১৯৪৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই রফিকুল ইসলামের দিন কেটেছে। চোখের সামনে দেখেছেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেসব স্মৃতিকথা।
কে সাক্ষাৎকার নিতে এলো, সেদিকে একবারও চোখ তুলে তাকাননি তিনি। কিংবা তাকালেও সাক্ষাৎকারগ্রহীতাকে দেখতে পেয়েছেন বলে মনে হলো না। গভীর চিন্তায় মগ্ন দুটি চোখ যেন স্মৃতির অথৈ জলে ডুবে আছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরটা নিয়ে ডেস্কে বসলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন কথা বলতে চান?’
রফিকুল ইসলাম। লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, সেখানকার নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক, দেশের প্রথম নজরুল গবেষক। অর্জন করেছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণকারী রফিকুল ইসলামকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে। এ সব কিছুর বাইরে তাঁর অন্য একটি পরিচয় রয়েছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী।
ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকার ক্রোড়পত্র স্টার লিটারেচার ও রিভিউ পাতার সম্পাদক সোহানা মঞ্জুর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির এক শুভ্রসকালে রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য ‘Prof. Rafiqul Islam: a witness to the language movement and the liberation war of Bangladesh’ শিরোনামের সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করা হলো। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করায় মূল বাংলা থেকে এর কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে।
খুব ঘটা করে নেওয়া কোনো সাক্ষাৎকার এটি নয়। তাই রফিকুল ইসলামের প্রশ্নের উত্তরে সোহানা মঞ্জুর বললেন, ‘যখন আপনার সময় হয়, স্যার। চাইলে এখনি কথা বলা যেতে পারে।’
ছোট্ট করে মাথা নেড়ে আবার চুপ হয়ে গেলেন। হঠাৎ করেই জানতে চাইলেন, ‘আপনার প্রশ্নটা কী?’
সোহানার প্রশ্ন তৈরিই ছিল। বলতে গেলে, প্রশ্নের একটা তালিকা নিয়েই এসেছিলেন তিনি। কিন্তু আচমকা যেন মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। কী জিজ্ঞাসা করা উচিত, তা-ই ভেবে পাচ্ছিলেন না। একজন বাংলাদেশি হিসেবে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ইতিহাসটুকু সবার জানা। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের মতো ভাষা শহীদদের নাম জানে না, এমন বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতে নিরস্ত্র ছাত্র সংগঠনের ওপর বিরুদ্ধ শক্তি কী নির্যাতনটা চালিয়েছিল, তা কারো অজানা নয়।
ইতিহাস সম্পর্কে নিজের জ্ঞান নিয়ে সবসময় গর্ববোধ করতেন সোহানা। তবে রফিকুল ইসলামের সামনে বসে ওই মুহূর্তে নিজেকে এক অজ্ঞ শিশু ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না তাঁর। এমন একজনের সামনে তিনি বসেছিলেন, যিনি এই ইতিহাসের সমস্তটাই নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি এই আন্দোলনের এক সক্রিয় অংশগ্রহণকারীও বটে। আন্দোলনের দিনগুলোতে হারিয়েছেন বন্ধুদের। তাঁর কাছে সেই দিনগুলো কোনো সুদূর অতীত নয়, বরং তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। ভাষা আন্দোলন আমাদের ইতিহাসের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তারই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ’৫২ এর এই আন্দোলন।
১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া সোহানা গভীর এক নিঃশ্বাস নিয়ে সাহসের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেদিন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে কথা বলছিলেন, শুনলাম। আপনি যে ক্যামেরাটি দিয়ে ছবি তুলেছিলেন, সেটির কথা বলছিলেন। পরবর্তীতে সেই ছবিগুলো ঐতিহাসিক দলিল হয়ে যায়। সে সময়কার এমন কিছু মুহূর্তের কথা বলতে পারেন যা আপনার স্মৃতিতে গেঁথে আছে?’
