যায়। তিনি বলেন, জেলখানায় মাধাভানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- তিনি আসলেই ফরাসি কিনা। উত্তরে মাধাভান বলেন, তিনি সত্যিই ফরাসি এবং ১৭২১ সাল থেকে তার পরিবার দেশটিতে বসবাস করছে! সহযোদ্ধার মতে, তিনি যদি আসল পরিচয় দিতেন, তাহলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো না। কিন্তু তারপরও তার কমরেডদের ফেলে তিনি চলে যেতে চাননি। ফ্যাসিজম উৎখাত না করেই তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন– এটি হতো তার জন্য বিরাট লজ্জার বিষয়।

মাধাভানের এই আত্মত্যাগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভুলে যাওয়া ঘটনাগুলোর অন্যতম। মাধাভান চাইলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বদেশে ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু চোখের সামনে নাৎসিদের অন্যায় আগ্রাসন প্রতিহত করার যে বাসনা, সেটি পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। এতে  তাকে জীবন বাজি রেখে লড়তে হয়েছে, দিনশেষে প্রাণ দিতে হয়েছে। ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে তিনি যদি ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতেন, তাহলেও তাকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হতো। কিন্তু তিনি তা করেননি। তার এই আত্মত্যাগ নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালের সকলের জন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

Related Articles

Exit mobile version