আবারও থেমে গেলেন রফিকুল ইসলাম। মনে হচ্ছিল, বড় বড় চোখ দুটোতে অতীতের নানা ঘটনার ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছে। একটুও পেছনে ঝুঁকলেন না, বসার ভঙ্গিও পাল্টালেন না। যেখানে বসে ছিলেন সেখানে বসেই বললেন, ‘আমি থাকতাম রেলওয়ে কলোনিতে। বাবা ছিলেন ডাক্তার। সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই তাদের দেখছি- আন্দোলনকারীরা, যার বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, মিছিলে অংশ নিচ্ছে। আমার বয়স তখন কত? ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসলাম। মানে তখন ক্লাস টেনে পড়ি। তখন বেশ ছোট ছিলাম। তবে ১৯৫১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলাম। এবং একজন ছাত্র হিসেবে আমি বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়লাম। ১৯৫১ সালে আমরা জবানবন্দী নামে মুনীর চৌধুরীর একটি নাটক মঞ্চস্থ করলাম।’ এটুকু বলে আবার বিরতি দিলেন।
কিছুক্ষণ পর বলে উঠলেন, ‘১৯৫২ সালে কী ঘটেছিল, সেটা তো সবার জানা। সেসব এখন ইতিহাস। আমার একটা ভোগল্যান্ডার ক্যামেরা ছিল, ওটা দিয়েই ছবি তুলতাম। আমিও সেদিনকার মিছিলের অংশ ছিলাম। তবে আহত হইনি।’ আবারও থামলেন।
বললেন, ‘জিজ্ঞেস করছিলেন বিশেষ কোনো ঘটনার কথা মনে আছে কিনা। ঠিক আছে, আমি যে ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম, সে সম্পর্কে বলতে পারি। কয়েকজন মিলে মাথায় গুলিবিদ্ধ একজনের মৃতদেহ নিয়ে এলো। এত রক্ত ঝরছিল… এখনো সেই রক্ত আর তরল মগজ গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য চোখে ভাসে।’ একটু থেমে বললেন, ‘১৯৫৩ সালে আমরা বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি করার দাবি জানিয়েছিলাম। আর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির একটা ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা কেন্দ্র হবে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক একাডেমি তৈরির আদেশ দেন।’
বিরতি নিয়ে বললেন, ‘ওহ, ভুলে গিয়েছিলাম, ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার জন্য মুনীর চৌধুরীকে কারাবরণ করতে হয়েছিল এবং ১৯৫৩ সালে তিনি জেল থেকে তাঁর বিখ্যাত নাটক কবর লিখেছিলেন। কারাগারে আটক বন্দীরা তাঁর এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন, আর ’৫৪ সালে আমরা এই নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ছিল অস্থায়ী। কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ’৫৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৯২ ধারা অনুসারে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে বাধা দিলে আবার দাঙ্গা বাঁধে। সে সময় ‘৫২ এর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী হতাহত হয়। সেখানে নারী শিক্ষার্থীরাও ছিল, তারা সমাবেশে অংশ নিয়ে আহত হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ নারীদের জন্য একটি বিশেষ কারাগার তৈরি করেছিল।’
‘যুক্তফ্রন্টের হাতে ক্ষমতা চলে আসায় ১৯৫৬, ৫৭ আর ৫৮ এর দিকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। শান্তিপূর্ণভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। যাই হোক, ১৯৫৮ সালের শেষদিকে আবারও পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়, আমরা গণতন্ত্রের শেষটুকু দেখলাম। তবুও একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন চলল। এরপরে আমি পড়ালেখা করতে বিদেশে চলে যাই। ’৫৯ আর ’৬০ এ আমি বাইরেই ছিলাম। আন্দোলন অব্যাহত ছিল। ধীরে ধীরে ছোট পরিসরে শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি মিলল। অবশেষে ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা ভাষা শহীদদের যথাযথ সম্মান জানাতে পারলাম। তবে শহীদ মিনার বাঙালি চেতনার এমন এক প্রতীক, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যা আজীবন দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। কাজেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হতো।’
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেখুন, প্রতিটি ঘটনা আসলে একে অপরের সাথে যুক্ত- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান গণঅভ্যুত্থানের বিজয় দিবস ছিল। রক্তাক্ত হলেও এমন গৌরবের দিন আর হয় না। প্রতিটি আন্দোলনই আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছে। আমাদের মধ্যে কত শত জন প্রাণ হারিয়েছে। আমিও জেল খেটেছি। ওয়াশিংটন ডিসির কিছু বন্ধু এক সিনেটরের মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চাপ দিয়েছিল বলেই আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি কারাগারে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন, আমিও তাদেরই একজন ছিলাম। আমাদের মুক্তির আদেশ চলে এলো। অথচ এরপরেও আমাদের খুঁজে বের করে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা বেশিরভাগই পালিয়ে গেলাম। যারা পালাতে পারেননি তাদের একজন ছিলেন ড. খায়ের। এর মধ্যে কতজন যে মারা গেল! আমি সেই সব গণহত্যার সাক্ষী।’
এই পর্যায়ে এসে আলাপচারিতায় বিঘ্ন ঘটল। অধ্যাপক সাহেবের কারো সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বোধহয়। তবে তিনি বললেন, ‘আবার আসবেন কিন্তু। আমরা এই কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারি।’
সোহানা মঞ্জুর উঠে আসার আগেই তিনি বলে উঠলেন, ‘কলাভবনের সামনের বটগাছটা দেখেছেন? এটা আসল গাছটা নয়, জানেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সিনেটর কেনেডি এসেছিলেন। তাকে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কেটে ফেলা আসল গাছটির একটি অংশ লাগানো হয়। তবে এভাবে কি চাইলেই একটা গাছ কেটে ফেলা যায়? শিকড় তো রয়েই যায়।’
রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তাঁর বই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছরের’ সংশোধিত ও বর্ধিত সংস্করণ ‘শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। বইটিতে ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা নিয়েছিল তা প্রত্যেকেরই জানা উচিৎ। এটি কোনো ইতিহাসের বই নয়, স্মৃতিকথা নয়। তবুও আমি বলব, বইটিতে এই দুটো উপাদানই আছে।’